অধ্যায় ২১ : সম্ভাব্য সব পৃথিবীর সেরা? – ভলতেয়ার এবং গটফ্রিয়েড লাইবনিজ
আপনি যদি এই পৃথিবীটি পরিকল্পনা করতেন, তাহলে কি এটি এখন যেমন আছে তেমনভাবেই করতেন? সম্ভবত না। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিছু মানুষ দাবি করেছিলেন তাদেরটাই সম্ভাব্য সকল পৃথিবীর মধ্যে সেরা। ‘যা কিছু যেমনভাবে আছে, সেটাই ঠিক’, দাবি করেছিলেন ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮- ১৭৪৪)। এই জগতে সবকিছুই যেভাবে আছে তার একটি কারণ আছে: কারণ সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান। সুতরাং এমনকি যখন স্পষ্টতই মনে হবে সবকিছু খারাপভাবেই চলছে, সেগুলো আসলে খারাপ নয়। রোগবালাই, বন্যা, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড, খরা, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সবকিছুই যত দুর্গতির মনে হোক না কেন, সেগুলো শুধুমাত্র ঈশ্বরের পরিকল্পনারই একটি অংশ। আমরাই বরং ভুল করি যখন সামগ্রিক দৃশ্যটি না ভেবে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিটি ঘটনার দিকে নজর দিই। আমরা যদি ঈশ্বর যেখানে বসে এই মহাবিশ্বকে দেখছেন সেখান বসে সবকিছু দেখতে পারতাম তাহলে আমরা এর নিখুঁতত্বটি অনুভব করতে পারতাম, কীভাবে প্রতিটি অংশ পরস্পরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে সামগ্রিক দৃশ্যটি তৈরি করছে, যা কিছুই আমাদের এখন অশুভ আর দুর্ভোগের কারণ হিসাবে মনে হচ্ছে তারা সত্যিকারভাবে ঈশ্বরের আরো অনেক বিশাল পরিকল্পনারই অংশ।
পোপ ছাড়াও অনেকেই আক্রান্ত হয়েছিলেন এই আশাবাদে। জার্মান দার্শনিক গটফ্রিয়েড ভিলহেম লাইবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) তাঁর Principle of Sufficient Reason ব্যবহার করে একই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন সবকিছুর অবশ্যই একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে, যেহেতু প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঈশ্বর ত্রুটিমুক্ত, ত্রুটিহীনতাই ঈশ্বরের প্রচলিত সংজ্ঞার অংশ, এটাই দাবি করে যে, ঈশ্বর মহাবিশ্বকে যেমন করে সৃষ্টি করেছেন, ঠিক সেভাবে এটি সৃষ্টি করার মধ্যে অবশ্যই খুবই উত্তম কারণ আছে। কোনোকিছুই অপরিকল্পিত নয়। ঈশ্বর একেবারে চূড়ান্তভাবে নিখুঁত জগৎসৃষ্টি করেননি প্রতিটি ক্ষেত্রে, সেটি হলে এই জগৎই রূপান্ত রিত হবে ঈশ্বরে। যেহেতু যা-কিছু আছে, ছিল এবং হতে পারে, তার মধ্যে ঈশ্বর হচ্ছেন সবচেয়ে ত্রুটিহীন। কিন্তু তিনি অবশ্যই সব সম্ভাব্য জগতের চেয়ে সবচেয়ে সেরাটি তৈরি করেছেন, সেই জগৎ, যেখানে ফলাফল অর্জনের জন্য ন্যূনতম যতটুকু অশুভ কিছুর দরকার তারচেয়ে একবিন্দু বেশি নেই। আর কোনোভাবেই এই সবকিছু সৃষ্টি করার এর চেয়ে উত্তম কোনো উপায় থাকতে পারেনা: আর অন্য কোনো পরিকল্পনাই এরচেয়ে কম অশুভ বিষয়গুলো ব্যবহার করে আরো বেশি শুভ কিছু সৃষ্টি করতে পারত না। ফ্রাঁসোয়া-মারি আরুয়ে (১৬৯৪, ১৭৭৮), যিনি সুপরিচিত ছিলেন ভলতেয়ার নামে, তিনি জগৎটাকে এভাবে দেখেননি। এইসব তথাকথিত ‘প্রমাণ’ দেখে তিনি কোনো স্বস্তিবোধ করেননি যে, সবকিছুই ভালোভাবে চলছে। তিনি গভীরভাবে সংশয়বাদী ছিলেন সেইসব দর্শনপদ্ধতি আর চিন্তাবিদদের ব্যাপারে, যা বা যারা কিনা বিশ্বাস করে, তাদের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে।
ভলতেয়ারের বাবা ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, রাজধানীর সেরা স্কুলে তাকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, এবং সব সূত্রমতেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। তরুণ ভলতেয়ার খুব অল্পবয়স থেকেই লেখক হতে চেয়েছিলেন, নিজের নামটি সুপরিচিত করে তুলতে চেয়েছিলেন, আর আসলেই প্রথমে তিনি যেটি করেছিলেন সেটি হলো তাঁর নাম বদলে রেখেছিলেন ভলতেয়ার। অষ্টাদশ শতাব্দীকে আমরা সাধারণত যুক্তি আর এনলাইটেন্টমেন্টের যুগ হিসাবে চিহ্নিত করি, এবং কখনো যাকে বলা হয় ভলতেয়ারের যুগ। সুতরাং নাম বদলে তিনি ভুল করেননি, ‘আরুয়ের যুগ’ শুনতে তেমন ভালো লাগত না। কবি হিসাবে তার প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে তারুণ্যে, চব্বিশ বছর বয়সে তার লেখা প্রথম কাব্যনাটক মঞ্চস্থ হয় Comédie françaiseএ। এর আগেই তিনি একটি মহাকাব্য লিখতে শুরু করেছিলেন ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ফরাসি ধর্মীয় গৃহযুদ্ধ নিয়ে, যে-কবিতাটি রাজা হিসাবে চতুর্থ হেনরির মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে, যিনি প্রোটেস্টান্টবাদ থেকে ক্যাথলিসিজম গ্রহণ করে উপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গৃহযুদ্ধে লাগামহীন রক্তপাতের পরিসমাপ্তি ঘটাতে। এই বিষয়টি ভলতেয়ারের খুব প্রিয় একটি বিষয়। কারণ জাতীয় একটি মহাকাব্য লেখার ছলে তিনি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে সৃষ্ট সহিংসতার রক্তাক্ত পরিণতি নিয়ে।
এই ফরাসি নাট্যকার, প্রহসন লেখক ও ঔপন্যাসিক, তার স্পষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সারা ইউরোপেই পরিচিত ছিলেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্যটি, যা সৃষ্টি করেছিলেন জ্যা-আঁতোয়াঁ উদোঁ, যিনি সাহসী আর বুদ্ধিদীপ্ত ভলতেয়ারের ঠোঁটচাপা স্মিতহাসি আর মুখে ও চোখের পাশে কৌতুকময় হাসির রেখা সফলভাবে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আর বাকস্বাধীনতার অন্যতম সমর্থক হিসাবে তিনি বেশ বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। যেমন, মনে করা হয় তিনি সম্ভবত বলেছিলেন, I hate what you say, but will defend to the death your right to say (অর্থাৎ আপনি যা বলছেন সেটা আমি ঘৃণা করি, কিন্তু আপনার সেটি বলার অধিকার আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব), খুবই শক্তিশালী সেই ধারণা যা দাবি করে এমনকি যে ধারণাগুলো আপনি ঘৃণ্য মনে করেন, সেটিও উচ্চারিত হবার দাবি রাখে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, তবে ক্যাথলিক চার্চ, বিশেষ করে দক্ষিণ-ইউরোপে শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল, কী প্রকাশ করা যাবে আর কী প্রকাশ করা যাবে না। ভলতেয়ারে বহু নাটক আর বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং সেগুলো প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়েছিল, এমনকি তাঁকে বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে রাখাও হয়েছিল, কারণ তিনি একজন ক্ষমতাবান অভিজাতশ্রেণির কাউকে তিক্ত সমালোচনা করে অপমান করেছিলেন। কিন্তু এসব কোনোকিছু তার চারপাশের মানুষগুলোর মধ্যে বিদ্যমান কুসংস্কার, পূর্বসংস্কার আর দাম্ভিকতাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বর্তমানে তিনি সবচেয়ে পরিচিত, যদিও কাঁদিদ-এর লেখক হিসাবে (Candide, ১৭৫৯)।
‘কাঁদিদ’ একটি সংক্ষিপ্ত দার্শনিক উপন্যাস, যেখানে তিনি পুরোপুরিভাবে মানবতা আর মহাবিশ্ব সম্বন্ধে পোপ আর লাইবনিজের প্রস্তাবিত আশাবাদিতার ভিত্তিকে আক্রমণ করেছিলেন এবং তিনি কাজটি এত চিত্তাকর্ষকভাবে করেছিলেন যে বইটি তাৎক্ষণিকভাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বইয়ে পরিণত হয়েছিল। বুদ্ধিমত্তার সাথেই ভলতেয়ার তার নিজের নামটি বইটির শিরোনাম পাতায় উহ্য রেখেছিলেন, নতুবা এটি প্রকাশের কারণে তাকে আবারো কারাগারে বন্দি হতে হতো ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে হাসিঠাট্টা করার জন্যে। কাঁদিদ হচ্ছে বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার নাম বিশুদ্ধতা আর নিষ্পাপ সরলতার প্রতিনিধিত্ব করছে। বইটির শুরুতেই, তিনি তরুণ একজন ভৃত্য যিনি আশাহীনভাবে তার মনিবের কন্যা, কুনেগন্দের প্রেমে পড়েছিলেন, কিন্তু মেয়েটির পিতা একদিন দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় আবিষ্কার করার পর কাঁদিদকে তার প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এই দ্রুতলয়ের আর প্রায়শই কল্পনাপূর্ণ কাহিনীতে, কাঁদিদ তার দর্শনের শিক্ষক ডক্টর প্যানগ্লসের সাথে সত্যিকার এবং কাল্পনিক নানা দেশে ভ্রমণ করেন, এবং অবশেষে তার আবার দেখা হয় হারানো ভালোবাসা কুনেগন্দের সাথে, কিন্তু ততদিনে কুনেগন্দ বিশাল বপু, হতযৌবনা এবং কুৎসিত একটি রমণীতে পরিণত হয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে নানা কৌতুককর পর্বে কাঁদিদ আর প্যানগ্লস নানা ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন এবং সেইসাথে তাদের সাথে দেখা হয়েছিল বিচিত্র ধরনের চরিত্রদের, যাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতায় আছে ভয়ংকর নানা দুর্ভাগ্যের কাহিনি।
ভলতেয়ার দর্শনের শিক্ষক প্যানগ্লসকে ব্যবহার করেন লাইবনিজের দর্শনের একটি ব্যঙ্গাত্মক সংস্করণকে তার উপন্যাসের শব্দমালায় প্রবাহিত করতে, লেখকের উদ্দেশ্য এভাবে সেই দর্শনকে ঠাট্টা করা। যা-কিছু ঘটুক, সেটি প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয়, নির্যাতন, যুদ্ধ, ধর্ষণ, ধর্মীয় নিপীড়ন অথবা দাসত্ব যাই হোক না কেন, প্যানগ্লস সেটিকে ব্যবহার করেন তারা যে সম্ভাব্য সব জগতের শ্রেষ্ঠ জগতে বাস করছেন তার প্রমাণ হিসাবে। তার নিজের বিশ্বাসকে আবার প্রশ্ন করার বদলে বরং প্রতিটি দুর্ঘটনা তার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয় যেন সবকিছুই ঘটছে ভালোর জন্যে, এবং ত্রুটিহীন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার এটাই একমাত্র উপায়। ভলতেয়ার তীব্র আনন্দের সাথে চোখের সামনে যা ঘটছে পানগ্লসের সেটি দেখতে অস্বীকার করার বিষয়টি উন্মোচন করেছিলেন, আর এর মূল অর্থ ছিল লাইবনিজের আশাবাদিতাকে উপহাস করা। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে যদি লাইবনিজের কথা ভাবেন, তার প্রস্তাব কিন্তু দাবি করেনি যে অশুভ বা খারাপ কিছু ঘটে না, বরং এই অশুভ যার অস্তিত্ব আছে তার প্রয়োজন আছে শ্রেষ্ঠতম পৃথিবী সৃষ্টি করার। যদিও এটি প্রস্তাব করে, পৃথিবীতে প্রচুর খারাপ জিনিস আছে, কিন্তু তার মানে লাইবনিজের প্রস্তাবনা ঠিক তা কিন্তু না, ভালো ফলাফল অর্জনের এগুলো ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা হতে পারেনা। কারণ সেটি সত্য হবার জন্য এই পৃথিবীতে যতটুকু দুঃখকষ্ট থাকার দরকার, তার চেয়ে বহু পরিমাণেই দুঃখকষ্ট আছে।
১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে অষ্টাদশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগটি ঘটেছিল : পর্তুগালের লিসবন ভূমিকম্পে মারা যায় ২০,০০০-এরও বেশি মানুষ। শুধু ভূমিকম্পই ধ্বংস করেনি সেই পর্তুগিজ শহরকে, এরপর এসেছে সুনামি এবং তারপর বহুদিন ধরে চলমান অগ্নিকাণ্ড শহরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এই দুর্ভোগ আর হতাহতের সংখ্যা ভলতেয়ারের ঈশ্বরবিশ্বাসের ভিত্তিতে চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিল। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেননি, কীভাবে এমন ঘটনা বৃহত্তর স্বর্গীয় কোনো পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। হতাহত আর দুর্ভোগের মাত্রা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল, কেন একজন সবচেয়ে দয়ালু ঈশ্বর এমন কিছু ঘটার অনুমতি দিতে পারেন? এছাড়াও তিনি বুঝতে পারেননি কেন লিসবনকে নিশানা করা হয়েছিল, কেন সেখানে, অন্য কোথাও না কেন?
কাঁদিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে, ভলতেয়ার এই বাস্তব ট্রাজেডিকে ব্যবহার করেন আশাবাদীদের বিরুদ্ধে তার কেসটি সংহত করার জন্য। যাত্রীরা লিসবনের কাছে একটি ঝড়ে জাহাজডুবির শিকার হয়, যা মৃত্যুর কারণ হয় জাহাজে প্রায় সবারই। জাহাজের নাবিকদের একমাত্র একজন বেঁচে ছিল, যে-কিনা আপাতদৃষ্টিতে ইচ্ছা করেই তার এক বন্ধুকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে সেখানে সুবিচারের অনুপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও পানগ্লস তারপরও পুরো বিষয়টি যা ঘটেছে সেটি তার দার্শনিক আশাবাদিতার ছাঁকুনি দিয়ে দেখেন। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত ও সহস্র প্রাণহানির ঘটনার পর পরইলিসবনে এসে, যখন তার চারপাশে মানুষের অহেতুক প্রাণহানি অব্যাহত আছে দুর্যোগের পরিণতিতে, পানগ্নস অদ্ভুতভাবে, দাবি করে যেতে থাকেন, সবকিছুই ঠিক আছে। বইটির বাকি অংশটি ক্রমেই আরো খারাপ হয় প্যানগ্লসের জন্যে, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ করা হয়, শারীরিক নির্যাতন করা হয়, এবং জাহাজের দাঁড় টানতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তারপরও তিনি তার বিশ্বাসটি ধরে রাখেন যে, লাইবনিজ সঠিক কথাই বলেছেন, তার বিশ্বাসটি ঠিক, যা-কিছু আছে তা সবই বড় পরিকল্পনার অংশ, ইতিপূর্বে প্রতিষ্ঠিত সবকিছুর সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ। কোনো অভিজ্ঞতাই এই একগুঁয়ে দার্শনিককে তার বিশ্বাস থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। কিন্তু প্যানগ্লসের বিপরীত, কাঁদিদ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছিল তার অভিজ্ঞতার কারণে। যদিও যাত্রার শুরুতে সে তার শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত হলেও, বইয়ের শেষে তার অভিজ্ঞতা তাকে সব দর্শন সম্বন্ধেই সন্দিহান করে তুলেছিল, এবং জীবনের সমস্যা সমাধানে সে বেছে নিয়েছিল আরো বেশি বাস্তবসম্মত সমাধানগুলো।
কাঁদিদ আর কুনেগন্দ-এর পুনর্মিলন হয়, তারা প্যানগ্লস আর কিছু চরিত্র নিয়ে একটি ছোট খামারে বাস করতে শুরু করেছিল। একটি চরিত্র, মার্টিন, প্রস্তাব করে যে, জীবনকে সহনশীল করার একটি উপায় হচ্ছে, সবকিছু বেশি দর্শনায়িত না করে সরাসরি কাজে নেমে পড়া। প্রথমবারের মতো তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করতে শুরু করে নিজেদের সেরা দক্ষতা দিয়ে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে। যখন প্যানগ্লস যুক্তি দেয়া শুরু করেন যে তাদের জীবনে খারাপ যা-কিছু ঘটেছে সেগুলো প্রয়োজনীয় অশুভ, যা সুখী পরিণতিতে সমাপ্ত হয়েছে। কাঁদিদ তাকে বলে, সে সবই ভালো কথা, তবে ‘আমাদের নিজেদের বাগান অবশ্যই আমাদের আবাদ করতে হবে।’ কাহিনিটির এটাই ছিল শেষ বাক্য, এবং এর উদ্দেশ্য ছিল পাঠকদের কাছে শক্তিশালী একটি বার্তা পৌঁছে দেয়া। এই বাক্যটাই বইয়ের মূল নীতিবাক্য, এই দীর্ঘ কৌতুক নকশার শেষ মোক্ষম পক্তি বা পাঞ্চলাইন। একটি স্তরে, কাহিনিটিতে, কাঁদিদ শুধু বলছে, তাদের চাষাবাদের কাজ শুরু করার প্রয়োজন, তাদের প্রয়োজন আছে নিজেদের কাজে ব্যস্ত রাখার। গভীর স্তরে, যদি, আমাদের বাগান আবাদ করা, ভলতেয়ারের জন্য, হচ্ছে একটি রূপক, বিমূর্ত দর্শনের প্রশ্ন নিয়ে শুধু কথা না বলে বরং মানবতার জন্যে উপযোগী কিছু করার একটি রূপক। বইটির চরিত্রগুলোর সেটাই করা প্রয়োজন ছিল নিজেদের সমৃদ্ধ আর সুখী করার জন্য। কিন্তু ভলতেয়ার শক্তভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র কাঁদিদ আর তার বন্ধুদের না, আমাদের সবার কাজও সেটাই হওয়া উচিত।
অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে ভলতেয়ারের আরেকটি ব্যতিক্রম ছিল, তিনি খুব ধনী ছিলেন। তারুণ্যে তিনি একটি সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন, যারা রাষ্ট্রীয় লটারিতে একটি ভুল খুঁজে বের করেছিলেন, এবং প্রচুর পরিমাণে নিশ্চিত জয়ের টিকিট কিনেছিলেন, বুদ্ধিমানের মতো তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন, এবং ধনীও হয়েছিলেন আরো। এটাই তাকে আর্থিক স্বাধীনতা দিয়েছিল তার অন্যান্য লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য। অন্যায় অবিচার দূর করা তার তীব্র আকাঙ্ক্ষার অংশ ছিল। তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা একটি কাজ ছিল জ্যা কালাসের সুনাম রক্ষা করা, যাকে নির্যাতন করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তার নিজের ছেলেকে হত্যার অভিযোগে। কালাস স্পষ্টতই সেই কাজটি করেননি। তার ছেলে আত্মহত্যা করেছিল, কিন্তু আদালত সব প্রমাণগুলো উপেক্ষা করেছিল। ১৭৬১ সালে এক প্রটেস্টান্ট ব্যবসায়ী জ্যা কালাসকে তুলুজের আদালত অভিযুক্ত করেছিল তার পুত্রকে হত্যার জন্য। এর জন্য তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যু। পুরো বিচারপ্রক্রিয়ায় সুস্পষ্টভাবে ক্যাথলিকপ্রধান শহরের এক বিচারকের ধর্মান্ধ অতিউৎসাহের নমুনা ছিল। কালাস নির্দোষ ছিলেন, তার ছেলে মূলত আত্মহত্যা করেছিল। ভলতেয়ার এই কেসে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, ততদিনে কালাস মৃত, তবে তিনি তার সুনাম পুনরুদ্ধার ও তার দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। প্রচুর লেখালেখি করেন তিনি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে; ১৭৬৩ সালে তাঁর Traité sur la tolérance শুরু হয়েছিল কালাসের উদাহরণ দিয়ে যা সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা রাখে কীভাবে ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বিস্তার লাভ করছে। জনমতের উপর ভলতেয়ারের লেখার প্রভাব ছিল বিস্ময়কর। প্যারিসের বিচারক অবশেষে তুলুস আদালতের রায় বাতিল করে, কালাসকে তিনি বাঁচাতে পারেননি ঠিকই, তবে তিনি একটি শিক্ষা পেয়েছিলেন এখান থেকে কীভাবে পরিবর্তন আনা যায় জনমতের চাপ সৃষ্টি করে। ১৭৬৪ সালে তিনি লেখেন, ‘মতামত পৃথিবীকে পরিচালিত করে ঠিকই, কিন্তু মতামতগুলোর রূপ দেন দার্শনিকরাই’। যেভাবে ভলতেয়ার প্লানগ্লসের ‘প্রমাণগুলোকে’ উপহাস করেছিলেন, ঈশ্বর সব সম্ভাব্য জগতের সেরা জগৎটি তৈরি করেছেন, আপনি হয়তো মনে করতে পারেন যে কাঁদিদের লেখক বোধহয় নাস্তিক। বাস্তবিকভাবেই, তিনি সংগঠিত কোনো ধর্মের পেছনে কালক্ষেপণ না করলেও, ভলতেয়ার ছিলেন একাত্মবাদী, ডেইস্ট বা যৌক্তিক একেশ্বরবাদী, যিনি হচ্ছেন এমন কেউ যিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিতেই দৃশ্যমান আছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আর পরিকল্পনার প্রমাণ। তাঁর জন্যে রাতের আকাশের দিকে তাকানোই যথেষ্ট ছিল প্রমাণ করার জন্যে যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছে। ডেভিড হিউম অবশ্যই খুবই সন্দিহান ছিলেন তার এই ধারণায়। এই ধরনের যুক্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে তার সমালোচনা ছিল বিধ্বংসী।
ভালো ও খারাপ, শুভ ও অশুভের প্রশ্ন নিয়ে ভলতেয়ার সংগ্রাম করেছেন তার সারা জীবনই, আর এটাই তার সুপরিচিত উপন্যাস কাঁদিদ (কঁদিদ)-এর মূল বিষয় ছিল। এই ছোট প্রহসনমূলক উপন্যাসটি প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশিত হবার পরপরই এটি জনপ্রিয় হয়েছিল। সম্ভাব্য সকল ভাষায় বইটি অনূদিত হয়েছে ইতিমধ্যেই, এবং ইউরোপীয় এনলাইটেন্টমেন্ট-পর্বের এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল। এবং অবশ্যই বহু ভাষায় এটি তার চিরস্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছে। কিছু অভিব্যক্তি, যেমন, pour encourager les autres (অন্যদের অনুপ্রাণিত করার জন্য) অথবা il faut cultiver le jardin (আমাদের বাগান আবাদ করতে হবে), এখন বহু ভাষার অংশ। কাঁদিদ কোনো সন্দেহ নেই একটি কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি; মানব জীবন ও পরিস্থিতির একটি প্রহসন এবং দর্শন। এছাড়া এটি মানুষের মনকে উন্মুক্ত ও আলোকিত করে দেবার মতো একটি কাজ করেছিল, এর দার্শনিক মূল ভিত্তিটি প্রকাশিত হয়েছে এর শিরোনামেই, কাঁদিদ বা আশাবাদ। কাঁদিদের নায়ক, যেমনটি তার নামই বলে দিচ্ছে সরল, বিশ্বাসপ্রবণ আশাবাদী, নায়কোচিত কোনো চরিত্রের বিপরীত, অ্যান্টি হিরো। সে তার শিক্ষক প্যানগ্লসের শুদ্ধ অনুসারী, যিনি আশাবাদের দর্শন প্রচার করতেন। এই আশাবাদ বর্তমানের আশাবাদের ধারণা বা looking on the bright side থেকে ভিন্ন। এই Optimism যা বানান করা হয় বড় হাতের o ব্যবহার করে, যার প্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ, তার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বে অশুভ বা evil- এর উপস্থিতি সংক্রান্ত বহুযুগের পুরোনো সেই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান। কেন, ঈশ্বর যদি সবচেয়ে দয়ালু আর ভালো হন, তিনি কি পৃথিবীতে তাহলে অশুভ সবকিছুর অস্তিত্বকে অনুমতি দিয়েছেন? এর উত্তরে অষ্টাদশ শতাব্দীর আশাবাদীরা উত্তর দিয়েছেন, অশুভ বা খারাপ হচ্ছে শুভ বা ভালোর বৃহত্তর পরিকল্পনার একটি অংশ, সব আংশিক অশুভ, বিশ্বজনীন শুভ যেমন করে ইংরেজ কবি পোপ বলেছিলেন, অর্থাৎ অশুভ কোনোকিছুর আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই, এটি শুধুমাত্র মানুষের কল্পনা, কারণ মহাবিশ্ব সম্বন্ধে তার ধারণা সীমাবদ্ধ। এটাই সেই বিখ্যাত থিওডিসির প্রস্তাবনা, যা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে ঈশ্বর এত দয়াশীল হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীতে কেন এত অশুভ ঘটনা ঘটে, কেন এত দুর্গতি, দুর্দশা ও কষ্ট। হ্যাঁ, খুব পরিচিত সব যুক্তি, তাই না?
বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় ধাঁধার মতো মনে হতে পারে, ভলতেয়ারের কাছে এটি মনে হয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আর আত্মবিশ্বাসের অপমান। কিন্তু এই ধারণাটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। কাঁদিদ-এ ভলতেয়ার এই দর্শনকে পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন। এর নায়ক কাঁদিদকে তার স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন থেকে বিদায় নিতে হয় ব্যারনের সুন্দরী কন্যা কুনেগন্দের প্রতি ভালোবাসার প্রস্তাবনা দিতে গিয়ে। এরপর জীবনে তাকে বহু সংগ্রাম, দুঃখকষ্টের মুখোমুখি হতে হয়, তাকে জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়, রণক্ষেত্রে আমরা তাকে দেখি, এরপর মরুভূমিতে, তারপর লিসবনের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাক্ষী হিসাবে, যে ভূমিকম্পটি ভলতেয়ারের সমসাময়িক সময়ে ঘটেছিল, হতাহতের কারণ হয়েছিল বহু হাজার মানুষের। অশুভের নানা চরমতম রূপের সাথে কাঁদিদকে মুখোমুখি হতে হয় বারবার, নৈতিক অশুভ ঘটনা, ভূমিকম্পের সময়, যেখানে মানুষের আপাতদৃষ্টিতে কোনো দোষ ছিল না, এছাড়া বহু ধরনের মানবিক অশুভ কর্মকাণ্ড, যেমন যুদ্ধ, যেখানে নিশ্চয়ই দোষ দেয়া যায় মানুষকেই। প্যানগ্লসের বায়বীয় Optimism স্পষ্টতই এইসব ভয়াবহ বিপর্যয়ের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিতে পারেনা। ধীরে ধীরে কাঁদিদ সেই উপলব্ধিতে পৌঁছান, এবং মাঝে মাঝে প্যানগ্লস কাঁদিদকে বলতেন, ‘সব ঘটনাগুলো একটি শৃঙ্খল তৈরি করে সম্ভাব্য সব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পৃথিবী সৃষ্টিতে, কারণ, পরিশেষে বলা যায়, মিস কুনেগন্দকে ভালোবাসার জন্য যদি তোমার পশ্চাৎদেশে ভালো একটি লাথি মেরে সুন্দর দুর্গ থেকে বের করে না দেয়া হতো, আর যদি তুমি ইনকুইজিশনের শিকার না হতে এবং যদি পায়ে হেঁটে আমেরিকা না ঘুরে বেড়াতে, এবং যদি তুমি ব্যারনকে তোমার তলোয়ার দিয়ে ভালোভাবে আঘাত না করতে, যদি তুমি সেই সুন্দর দেশ এল দোরাদো থেকে আনা তোমার সব সম্পদ না হারাতে, তুমি এখানে বসে চিনির সিরায় ডোবা লেবুর টুকরো আর পেস্তা বাদাম খেতে পারতে না।’ ‘বেশ ভালোই বলেছেন’, কাঁদিদ উত্তর দিয়েছিল, কিন্তু আমাদের অবশ্যই আমাদের নিজেদের বাগান আবাদ করতে হবে’।
শুরু থেকেই খুব সুস্পষ্ট দৃঢ়তার সাথে ভলতেয়ার ধর্ম সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অবশ্যই নাস্তিক ছিলেন না, এর আংশিক কারণ অবশ্য তিনি মনে করতেন যে সামাজিক সংহতির জন্য কোনো একটি স্বর্গীয় সত্তার উপর ন্যূনতম বিশ্বাসের দরকার আছে। তবে ভলতেয়ারের ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, আমাদের মধ্যে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা প্রদান করেছেন, এরপর মূলত তিনি দৃশ্য থেকে সরে গেছেন। এটাই ছিল যৌক্তিক ধর্ম, অষ্টাদশ শতাব্দীতে যা প্রাকৃতিক ধর্ম বা দেইজম নামে পরিচিত ছিল। কোনো ধরনের মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যার সাথে যার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ভলতেয়ার যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন যিনি মৌলবাদিতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পৌত্তলিকতা, কুসংস্কার তীব্র ঘৃণা করতেন। ধর্মীয় মতবাদের কোনো একটি অংশ রক্ষা করার জন্য যে মানুষরা পারস্পরিক খুনে উন্মত্ত হতে পারে, যখন কিনা সেই মতবাদ তারা প্রায় বোঝে না বললেই চলে, বিষয়টি ভলতেয়ারকে তীব্র বিকর্ষণ করত। তবে তার সবচেয়ে ঘৃণা ছিল ধর্মপ্রচারক ও যাজকদের প্রতি যারা বিশ্বাসীদের বিশ্বাস প্রবণতাকে তাদের ক্ষমতার ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করত। ভলতেয়ার চার্চের কাঠামোমুক্ত ধর্ম চেয়েছিলেন।
আর খুব স্পষ্ট কারণে ক্যাথলিক চার্চও চতুর্থ হেনরিকে নিয়ে ভলতেয়ারের La Henriade মহাকাব্যটি ফ্রান্সে যেন প্রকাশিত না হয় সেই ব্যবস্থা নিয়েছিল। সুতরাং ভলতেয়ার তার কবিতাটি প্রকাশ করেছিলেন লন্ডন থেকে, এবং ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে যান। যদিও মূলত বই প্রকাশের কাজেই যাওয়া, কিন্তু দ্রুত তার সেই ভ্রমণ রূপান্তরিত হয় অন্যকিছুতে। তিনি ইংল্যান্ডে ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। ইংরেজি শিখেছিলেন, পরিচিত হয়েছিলেন লেখক আর রাজনীতিবিদদের সাথে এবং ইংল্যান্ডের প্রোটেস্টান্ট ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন, Letters Concerning the English Nation, প্রথম ইংরেজি ভাষায় আবির্ভূত হয় ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে। ইংরেজবিদ্বেষী ফরাসি কর্তৃপক্ষ রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং বইটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, ভলতেয়ার কোনোমতে কারাগার এড়াতে পেরেছিলেন।
বইটি ইংলিশ সংস্কৃতির একটি অনানুষ্ঠানিক চিত্র উপস্থাপন করেছিল তার বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ এবং কিছু শ্লেষাত্মক তুলনামূলক সমালোচনার মিশ্রণে। রাজনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য সব বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন। যেমন এখানে ভলতেয়ার রয়্যাল এক্সচেঞ্জকে উপস্থাপন করেন, ‘লন্ডনের ঠিক মাঝখানে চমৎকার একটি বিল্ডিং, যেখানে সারা পৃথিবী থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন ব্যবসার কাজ করতে’, ভলতেয়ার লিখেছিলেন, ‘লন্ডনের রয়্যাল এক্সচেঞ্জ-এর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক, যেখানে সব জাতির প্রতিনিধিরা পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করেন মানবজাতির কল্যাণের জন্য। এখানে ইহুদি, মুসলমান আর খ্রিস্টানরা একসাথে বাণিজ্য করে এমনভাবে যেন মনে হয় তারা সবাই একই ধর্মের অনুসারী, যারা শুধুমাত্র দেউলিয়াদের ছাড়া আর কাউকেই অবিশ্বাসী হিসাবে চিহ্নিত করেন না। এখানে প্রেসবাইটেরিয়ান বিশ্বাস করে অ্যানাব্যাপ্টিস্টকে, চার্চের মানুষকে নির্ভর করতে হয় কোয়েকারদের কথার উপর। এই শান্ত আর মুক্ত সমাবেশ ভাঙার পর কেউ সিনাগগে যায়, কেউ পানশালায়। আর এই মানুষটা যাচ্ছে কোনো বড় পানির পাত্রে পিতা, পুত্র আর পবিত্র আত্মার নামে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হতে, আর ঐ মানুষটা তার ছেলের খত্না করিয়েছে, যখন একগুচ্ছ হিব্রু শব্দ (পুরোপুরি যা অবোধ্য তার কাছে) উচ্চারণ করা হয়েছে তার শিশুর জন্য। যদি ইংল্যান্ডে শুধুমাত্র একটি ধর্ম পালনের অনুমতি থাকত, খুব সম্ভব সেখানে সরকারও স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত হতো; যদি দুটি ধর্ম পালনে অনুমতি থাকত, তাহলে মানুষ একে অপরের গলা কাটত; কিন্তু যেহেতু সেখানে অনুমতি আছে বহুধর্ম পালনে, তারা সবাই সেখানে সুখে আর শান্তিতে বাস করে।’
ভলতেয়ারের বার্তাটা খুব স্পষ্ট: ধর্মীয় পার্থক্যগুলো তুচ্ছ, তবে তারা মানুষের মধ্যে বিভাজন করে, যদিও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ এবং যা তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যের বন্ধন সৃষ্টি করে; তার উপসংহার, ইংল্যান্ডে বহু ধর্মের উপস্থিতি অনেক বেশি শান্তি পূর্ণ সমাজ সৃষ্টির জন্য সহায়ক, এই প্রস্তাবনাটি আসলে ফ্রান্সের পরিস্থিতির প্রতি পরোক্ষ সমালোচনা, যেখানে ক্যাথলিক চার্চ প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল। তাঁর Letters Concerning the English Nation-এ তিনি লক এবং নিউটনকে নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যারা কেউ তখন ফ্রান্সে সুপরিচিত ছিলেন না। তার লেখার বিষয়বস্তু কঠিন হতে পারে, তবে ভলতেয়ারের অতুলনীয় দক্ষতা ছিল কঠিন বিষয়গুলোকে জনপ্রিয় একটি রূপ দেবার জন্য। আজকের দিনে বিজ্ঞান সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণা রাখেন যে-কাউকে জিজ্ঞাসা করুন নিউটন সম্বন্ধে, তারা আপনাকে বলতে পারবে, একদিন বাগানে বসে থাকার সময় তার মাথায় আপেল পড়ার কাহিনিটি, আর সেই কাহিনীটি আজো টিকে আছে, কারণ এটি প্রথম লিখেছিলেন ভলতেয়ার। সম্ভবত তিনি এটি শুনেছিলেন নিউটনের ভাইঝির কাছে এবং সাথে সাথেই বুঝতে পেরেছিলেন সেই শান্ত ঘরোয়া দৃশ্যকল্পটি সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হবে মাধ্যাকর্ষণশক্তি সংক্রান্ত নিউটনের ধারণাটিকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। তাঁর Letters Concerning the English Nation- এ গল্পটি ব্যবহার করার পর সবাই তা মনে রেখেছে, এবং ভলতেয়ারও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে তার চিরস্থায়ী একটি ছাপ রেখে গিয়েছেন।
ভলতেয়ার বলতেন তিনি লেখার মাধ্যমে কাজ করেন, তার লেখাই সমাজ পরিবর্তনের জন্য তার অবদান, তার প্রকৃত কাজ। তিনি চাইতেন তার লেখা যেন মানুষ কীভাবে ভাবে আর আচরণ করে তা যেন পরিবর্তন করতে পারে। ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা আর গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি এমনকি একটা শ্লোগানও আবিষ্কার করেছিলেন Ecrasez I ‘Infame !, যার মোটামুটি একটা মানে হতে পারে এমন, ঘৃণ্য সবকিছুকে ধ্বংস করো। L’Infäme মানে যা-কিছু ভলতেয়ার ঘৃণা করেন, যা কিছু যার জন্য তিনি সারাজীবন তার বুদ্ধি বৃত্তিক সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন: কুসংস্কার, অসহিষ্ণুতা, সবধরনের অযৌক্তিকতা। তবে কখনোই ভুললে চলবে না, তিনি অসাধারণ একজন লেখক ছিলেন; ফরাসি ভাষায় লেখায় তার শৈলী ছিল অতুলনীয়। তার চিন্তাগুলোর শক্তি সংশ্লিষ্ট ছিল তাঁর প্রকাশ করার শক্তির সাথে : বহু লেখকই অলৌকিক নানা বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছেন, কিন্তু কেউ ভলতেয়ারের মতো ব্যঙ্গাত্মকভাবে পারেননি। বর্তমানে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিতর্কে ভলতেয়ারের লিগেসি এখনও শক্তিশালী। খুব কমই সপ্তাহ গেছে যেখানে কোনো নিবন্ধে ভলতেয়ারকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়নি, বিশেষ করে তার সেই বিখ্যাত বাক্য Idisapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it, বাক্যটি এতই শক্তিশালী যদি ভলতেয়ার এটি নাও বলতেন, আমাদের এটি আবিষ্কার করতে হতো, আসলেই সেটা হয়েছে, ১৯০৬ সালে একজন ইংরেজ লেখিকা এই বাক্যটি আবিষ্কার করেছিলেন। তবে যাই হোক না কেন, এটি সেই সত্যের কথা বলছে, যা আমাদের সংস্কৃতির জন্য মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেকারণে এই বাক্যটিকে সবাই গ্রহণ করে নিয়েছেন, যেন সেটি বলেছে ভলতেয়ার নিজেই। ভলতেয়ারের নামের সাথে বেশকিছু উদারনৈতিক মূল্যবোধ সমার্থক হয়ে আছে, বাকস্বাধীনতা, গোঁড়ামি আর কুসংস্কার বর্জন, যুক্তিতে বিশ্বাস এবং সহিষ্ণুতা, সভ্যতার জন্য যা অনন্য আর অমূল্য উত্তরাধিকার।