1 of 2

অধ্যায় ৪৩ : বিষণ্ণতার রাজপুত্র – এমিল চিওরান

অধ্যায় ৪৩ : বিষণ্ণতার রাজপুত্র – এমিল চিওরান

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিখ্যাত একজন রোমানীয়-ফরাসি দার্শনিক ও অ্যাফোরিস্টকে (অ্যাফোরিজম হতে পারে কোনো সংক্ষিপ্ত পর্যেবক্ষণ, বা কোনো বক্তব্য, যা কোনো সাধারণ সত্যকে প্রকাশ করে) জুরিখে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। নানা প্রশংসাসূচক বিশেষণ ব্যবহার করে ও কিয়ের্কেগার্ড আর শোপেনহাউয়ারের সাথে তুলনা করে সঞ্চালক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেবার পর বক্তা মৃদু হেসে সাথে সাথেই তার জার্মান দোভাষীকে সংশয়ে ফেলে দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেছিলেন, Mais je ne suis qu’un déconneur – কিন্তু আমি শুধুমাত্র একজন জোকার (বা ভাঁড়)। তার কিছু সমালোচক অবশ্য তার সাথে একমত হতেন, কিন্তু তারাও ভুল করতেন। কারণ এমিল মিহাই চিওরান অবশ্যই মহান ফরাসি আর ইউরোপীয় সেই নৈতিক দার্শনিকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার জন্যে কোনো অংশে কম অযোগ্য ছিলেন না, যে তালিকায় আছেন মনতাইন, শামফোর,পাসকাল, লা রোশফুকোর মতো দার্শনিকরা। ১৯১১ সালে রোমানিয়ার রাসিনারিতে চিওরান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন গ্রিক অর্থোডক্স যাজক। এই দুটি বাস্তব তথ্য চিওরানের পরবর্তী কাজগুলোর মর্মোদ্ধার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চিওরানের লেখায় বিদ্যমান বিষণ্ণতা, রোমান্টিকতা, নিয়তিবাদী মেজাজের কারণ হিসাবে তার রোমানীয় ঐতিহ্যকে চিহ্নিত করেছেন অনেকেই, আর খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক বাবার ছেলে হিসাবে ধর্ম বা সেই সংক্রান্ত ভাবনাগুলো নিয়মিত প্রতিধ্বনিত হয়েছিল তার দর্শনে, যেমন নাস্তিক্যবাদের আনন্দ আর বিপদ। রোমানিয়ার একপ্রান্তে সিবিউতে তিনি পড়াশুনা করেছিলেন ১৯২০ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৪ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মাতৃভাষায় প্রথম বই প্ৰকাশ করেছিলেন, On the Heights of Despair, পরবর্তীতে যা-কিছু সুস্পষ্টভাবে বিষণ্ন, নিরানন্দ আর নাস্তিবাদী দর্শন তিনি তার সারাজীবন ধরে বিকশিত আর অনুশীলন করেছিলেন এই বই তার ভ্রূণ ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন লেখা তার জন্যে আত্মহত্যার বিকল্প ছিল। হতাশা আর বিষণ্নতার মুহূর্তে পড়ার জন্যে তিনি আরেকজন দার্শনিক। তিনি আমাদের হতাশ করেন না, শুধুমাত্র আমাদের দুঃখে একাকিত্বের অনুভূতি খানিকটা কমিয়ে দেন। তার কাজের মধ্যে উঁকি দিলে আমরা দেখতে পাই এমন কিছু বাক্য :

‘আত্মহত্যা করে কোনো লাভ নেই, কারণ আপনার আত্মহত্যা করতে সবসময়েই অনেক দেরি হয়ে যাবে।’

‘শুধুমাত্র আশাবাদীরাই আত্মহত্যা করে, যে আশাবাদীরা আশাবাদী হয়ে বাঁচতে ব্যর্থ হন। অন্যরা, যাদের বেঁচে থাকারই কোনো কারণ নেই, মরার জন্যে কেনই বা তাদের কোনো কারণ থাকতে পারে?’

‘বই লিখুন, তবে শুধুমাত্র যদি আপনি সেখানে এমন কিছু বলতে চান যা আপনি কখনোই কাউকে বলার সাহস পেতেন না।’

এছাড়াও যেমন :

‘সারাদিন কী করেন আপনি? নিজেকে সহ্য করি আমি।’

চিওরানের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর ছিল ১৯৩৭ সাল, যে বছর তিনি প্যারিসে থাকা শুরু করেছিলেন, এবং খুব শীঘ্রই ফরাসি নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন। তিনি আর কখনোই তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে যাননি। এই পরিবর্তনটি একটি তাঁর বিষণ্ণতা ও দুঃখবোধের কারণ ছিল, কারণ এটি ছিল নির্বাসন। কিন্তু তারপরেও তিনি দাবি করছিলেন যে, যদি কেউ নিজেদের নির্বাসিত হিসাবে অনুভব করতে না পারেন সেটির কারণ শুধুমাত্র তাদের কল্পনাশক্তির অভাব : ‘শুধুমাত্র গ্রামের নির্বোধই মনে করতে পারে তারা কোনো জায়গার সাথে চিরকালের জন্যে সংযুক্ত!’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি প্যারিসে ছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গ্যালিমর্দের কাছে ফরাসি ভাষায় লেখা তার প্রথম পাণ্ডুলিপিটি তুলে দেন, A Short History of Decay বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ফরাসি ভাষায় লেখা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, কাজটি অনেকটা অভিধান ব্যবহার করে প্রেমপত্র লেখার মতো। এই বইটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এটি ছিল দুর্দান্তভাবে নৈরাশ্যবাদী ধারাবাহিক কয়েকটি বইয়ের প্রথমটি, যাতে মূল বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে মূলত অ্যাফোরিজম আর শ্লেষাত্মক তিক্ততাপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ ব্যবহারের মাধ্যমে। বইগুলোর শিরোনামই প্ররোচনামূলক অথবা আঘাত করার মতো : Syllogisms of Bitterness, The Temptation to Exist, এবং তার মাস্টারপিস বলে পরিচিত The Trouble with Being Born। প্রতিটি বইই নিরন্তরভাবে অসুস্থতা, মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করেছে। নিয়তির শ্লেষই বলতে হবে কারণ এই বইগুলোর লেখক দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন (৮৪ বছর বয়সে ১৯৯৫ সালে তিনি মারা যান)। তিনি যখন মারা যান, ততদিনে চিওরান সুপরিচিত ফ্রান্সে। তাঁর বইতে যে-ধরনের খামখেয়ালি মনোযোগ আর আকর্ষণ তিনি তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিলেন, তাঁর পাঠকদের কাছ থেকে সেই ধরনের আকর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য সবসময়ই বলে গেছেন, ‘প্রতিটি জীবনই চূড়ান্তভাবে অদ্ভুত এবং পুরোপুরিভাবে গুরুত্বহীন। ওয়াল্ট ডিজনির এই যুগে এই ধরনের নৈরাশ্যবাদিতার মূল্য আছে।’

চিওরানের লেখা বিখ্যাত ইউরোপীয় সেইসব নির্লিপ্ত উদাসীন দুঃখবাদীদের মতো, যেমন, লা রোশফুকো, শামফোর, লোপার্ডি, নিচাহ, বেকেট, তাদের মতো তিনি সভ্যতাকে দেখেছেন অস্তিত্বের চূড়ান্ত অর্থহীনতা থেকে একটি উদ্ভট চিত্তবিক্ষেপ হিসাবে। তিনি দাবি করেছিলেন, শুধুমাত্র একজন নির্বোধই পারে এর মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজে পেতে। কিন্তু তিনি নিজে তার বুদ্ধিমত্তা আর চমৎকার মেজাজ হারাননি। তার দুঃখের আরেকটি কারণ ছিল, তিনি ঘুমাতে পারতেন না ভালো করে। প্রায়ই ভোর তিনটায় তার ঘুম ভেঙে যেত। ভোরবেলা অবধি তিনি প্যারিসের নানা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি The Trouble with Being Born বইটিতে অবজ্ঞামিশ্রিত শ্লেষের সাথে মন্তব্য করেছিলেন, ‘একবার মাত্র ক্রুশবিদ্ধ হবার যন্ত্রণা কীভাবে তুলনা করা যেতে পারে সেই যন্ত্রণার সাথে, অনিদ্রায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রতিদিনই যা ভোগ করেন’? আত্মহত্যার বিষয়টি নিয়ে তার আগ্রহে একধরনের আচ্ছন্নতা ছিল। কিন্তু তিনি লিখেছিলেন, তবে এর চেয়ে বেঁচে থাকাই ভালো, কিন্তু তারপর এমনভাবে চিন্তা ও কাজ করা উচিত যেন সে আসলেই মৃত।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আর যাই হোক আরো বেশিদিন বেঁচে থাকার সান্ত্বনাদায়ক ধারণা থেকে কেনই বা কেউ নিজেকে বঞ্চিত করবে?’ তিনি আরো বলেন, ‘বেঁচে থাকা সম্ভব শুধুমাত্র আমাদের কল্পনা আর স্মৃতির ঘাটতির কারণে। বা, আমি দুর্ঘটনা মাত্র, কেন সবকিছু এত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করন হবে?’ কিন্তু আত্মহত্যা সার্বক্ষণিক মুক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে তার ভাবনায়: “ আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হই তখন, যখন নিশ্চিত হতে পারি না ইচ্ছামাত্রই আত্মহত্যা করতে পারব কিনা।’ তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ কিছু দ্বারা বিস্মিত হবার ভয়ে চিরকালই বাস করার কারণে, আমি সব পরিস্থিতিতে চেষ্টা করেছি এগিয়ে থাকার জন্যে, ঘটবার বহু আগে আমি দুর্ভাগ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।’

আমাদের যুগটি বিশেষভাবে আশাবাদী, আর সেকারণে আমাদের অনেক কষ্টভোগও করতে হয়। ব্যক্তিগত স্তরে, সবার আড়ালে আমরা যতটা স্বীকার করতে চাই তার চেয়েও আমরা অনেক বেশি বিষণ্ণ। চিওরানের মতো লেখকরা সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমাদের সবার মধ্যে থাকা দুঃখগুলোর একটি সামাজিক অভিব্যক্তি দেয়ার জন্যে, এভাবে খুব সামান্য, শুধুমাত্র খুব সামান্য পরিমাণে সেটি হ্রাস আর সহনীয় করা সম্ভব হয়। তাঁর সুন্দর The Trouble with Being Born বইটিতে চিওরান লিখেছিলেন: ‘আমি মানুষের বন্ধু হতে পারি শুধুমাত্র যখন তারা সবচেয়ে বিষণ্নতম পরিস্থিতিতে থাকে, যখন তাদের ভাবাবেগের বিভ্রান্তিগুলো পুনরুদ্ধার করার না থাকে শক্তি, না থাকে ইচ্ছা।’ আর ঠিক এটাই সেই মনের অবস্থা, যার মধ্যে প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষদের অবশ্যই বেশ নিয়মিতভাবে নিমজ্জিত হওয়া উচিত, যেন আমরা সেই সৌভাগ্যটি অনুভব করতে পারি যে বেশকিছু দার্শনিকের মতোই চিওরানের বিষণ্ন আর সান্ত্বনা দেবার মতো কাজ আমাদের প্রতীক্ষায় আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *