অধ্যায় ২৩ : জন্মগতভাবে স্বাধীন – জ্যাঁ-জাক রুসো
১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে দার্শনিক ডেভিড হিউমের আমন্ত্রণে লন্ডনে ডুরি লেন থিয়েটারে লম্বা পশমের কোট পরা সুদর্শন এক ব্যক্তি নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন উপস্থিত সবাই (যাদের মধ্যে রাজা তৃতীয় জর্জও ছিলেন) মঞ্চে অনুষ্ঠিত নাটকের চেয়ে বরং এই বিদেশি অতিথি সম্বন্ধে জানতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। গভীর চোখের সেই মানুষটিকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব অস্বস্তিতে ভুগছেন, কারণ তিনি দুশ্চিন্তা করছিলেন তার প্রিয় অ্যালসেশিয়ান কুকুরটিকে নিয়ে, যাকে বাসায় তালাবদ্ধ করে রেখে আসতে হয়েছিল। তাঁর প্রতি মানুষের এই ধরনের কৌতূহল আদৌ পছন্দ করতেন না তিনি, বরং অনেক খুশি হতেন দূর কোনো গ্রামে প্রকৃতির মধ্যে তার পছন্দের বুনোফুলের মধ্যে হাঁটতে। কিন্তু মানুষটি কে ছিলেন? কেন সবাই এতবেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটিকে নিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে তিনি ছিলেন সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক জ্যা-জাক রুসো (১৭১২-১৭৭৮)। ডেভিড হিউমের নিমন্ত্রণে সেই সময়ের সাহিত্য ও দর্শনে চমক-সৃষ্টিকারী রুসোর লন্ডনে আগমন, আজকের দিনে কোনো পপ তারকা যেমন তার ভক্তদের মধ্যে আলোড়ন তোলে, তেমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তার রাজনৈতিক দর্শন ফ্রান্সসহ ইউরোপের বহু দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনাকে প্রভাবিত করেছিল। ফরাসি বিপ্লবতো বটেই, তার প্রভাব আমরা অনুভব করি আধুনিক রাজনৈতিক ও শিক্ষার দর্শনের ভিত্তিতে। ততদিনে তার বেশকিছু বই ক্যাথলিক চার্চ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল কারণ সেখানে অপ্রচলিত ধর্মভাবনার আভাস ছিল। রুসো বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের ধর্ম আসে হৃদয় থেকে, কোনো ধর্মীয় আচারের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাকে বেশি ঝামেলায় ফেলছিল তার রাজনৈতিক ধারণাগুলো।
‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্ম নেয় কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত’, ঘোষণা করেই তিনি তার বিখ্যাত The Social Contract বইটি শুরু করেছিলেন। বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই বিপ্লবীরা তাঁর লেখার প্রতিটি অক্ষরই মুখস্থ করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের অন্য অনেক নেতার মতো ম্যাক্সিমিলিয়েন রোবসপিয়েরও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রুসোর লেখায়। বিপ্লবীরা সেই শৃঙ্খল ভাঙতে চেয়েছিলেন যা দিয়ে সমাজের বিত্তবান অভিজাতশ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল। যাদের অনেকেই ছিল অভুক্ত যখন তাদের ধনী মনিবরা কাটিয়েছে আয়েশি জীবন। যখন দরিদ্র মানুষরা সামান্য কিছু খাবার খুঁজে পাওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত, তখন ধনীদের বিলাসী জীবনযাপন রুসোর মতোই বিপ্লবীদেরও ক্ষুব্ধ করেছিল। সমতা আর ভাতৃত্বসহ তারা চেয়েছিলেন সত্যিকারের স্বাধীনতা। তবে সম্ভাবনা খুবই কম যে রুসো, যিনি ফরাসি বিপ্লবের এক দশক আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন, রোবসপিয়েরের সেই সন্ত্রাসের রাজত্বে (যা পরিচিত reign of terror নামে) শত্রুদের গিলোটিনে হত্যাকাণ্ডের প্রতি সমর্থন জানাতেন। বিরোধীদের শিরোচ্ছেদ রুসো নয় বরং মাকিয়াভেলির চিন্তার সাথে বেশি মানানসই।
রুসোর মতে, প্রাকৃতিকভাবে মানুষ ভালো, নিজেদের উপর যদি আমাদের ভার ছেড়ে দেয়া হয়, আর জঙ্গলে যদি আমরা বাস করতাম তাহলে আমরা এত সমস্যা সৃষ্টি করতাম না। কিন্তু প্রাকৃতিক এই অবস্থা থেকে আমাদের বের করে আনা হোক, শহরে রাখা হোক, সবকিছুই খারাপ হতে শুরু করবে। আমরা আচ্ছন্ন হয়ে থাকি কীভাবে অন্য মানুষদের শোষণ আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে অন্য মানুষদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়, অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় জীবনের প্রতি এই দ্বন্দ্বসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ংকর একটি মানসিক প্রভাব আছে, এবং টাকার আবিষ্কার এই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়েছে। ঈর্ষা এবং লোভ শহরে মানুষদের একসাথে বসবাস করার পরিণতি। রুসোর মতে বনে, ‘নোবেল স্যাভেজেস’ বা মহান বন্যরা হতো স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী এবং সর্বোপরি স্বাধীন। কিন্তু রুসো অনুভব করেছিলেন যে আপাতদৃষ্টিতে সভ্যতাই মানুষকে কলুষিত করেছে। তবে যাই হোক না কেন, সমাজকে সাজানোর একটি উত্তম উপায় খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে আশাবাদী ছিলেন তিনি, যেখানে প্রতিটি সদস্যের সুযোগ থাকবে পূর্ণ একটি জীবন পাবার আর সমৃদ্ধ হবার, কিন্তু যেখানে সবাই সংহতির সাথে বসবাস করবে, সবাই একটি সার্বিক মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। রুসো তাঁর ‘দ্য সোস্যাল কনট্রাক্ট’ (১৭৬২) বইটিতে যে সমস্যাটি নিয়ে ভেবেছিলেন সেটি হলো, এমন একটি পথ খুঁজে বের করা যেখানে সব মানুষ একত্রে এমনভাবে বসবাস করবে যা সবাইকে স্বাধীনভাবে যেমন বাস করার সুযোগ করে দেবে যেন তারা সমাজের বাইরেই বসবাস করছে অথচ তারপরও সবাই রাষ্ট্রের আইন মেনে চলবে। প্রায় অসম্ভব মনে হতে পারে এমন কিছু অর্জন করা। এবং হয়তো এটি অসম্ভবই। সমাজের অংশ হবার পরিণতি যদি হয় একধরনের দাসত্বকে মেনে নেয়া, তাহলে আমাদের আসলেই উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হয় সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করার সুবিধাগুলোর বিনিময়ে। স্বাধীনতা আর সমাজের চাপানো কঠোর নিয়মগুলো একসাথে যায় না, কারণ নিয়মগুলো শিকলের মতো হতে পারে যা- কিছু কাজ করতে বাধা দেয়। কিন্তু রুসো বিশ্বাস করতেন এর থেকে পরিত্রাণের একটি উপায় আছে। তাঁর সমাধানের ভিত্তি ছিল তার General Will বা সাধারণ ইচ্ছার ধারণাটি।
রুসোর ‘জেনারেল উইল’ হচ্ছে সেই সবকিছু যা পুরো সমাজ, পুরো রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর। যখন মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয় পারস্পরিক সুরক্ষার জন্য, মনে হতে পারে যে সেজন্যে তাদের অনেক স্বাধীনতাই পরিত্যাগ করতে হয়। দার্শনিক লক এবং হবস এমনটাই ভেবেছিলেন। খুবই কঠিন ভাবা যে আপনি পুরোপুরিভাবে স্বাধীন থাকবেন এবং তারপরও একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে বাস করবেন, কারণ অবশ্যই কিছু আইন থাকতে হবে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের আচরণের উপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার জন্যে। কিন্তু রুসো বিশ্বাস করতেন কোনো একটি রাষ্ট্রে বাস করা ব্যক্তি একই সাথে স্বাধীন ও রাষ্ট্রের আইন মেনে চলতে পারে এবং প্রতিপক্ষ না হয়ে স্বাধীনতা আর আনুগত্যের ধারণা একসাথে যুক্ত হতে পারে।
রুসো তার জেনারেল উইল দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটি ভুল বোঝা খুব সহজ। একটি আধুনিক উদাহরণ হচ্ছে এমন : আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন, দেখবেন অধিকাংশ মানুষই বেশিমাত্রায় কর বা ট্যাক্স দিতে পছন্দ করেন না। বাস্তবিকভাবেই, নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার জন্য এটি খুব পরিচিত একটি কৌশলঃ রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র নির্বাচনের পূর্বে কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাদের ভোটারদের সমর্থন আদায় করতে। যদি বাছাই করতে বলা হয় তারা তাদের আয়ের ২০ শতাংশ, নাকি ৫ শতাংশ কর দেবেন, অধিকাংশ মানুষই কম পরিমাণ কর দেবার বিকল্পটাই বেছে নেবে। কিন্তু সেটি ‘জেনারেল উইল’ হবে না। যদি আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন আর সবাই তারা যা চায় সেটাই বলে, রুসো সেটি বলতেন ‘উইল অব অল’ বা, সবার ইচ্ছা। এর ব্যতিক্রম, জেনারেল উইল হচ্ছে, তাদের আসলে যা চাওয়া উচিত, যা পুরো সমাজের জন্যে মঙ্গলজনক। শুধুমাত্র একক কারোর জন্যে নয়, যারা স্বার্থপরের মতো সেখানে ভাবছে। জেনারেল উইল কী হবে সেটা নির্ধারণ করার সময় আমাদের আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে এবং পুরো সমাজ, সাধারণ মঙ্গলের প্রতি নজর দিতে হবে। আমরা যদি নানা ধরনের সেবা গ্রহণ করি, যেমন রাস্তা সংস্কার, যার ব্যয়বহন করার জন্য কর আরোপ করা জরুরি, তাহলে পুরো সমাজের জন্য ভালো সেই পরিমাণ কর আরোপ করা যা এইসব সেবা নিশ্চিত করবে। যদি কর খুব কম হয় তাহলে পুরো সমাজ এর ভুক্তভোগী হবে, তাহলে জেনারেল উইল হচ্ছে: কর এমন উচ্চহারে হওয়া উচিত যেন সেটি সেবাগুলোর মান নিশ্চিত করতে পারে। রুসো মনে করতেন, যখন মানুষ একসাথে জড়ো হয় এবং একটি সমাজ সৃষ্টি করে, তারা একধরনের একটি সত্তায় পরিণত হয়, যেখানে প্রতিটি মানুষ আরো বড় সম্পূর্ণ একটি সত্তার অংশ। রুসো দাবি করেছিলেন যে, তারা আসলে সত্যিকারভাবে স্বাধীন থাকতে পারে সমাজে, যদি তারা সেই আইনগুলো মেনে চলে, যা জেনারেল উইলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই আইনগুলো বানাবে বুদ্ধিমান আইনপ্রণেতারা, তাদের দায়িত্ব এমন একটি আইনকাঠামো তৈরি করা যা মানুষকে এই জেনারেল উইলের সীমায় রাখতে পারে, যেন তারা আরেকজনকে ঠকিয়ে নিজেদের স্বার্থপর উদ্দেশ্য অনুসরণ করার কোনো সুযোগ না পায় ৷ রুসোর মতে, সত্যিকার স্বাধীনতা হচ্ছে কোনো এক গোষ্ঠীর অংশ হওয়া এবং সমাজের কল্যাণের জন্য কিছু করা, সেই সমাজের একজন হয়ে। আপনার ইচ্ছা সবার জন্যে যা ভালো তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত এবং স্বার্থপরের মতো কোনো আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে আইনের আপনাকে সাহায্য করা উচিত।
কিন্তু কী হতে পারে, যদি আপনি আপনার রাষ্ট্রের জন্যে যা ভালো তার বিরোধিতা করেন? আপনি, একক ব্যক্তি হিসাবে, হয়তো জেনারেল উইল অনুসরণ করতে রাজি নন, এখানে রুসোর একটি উত্তর ছিল। কিন্তু সেই উত্তরটি বেশিরভাগ মানুষই হয়তো পছন্দ করবেন না। তিনি বিখ্যাতভাবে এবং বরং উদ্বেগজনকভাবেই ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি কেউ সমাজের সবার ভালোর জন্য আরোপিত আইন মানতে ব্যর্থ হয় সেই মানুষটিকে বাধ্য করতে হবে স্বাধীন হবার জন্য, forced to be free; রুসো বোঝাতে চেয়েছিলেন, যে কিনা বিরোধিতা করে এমন কিছুর যা সত্যিকারভাবে কল্যাণকর তার সমাজের জন্য, যদিও তিনি হয়তো ভাবতে পারেন যে তিনি স্বাধীনভাবেই সেটি বাছাই করছেন, তিনি আসলে সত্যিকারভাবে স্বাধীন না, যদি-না তিনি জেনারেল উইলের অনুবর্তী হন। কিন্তু কীভাবে আপনি কাউকে জোর করবেন স্বাধীন হবার জন্য? আমি যদি আপনাকে বাধ্য করি এই বইটির শেষ অবধি পড়ার জন্যে, তাহলে সেটি নিশ্চয়ই আপনার নিজের নেয়া স্বাধীন ইচ্ছা হবে না, তাই না? নিশ্চয়ই কাউকে কোনোকিছু জোর করে করানোর ব্যাপারটি তাদেরকে স্বাধীনভাবে কিছু নির্বাচন করার সুযোগ দেবার ঠিক বিপরীত। রুসো, অবশ্য মনে করতেন, এখানে কোনো স্ববিরোধিতা ছিলনা। যে মানুষটি সঠিক জিনিসটি করার জন্য শনাক্ত করতে পারবে না, সে আরো বেশি স্বাধীন হবে যদি তাকে বাধ্য করা হয় নিয়ম মানার জন্য। কারণ সমাজের বাকি সবাই এই বড় গ্রুপের অংশ, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করা নয় বরং আমাদের জরুরিভাবে জেনারেল উইল অনুসরণ করার কথা মনে রাখতে হবে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, শুধুমাত্র যখন আমরা জেনারেল উইল অনুসরণ করি, তখনই আসলে আমরা সত্যিকারভাবে স্বাধীন, এমনকি যখন আমাদের বাধ্য করা হয় সেটি করার জন্যে। এটাই রুসোর বিশ্বাস, কিন্তু পরবর্তী অনেক দার্শনিক, যেমন জন স্টুয়ার্ট মিল যুক্তি দিয়েছিলেন যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা যতদূর সম্ভব ব্যক্তিস্বাধীনতা হওয়া উচিত, যেন তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আসলেই রুসোর ধারণায় খানিকটা অশুভ আভাস আছে, যিনি কিনা মানবজাতিকে শৃঙ্খলিত বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি আবার কিনা প্রস্তাব করছেন কাউকে জোর করে কিছু করানো হচ্ছে আরেক ধরনের স্বাধীনতা।
এই আধুনিক জীবন বহু উপায়েই প্রগতির ধারণার উপর স্থাপিত: সেই ধারণাটি, আমরা যত জানব (বিশেষ করে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি) এবং যতই অর্থনীতি আকারে বড় হবে, আমরা সুখি হতে বাধ্য। বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে, যখন ইউরোপীয় সমাজ ও তাদের অর্থনীতি ক্রমশ জটিলতর হয়েছে, প্রচলিত ধারণা ছিল মানবজাতি দৃঢ়ভাবে ইতিবাচক একটি পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বন্য আদিমতা আর অজ্ঞতা থেকে ক্রমশ দূরে সমৃদ্ধি ও সভ্যতার প্রতি। কিন্তু রুসো প্রগতির এই ধারণাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, এবং এখনও আমাদের যুগে তার বেশকিছু উস্কানিমূলক কথা বলার আছে। জ্যাঁ-জাক রুসোর বাবা ছিলেন আইজাক রুসো, শিক্ষিত একজন ঘড়িনির্মাতা। ১৭১২ সালে রুসো জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। রুসোর জন্মের নয় দিনের মাথায় তার মা মারা যান প্রসব-পরবর্তী অসুস্থতায়, রুসোর জীবনে এটি চিরস্থায়ী একটি প্রভাব ফেলেছিল। তার বাবাকে নানা আইনি জটিলতার কারণে প্রায়শই পুরো পরিবারকে বিভিন্ন শহরে বসতি গড়তে হয়েছে। শৈশব থেকেই রুসোর জীবন পূর্ণ ছিল অস্থিতিশীলতা আর বিচ্ছিন্নতায়। কৈশোর আর তারুণ্যে হরহামেশাই তাকে বাড়ি বদলাতে হয়েছে। পরে কোনো একটি সময় রুসো প্যারিসে আসেন, যেখানকার বিলাসিতা আর প্রাচুর্য দেখার সুযোগ পান যা সেই সময়ের পুরোনো প্যারিসের সমাজের স্বাভাবিক রূপ ছিল। সাদামাটা বিলাসিতা বিবর্জিত জেনেভা থেকে যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বুর্জোয়া সমাজ সাধ্যমতো সবই করত রাজা ও অভিজাতদের রুচি এবং স্টাইল অনুকরণ করার জন্য, যা প্যারিসের সামাজিক জীবনে শুধু দ্বন্দ্বমূলক মনোভাবকে উসকে দিত জোরালোভাবে।
রুসোর জীবনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাকতালীয় ঘটনা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি ১৭৪৯-এ, তিনি Mercure de France নামে একটি খবরের কাগজে একটি রচনা প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন পড়েছিলেন, বিষয় ছিল ‘বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় সাম্প্রতিক অগ্রগতিগুলো কি নৈতিকতা বিশুদ্ধিকরণের কোনো ভূমিকা রেখেছে?’। Académie de Dijon-এর দেয়া এই বিজ্ঞাপনের লেখাটি পড়ে রুসোর একধরনের উপলব্ধি হয়েছিল, তাকে যে বিষয়টি ধাক্কা দিয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে প্রথমবারের মতো, সেটি হলো সভ্যতা ও প্রগতি আসলেই মানুষের জীবন উন্নত করেনি। মানুষ যারা কিনা একসময় ভালো ছিল, এটি তাদের নৈতিকতার উপর বিধ্বংসী একটি প্রভাব ফেলেছে। রুসো এই অন্তর্দৃষ্টিটি আত্মস্থ করেন এবং এটাকে মূল বিষয়ে পরিণত করে তার বিখ্যাত Discourse on the Arts and Sciences রচনাটির, যা প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। এই রচনায় আধুনিক সমাজের তীব্র সমালোচনা করেন রুসো; এনলাইটেনমেন্ট ধারণার মূল বিষয়গুলোকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর যুক্তি ছিল সরল, মানুষ একসময় ভালো আর সুখী ছিল, কিন্তু যখন মানুষ প্রাক-সামাজিক অবস্থা থেকে বের হয়ে এসেছে নানাধরনের অনাচারের স্বীকার হয়েছে এবং দরিদ্রতর হয়েছে। রুসো পৃথিবীর ইতিহাসের বর্ণনা দেন বর্বরতা থেকে সভ্যতা আর ইউরোপের মহান শহর আর কারখানা সৃষ্টির গল্প হিসাবে না, বরং সেই সুবিধাজনক পরিস্থিতি থেকে পশ্চাৎগমন হিসাবে যখন আমরা খুব সাধারণভাবে বাস করতাম, কিন্তু আমাদের সুযোগ ছিল আমাদের স্বাভাবিক প্রয়োজনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেবার।
কারিগরিভাবে অনগ্রসর প্রাগৈতিহাসিক পর্বে, রুসো যাকে বলেন l’état de nature, বা প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে যখন নারী পুরুষ সবাই বনে বাস করত, কখনোও তাদের কোনো দোকানে ঢুকতে হয়নি, বা খবরের কাগজ পড়তে হয়নি। রুসো তাদের দেখেছেন যে মানুষগুলো সহজেই তাদের চাহিদাকে বুঝতে পেরেছে এবং সেকারণে সন্তুষ্টির একটি জীবনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলোর প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়েছে— পরিবারের জন্য ভালোবাসা, প্রকৃতির জন্য শ্রদ্ধা, মহাবিশ্বের সৌন্দর্য সম্বন্ধে বিস্ময়, অন্যদের ব্যাপারে কৌতূহল, সংগীত ও সরল আনন্দময়তার প্রতি আকর্ষণ। প্রকৃতির এই রূপ ছিল আরো নৈতিকতাময়, যা পরিচালিত করত অন্যদের ও তাদের নিজেদের কষ্টের প্রতি সহমর্মিতা দ্বারা। এই পরিস্থিতি থেকে আধুনিক বাণিজ্যিক সভ্যতা যা আমাদের টেনে নিয়ে এসেছে, সেটি আমাদের ঈর্ষা, কামনা আর সমৃদ্ধির এই পৃথিবীতে যন্ত্রণাভোগ রেখে গেছে। রুসো অবশ্যই সচেতন ছিলেন তার উপসংহারগুলো কতটা বিতর্কিত হতে পারে, তিনি এর বিরুদ্ধে সর্বজনীন প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন। এবং আসলেই সেটা হয়েছিল। রুসো খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। কিন্তু সভ্যতার কোন্ বিষয়টি তিনি ভেবেছিলেন মানুষকে কলুষিত করেছে আর এই নৈতিক অধঃপতনের সৃষ্টি করেছে? এই বৈরিতার শিকড় হিসাবে তিনি দাবি করেন আমাদের এই প্রগতি সভ্যতার প্রতি মানুষের মনে একধরনের আত্মপ্রেম সৃষ্টি করেছে, amour-propre, যা কৃত্রিম এবং যা ঘিরে থাকে আত্মাভিমান, ঈর্ষা ও অহংকার। তিনি দাবি করেন যে আত্মপ্রেমের এই ক্ষতিকর রূপটির আবির্ভাব হয়েছে যখন মানুষ বড় শহরে বাস করতে শুরু করেছিল, যেখানে তারা অন্যদের দিকে তাকাতে শুরু করে তাদের নিজেদের সম্বন্ধে ধারণাটি পেতে। সভ্য মানুষ তারা কী চায় বা অনুভব করে সেই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছে, তারা শুধুমাত্র অন্যদের অনুকরণ করে সামাজিক মর্যাদা আর অর্থের ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে।
আদিম মানুষ, রুসো দাবি করেছিলেন, কারো সাথে নিজেকে তুলনা করেনা বরং তার লক্ষ্য শুধুমাত্র তার নিজের উপর, তার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বেঁচে থাকা। যদিও রুসো নিজে noble savage শব্দটি ব্যবহার করেননি তাঁর লেখায়, কিন্তু প্রাকৃতিক মানুষ সম্বন্ধে তাঁর প্রস্তাবনা এমন একটি ধারণার পথ উন্মুক্ত করেছিল, যা রুসোর ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছে। যারা হয়তো এটিকে অসম্ভাব্য একটি রোমান্টিক গল্প হিসাবে দেখতে চান, যাকে কিনা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে আধুনিকতার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী একজন উত্তেজিত লেখকের উর্বর কল্পনা হিসাবে, তাদের এখানে ভাবতে হবে যে যদিও অষ্টাদশ শতাব্দী রুসোর যুক্তি শুনেছে, তার প্রধান কারণ এর সামনে তখন স্পষ্ট একটি উদাহরণ ছিল এই ধারণাটির আপাত গ্রাহ্যতায়, আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ান সমাজের আকার ও নিয়তির সেই কাহিনী। ষষ্ঠদশ শতকে সংগৃহীত ইন্ডিয়ান সমাজ সংক্রান্ত সব বিবরণ তাদের বর্ণনা করেছে বস্তুগতভাবে সাধারণ হলেও মনোজাগতিকভাবে সুখী একটি সমাজ হিসাবে: সমাজ ছোট, যেখানে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ়, সাম্য, আধ্যাত্মিক, সামরিক, প্রাণবন্ত। কোনো সন্দেহ নেই অর্থনৈতিকভাবে তারা সেকেলে। তারা ফল আর বন্যপ্রাণী খেয়ে জীবনধারণ করত, তাদের সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল। প্রতিবছর তারা একই পরিচ্ছদ আর জুতো পরত, তাঁবুতে ঘুমাত। এমনকি গোত্রপ্রধানদের অল্পকিছু পাত্র আর বর্শা ছাড়া বাড়তি কিছু ছিল না। কিন্তু এই সরলতার মধ্যে ছিল সন্তুষ্টি।
কিন্তু ইউরোপীয়দের সেখানে আসার কয়েক দশকের মধ্যে আদিবাসীদের সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে ইউরোপীয় প্রযুক্তি আর নানা বিলাস সামগ্রীর কারণে। তখন তাদের সমাজে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি আর জ্ঞান ও প্রকৃতির নানা বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান যথেষ্ট ছিল না, বরং অস্ত্র, গহনা, অ্যালকোহল কত আছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আদিবাসীরা তখন রুপোর কানের দুল, তামার ব্রেসলেট, পুঁতি আর আয়না, ভেনেশিয়ান কাচের বানানো নেকলেস, পাথর ভাঙার ছেনি, বন্দুক, অ্যালকোহল, কেতলি ইত্যাদি কামনা করত। এইসব জিনিসের প্রতি আগ্রহ তাদের ঘটনাচক্রে সৃষ্টি হয়নি, ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছা করেই তাদের প্রলুব্ধ করেছে, তারা যেন সেইসব প্রাণীদের শিকার করে আনে যাদের পেল্ট বা চামড়ার চাহিদা বেশি ইউরোপীয় বাজারের। দুঃখজনকভাবে আদিবাসীরা এইসব নতুন সম্পদ পেয়ে বেশি সুখী হতে পারেনি। অবশ্যই তারা অনেক পরিশ্রম করেছে, ১৭৩৯ থেকে ১৭৫৯ চেরোকী গোত্রের ২০০০ যোদ্ধা প্রায় দেড় মিলিয়ন হরিণ শিকার করেছিল ইউরোপের চাহিদা মেটাতে। কিন্তু আত্মহত্যা আর অ্যালকোহল-আসক্তিও বেড়েছিল, সমাজ ভেঙেছে, আন্তঃগোত্র দ্বন্দ্বে আক্রান্ত করেছে। গোত্রনেতাদের রুসোর বই পড়ার কোনো দরকার ছিল না কী হয়েছে সেটি বুঝতে। তবে তারা তাঁর বিশ্লেষণের সাথে পুরোপুরি একমত হতেন সে- বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৭৭৮ সালে রুসো ৬৬ বছরে মারা যান, তখন তিনি প্যারিসের বাইরে কোথাও হাঁটতে বের হয়েছিলেন। জীবনের শেষদিকে তিনি আসলেই সেলেব্রিটির মতোই জীবন কাটিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে আইনের হাত থেকে, বিশেষ করে ধর্মসংক্রান্ত কিছু মন্তব্যের জন্যে। এই পালিয়ে বেড়ানো তার মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করেছিল। যদিও জেনেভা তার জন্মশহর, যে শহর একদিনও তাকে জায়গা দেয়নি, তারা রুসোকে নিয়ে এখন গর্ব করে। রুসো মৃত্যুর পর অবশ্য সমাহিত হয়েছেন প্যারিসের প্যানথিওনে।
আমাদের এই যুগে, যখন বিলাসিতা আর প্রাচুর্য মনে হতে পারে একই সাথে আরাধ্য এবং অতিমাত্রায় অশোভন, রুসোর ভাবনাগুলো এখনও প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি উৎসাহ দেন ঈর্ষা আর প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে আমাদের নিজেদের ভিতরে সত্যিকারের মূল্যটাকে খুঁজতে। রুসোর মতে কারো সাথে তুলনা করার অশুভ অভ্যাসটি প্রতিহত করেই আমাদের দুঃখ আর অক্ষমতার অনুভূতিকে এড়াতে পারি। যদিও কঠিন, রুসো আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এটি অসম্ভব নয় এবং একারণে তার দর্শন মৌলিকভাবে সমালোচনামূলক ছিল ঠিকই, তবে সেটি একই সাথে গভীর আশাবাদেরও ছিল। দুর্দশা দুর্নীতি যা সৃষ্টি করেছে আধুনিক সভ্যতার সামাজিক আচরণ ও প্রতিষ্ঠানগুলো, সেখান থেকে মুক্তি পাবার উপায় আছে। সবচেয়ে কঠিন অংশটি হচ্ছে সেটি করতে হলে আমাদের নিজেদের ভিতরের দিকে তাকাতে হবে, আমাদের প্রাকৃতিক সেই ভালোত্বকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।