1 of 2

অধ্যায় ১৯ : রাজকুমার ও মুচি – জন লক ও টমাস রিড

অধ্যায় ১৯ : রাজকুমার ও মুচি – জন লক ও টমাস রিড 

আপনার শৈশবে কেমন ছিলেন আপনি? যদি আপনার কাছে সেই সময়ে তোলা কোনো আলোকচিত্র থাকে, ভালো করে দেখুন। কী দেখতে পাচ্ছেন আপনি? আসলেই কি ছবির মানুষটি আপনি? এখন আপনি হয়তো দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি কি মনে করতে পারেন একটি শিশু হিসাবে কেমন অনুভূত হতো আপনার? অধিকাংশ মানুষই সেটি পারেনা। সময়ের সাথে আমরা বদলে যাই। আমরা বড় হই, প্রাপ্তবয়স্ক হই, তারপর আবার বৃদ্ধ হতে শুরু করি, স্মৃতির বিভ্রম হয়, আমাদের চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করে, চুলের রং সাদা হয়ে যায় এবং সেগুলো পড়তে শুরু করে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় কাপড়ে, বন্ধুত্বে, আমাদের অগ্রাধিকারের বিষয়বস্তুগুলোয়। তাহলে কোন্ অর্থে আপনি সেই শিশুটির মতো আজও সেই একই মানুষ, যখন আপনার বয়স বেড়েছে? সময় অতিক্রান্ত হবার পরেও কোন্ বিষয়টি আমাদের সেই একই মানুষ বানায়, এই প্রশ্নটি ইংরেজ দার্শনিক জন লককে অনেক ভাবিয়েছিল। 

বহু দার্শনিকদের মতোই লকও নানা বিষয় নিয়ে ভেবেছিলেন। বন্ধু রবার্ট বয়েল আর আইজাক নিউটনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও তাকে উৎসাহিত করেছিল। সেই সময়ের রাজনীতিতে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও লিখেছেন। ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের পর রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রকারীদের একজন হিসাবে অভিযুক্ত হলে তিনি নেদারল্যান্ডে পালিয়ে যান, সেখান থেকে তিনি তাঁর দর্শনে সেই বিষয়গুলোর সূচনা করেন, আজ যেগুলোকে আমরা চিহ্নিত করি, লিবারেলাজিম বা উদারনীতিবাদ হিসাবে। নেদারল্যান্ডে বসেই তিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা লেখেন, যুক্তি দেন নিপীড়ন নির্যাতন করে মানুষের ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করার প্রচেষ্টার কোনো অর্থ হয় না। তিনি মনে করতেন আমাদের সবারই ঈশ্বরপ্রদত্ত জীবনধারণের অধিকার আছে, অধিকার আছে স্বাধীনতার, সুখী এবং সম্পত্তির মালিক হবার, আর সংবিধান রচনা করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতির পিতাদের লকের এই ধারণাগুলোই প্রভাবিত করেছিল। 

শৈশবে কেমন দেখতে ছিলেন লক তার কোনো ছবি কিংবা ড্রইং আমাদের কাছে নেই। কিন্তু নিরাপদে বলা যায় বয়স বাড়ার সাথে তিনি সম্ভবত বেশ বদলে গিয়েছিলেন। মধ্যবয়সে তাকে আমরা দেখি বেশ শীর্ণকায়, লম্বা এলেমেলো চুলসহ খুবই তীব্রতার সাথে তাকিয়ে থাকা একজন মানুষ, যদিও তার শৈশবে, তিনি নিশ্চয়ই খুব ভিন্ন ছিলেন। লকের অন্যতম একটি বিশ্বাস ছিল নবজাতকের মন হচ্ছে blank slate বা শূন্য স্লেটের মতো। আমাদের যখন জন্ম হয় আমাদের কিছুই জানা থাকে না, আমাদের সব জ্ঞানই আসে জীবনে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে। শিশু লক যখন ক্রমশ তরুণ দার্শনিক হিসাবে রূপান্তরিত হচ্ছিলেন, তখনই তিনি তার নানাধরনের বিশ্বাসগুলো অর্জন করেছিলেন এবং রূপান্তরিত হয়েছিলেন সেই ব্যক্তিতে, যাকে আমরা এখন লক বলে মনে করি। কিন্তু কোন্ অর্থে তিনি আর সেই শিশুটি আসলে একই ব্যক্তি এবং কোন্ অর্থে মধ্যবয়সী লক আর তরুণ লক একই ব্যক্তি? 

সাধারণত অতীতের সাথে নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবেন এমন মানুষদের জন্যে এই ধরনের কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়না। লক যেমন বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন, এমনকি মোজা নিয়ে ভাবার সময়েও এটি সমস্যা করতে পারে। আপনার যদি এমন একটি মোজা থাকে যেখানে কোনো ছিদ্র ছিল এবং আপনি সেই ছিদ্রটি সেলাই করে ঢেকে দিলেন, এরপর আবার একটা ছিদ্র হলো আপনি সেটিও পট্টি দিয়ে ঢেকে দিলেন, এভাবে চলতে থাকলে আপনি শেষ অবধি এমন একটা মোজা পাবেন যে মোজা শুধুমাত্র ছিদ্রগুলোকে ঢাকা পট্টি দিয়ে বানানো, যেখানে একসময় এর মূল উপাদানের কোনো অংশই আর থাকবে না। সেই মোজাটি কি একই মোজা থাকবে? এক অর্থে, এটি আগের মোজাই থাকবে, কারণ মূল মোজা থেকে এই পুরোপুরি পট্টি দিয়ে ঢাকা এই মোজাটি সৃষ্টি হবার একটি ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু অন্য একটি অর্থে এটি আর আগের সেই মোজাটি নয়, কারণ মূল উপাদানের আর কিছুই তো সেখানে অবশিষ্ট নেই। অথবা একটি ওক গাছের কথা ভাবুন, অ্যাকর্ন বা ওকের বীজ থেকে এটি বেড়ে ওঠে, প্রতিবছর এর পাতা পড়ে যায়, এটি আকারে আরো বড় হয়, ডাল ভেঙে পড়ে, কিন্তু তারপরও এটি সেই একই ওক গাছ থাকে। তাহলে কি বীজটি সেই চারাগাছের মতো একই গাছ, এবং চারাগাছটি কি সেই বিশাল ওকের মতো একই গাছ? 

সময়ের সাথে বদলে যাওয়া কোনো মানুষের একই মানুষ থাকার কারণ সংক্রান্ত এই প্রশ্নটি জবাব দেবার একটি উপায় হচ্ছে সেই বিষয়টির দিকে নজর দেয়া যে, আমরা হচ্ছি জীবিত সত্তা। শৈশবে আপনি যেমন ছিলেন, আপনি সেই একই মানুষ, লক মানুষ বোঝাতে ‘ম্যান’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন (ম্যান আর উওম্যান উভয়কে বোঝাতে), মূলত হিউমান বা মানব প্রাণীকে বোঝাতে। তিনি ভেবেছিলেন, এমন কিছু বলা সত্য : জীবনকালে আমরা প্রত্যেকেই একই ‘মানুষ ‘ হিসাবে রয়ে যাই সেই অর্থে। জীবিত মানুষদের সারাজীবন ব্যাপী ক্রমশ বেড়ে ওঠার একটি ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু লক মনে করতেন একই ‘মানুষ’ থাকার বিষয়টি খুবই ভিন্ন একটি ‘পারসন’ বা ব্যক্তিথাকার চেয়ে। লকের মতে, আমি সেই একই মানুষ (man তার ব্যবহৃত শব্দ) হতে পারি, কিন্তু আমি আর একই ব্যক্তি থাকি না (তাঁর ভাষায় person) যা আমি আগে ছিলাম। কীভাবে সেটি হতে পারে? সময়ের পরিক্রমায় যা আমাদের একই ব্যক্তি হিসাবে রাখতে পারে। লক দাবি করেন, সেটি হচ্ছে আমাদের consciousness বা সচেতনতা বা সজ্ঞানতা, আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে আমাদের সচেতনতা। যা আপনি মনে করতে পারবেন না, সেটি ব্যক্তি হিসাবে আপনার কোনো অংশ না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি একটি কাহিনী কল্পনা করেছিলেন। কোনো একটি মুচির স্মৃতি নিয়ে একজন রাজকুমারের ঘুম থেকে জেগে ওঠা ও রাজকুমারের স্মৃতি নিয়ে কোনো এক মুচির ঘুম থেকে জেগে ওঠার একটি রূপক কাহিনী। রাজকুমারের যথারীতি ঘুম ভাঙে তার প্রাসাদেই, তার বাইরের সবকিছু সেই রাজকুমারের, ঘুমাতে যাবার আগে যেমন তিনি ছিলেন। কিন্তু তার নিজের স্মৃতির বদলে যেহেতু এখন আছে এক মুচির স্মৃতি, তিনি নিজেকে একজন মুচি হিসাবে অনুভব করতে শুরু করেন। লক বোঝাতে চাইছিলেন, রাজকুমার কিন্তু সঠিক যখন তিনি নিজেকে মুচি হিসাবে অনুভব করেন। শারীরিক ধারবাহিকতা সেখানে কোনোকিছু নির্ধারণ করে না। ব্যক্তিগত পরিচয় সংক্রান্ত সকল প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে মানসিক ধারাবাহিকতা। আপনার যদি রাজকুমারের স্মৃতি থাকে, তাহলে আপনি রাজকুমার, আপনার যদি মুচির স্মৃতি থাকে তাহলে আপনি মুচি, এমনকি যখন আমার শরীর একজন রাজকুমারের। যদি মুচি কোনো অপরাধ করে,সেটি সে করবে রাজকুমারের শরীর নিয়ে এবং আমরা সেই শরীরকে তার জন্য দোষী সাব্যস্ত করব। 

অবশ্যই এভাবে স্মৃতির রদবদল হয়না, চিন্তার পরীক্ষা হিসাবে লক উদাহরণটি ব্যবহার করেছিলেন তার বক্তব্যটি বোঝানোর জন্যে। কিন্তু কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন একটি শরীরে একাধিক ব্যক্তির (person) বসবাস থাকতে পারে। যে পরিস্থিতি পরিচিত multiple personality disorder হিসাবে, যেখানে একটি একক ব্যক্তির শরীরে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বসবাস করে বলে মনে হয়। লক কিন্তু এই ধরনের সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন এবং একই শরীরে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের বসবাসও কল্পনা করেছিলেন; একটি উপস্থিত থাকে দিনের বেলা আর আরেকটি রাতের বেলায়। আর এই দুটি ভিন্ন মনের মধ্যে যদি পরস্পর যোগসূত্র না থাকে, তাহলে লকের হিসাব মতে তারা দুটি ব্যক্তি। 

লক মনে করতেন, ব্যক্তিগত পরিচয়ের প্রশ্নটি নৈতিক দায়িত্ববোধের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর মানুষকে শাস্তি দেবেন শুধুমাত্র সেইসব অপরাধের জন্যে যে-অপরাধগুলো তারা করেছে বলে ‘মনে’ করতে পারে। এমন কেউ, যে কিনা মনে করতে পারেনা যে সে অপরাধ করেছে, সে আর সেই একই ব্যক্তি থাকে না, যে কিনা অপরাধ করেছিল। দৈনন্দিন জীবনে, অবশ্যই মানুষ মিথ্যা কথা বলে, তারা কী মনে করতে পারছে সে-বিষয়ে মিথ্যা বলতেই পারে। সুতরাং যদি কেউ দাবি করে তারা কী করেছে ভুলে গেছেন বলে, বিচারকরা খুব একটা সহানুভূতিশীল হন না তাদের দায়মুক্ত করার ব্যাপারে। কিন্তু লক বলেন, যেহেতু ঈশ্বরের কিছু অজানা নেই, তিনি বলতে পারেন কার শাস্তি প্রাপ্য। লকের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিণতি হতে পারে। যেমন, বর্তমানে স্মৃতিশক্তিহীন কোনো মানুষ যে তার তারুণ্যে নাৎসি বন্দিশিবিরের প্রহরী ছিল, যাকে নাৎসিদের খুঁজে বের করার একটি দল অবশেষে খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু লকের প্রস্তাবনা মতে তাকে শুধু সেই অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে, যা সে মনে করতে পারে, অন্য কোনো অপরাধের জন্যে নয়। ঈশ্বর তাকে শাস্তি দেবেন না সেইসব কাজের জন্য যা তিনি ভুলে গেছেন, যদিও সাধারণ আদালত তাকে কোনো ক্ষমা প্রদর্শন করবে না সন্দেহের অবকাশ আছে এমন কোনো অজুহাত ব্যবহার করে। 

ব্যক্তিগত পরিচয়ের ব্যাপারে লকের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে তার বেশকিছু সমসাময়িকদের উদ্বিগ্ন একটি প্রশ্নের উত্তর ছিল। তারা চিন্তা করতেন আপনার কি সেই একই শরীর লাগবে যখন স্বর্গে যাবার জন্য আপনাকে আবার জীবিত করা হবে। যদি আপনার সেটি দরকারই হয় তাহলে কী হবে যদি আপনার শরীর কোনো বন্যপ্রাণী কিংবা নরমাংসভোজীর খাদ্য হয়? তাহলে মৃতাবস্থা থেকে যখন আবার বাঁচিয়ে তোলা হবে তখন কীভাবে শরীরের অংশগুলো জোগাড় করা হবে। কারণ যদি কোনো নরমাংসভোজী শরীরকে খেয়ে ফেলে, তাহলে সেই শরীরের অংশ তো ভক্ষকের শরীরের সাথে মিশে যাওয়ার কথা। তাহলে কীভাবে নরখাদক ও তার খাদ্য (যেমন আপনি) দুজনের শরীরকে আলাদাভাবে গড়ে তোলা হবে মৃত্যুর পর? লক এই বিরক্তিকর সমস্যার সমাধান করতে প্রস্তাবনা করেন, যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে আপনি কি সেই একই ব্যক্তি আছেন কিনা মৃত্যুর পর, একই শরীর থাকুক বা না থাকুক। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনি একই ব্যক্তি থাকবেন যদি আপনার একই স্মৃতি থাকে, এমনকি যদি সেটি অন্য কোনো শরীরের সাথে যুক্তও থাকে। লকের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করার একটি পরিণতি হচ্ছে আপনার শৈশবের সেই ছবির শিশুটি আর আপনি সম্ভবত এক ব্যক্তি নন, অবশ্যই সেই একই মানুষ হিসাবে চিহ্নিত হতে পারেন ঠিকই, তবে যদি সেই শৈশবের স্মৃতি মনে না রাখতে পারেন তাহলে আর আপনারা এক ব্যক্তি হতে পারেন না। আপনার ব্যক্তি-পরিচয় আপনার স্মৃতি যতটুকু প্রসারিত ততটুকুই। বৃদ্ধ হলে যখন আপনার স্মৃতিশক্তি ম্লান হয়ে যাবে, ব্যক্তি হিসাবে আপনিও ততটা সংকুচিত হয়ে যাবেন। 

লকের সমসাময়িক বেশ কয়েকজন দার্শনিক অনুভব করেছিলেন যে আত্মসচেতন স্মৃতির সাথে ব্যক্তি-পরিচয়ের বিষয়টি যুক্ত করা যুক্তিযুক্ত হয়নি লকের। অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্কটল্যান্ডের দার্শনিক টমাস রিড একটি উদাহরণ উপস্থাপন করেছিলেন যা লকের ব্যক্তি-পরিচয়ের প্রস্তাবনাটির দুর্বলতাটি দেখিয়েছিল। একজন বৃদ্ধ সৈন্য যখন সে তরুণ সেনা অফিসার ছিল, সেই সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তার সাহসিকতাকে সে মনে করতে পারে, এবং যখন সে তরুণ সেনা অফিসার ছিল সে মনে করতে পারে শৈশবে একবার ফলের বাগান থেকে আপেল চুরি করার অপরাধে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল, নিশ্চয়ই এই ধরনের ওভারল্যাপ বা অধিক্রমণ করা স্মৃতিগুলোর অর্থ হবে সেই বৃদ্ধ সেনা আর বালকটি একই ব্যক্তি? থমাস রিডের মতে বিষয়টি স্পষ্ট বৃদ্ধ সেনা অফিসার আর বালকটি এখনও একই ব্যক্তি। কিন্তু লকের তত্ত্ব অনুযায়ী, বৃদ্ধ সেনা অফিসার তরুণ সাহসী অফিসার একই ব্যক্তি, কিন্তু সে সেই বালকটি নয় যে আপেল চুরি করার অপরাধে শাস্তি পেয়েছিল (কারণ বৃদ্ধ অফিসারের সেই স্মৃতিটি স্মরণে নেই)। তারপরও লকের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, তরুণ সেই সাহসী সেনা অফিসারটি আর আপেল চুরি করে শাস্তি পাওয়া বালকটি একই ব্যক্তি (কারণ সে আপেলবাগানে আপেল চুরি করার ঘটনা মনে করতে পারে)। পুরো বিষয়টি একটি অদ্ভুত ফলাফল দেয়, বৃদ্ধ সেনা অফিসার আর তরুণ সেনা অফিসারটি একই ব্যক্তি, এবং তরুণ সেনা অফিসারটি আর বালকটি একই ব্যক্তি। এবং একই সাথে বৃদ্ধ সেনা অফিসার আর শিশুটি একই ব্যক্তি নয়। এখানে যুক্তির প্রক্রিয়াটি ভেঙে পড়ে, অনেকটা অ = ই, ই = ঈ কিন্তু অ = ঈ না। ব্যক্তি-পরিচয়ের ব্যাপারটি মনে হচ্ছে নির্ভর করে ওভারল্যাপিং বা অভিক্রমণকারী স্মৃতিদের উপর, পুরো স্মৃতি একসাথে মনে করার উপরে নয় যেমনটি লক ভেবেছিলেন। 

দার্শনিক হিসাবে লকের প্রভাব অবশ্যই তার ব্যক্তি-পরিচয়ের আলোচনার চেয়ে অনেক বিস্তৃত। তাঁর An Essay Concerning Human Understanding (১৬৯০)-এ তিনি প্রস্তাব করেন যে আমাদের ধারণাগুলো পৃথিবীকে আমাদের কাছে প্রতিনিধিত্ব করে। লক ‘আইডিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যে- কোনোকিছু যা কেউ ভাবছে সেই বিষয়টি বোঝাতে। আপনি যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, আপনি যা-কিছু দেখতে পান, একটি গাছ হয়তো, অথবা একটা চড়ুইপাখি, ধারণাগুলো নিজে গাছ কিংবা চড়ুইপাখি নয়, বরং এমন কিছু যা তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে, একটি ধারণা, আইডিয়া, আপনার মাথার মধ্যে একটি ছবি। আপনি যা দেখছেন সেটি শুধুমাত্র বাস্তব পৃথিবীতে যে জিনিসটা আছে সেটাই শুধু না, এটি একই সাথে আপনার সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্রের একটি সৃষ্টি। কিন্তু আমাদের সব ধারণাই পৃথিবীর তাৎক্ষণিক অনুভূতিসৃষ্ট না, তাদের কিছু আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ার সৃষ্টি, যেমন যখন আমরা যুক্তি দিই, কোনো কিছু মনে করি কিংবা কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করি। লক মনে করতেন ধারণাগুলো মূলত আসে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে, সুতরাং আমাদের চিন্তার বিষয়বস্তু, এমনকি যখন আমরা অনুভব করছি না, চিন্তা করছি, সবকিছুই আসে ইন্দ্রিয়বোধ থেকে। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো শিশুর শুধু সাদা আর কালোর অনুভূতিবোধ থাকবে, তার লাল কিংবা সবুজের কোনো বোধ থাকবে না, যেমন যে কখনোই ঝিনুক কিংবা আনারসের স্বাদ অনুভব করবে না যদি-না সে কখনো এর স্বাদ নেয়। ধারণাগুলো নানাভাবে যুক্ত হতে পারে, সুতরাং একবার যখন আমরা লাল রঙের ধারণা পাব, কোনো কোটের ধারণা পাব, আমরা একটা লাল কোট কল্পনা করতে পারব, এমনকি যদি কোনো লাল কোট আমরা কখনোই না দেখি। কিন্তু সরলতর ধারণাগুলো, যারা জটিল ধারণাগুলো তৈরি করে, সেই সবগুলোর উৎস আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়। লক যে দার্শনিককে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি জর্জ বার্কলি। বার্কলি বাস্তবতা-সংক্রান্ত তাঁর নিজস্ব সৃজনশীল একটি ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *