1 of 2

অধ্যায় ৪১ : মনের দর্শন – এডমন্ড হুসেরেল

অধ্যায় ৪১ : মনের দর্শন – এডমন্ড হুসেরেল

যদিও নামটি তিনি দেননি, তবে কোনো বিতর্ক ছাড়াই দার্শনিক এডমন্ড হুসেরেলকে (১৮৫৯-১৯৩৮) দর্শনের সেই বিশেষ আন্দোলন, ফেনোমেনোলজির জনক বলা যেতে পারে। ফেনোমেনোলজিকে মোটাদাগে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে কোনো অধিবিদ্যাগত এবং তাত্ত্বিক অনুমান ছাড়া অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা হিসাবে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বাদ দিয়েই দর্শন আরো বেশি সুস্পষ্ট আর প্রকৃতভাবে কঠোর বিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে এবং তিনি দাবি করেছিলেন যে ফেনোমেনোলজি হচ্ছে এমপিরিকাল বা পর্যবেক্ষণ নির্ভর কিছু না বরং এটি সচেতনতার বিজ্ঞান (science of consciousness)। মোরাভিয়ায় জন্ম নেয়া গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক হুসেরেল তার সারাজীবনই ব্যয় করেছিলেন ফেনোমেনোলজি সংক্রান্ত অনুসন্ধানে, এবং এমন একটি পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেছিলেন যা তিনি নিজেই আবিষ্কার করেছিলেন, যা philosophy of mind-এর কিছু কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে বৈপ্লবিক কিছু ধারণার প্রস্তাব করেছিল। সচেতনতা বা consciousness নিয়ে এখন খুব সতর্কভাবেই গবেষণা করা হচ্ছে বিশেষভাবে যারা আগ্রহী কগনিটিভ সায়েন্স নিয়ে। ফেনোমেনোলজি, যে শব্দটি দিয়ে বোঝা যেতে পারে অভিজ্ঞতাগুলোর একটি সতর্ক বিবরণ যেভাবে সেই অভিজ্ঞতাটির দ্বারা অভিজ্ঞতালব্ধ হন কোনো ব্যক্তি। হুসেরেল এর নিজের ভাষায় এটি আমাদের life of consciousness-এর পুরোটাই গবেষণা করার প্রস্ত বি দেয়। এর সাথে শুধুমাত্র সুস্পষ্ট কগনিটিভ অবস্থা বা কর্ম নয়, যেমন জাজমেন্ট বা বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি, বরং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সচেতনতার অসংখ্য কাজ ও অবস্থা, যেমন সংবেদনশীলতায় সতর্কতা, বোধশক্তি, স্মৃতি, কল্পনা, আবেগ, মেজাজ, ইচ্ছাশক্তি, সময়সচেতনতা, বিচারিক ক্ষমতা, যুক্তিপ্রক্রিয়া, প্রতীকী চিন্তা, আত্মসচেতনতা, এবং এছাড়াও অবচেতন মনের তাড়না আর কামনাগুলো ইত্যাদি। অবশ্যই এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। হুসেরেল এছাড়াও ভাবতেন যে মনোবিজ্ঞান (এর অন্তর্গত প্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে) আত্মমাত্রিকতা বা subjectivity-র সত্যিকার বিজ্ঞান হতে পারেনা। আত্মমাত্রিকতার নতুন বিজ্ঞানকে অবশ্যই সাইকি-সংক্রান্ত সব প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক এবং লোকধারণাগুলোকে পরিহার করতে হবে এবং সত্যিকারের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। যেমন তিনি লিখেছিলেন : প্রথমেই যা আমাদের অবশ্যই করতে হবে, কোনো তাৎক্ষণিক চিন্তাশীল আত্ম-অভিজ্ঞতায়, সেটি হচ্ছে সচেতন জীবনকে কোনো ধরনের পূর্বসংষ্কার ছাড়াই গ্রহণ করতে হবে, ঠিক যেভাবে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে নিজেকে উন্মোচন করে। হুসেরল একক আত্ম-অভিজ্ঞতার কাঠামোকেই শুধু বিশ্লেষণ করেননি (Selbsterfahrung), নিজের সচেতন অবস্থা-সংক্রান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতা, বরং তিনি অন্যদের নিয়ে বা সম্বন্ধে কারো অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যা সমসাময়িক মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, তিনি নাম দিয়েছিলেন empathy (Einf ti hlung), সহমর্মিতা। তিনি একক ইগোর (das Ich) প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, কীভাবে ইগোনির্ভর অভিজ্ঞতাগুলো একসাথে মিশ্রিত হয়ে একটি একক ব্যক্তিগত জীবনের পুরোটা তৈরি করে। তার Ideas II বইটিতে তিনি আরো আলোচনা করেছিলেন কীভাবে মানুষ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন intersubjectivity, এছাড়াও একটি সমাজ ও সাধারণ পৃথিবীতে একসাথে বাস করার অভিজ্ঞতাও যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাঁর প্রধান বইগুলোয়, LogicalInvestigations, Ideas I, Cartesian Meditations. তিনি মূলত বিষয়গুলোকে ব্যক্তিতান্ত্রিক বা ইগোলজিকাল অহংবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সচেতন জীবনকে ব্যাখ্যা করেছে একক ব্যক্তি সত্তার উপর ভিত্তি করে, কিন্তু তিনি এই অহংবাদী অংশটি যে পারস্পরিক, সামাজিক সচেতনা থেকেই উদ্ভূত সেটাও দাবি করেছিলেন। মনের দর্শন নিয়ে কাজ করা একমাত্র দার্শনিক হিসাবে তিনি বিশেষভাবে সামাজিক কর্ম, সম্মিলিত উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণভাবে কথা বলেছিলেন। কোনো সার্বিক ফেনোমেনোলজির অবশ্যই লক্ষ্য থাকবে আত্মগত ও আন্ত-আত্মগত জীবনকে এর পূর্ণতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা, বৃহত্তর সামাজিক আর আধ্যাত্মিক রূপে যাকে তিনি বলেছিলেন সম্পূর্ণ eidetics of the spirit; হুসেরেল শুরু করেছিলেন একক, আত্মমাত্রিক, ব্যক্তিগত সচেতনতা নিয়ে, অর্থাৎ সচেতনতা, পুরোপুরিভাবে পূর্ণ জীবন্ত, সুস্পষ্ট, গতিময় সমৃদ্ধতায়, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন Heraclitean flux বা সচেতন জীবনের প্রবাহ। সাধারণত আমরা শুধুমাত্র বাঁচি, হরি বার্গনস ও উইলিয়াম জেমস হয়তো যাকে বলবেন, সচেতন অভিজ্ঞতার প্রবাহে। এর মানে একক ব্যক্তির মানসিক কর্মকাণ্ড অথবা প্রক্রিয়াগুলোয়।

হুসেরেল নিজে অবশ্য প্রবাহ রূপকটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের সচেতনতার নিরবিচ্ছিন্ন সামগ্রিক রূপটি প্রকাশ করে, জেগে থাকা অবস্থা, কিন্তু আসলেই আমাদের সচেতনতার ধারণাটি আরো সম্প্রসারণ করতে হবে সেখানে নিদ্রা, স্বপ্ন, নেশাগ্রস্থ অবস্থা, অ্যানাসথেসিয়া (ঔষধের মাধ্যমে অচতেনতা), ধ্যানের পরিস্থিতি ইত্যাদি যুক্ত করতে হবে। হুসেরেল বলেছিলেন বাঁচা মানে অভিজ্ঞতা অনুভব করা (leben ist erleben)। অন্তত শুরুর দিকে তাঁর আগ্রহ মূলত ছিল, যদিও শুধুমাত্র নয়, সমসাময়িক দর্শনযাকে চিহ্নিত করেছিল সচেতনতার occurrent ক্রিয়া হিসাবে (dispositional নয়), অর্থাৎ যা সচেতনভাবে ঘটছে তার উপর। পরে তার Passive Synthesis লেকচারে dispositional বিষয়টির দিকে তিনি নজর দিয়েছিলেন, সেই জটিল নানা স্তরগুলো, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন আমাদের pre-predicative জীবন, আমাদের অভ্যাস,বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং নানা সংস্কার যা আমাদের প্রভাবিত করে। তিনি পরে depth psychology-র ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন, মূলত ফ্রয়েড, ইউং, অ্যাডলারের মনোবিশ্লেষণের নানা রূপগুলো বর্ণনা করতে। হিউম যেমন প্রস্তাব করেছিলেন সচেতন অনুভূত অভিজ্ঞতাগুলো মূলত সময়ের ধারবাহিকতায় ঘটে, কিন্তু হুসেরেল বুঝতে পেরেছিলেন রূপায়িত অভিজ্ঞতাগুলোই সময়ের ধারাবাহিকতা না-মেনেই একত্র হয়ে তৈরি করে আমাদের সচেতনতা, যেখানে প্রতিটি সচেতন অভিজ্ঞতা পরিবর্ধন, পরিবর্তন বা পরস্পরকে বিকৃত করতে পারে যেমন, তেমনি পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে যা আমরা জীবন হিসাবে অভিজ্ঞ হই। ফেনোমেনোলজির দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র বিষয়টিকে স্পষ্ট করতে, গুরুত্বপূর্ণভাবে শনাক্ত করতে হবে কোনো সচেতন কগনিটিভ বা জ্ঞানীয় সত্তা মানবজীবনের প্রাকৃতিক কিংবা কার্যকারণনির্ভর কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেবার চেষ্টা করেননি। বা কীভাবে আমাদের বাস্তবে রূপায়িত এই মনটি কাজ করতে সক্ষম হয়। আমাদের মস্তিষ্ক হচ্ছে এমন একটি অঙ্গ যা আমরা সরাসরি অনুভব করতে পারিনা (বিজ্ঞান বলছে যে আমাদের মস্তিষ্ক আছে), হুসেরেল শুরু করতে চেয়েছিলেন সচেতন অভিজ্ঞতার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো, তাদের আধেয় এবং উদ্দেশ্যগুলো ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে। তিনি মৌলিক কাঠামোটি খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন যে, পূর্বনির্ধারিত নিয়মগুলো সচেতনাকে পরিচালনা করে (এর ক্রিয়া, উদ্দেশ্য, আধেয়, সত্যায়ন করার প্রক্রিয়া, সুতরাং এটি আইডেটিক বিজ্ঞান, আইডেটিক উপসংহারে পৌঁছানো মানে কোনো একটি ঘটনা বা ফেনোমেনাকে এর মৌলিক ফেনোমেনা অংশে বিভাজিত করার প্রচেষ্টা)। হুসেরেল নানা ধরনের কগনিটিভ অথবা এপিসটেমিক দৃষ্টিভঙ্গি (যে-কোনোকিছু উপলদ্ধি করা, মনে করা, কল্পনা, বিচার বা আন্দাজ করা ইত্যাদি) যা আমাদের কোনো কর্ম-সম্পাদনকারী আর কোনোকিছু সম্বন্ধে জ্ঞাত (বা এজেন্ট) হিসাবে যৌক্তিক জীবনের কাঠামো গড়ে তোলে। তিনি পরিবর্তনের সূত্রগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, যার মাধ্যমে কোনো একটি পরিস্থিতি বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয় অন্য একটি অবস্থা বা দৃষ্টিভঙ্গিতে (অনিশ্চয়তা রূপান্তরিত হয় বিশ্বাসে, কোনো উপলব্ধি স্মৃতিতে ইত্যাদি) এবং এইসব কগনিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক সম্বন্ধে। কোনো একটি সচেতন অভিজ্ঞতার স্বরূপ বোঝার মূল চাবি হচ্ছে intentionality বা উদ্দেশ্য বোঝা। হুসেরেলও মনে করতেন মানসিক অবস্থা মূলত ইনটেনশনাল অবস্থা, মানে এর পেছনে মনে কোনো উদ্দেশ্য আছে। প্রতিটি উপলব্ধি, স্মৃতি, চিন্তা, অনুভূতি অথবা আবেগ কোনোকিছু সম্বন্ধে, কোনোকিছুর প্রতি তা নির্দেশিত এবং এটি কোনোকিছু নিয়ে, তিনি এই ইনটেনশনালিটিকে সব সচেতনতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য মনে করতেন।

তিনি দেকার্তের ভাষায় বলেছিলেন প্রতিটি cogitatio একটি cogitatum-এর উদ্দেশ্য ধারণ করে। তিনি দুটি গ্রিক শব্দও ব্যবহার করেছিলেন, noesis আর noema। কোনো একটি অভীষ্ট বস্তুর কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা গবেষণা করতে পারি এর অস্তিত্ব থাকুক বা না-থাকুক বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে। যেমন আমি কোনো আদর্শ সঙ্গী খুঁজতে পারি (যাকে আমি হয়তো কখনোই না-খুঁজে পেতে পারি) কিন্তু আমি বেশ নিশ্চিত হতে পারি সেই মানুষটির সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে। সাংস্কৃতিক কোনো বস্তু, শিল্পকলার কোনো উপাদান বা ধর্মীয় কোনো স্মারক সবকিছুই উদ্দেশ্যনির্ভর বৈশিষ্ট্য। নোয়েটিক বা আমাদের বুদ্ধিমত্তার বা মনের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা এই জিনিসগুলোর উপর আমাদের আরোপিত অর্থ সুস্পষ্ট হয়। তারা কী উপস্থাপন করছে বা গোপন করছে সেটি গবেষণা করা মানে তাদেরnoematically (এটি সম্বন্ধে আমাদের বোঝাপড়া) গবেষণা করা। কোনো একটি ক্রিয়া ও বস্তুর মধ্যে উদ্দেশ্যসংশ্লিষ্টতা গবেষণা করার মানসিক কোনো অবস্থার মূল বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করা। সেকারণে ইনটেশনাল জীবনের স্ত রগুলো চিহ্নিত করলেই হবে না, তিনি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন তার আন্ত :সম্পর্কগুলো কীভাবে একটি একক কাঠামো গড়ে তোলে যা শুধু একক সচেতনতাকেই চিহ্নিত করতে সাহায্য করেনা, সম্মিলিত একটি কগনিটিভ জীবনের অংশ (Erkenntnisleben)।

হুসেরেল হলিস্ট ছিলেন, ইনটেশনাল জীবন একটি সম্পর্কযুক্ত সম্পূর্ণ, একটি বোধগম্য সম্মিলিত কমপ্লেক্স বা নেক্সাস (Zusammenhang)। দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, পরিবর্তন, সেডিমেন্টেশন ( যে বিশ্বাসগুলো আমাদের মনে সুস্থির বিশ্বাস হিসাবে স্থিতিশীল হয় বা অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়) সবই সংশ্লেষিত হয় একটি অবিরামভাবে চলমান জীবনে। তিনি এই সচেতন জীবনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। তিনি সচেতন কর্মের নানা স্তরের কথা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর মতে সেই স্তরগুলো একটির উপর একটি সাজানো নয় বরং তারা পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করে, অধিক্রমণ করে। তিনি বাইরের ও ভিতরের পারসেপশনের কথা বলেছিলেন, বাইরের পারসেপশনে আমরা আমাদের বাইরের কোনোকিছুকে বুঝতে পারি, আর ভিতরের পারসেপশনে আমরা আমাদের নিজেদের সচেতন চিন্তা ও অনুভূতিগুলোকে অনুভব করি। তিনি ফেনোমেনোলজির আরো বিস্তারিত বিবরণে বলেন, যা আমাদের সচেতন স্তরে ঘটছে আমাদের বাইরে, সেটি সুনির্দিষ্ট চিন্তার মাধ্যমে আমরা পুনরুদ্ধারও করতে পারি শুধুমাত্র আমাদের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে। এভাবে কোনো একটি গাছ দেখা থেকে আমরা যে গাছ দেখছি সেটি দেখি, যার সাথে সংযুক্ত সাময়িকভাবে কিছু ভিন্ন অনুভূতির পরিবর্তন। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারার ক্ষমতা অমাাদের মৌলিক স্বাধীনতা যুক্তিশীল কোনো প্রাণী হিসাবে। ঠিক যেভাবে কোনো সিনেমা দেখার সময় আমি কাহিনীর মধ্যে ডুবে গিয়েও, চিন্তার মাধ্যমে নিরীক্ষা করতে পারি কীভাবে ক্যামেরার শটগুলো সেটআপ করা হয়েছে বা অন্যান্য কোনো কারিগরি বিষয়। আমি আমার ক্রিয়া থেকে আমার সচেতন মনোযোগ পরিবর্তন করতে পারি, আমি নিজস্ব মনোযোগ দেবার প্রক্রিয়ায়। হুসেরেল যেমন বলতেন বাইরের পারসেপশনগুলো সবসময়ই আংশিক, এবং অভ্যন্তরীণভাবে এটি চিহ্নিত করে কখনোই এটি সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন আভ্যন্তরীণ পারসেপশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ ও সত্য। কিন্তু পরে তিনি মতপরিবর্তন করেছিলেন এটি পুরোপুরিভাবে সত্য নাও হতে পারে। আমি আমার নিজের কষ্ট বা রাগ সম্বন্ধে হয়তো নিশ্চিত হতে পারি, এমনকি আমার চেহারায় সেটি বাইরের কোনো বস্তুর মতোই স্পষ্ট হতে পারে এবং আমি হয়তো চিন্তার মাধ্যমে সেই উপসংহারে আসতে পারি যে এটি আসলে আঘাত বা মনোকষ্ট পাবার অনুভূতি। আমাদের এই পারসেপশনগুলোর নিশ্চয়তা আর সার্বিক বিশ্বাসের কাঠামো, যাকে তিনি বলেছিলেন প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। তার ফেনোমেনোলজির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার হচ্ছে, সাধারণ, নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা, পৃথিবীর নানা কিছু, উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ এবং জায়গা, প্ৰাক-তাত্ত্বিক, প্রাক-বৈজ্ঞানিক জগৎ এ সবকিছুই খুব সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংশ্লিষ্ট, যাকে বলা হয় natural attitude. ফেনোমেনোলজি দেখিয়েছে প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেটি নিজে যে একটি দৃষ্টিভঙ্গি সেটি সম্বন্ধে সচেতন নয়, একটি transcendental দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে যা নানা সহযোগিতাপূর্ণ সত্তার অর্জনকে দেখে নৈর্ব্যক্তিক রূপে। এভাবে যেমন, কোনো একটি নাটক তখনই নাটক হবে যদি সব অংশগ্রহণকারী (অভিনেতা, পরিচালক, লেখক, দর্শক, মঞ্চের কুশলীরা বিশ্বাস করে তারা যা করছে তাহলো একটি নাটক মঞ্চস্থ করছে)। একই বিষয় প্রযোজ্য সব সাংস্কৃতিক দ্রব্যের ক্ষেত্রে (ধর্মীয় আচরণ, শিল্পকলার কোনো অনুষ্ঠান, বিচারের জন্যে জমায়েত যেমন আদালত ইত্যাদি)।

হুসেরেল এমনকি আরো দাবি করেন যে প্রকৃতি নিজেই (বিশেষ করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন বোঝা হয়ে থাকে) এই প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উৎপন্ন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান কাজ করে প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর এবং কোনো প্রশ্ন করেনা। কিন্তু হুসেরেল মনে করতেন দর্শন এই অজ্ঞতায় বাস করতে পারেনা। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল কগনিশনের প্রকৃতি সম্বন্ধে জানা, বিশেষ করে বিচারিক প্রক্রিয়া, এবং যুক্তির জীবন সম্বন্ধে জানা। তিনি কগনিশনকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছিলেন সরাসরি ও তাৎক্ষণিক পারসেপচুয়াল অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে, তাঁর মতে এটাই সব সচেতনতার ভিত্তি তৈরি করে। মানসিক কোনো ক্রিয়ার ভিত্তি হচ্ছে পারসেপশন এবং সেকারণে জ্ঞান এবং সচেতনতার কোনো গবেষণা অবশ্যই শুরু করতে হবে পারসেপশন থেকে, যদিও স্পষ্টতই এটি এখানেই শেষ হয়না। এটাই আমাদের প্রথম নৈর্ব্যক্তিকতা দেয়, পৃথিবীর বাস্তব অভিজ্ঞতাকে অনুভব করতে দেয়, আমাদের ও পৃথিবীর। এইসব পারসেপশনকে বাতিল করা মানে এসব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করা। যে বাস্তবতাকে আমরা গ্রহণ করেছি সেটিকে অস্বীকার করা। শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তির পারসেপশন নয়, অবশ্যই তিনি স্পর্শ আর দৃষ্টি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন (যদিও শ্রবণ, গন্ধ, আর স্বাদ নেবার বিষয়ে বেশিকিছু বলেননি)। তিনি বলেছিলেন যে যা আমরা দেখি এবং যেভাবে দেখি, যার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুভব করার প্রক্রিয়া, যা অনুভব করা হচ্ছে তার প্রকৃতি, অনুভব করার বোধসহ নানা বিষয়। আধুনিক দার্শনিকদের কাছে হুসেরেলের আবেদন আছে প্রত্যক্ষ বাস্তবতার প্রতি তার দায়বদ্ধতার কারণে, representationalism (কোনো দৃষ্টিভঙ্গি যা দাবি করে কোনো প্রতীক বা ছবি, আসল অনুভূত বস্তুটিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে) এবং conceptualism (যার মানে সব অনুভূত সচেতনতা মূলত কোনো একটি ধারণার অনুশীলন)-কে প্ৰত্যাখান করার কারণে। এবং তিনি জাজমেন্ট থেকে পারসেপশনের মূল বিষয়টিকে আলাদা করেছিলেন। ধারণা আর অনুভূতির উপাত্ত-সংক্রান্ত এমপিরিকাল ধারণা তীব্র সমালোচক ছিলেন। আমরা রঙের টুকরো দেখিনা বা বিশৃঙ্খল শব্দ শুনিনা বরং বহু বর্ণিল ভূদৃশ্য এবং ট্রাফিক, পাখি আর ফ্রিজের শব্দ শুনি। পারসেপশনের কার্যকারণকে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। দরজার ঘণ্টি বাজা শোনা মানে ঘণ্টির বোতাম চাপা হচ্ছে সেটি শোনা নয়। যদিও বোতাম চাপার কারণে ঘটনাগুলো ঘটছে যার কারণে আমরা ঘণ্টির শব্দ শুনছি। যে কারণে আমরা ঘণ্টি শুনি, বোতাম দাবানো শুনিনা, কারণ যদিও আমাদের শ্রবণ-অভিজ্ঞতায় দুটি বিষয় ধরা পড়ে: ঘণ্টি (এটি বাজছে) এবং বোতাম (এটি চাপা হয়েছে), কিন্তু ঘণ্টি বাজাটা প্রাথমিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করছে, বোতাম চাপাটি নয়। আমরা শুধু জানি বোতাম চাপা হয়েছে, কারণ কার্যকারণ সংক্রান্ত কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি আমরা ইতিমধ্যে জানি। আমরা কারণগুলোকে আমাদের অনুভূত দৃশ্যে পাঠ করি যেন সেটি সেখানে আছে। হুসেরেল বলতেন আমরা যা উপলব্ধি করি সেটি কোনোকিছুকে সরাসরি আর তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করে, এবং এই অনুভব করার প্রক্রিয়া আছে প্রশ্নাতীতভাবে কোনোকিছু মেনে নেয়ার বিষয়। পারসেপশনের আরেকটি উপাদান হচ্ছে এর সাথে বিশ্বাস আর নিশ্চয়তা জড়িত, যাকে তিনি বলেছিলেন protodoxa, তাঁর মতে প্রতিটি সাধারণ অনুভূতি বা উপলব্ধি বোধ আসলে সত্যতার সচেতনতা, Urdoxa। হুসেরেলের তৃতীয় দাবিটি হচ্ছে পারসেপশনে যখন কোনো একটি বস্তুকে আমরা অনুভব করি, পুরো জিনিসটাকে আমরা অনুভব করি, যদিও বস্তুটিকে আমরা হয়তো একদিক থেকে দেখছি। হুসেরেলের দাবি ছিল পারসেপশনই সচেতনতার মূল ভিত্তি।

অন্য সবধরনের সচেতন অভিজ্ঞতা কোনো-না-কোনো উপায়ে পারসেপচুয়াল আর সংবেদী সচেতনতার অংশ। মনে করার প্রক্রিয়ায় যে-অভিজ্ঞতাটি মনে করা হয় সেটি মূলত যে মনে করছে তার অভিজ্ঞতার অংশ। শুধুমাত্র সময়ের ব্যবধান সেটিকে বর্তমান থেকে ভিন্ন করছে। মনে করাটি সেই পারসেপশনকে পুনরায় মনে করিয়ে দেয়। অন্যদের সচেতন অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাও একধরনের presentiation, সেই সময়ের মনোবিজ্ঞানের ধারা অনুযায়ী হুসেরেল এটিকে এমপ্যাথি বলেছিলেন। তিনি originary অথবা প্রিমোর্ডিয়াল বা আত্ম- অভিজ্ঞতার সাথে অন্য অভিজ্ঞতার পার্থক্য করেছিলেন, যাকে তিনি বলেছেন non- originary, তিনি দাবি করেন কেউ অন্য কারো সরাসরি অভিজ্ঞতা একইভাবে অনুভব করতে পারেনা। অবশ্যই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি হতে পারে, দুই ভাই তাদের বাবার মৃত্যুশোক ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু দুজনের দুঃখ ব্যক্তিগত। এবং তাদের দুঃখের ইনটেনশন বা উদ্দেশ্যের কাঠামোও ভিন্ন, এমনকি যখন ইনটেনশনের অবজেক্ট মূলত একই। উপরন্তু দুজনেই পরস্পরের দুঃখের ব্যপারে সচেতন স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে। একজন বোন হয়তো তার ভাইয়ের দুঃখের সমব্যথী হতে পারে, তারপরও বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন ভাবতে পারে ইত্যাদি। হুসেরেল নানা উপায়ে চেষ্টা করছিলেন অনুসন্ধান করতে যে কীভাবে সহমর্মিতার বোঝাপড়াটি অর্জন করা যায়। একটি উপায় হচ্ছে আমাদের শরীর দিয়ে অন্য শরীরের সাথে সমরূপী বন্ধন, কোনো করমর্দনের সময়, দুজনেই অনুভব করতে পারে অন্যজন সংস্পর্শ করতে চাইছে। অবশ্যই এটা নানাভাবে সম্ভব, আমি হয়তো অন্যজনের অনিচ্ছা টের পেতে পারি, কিন্তু যাই অনুভব করিনা কেন, আমার শরীর ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য একটি শরীর স্পর্শ করেছে। স্বকীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে হুসেরেলের বেশকিছু দাবি আছে। কোনো ব্যক্তি একটি ব্যক্তি হিসাবে দেখা হয় সুনির্দিষ্ট একটি দিক থেকে, যাকে তিনি বলেছিলেন personalistic attitude, এখানে কোনো ব্যক্তির অন্যান্য অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি। শুধুমাত্র সেটি উন্মোচিত হয় যখন আমরা তাদের দেখি একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থেকে। বিশেষভাবে personalistic attitude হচ্ছে যে-দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা থাকি যখন আমরা অন্যদের সাথে বসবাস করি, কথা বলি, করমর্দন করি, অথবা ভালোবাসা ঘৃণার কোনো সম্পর্কে থাকি, মেজাজে ও কাজে, আলোচনায়। হুসেরেল মনে করতেন কোনো ব্যক্তি বা পার্সন হচ্ছে প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তি যার পরিচিতি পরিবর্তনশীল নানা অবস্থায় (শৈশব, প্রাপ্তবয়স্কতা), যার স্বাধীনতা অনুশীলন করার ক্ষমতা আছে, যৌক্তিক কাজ ও দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা আছে। হুসেরেল ব্যক্তির কেন্দ্রে যুক্তির চালিকাশক্তিটিকে রেখেছেন, আমরা নানা স্তরের উন্মুক্ত একটি সংযোগময় সামাজিকতায় বাস করি। আর সংযোগ ঐক্য সৃষ্টি করে। একটি সচেতনতা আরেকটি সচেতনতার সাথে যুগপৎ ঘটে; বোঝাপড়া, উদ্দেশ্য, ভাগ করে নেয়া পছন্দ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ঐক্য গড়ে তোলে। মনের দর্শনের নানাক্ষেত্রে হুসেরেল-এর দর্শন অসাধারণভাবে সমৃদ্ধ। অ্যানালাইটিক দর্শনও প্রভাবিত হয়েছে তার দ্বারা; নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে ব্যক্তিপর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গি, একক ও সমষ্টিগত উদ্দেশ্যময়তা। আবেগ ও সহমর্মিতার প্রকৃতি, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধে ধারণা, কল্পনার প্রকৃতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতের সামগ্রিক গঠনের বিষয়গুলো আবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *