1 of 2

অধ্যায় ৩ : প্ৰকৃত সুখ – অ্যারিস্টোটল

অধ্যায় ৩ : প্ৰকৃত সুখ – অ্যারিস্টোটল

‘একটি কোকিল মানেই বসন্ত নয়’, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এমন কোনো বাক্য হয়তো এসেছে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার অথবা অন্য কোনো মহান কবির কবিতা থেকে। শুনলেও মনে হতে পারে সেটাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্ত বিকভাবে বাক্যটিকে আমরা খুঁজে পাব ‘দ্য নিকোম্যাকিয়ান এথিকস’ নামে অ্যারিস্টোটলের একটি বইতে। বইটির নাম এরকম হবার কারণ এটি অ্যারিস্টোটল উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর ছেলে নিকোম্যাকাসকে। বইটি এই নামে পরিচিত হবার আরেকটি কারণ এটি সম্পাদনা করেছিল তাঁর ছেলে নিকোম্যাকাস। এই বাক্যটির মাধ্যমে তিনি যা বোঝাতে চাইছিলেন সেটি হচ্ছে, বসন্ত কিংবা গ্রীষ্ম এসেছে সেটি প্রমাণ করার জন্য একটি মাত্র কোকিলের আগমনের চেয়েও আরো বেশিকিছুর প্রয়োজন আছে এবং একটি উষ্ণ দিন, বা অল্পকিছু মুহূর্তের আনন্দ আর সত্যিকারের সুখ কিন্তু এক নয়। অ্যারিস্টোটলের কাছে সুখ মানে ক্ষণিকের জন্য অনুভূত আনন্দের কোনো বিষয় ছিল না। বিস্ময়করভাবে, তিনি মনে করতেন শিশুরা কখনোই সুখী হতে পারেনা। এই কথাটি খুব অদ্ভুত শোনায় আমাদের কাছে, কারণ যদি শিশুরাই সুখী হতে না পারে, তাহলে কে পারে? কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাবনাটি স্পষ্ট করে দেয়, সুখ সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গিটি আসলে আমাদের থেকে কতটা ভিন্ন। শিশুরা কেবলই তাদের জীবন শুরু করেছে, সুতরাং কোনো অর্থেই বলা যাবেনা তারা পুরো জীবনের আস্বাদ পেয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, সত্যিকার সুখের জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘজীবন।

অ্যারিস্টোটল ছিলেন প্লেটোর ছাত্র, আর প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের ছাত্র। সুতরাং মহান এই তিন দার্শনিক একটি ধারাবাহিক শৃঙ্খল তৈরি করেছিল : সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টোটল। এবং প্রায়শ সেটাই ঘটে, প্রতিভাবানরা সাধারণত শূন্য থেকে আবির্ভূত হন না। তাদের অধিকাংশের জীবনেই দেখা মেলে অনুপ্রেরণা দেবার মতো কোনো-না-কোনো একজন শিক্ষক। কিন্তু এই তিনজনের প্রত্যেকের ভাবনাই ছিল পরস্পর থেকে ভিন্ন। তারা কেউই তোতাপাখির মতো তাদের শিক্ষকের কাছে যা শিখেছিলেন শুধু তারই পুনরাবৃত্তি করে যাননি। প্রত্যেকের চিন্তারই একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। খুব সহজভাবে যদি বলি, সক্রেটিস অসাধারণ ছিলেন তাঁর কথোপকথনে, প্লেটো ছিলেন অসাধারণ একজন লেখক, আর অ্যারিস্টোটলের অসাধারণ কৌতূহলী মন অনুসন্ধান করেছে সবকিছু। সক্রেটিস এবং প্লেটো পৃথিবীকে ভাবতেন সত্যিকার বাস্তবতার একটি ফ্যাকাশে প্রতিফলন হিসাবে, যে বাস্তবতাটির স্বরূপ অনুসন্ধান শুধুমাত্র সম্ভব হতে পারে নৈর্ব্যক্তিক দার্শনিক ভাবনার দ্বারা। এর ব্যতিক্রম, অ্যারিস্টোটল, তাঁর চারপাশে বিদ্যমান সবকিছুর বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান নিয়েই আবিষ্ট ছিলেন তাঁর পুরোটা জীবন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অ্যারিস্টোটলের বেশিরভাগ লেখাই টিকে আছে লেকচার নোটের আকারে। কিন্তু তারপরও তাঁর চিন্তার এই লিপিবদ্ধ বিবরণ পশ্চিমা দর্শনের উপর এখনও তার প্রভাব বজায় রেখেছে, এমনকি যদিও তাঁর লেখার শৈলী প্রায়শই শুষ্ক। কিন্তু তিনি শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, প্রাণিবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি এবং নাটক ইত্যাদি বহু বিষয়েও আগ্রহী ছিলেন।

৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিক রাজ্য মেসিডোনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি, যেখানে তাঁর বাবা ছিলেন রাজ-চিকিৎসক। তর্কসাপেক্ষে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক, যিনি সাধারণ কিছু ডাকনামেও পরিচিত, যেমন দ্য মাস্টার’ বা শুধুমাত্র ‘দ্য ফিলোসফার’। প্লেটোর শিক্ষার্থী হিসাবে কিছুদিন পড়াশুনা করার পর, বিভিন্ন দেশ ঘুরে অবশেষে তিনি কিছুদিন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাঁর যে-ছাত্রটি এর পরে খুব শীঘ্রই সেই সময়ে জানা-বিশ্বের পুরোটাই জয় করেছিলেন। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যেসব দেশ জয় করেছিলেন, সেখান থেকে নানাধরনের প্রাণী আর উদ্ভিদও সংগ্রহ করে এনেছিলেন, যা অ্যারিস্টোটলকে সহায়তা করেছিল পৃথিবীর প্রথম চিড়িয়াখানা আর উদ্ভিদ-উদ্যান প্রতিষ্ঠা করার জন্য। অ্যারিস্টোটল পরে এথেন্সে ফিরে এসে তাঁর নিজের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, লাইসিয়াম। সেই সময়ে লাইসিয়াম সবচেয়ে বিখ্যাত জ্ঞানপীঠ ছিল, কিছুটা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই। সেখান থেকেই তিনি গবেষকদের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিতেন, তাদের কাজ ছিল রাজনীতি থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞান যে- কোনো বিষয়ে কিছু-না-কিছু নতুন তথ্য সংগ্রহ করে আনা।

পড়ানো কিংবা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময় হেঁটে হেঁটে কথা বলতে পছন্দ করতেন অ্যারিস্টোটল। তাঁর অনুসারীরা সেকারণে পরিচিত হয়েছিল পেরিপ্যাটেটিক নামে বা যারা ঘুরে বেড়াতেন। একই সময় সেখানে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রেনেসাঁ-পর্বের শিল্পী রাফায়েলের একটি বিখ্যাত দেয়ালচিত্র বা ফ্রেস্কো আছে, ‘দ্য স্কুল অব এথেন্স’, যেখানে আমরা প্লেটোকে উপরের দিকে নির্দেশ করতে দেখি তাঁর বিশুদ্ধ ফর্মের দিকে, এর ঠিক বিপরীত, অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টি আমরা দেখি তাঁর সামনেই বাস্তব পৃথিবীর দিকে। প্লেটো হয়তো সন্তুষ্ট ছিলেন এক জায়গায় বসে নানা বিষয় নিয়ে দার্শনিক প্রস্তাবনা ও আলোচনা করার জন্য, কিন্তু অ্যারিস্টোটল বাস্তব এই পৃথিবীকে, যা আমরা আমাদের সব ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করি, সেটি পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর শিক্ষকের থিওরি অব ফর্ম বা সবকিছুর একটি আদর্শ নিখুঁত রূপ আছে এমন প্রস্তাবনা সমর্থন করেননি কখনো। এর পরিবর্তে তিনি বিশ্বাস করতেন কোনো একটি সাধারণ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত কোনোকিছুকে বুঝতে হলে, সেই শ্রেণীর কোনো একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতে হবে। সুতরাং একটা বিড়াল আসলে কী সেটা বোঝার জন্য অ্যারিস্টোটল ভাবতেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে কোনো বিড়ালের ফর্মের কথা না-ভেবে সত্যিকারের কোনো বিড়ালের দিকেই আমাদের তাকানো উচিত।

অ্যারিস্টোটল খুব কৌতূহলী ছিলেন কীভাবে সবকিছু কাজ করে সেটি জানার জন্যে। কীভাবে মুরগির ডিমের ভিতর মুরগির ভ্রূণ বিকশিত হয়? কীভাবে স্কুইডরা প্রজনন করে? কেন একটি উদ্ভিদ কোনো জায়গায় ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় আর অন্য কোথাও আদৌ বাড়ে না? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, কীভাবে একটি মানুষের জীবন আর পুরো সমাজকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা যায়? অ্যারিস্টোটলের জন্য দর্শন ছিল ব্যবহারিক, প্রয়োগ করা যায় এমন জ্ঞান। একটি প্রশ্ন যা অ্যারিস্টোটলকে বেশ ভাবিয়েছিল, সেটি হচ্ছে, কীভাবে আমাদের বাঁচা উচিত? তাঁর আগে এই প্রশ্ন সক্রেটিস এবং প্লেটোও করেছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়োজনীয়তা মূলত মানুষকে দর্শনের দিকে আকৃষ্ট করে। এই প্রশ্নের উত্তরে অ্যারিস্টোটলের একটি নিজস্ব উত্তর আছে, সেই উত্তরের খুব সরলতম সংস্করণটি হচ্ছে: সুখের অনুসন্ধান করা।

কিন্তু ‘সুখের অনুসন্ধান করা, এই বাক্যটি আসলে কী বোঝাচ্ছে? আজ বেশিরভাগ মানুষ যাদের উপদেশ দেয়া হয় সুখ খোঁজার জন্য, তারা এমন কিছু উপায় অনুসন্ধান করার কথা ভাবেন, যা করলে তারা নিজেদেরকে তৃপ্ত বা উপভোগ করতে পারবেন। হয়তো সুখ আপনার জন্য কোনো সুন্দর জায়গায় ছুটি কাটানোর সাথে সংশ্লিষ্ট, অথবা কোনো সংগীতের অনুষ্ঠান বা পার্টিতে যাওয়া অথবা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো ইত্যাদি। এমনকি এর মানে হতে পারে আরাম করে কোথাও বসে আপনার প্রিয় বইটি পড়া, অথবা কোনো শিল্পকলার গ্যালারিতে যাওয়া। কিন্তু যদিও এই সবকিছুই একটি উপভোগ্য জীবনের অংশ হতে পারে ঠিকই, তবে তিনি অবশ্যই বিশ্বাস করতেন না যে এভাবে বাইরে বের হয়ে আনন্দ খোঁজা, বেঁচে থাকার সবচেয়ে ভালো কোনো উপায় হতে পারে। কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব কিছু শুধুমাত্র তাদের নিজ গুণে একটি ভালো জীবনের নিশ্চয়তা দেয়না। প্লেটোর মতো যে গ্রিক শব্দটি অ্যারিস্টোটলও ব্যবহার করেছিলেন তার ‘সুখ’ বোঝাতে, সেটি হচ্ছে ইউডাইমোনিয়া (Eudaimonia); প্রায়ই তাঁর এই শব্দটি অনূদিত হয়, ‘সুখ’-এর বদলে বরং ‘সফলতা’, ‘পরিপূর্ণতা’ বা ‘সমৃদ্ধি লাভ করা’ হিসাবে। কিন্তু আসলেই এটি ধরুন আপনার পছন্দের আমের ফ্লেভার দেয়া আইসক্রিম বা আপনার প্রিয় দলকে খেলা জিততে দেখলে যে-ধরনের আনন্দময় অনুভূতি হয়, তার থেকেও আরো কিছুটা বেশি। ইউডাইমোনিয়া মানে ক্ষণিকের আনন্দ বা কীভাবে আপনি অনুভব করছেন সেই বিষয়সংশ্লিষ্ট নয়, এটি এর চেয়ে আরো বেশি চিন্তানিরপেক্ষ বাস্তব কোনোকিছু। এটি বোঝা বেশ কঠিন, কারণ আমরা কী অনুভব করছি শুধুমাত্র তার সাথেই সুখকে সংশ্লিষ্ট করতে আমরা খুব বেশি অভ্যস্ত এবং তার বাইরে বেশিকিছু ভাবতে পারিনা।

একটি ফুলগাছের কথা ভাবুন, আপনি যদি যত্ন করে পানি দেন, যথেষ্ট পরিমাণ আলো দেন, সামান্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, এটি ঠিকমতো বেড়ে উঠবে এবং সেখানে ফুল ফুটবে। আপনি যদি এটিকে অবহেলা করেন, অন্ধকারে রেখে দেন, এর পাতা পোকামাকড়ের খাবার হবার সুযোগ করে দেন, এটিকে শুকিয়ে যেতে দেন, এটিও ক্রমেই দুর্বল হয়ে মারা যাবে, অথবা নিদেনপক্ষে এটি রূপান্তরিত হবে অনাকর্ষণীয় একটি উদ্ভিদে। মানুষও গাছের মতোই ভালো বা খারাপভাবে বিকশিত হতে পারে, যদিও গাছের ব্যতিক্রম, আমরা আমাদের নিজেদের জন্যই সিদ্ধান্ত নিই। আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা কী করতে চাই এবং হতে চাই।

অ্যারিস্টোটল দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন যে মানবপ্রকৃতি বলে নিশ্চয়ই কিছু আছে এবং তিনি যেমন করে লিখেছিলেন, মানুষের কিছু নির্দিষ্ট ধরনের কাজ আছে, এবং মানুষ হিসাবে আমাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম হয়, এমন কোনো বাঁচারও উপায় আছে। অন্য যে-কোনো জীব বা আর অন্য সবকিছু থেকে যে-বিষয়টি আমাদের পৃথক করে, সেটি হচ্ছে আমরা চিন্তা করতে পারি এবং আমাদের কী করা উচিত এই বিষয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এখান থেকেই তিনি উপসংহারে আসেন যে, কোনো মানুষের জন্যে তার সবচেয়ে সেরা জীবনটি হবে সেটি, যেখানে সেই মানুষটি যুক্তির শক্তি ব্যবহার করতে পারবে।

বিস্ময়করভাবে, অ্যারিস্টোটল বিশ্বাস করতেন যে বিষয়গুলো সম্বন্ধে আপনার কোনোকিছু জানা নেই, এমনকি আপনার মৃত্যুর পরে ঘটা কোনো ঘটনাও, আপনার ইউডাইমোনিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। বিষয়টি বেশ অদ্ভুত শোনায়, তাই না? যদি ধরে নিই মৃত্যুর পরে কোনো জীবন নেই, তাহলে আপনি যখন বেঁচে থাকবেন না, তখন ঘটা এমন কোনোকিছু কীভাবে আপনার সুখের উপর প্রভাব ফেলতে পারে? বেশ, ধরুন, আপনি কোনো সন্তানের পিতা কিংবা মা, আংশিকভাবে আপনার সুখ নির্ভর করছে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার আশা- আকাঙ্ক্ষার উপর। যদি, দুঃখজনকভাবে, আপনার নিজের মৃত্যুর পর সেই সন্তান গুরুতর অসুখে আক্রান্ত হয়, তাহলে আপনার ইউডাইমোনিয়াও এটি দ্বারা প্রভাবিত হবে। অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনার জীবন আরো খারাপ হবে, এমনকি যদিও আপনার সন্তানের অসুস্থতার কথা আপনি আসলে জানতে পারবেন না এবং আপনিও আর জীবিত নন। এটি বেশ সুন্দরভাবে সুখ-সংক্রান্ত তাঁর ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করে, যা দাবি করছে যে, সুখ আপনি কী অনুভব করছেন শুধুমাত্র তার উপর নির্ভর করেনা। সুখ এই অর্থে হচ্ছে আপনার জীবনের সামগ্রিক অর্জন, এমন কোনোকিছু যাকে প্রভাবিত করতে পারে আপনি যাদের জন্য ভাবেন তাদের জীবনে কী ঘটল, এমনকি সেই বিষয়গুলোকেও। আপনার নিয়ন্ত্রণের ও জানার বাইরের ঘটনাগুলো একে প্রভাবিত করে। আপনি সুখী না অসুখী, আংশিকভাবে তা নির্ভর করবে আপনার ভাগ্য কতটুকু ভালো তার উপর

মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, আমরা কী করতে পারি আমাদের ইউডাইমোনিয়া সম্ভাবনা বাড়াতে? অ্যারিস্টোটলের উত্তর ছিল: সঠিক ধরনের চরিত্র গড়ে তোলা। সঠিক সময়ে আপনাকে সঠিক ধরনের আবেগ অনুভব করতে হবে এবং এটাই আপনার সঠিক আচরণ নিশ্চিত করবে। আংশিকভাবে আপনি কীভাবে প্রতিপালিত হয়েছেন সেটার উপরও বিষয়টি নির্ভর করবে, কারণ ভালো অভ্যাস গড়ে তোলার সেরা উপায়টি হচ্ছে খুব অল্পবয়স থেকেই সেটি অনুশীলন করা। সুতরাং সেখানেও ভাগ্যের হাত আছে। ভালো ধরনের আচরণগুলো সদ্‌গুণ আর খারাপগুলোই হচ্ছে অনাচার। তাঁর নিকোম্যাকিয়ান এথিকস বইয়ে তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন মানুষকে পরিপূর্ণভাবে সুখী করে কি অ্যারিস্টোটল সেইসব নিয়ামকগুলোকে অনুসন্ধান করেছিলেন যা কোনো মানুষের জীবনকে সুন্দর করে অথবা করে না? তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে ভালো এবং সফল মানুষদের সবারই সুনির্দিষ্ট কিছু গুণাবলি আছে এবং প্রস্তাব করেছিলেন যে সেই গুণগুলোকে শনাক্ত করার জন্য আমাদের আরো বেশি দক্ষ হয়ে ওঠা উচিত, যে আমরা সেই গুণগুলো আমাদের মধ্যে প্রতিপালন করতে পারি এবং অন্যদের মধ্যে সেগুলোকে সম্মান করতে পারি।

যুদ্ধের সময় সাহসিকতার সদ্গুণটির কথা ভাবুন। হয়তো কোনো একজন সৈন্যের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে কিছু বেসামরিক জনতাকে আক্রমণরত সেনাবাহিনী থেকে রক্ষা করার জন্য তার নিজের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো এক পরিস্থিতিতে ফেলা।

কোনো বেপরোয়া সাহসী ব্যক্তি, যার নিজের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো খেয়াল নেই, সে হয়তো যে-কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমনকি এমন কোনো সময়েও যখন সেটা করার কোনো দরকার নেই। কিন্তু সেটা সত্যিকারের সাহসিকতা নয়, শুধুমাত্র বেপরোয়া ঝুঁকি নেওয়া। এর অন্যপ্রান্তে আছে, কোনো ভীরু সৈন্য, যে তার ভয়কে যথেষ্ট পরিমাণে জয় করতে পারেনা এমন কোনো পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে আচরণ করার জন্য। এবং যখন তাকে সবচেয়ে প্রয়োজন, সেই বিশেষ মুহূর্তেই হয়তো সে ভয়ে অবশ হয়ে যাবে। একজন সাহসী মানুষ এই পরিস্থিতিতে ঠিকই ভয় অনুভব করবেন, কিন্তু সেই ভয়কে তিনি জয় করতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

অ্যারিস্টোটল লক্ষ করেছিলেন যে-কোনো সদ্‌গুণই অবস্থান করে এ-ধরনের দুটি চরম প্রান্তের মাঝামাঝি কোনো স্থানে। এখানে সাহসিকতা, ভীরুতা ও বেপরোয়া সাহসিকতার মাঝামাঝি অবস্থান করছে। মাঝে মাঝে এটিকে বলা হয় অ্যারিস্টোটল-এর ‘ডকট্রিন অব দ্য গোল্ডেন মিন’ (Doctrine of the golden mean) বা আদর্শ গড়ের মতবাদ। এথিকস-এর চার নং বইয়ে কথোপকথনের ভালো গুণ আর খারাপ অভ্যাস শিরোনামের অধীনে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ রসিকতা, ভাঁড়ামি, অভব্যতা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে অ্যারিস্টোটল দেখেছিলেন পরস্পরের

সাথে কথোপকথনের সময় মানুষ কখন সবচেয়ে ভালো আর কখন সবচেয়ে খারাপ। তিনি মনে করতেন, একটি ভালো সুন্দর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে কীভাবে ভালো কথোপকথন করতে পারা যায় তার দক্ষতা। কিছু মানুষ ভুল করে, কারণ তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম রসিকতা বোধের অভাব আছে: সেটাই বিরক্তিকর, এমন কেউ যে-কিনা সামাজিক আদান-প্রদানে কোনো অবদান রাখেনা এবং খুব সহজেই যাদের অনুভূতিও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু অন্যরা এই রসিকতাকে মাত্রাহীন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায়: ভাঁড়রা রসিকতা করা থামাতে পারেনা, নিজেকেও বাদ দেয়না, অন্য কাউকেও না, তার চাওয়া সবাইকে উচ্চস্বরে হাসানো ও এমন কিছু বলা যা রুচিশীল মানুষরা বলার কথা স্বপ্নেও ভাবেননা। সুতরাং গুণী মানুষ হচ্ছে এই দুটির গড় বা গোল্ডেন মিন : বুদ্ধিমত্তাপূর্ণভাবে রসিক কিন্তু কৌশলী।

নানা ধরনের ব্যক্তিত্ব ও আচরণের বিস্ময়কর জরিপে অ্যারিস্টোটল বিশ্লেষণ করে প্রদর্শন করেন বিশাল সংখ্যক গুণের কোটি খুব কম আর কোটি খুব বেশি আর ঠিক সঠিক কোটি। তিনি জানতেন যে আমরা চাইলে খুব দ্রুত এইসব ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ বদলে ফেলতে পারব না। কিন্তু ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব ‘নৈতিক সততা হচ্ছে’, অ্যারিস্টোটল বলতেন, ‘অভ্যাসের পরিণতি’। এর জন্য দরকার সময়, অনুশীলন এবং উৎসাহ। সুতরাং তিনি ভাবতেন, যে- মানুষগুলোর সদগুণ নেই তাদের অসৎ বা খারাপ না-ভেবে বরং দুর্ভাগা মনে করাই উচিত। তাদের যা দরকার, সেটি গালমন্দ নয় বা জেলখানায় বন্দীজীবন নয় বরং উত্তম শিক্ষক ও আরো বেশি তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনা। নৈতিকতার প্রতি অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র ঐতিহাসিকভাবে কৌতূহলের ব্যাপার না। বহু আধুনিক দার্শনিকও বিশ্বাস করেন, সদগুণ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটি সঠিক, এবং সুখসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটিও ছিল সঠিক এবং অনুপ্রেরণাদায়ী। জীবনের আনন্দ বাড়াবার উপায়গুলো খোঁজার পরিবর্তে, তারা মনে করেন, আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত ভালো মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করা এবং সঠিক কাজটি করা। এবং এটাই জীবনকে সুন্দর ও সুখী করে তোলে।

এই সবকিছুই শুনলে মনে হয় যেন অ্যারিস্টোটল একক ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের বিকাশ বা উন্নতিতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তিনি বিষয়টি বলেছিলেন আরো বড় পরিসরের কথা ভেবে। তিনি যুক্তি দেন, মানুষ হচ্ছে রাজনৈতিক জীব; আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় একটি কাজ হচ্ছে অন্য মানুষের সাথেও ভালোভাবে বাস করার মতো উপযুক্ত হওয়া এবং একটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পদ্ধতিরও প্রয়োজন, যা প্রকৃতির খারাপ দিকগুলোর সাথে বোঝাপড়া করতে সাহায্য করবে। ইউডাইমোনিয়া শুধুমাত্র অর্জন করা সম্ভব কোনো একটি সমাজের অভ্যন্তরে কাটানো সংশ্লিষ্ট সমগ্র জীবনে। আমরা একসাথে বাস করি এবং আমাদের সুখ খোঁজা প্রয়োজন একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রে আমাদের চারপাশে সবার সাথে ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। অ্যারিস্টোটল আমাদের জন্য আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিলেন। যেমন : শিল্পকলার প্রয়োজন কী? তাঁর সময়ে শিল্পকলার জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয়টি ছিল ট্রাজেডি, নাটক। এথেন্সবাসীরা উন্মুক্ত বিশাল মঞ্চের সামনে জড়ো হয়ে সামাজিক উৎসবে এইসব ভয়ংকর দুঃখজনক কাহিনীর নাটক উপভোগ করত। এস্কাইলাস, ইউরিপাইডিস আর সফোক্লিস ছিলেন অত্যন্ত জনপ্ৰিয়।

অ্যারিস্টোটল একটি বই লিখেছিলেন, কীভাবে ভালো নাটক লিখতে হবে তার নির্দেশনাসহ, ‘দ্য পোয়েটিকস’। অসংখ্য উপদেশ ছিল সেখানে; যেমন, নাটকে অবশ্যই ‘পেরিপেটেইয়া’ ব্যবহার করতে হবে, অর্থাৎ, ভাগ্যের পরিবর্তন, প্রধান নায়কের পরিস্থিতি খুব ভালো থেকে খুব খারাপের দিকে মোড় নেবে। এবং ‘অ্যানাগনরিসিসও’ মনে রাখতে হবে, সেই নাটকীয় মুহূর্ত, যখন হঠাৎ করেই নায়ক বুঝতে পারবেন যে তার জীবনের পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে, এবং আসলেই পরিস্থিতি ভয়ংকর। কিন্তু আসলেই ট্রাজেডি কিসের জন্যে? পুরো সমাজ একসাথে জড়ো হয়ে এই সব নাটকের প্রধান চরিত্রের জীবনে ঘটা এমন ভয়ংকর ঘটনা কেন দেখবে? যেমন, ইডিপাস, সফোক্লিসের এই নাটকে, যে দুর্ঘটনাবশত নিজের অজান্তেই তার পিতাকে হত্যা করেছিল, তার মাকে বিয়ে করেছিল, এবং হঠাৎ করেই জানতে পারেন, এই কাজগুলো তিনি করেছেন, তারপর তিনি নিজের চোখ উপড়ে ফেলেছিলেন তার কৃতকর্মের অনুশোচনা করার জন্যে আর দুঃখে। অ্যারিস্টোটলের উত্তর হচ্ছে: ক্যাথারসিস, ক্যাথারসিস হচ্ছে একধরনের শুদ্ধিকরণ: আপনি খারাপ জিনিসগুলো বর্জন করবেন। এই ক্ষেত্রে আমাদের আবেগের ক্যাথারসিস, বিশেষভাবে ভয় আর করুণাসংশ্লিষ্ট অনুভূতিগুলোকে ঘিরে থাকা সংশয়গুলো। খুব প্রাকৃতিক একটি সমস্যা আছে আমাদের, আমরা খুব কঠিন হৃদয়ের, যখন দরকার তখন আমরা কোনো করুণা প্রদর্শন করিনা, আর আমাদের প্রবণতা আছে ভয়কে অতিরঞ্জিত করা অথবা আদৌ যথেষ্ট পরিমাণ ভয় না-পাওয়া। ট্রাজেডি আমাদের মনেকরিয়ে দেয় যে, খুব ভালো মানুষের জীবনে ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে, যার মধ্যে আমরাও অন্তর্ভুক্ত। একটি ছোট ভুল পুরো জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। সুতরাং আমাদের আরো বেশি সহানুভূতিশীল থাকা উচিত তাদের জন্যে, যাদের কাজের পরিণতি ভয়ংকরভাবে খারাপ হতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যিগুলোকে নিয়মিত সমষ্টিগতভাবে আমাদের বারবার শিখতে হবে। ‘শিল্পকলার দায়িত্ব’, অ্যারিস্টোটল যেমন মনে করতেন, ‘জীবনের গভীরতম সত্যগুলো যেন আমাদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে সেটি নিশ্চিত করা। ‘

বন্ধু কেন প্রয়োজন? তাঁর নিকোমাকিয়ান এথিকস-এর অষ্টম ও নবম খণ্ডে অ্যারিস্টোটল তিন ভিন্ন ধরনের বন্ধুত্ব চিহ্নিত করেছিলেন, যে বন্ধুত্বটি হয় যখন প্রত্যেকেই আনন্দ অনুসন্ধান করছেন, তার প্রধান স্বার্থ হচ্ছে তাদের নিজেদের আনন্দ আর সেই মুহূর্তটির সুযোগ নেয়া, যা অন্য ব্যক্তিটি প্রদান করছে। এরপর আছে সেই বন্ধুত্ব, যা আসলে কৌশলগত পরিচয়। তারা পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করে ততটুকুই যতটুকু তারা সুবিধা নিতে পারবে বলে আশা করে। এরপর আছে সত্যিকারের বন্ধু, এমন কেউ না যে শুধুমাত্র আপনাকে পছন্দ করে, বরং এমন কেউ যে কিনা আপনি না, কিন্তু যার সম্বন্ধে আপনি এতটাই ভাবেন যতটা আপনি নিজের সম্বন্ধে ভাবেন। কোনো সত্যিকার বন্ধুর কষ্ট আপনারও কষ্ট। তাদের আনন্দ আপনারও আনন্দ। আপনাকে যা আরো বেশি নাজুক ও আক্রম্য করে তোলে, যদি সেই ব্যক্তি কোনো বিপদে আক্রান্ত হয়। কিন্তু একই সাথে এটি অনেক বেশি শক্তিও দেয়। আপনার নিজের চিন্তার সংকীর্ণ বলয় থেকে আপনার মুক্তি মেলে। আপনি আরেকজনের জীবনে সম্প্রসারিত হন, এইসাথে আরো বিশাল, বুদ্ধিমান আর আরো বেশি প্রাণবন্ত ও নৈতিকতাপূর্ণ একটি সত্তায় আপনিও রূপান্তরিত হন। পরস্পরের ত্রুটিগুলো বর্জন করে আপনারা পরস্পরের সদগুণগুলো ভাগাভাগি করে নেন। বন্ধুত্ব আমাদের শেখায় আমাদের কী হওয়া উচিত : এটি, অ্যারিস্টোটল মনে করতেন, আক্ষরিকার্থে, জীবনের শ্রেষ্ঠতম অংশ।

অ্যারিস্টোটল ভেবেছিলেন ব্যস্ত পৃথিবীতে কীভাবে ধারণাগুলো তাদের জায়গা খুঁজে পাবে? বহু মানুষের মতোই, তিনি সেই বাস্তবতাটি জানতেন, শ্রেষ্ঠতম যুক্তিগুলো সবসময় বিতর্ক জেতায় না অথবা জনপ্রিয়তাও পায়না। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কেন এমন হয়, এবং আমরা কী করতে পারি এ-বিষয়ে। পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপক সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। এথেন্সে, বহু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো সাধারণ সভার মাধ্যমে, প্রায়শই আগোরা বা শহরের চত্বরে সেটি হতো। বক্তারা বিতর্ক করতেন জনগণের মতামত তাদের পক্ষে প্রভাবিত করার জন্যে।অ্যারিস্টোটল লক্ষ করেছিলেন কী উপায়ে দর্শকরা সামগ্রিক এবং একক পর্যায়ে প্রভাবিত হয় নানা বিষয়ের দ্বারা, কিন্তুপ্রায়শই আসল ঘটনার বাস্তব তথ্যগুলো আর যুক্তিতর্কের প্রতি কঠোর আনুগত্য প্রদর্শন না করে। এটি আসলেই তাঁকে ভাবাত, এবং চিন্তাশীল কোনো মানুষও এটি সহ্য করতে পারতেন না। তারা বাজার আর উন্মুক্ত এই বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। অ্যারিস্টোটল অবশ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি আবিষ্কার করছিলেন সেই বিষয়টি, যা আজো আমরা ‘রেটোরিক’ বলি, অন্য মানুষদের আপনার মতামতের সাথে ঐকমত্যে নিয়ে আসার শিল্পকৌশল। তিনি চেয়েছিলেন চিন্তাশীল ভালো মানুষগুলো যেন শেখেন, কীভাবে প্ররোচিত করতে হয়, যারা একমত হয়নি তাদের কাছে কীভাবে পৌঁছানো যায়। তিনি কিছু চিরন্তন বিষয় উল্লেখ করেছিলেন যা এখনও প্রযোজ্য : আপনাকে প্রথমে মানুষের ভয়কে প্রশমিত করতে হবে, আপনাকে প্রস্তাবনার আবেগীয় দিকটি দেখতে হবে, এখানে কি কারো অহংবোধ আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে? তারা কি বিব্রত বোধ করছে? এবং সেভাবেই বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আপনাকে বক্তব্য খানিকটা কৌতুকময় করতে হবে, কারণ শ্রোতাদের মনোযোগের সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত, আর আপনাকে ছবি আর উদাহরণ ব্যবহার করতে হবে যেন আপনার বক্তব্যটি আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে।

অ্যারিস্টোটলের দুর্দান্ত মেধার একটি দুর্ভাগ্যজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে অবশ্য। তিনি খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন, এবং তাঁর গবেষণা এতবেশি গভীর এবং বিস্তারিত ছিল যে, অনেকেই যারা তাঁর লেখা পড়েছেন বিশ্বাস করতেন তিনি সব বিষয়েই সঠিক কথা বলেছেন। আর এটি প্রগতির জন্য সহায়ক ছিলনা, সক্রেটিসের সূচনা-করা দর্শনের ঐতিহ্যবাহিকতার ধারাতেও সেটি মঙ্গলজনক ছিলনা। তাঁর মৃত্যুর পর বহু শতাব্দী বেশিরভাগ গবেষকই পৃথিবী সম্বন্ধে তাঁর সব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নাতীতভাবে সত্য হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। যদি তারা কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারতেন, অ্যারিস্টোটল এই কথা বলেছেন, তাদের জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল, এবং এটাকে বলা হয়, ট্রুথ বাই অথরিটি’ বা কোনোকিছুকে ‘অবশ্য’ সত্য বলে বিশ্বাস করা, কারণ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কৰ্তৃত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা কেউ এটিকে সত্য বলেছেন। কী ঘটতে পারে যদি আপনি একই আকারের একটুকরো কাঠ আর একটুকরো ভারী কোনো ধাতু কোনো একটি উঁচু জায়গা থেকে নিচে ফেলেন? কোটি আগে মাটিতে পড়বে? অ্যারিস্টোটল ভেবেছিলেন, যেটা ভারী, যেটা বানানো হয়েছে ভারী ধাতু দিয়ে, সেটি আগে মাটিতে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম ঘটে না, তারা একই গতিতে মাটিতে পড়ে। কিন্তু যেহেতু অ্যারিস্টোটল বলেছেন এটাই সত্যি, পুরো মধ্যযুগ ধরে প্রায় সবাই ভেবেছেন এটাই অবশ্যই সত্যি। আর কোনো প্রমাণের দরকার পড়েনি। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে গ্যালিলিও গ্যালিলেই পিসার হেলানো টাওয়ারের উপর থেকে একটি কাঠের বল আর একটি কামানের বল একই সাথে নিচে ফেলেছিলেন এই বিষয়টিকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য (যদিও ঘটনাটির ঐতিহাসিক সত্যতা মেলেনি, তিনি প্রস্তাবনাটি করেছিলেন একটি চিন্তার পরীক্ষা ব্যবহার করে, তবে তিনি প্রথম পতনশীল বস্তুর গতির প্রকৃতি নির্ণয় করেছিলেন), দুটোই একই সাথে মাটিতে পড়েছিল (এই পরীক্ষাটি কোনো বিশাল ভ্যাকুম বা শূন্যতাপূর্ণ চেম্বারে করা হয়েছে, এছাড়া চাঁদের পৃষ্ঠেও করা হয়েছে।)। সুতরাং অ্যারিস্টোটল তাহলে ঠিক বলেননি। কিন্তু বহু আগেই এই পরীক্ষাটি খুব সহজে যে-কেউই করতে পারতেন।

অন্য কারো মতামত আর কর্তৃত্বের উপর নির্ভর করে কোনোকিছু মেনে নেয়া ছিল এমনকি অ্যারিস্টোটলের গবেষণারও মূল প্রাণশক্তির বিরুদ্ধে, এটি দর্শনের মূল চালিকাশক্তিরও বিরুদ্ধে। কোনো কর্তৃত্ব নিজেই কোনোকিছু প্রমাণ করতে পারে না। অ্যারিস্টোটলের নিজের পদ্ধতি ছিল : পরীক্ষা, গবেষণা এবং সুস্পষ্ট যুক্তি। দর্শন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিতর্কের জন্য, ভুল প্রমাণিত হবার সম্ভাবনায়, প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে। সৌভাগ্যক্রমেই, প্রতিটি যুগেই সেইসব দার্শনিকরা ছিলেন. যারা গভীরভাবে নিরীক্ষাধর্মী পর্যালোচনা করেছেন সেইসব বিষয়গুলো নিয়ে, অন্যরা যে-বিষয়গুলোকে অবশ্যই বিশ্বাস করার জন্যে তাদের বলেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *