1 of 2

অধ্যায় ২৭ : বাস্তবতার ক্ষণিক দর্শন – আর্থার শোপেনহাউয়ার

অধ্যায় ২৭ : বাস্তবতার ক্ষণিক দর্শন – আর্থার শোপেনহাউয়ার

জীবন যন্ত্রণার এবং না-জন্মানো সম্ভবত সবচেয়ে ভালো হতো, খুব কম মানুষেরই এমন হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে, কিন্তু আর্থার শোপেনহাউয়ার (১৭৮৮-১৮৬০)- এর তেমন ছিল। তাঁর মতে, আমরা সবাই কোনোকিছু পাবার কামনা এবং পাবার পর, আবারো আরো বেশিকিছু কামনা করার আশাহীন চক্রে আবদ্ধ হয়ে আছি। আমাদের মৃত্যু অবধি এটি চলমান। যখনই মনে হয় আমরা যা চাই সেটা পাই, আমরা অন্যকিছু পাওয়ার বাসনা অনুভব করতে শুরু করি। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনি সন্তুষ্ট হবেন একজন লক্ষপতি হলে, কিন্তু বেশিদিন আপনার সন্তুষ্টি থাকবে না। আপনার যা নেই বা যা পাননি আপনি সেটাই কামনা করতে শুরু করবেন। মানুষ এমনই। আমরা কখনোই সন্তুষ্ট নই, আমাদের যা আছে তার চেয়ে বেশি কামনা করতে আমরা কখনোই থামাতে পারিনা। পুরো ব্যাপারটাই খুব হতাশাজনক। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই জার্মান দার্শনিক, আজো চিন্তার জগতে স্মরণীয় হবার দাবি রাখেন, তার সবচেয়ে সেরা কাজ, The World as Will and Representation-এ অন্তর্ভুক্ত অন্তর্দৃষ্টিগুলোর জন্য। শুনলে যতটা মনে হতে পারে শোপেনহাউয়ারের দর্শন কিন্তু এতবেশি হতাশাপূর্ণ নয়। তিনি ভাবতেন আমরা যদি বাস্তবতার সত্যিকারের প্রকৃতিটা শুধুমাত্র শনাক্ত করতে পারি, তাহলে খুব ভিন্নভাবে আচরণ করতাম এবং হয়তো মানব পরিস্থিতির অপেক্ষাকৃত বিষণ্ণ হতাশাজনক কিছু পরিস্থিতি এড়াতে পারতাম। তাঁর বার্তাগুলো বুদ্ধের বার্তার বেশ কাছাকাছি। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, আমাদের পুরো জীবনটাই যন্ত্রণার আর আরো গভীরতর স্তরে এমন কোনোকিছু নেই যাকে আমরা বলতে পারি the self; যদি আমরা সেটি শনাক্ত করতে পারি, তাহলে আলোকপ্রাপ্ত হতে পারব। এই সদৃশতা কাকতলীয় নয়, বেশিরভাগ পশ্চিমা দার্শনিকদের ব্যতিক্রম, প্রাচ্যের দর্শন নিয়ে প্রচুর লেখাপড়া করেছিলেন শোপেনহাউয়ার। তার ডেস্কের উপর এমনকি একটি বুদ্ধের মূর্তি ছিল, তাঁর আরেক প্রিয় দার্শনিক কান্টের মূর্তির ঠিক পাশে, এবং যিনি তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। শোপেনহাউয়ারই প্রথম পশ্চিমা দার্শনিক যিনি বুদ্ধের দর্শন নিয়ে সত্যিকারভাবে ভেবেছিলেন। তাঁর চিন্তাকে এমনকি পড়া যেতে পারে বুদ্ধের চিন্তায় আলোকপ্রাপ্ত হতাশাবাদের ব্যাখ্যা অথবা প্রতিক্রিয়া হিসাবে।

কিন্তু কান্ট বা বুদ্ধের ব্যতিক্রম শোপেনহাউয়ার বেশ খানিকটা বিষণ্ণ, আত্মাভিমানী এবং বেশ জটিল ছিলেন তার আচরণে। বার্লিনে যখন প্রভাষকের একটি চাকরি পেয়েছিলেন, তিনি তাঁর প্রতিভা নিয়ে এতই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি দাবি করেছিলেন তাঁর লেকচারগুলো যেন ঠিক সেই সময়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় যখন হেগেল-এর লেকচার হয়। অবশ্যই এটা তাঁর সেরা ধারণা ছিল না, কারণ হেগেল খুবই জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর ছাত্রদের কাছে। বলতে গেলে কেউই শোপেনহাউয়ারের লেকচারে উপস্থিত হননি। অন্যদিকে হেগেলের ক্লাসরুমে জায়গা দেয়াই ছিল সমস্যা। পরে শোপেনহাউয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান, এবং উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদের উপর নির্ভর করেই তিনি তার বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন। তার সবচেয়ে সেরা বই The World as Will and Representation প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু তিনি এই বইটির উপর কাজ করে গেছেন বহুবছর, ১৮৪৪ সালে আরো বর্ধিত আকারে এটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। বইটির কেন্দ্রে মূল ধারণাটি খুব সরল। বাস্তবতার দুটি দিক আছে। এটি Will এবং Representation এই দুটি রূপেই বিদ্যমান। উইল হচ্ছে সেই অন্ধ পরিচালক শক্তি যা অবশ্যই পাওয়া যায় সবকিছুর মধ্যে যাদের অস্তিত্ব আছে, এটি হচ্ছে সেই শক্তি যা উদ্ভিদ বা প্রাণীর বৃদ্ধির কারণ, কিন্তু এটি চুম্বককে উত্তরমুখী করার কিংবা রাসায়নিক যৌগে স্ফটিক তৈরি হবারও শক্তি। আরেকটি দিক, পৃথিবী Representation রূপে, এটি সেই পৃথিবী, যেভাবে আমরা এর সম্বন্ধে অভিজ্ঞতালব্ধ হই।

রিপ্রেজেন্টেশনরূপে পৃথিবী আমাদের মনের মধ্যে আমাদেরই নির্মাণ করা বাস্তবতা, কান্ট যাকে বলেছিলেন phenomenal world; আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কোনো জানালা দিয়ে হয়তো আপনি গাছ দেখতে পারছেন, মানুষ অথবা গাড়ি, অথবা আপনার সামনে এই লেখাগুলো, হয়তো আপনি পাখির ডাক কিংবা রাস্তায় যানবাহন চলাচলের আওয়াজ শুনতে পারছেন, অথবা অন্য ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দ। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আপনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করছেন সেটাই World as Representation (প্রতিনিধি করছে এমন পৃথিবী)। সবকিছু বোঝার জন্য সেটি আপনার উপায়, যার জন্য আপনার সচেতনতা প্রয়োজন। আপনার মন সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে সাজায় তাদের অর্থবহ করে তোলার জন্য। এই World as Representation-এ আমাদের বসবাস। কিন্তু কান্টের মতো শোপেনহাউয়ার বিশ্বাস করতেন যে আরো গভীর একটি বাস্তবতা আছে যার অস্তিত্ব আছে আপনার অভিজ্ঞতার বাইরেও, সবকিছু আপাতদৃষ্টিতে যা দেখায় তার বাইরে, কান্ট যার নাম দিয়েছিলেন noumenal পৃথিবী। এবং তিনি ভাবতেন এর সাথে আমাদের কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই। কিন্তু শোপেনহাউয়ারের মতে World as Will হচ্ছে খানিকটা কান্টের noumenal জগতের মতো, যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্য আছে। কান্ট noumena নিয়ে লিখেছিলেন, যা noumenon- এর বহুবচন। তিনি ভেবেছিলেন বাস্তবতার একাধিক অংশ থাকতে পারে। অবশ্য কীভাবে কান্ট সেটি জেনেছিলেন সেটি স্পষ্ট নয়, বিশেষ করে যখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন noumena জগৎটি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ব্যতিক্রম শোপেনহাউয়ার মনে করতেন আমাদের পক্ষে এমন কিছু ধারণা করা সম্ভব না যে noumena-র বাস্তবতা আদৌ বিভাজিত করে কিনা, কারণ এই ধরনের বিজ্ঞানের জন্যে দরকার স্থান ও কাল, বাস্তবতায় এর নিজের অস্তিত্ব থাকার পরিবর্তে কান্ট বিশ্বাস করতেন সেটি প্রদান করে কোনো একক মন। এর পরিবর্তে শোপেনহাউয়ার World as Will-কে ব্যাখ্যা করেন একক, ঐক্যবদ্ধ, লক্ষ্যহীন শক্তি, যার অস্তিত্ব আছে এমন সবকিছুর পেছনে থাকে। আমরা এই জগৎটাকে দেখতে পারি আমাদের নিজেদের কাজের মাধ্যমে এবং শিল্পকলায়, আমাদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেও। আপাতত এটা পড়া বন্ধ করুন, আপনার মাথায় হাত দিন, কী ঘটল? আপনাকে দেখছে এমন কেউ দেখবে যে আপনার হাত উপরে উঠল, এবং আপনি মাথায় হাত রাখলেন। যদি কোনো আয়নায় দেখেন আপনিও একই জিনিস দেখবেন। এটাই phenomenal world-এর একটি বিবরণ, World as Representation; যদিও ‘শোপেনহাউয়ার-এর মতে, আমাদের শরীর নাড়াবার অভিজ্ঞতার একটি অভ্যন্তরীণ দিক আছে, সাধারণভাবে ফেনোমেনাল জগতটাকে আমরা যেভাবে অনুভব করি (ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত জগৎটার চেয়ে) তার চেয়ে ভিন্নভাবে অনুভব করতে পারি। আমরা World as Will-এর সরাসরি অভিজ্ঞতা নিতে পারিনা, কিন্তু আমরা সেটার খুব কাছাকাছি আসি যখন আমরা পরিকল্পিতভাবে কোনো কাজ করি, যখন আমরা শরীরের কোনো কাজ করার জন্য ইচ্ছা পোষণ করি সেটি ঘটানোর জন্যে। আর সেকারণে তিনি Will বা ইচ্ছা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বাস্তবতার বিবরণ দিতে, এমনকি যদিও এটি শুধুমাত্র মানবিক পরিস্থিতিতে যখন এই শক্তির কোনো যোগসূত্রতা থাকে কোনোকিছু ইচ্ছাকৃতভাবে করার সাথে, উদ্ভিদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বাড়ে না, রাসায়নিক ক্রিয়াও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঘটেনা। একারণে অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ যে Will শব্দটি সাধারণ অর্থে যেভাবে ব্যবহার করা হয় এটি তার থেকে আলাদা।

যখন কেউ কোনোকিছু ইচ্ছা পোষণ করে তাদের মনের ভিতর একটি লক্ষ্য থাকে, তারা কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু শোপেনহাউয়ার যখন World as Will শব্দটি ব্যবহার করছেন বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে সেটি এর থেকে ভিন্ন। Will (বড় হাতের W সহ) লক্ষ্যহীন, অথবা তিনি যেমনভাবে বলেন ‘অন্ধ’; এটি কোনো সুনির্দিষ্ট ফলাফল সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে না। এটি শুধুমাত্র সেই শক্তির বিশাল প্রবাহ যা প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনায় আছে এবং কোনোকিছু ঘটানোর জন্যে আমাদের সচেতন ইচ্ছার মধ্যেও আছে। শোপেনহাউয়ার মনে করতেন কোনো ঈশ্বর নেই এটি নির্দেশনা দেবার জন্য এবং Will নিজেও ঈশ্বর নয়। মানবিক পরিস্থিতি হচ্ছে যে আমরা, সব বাস্তবতার মতোই এই অর্থহীন শক্তির অংশ। কিন্তু তারপরও কিছু অভিজ্ঞতা জীবনকে সহনীয় করে তুলতে পারে। এগুলো মূলত আসে শিল্পকলা থেকে। শিল্পকলা একটি স্থির সেই সময়ের সন্ধান দেয়, এবং কিছুটা সময়ের জন্য আমরা সংগ্রাম আর কামনার নিরন্তর চক্র থেকে পালাতে পারি। তিনি মনে করতেন শিল্পকলার সেরা রূপটি হচ্ছে সংগীত আর সেকারণে সংগীত নিজেই সেই Will-এর অনুলিপি। তিনি মনে করতেন, এটাই ব্যাখ্যা করে আমাদের গভীরভাবে নাড়া দেবার জন্য সংগীতের ক্ষমতাটিকে। আপনি যদি বীটহোভেন-এর সিম্ফোনি শোনেন মনের সঠিক ভাবনা নিয়ে, আপনি শুধু আবেগীয়ভাবে উদ্দীপ্ত হবেন না, আপনি বাস্তবতা কী সেটিও সত্যিকারভাবে দেখতে পারবেন। শিল্পকলাকে এতটা গুরুত্ব আর কোনো দার্শনিক দেননি, সুতরাং বিস্ময়কর নয় কেন সৃজনশীল মানুষদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। সংগীতজ্ঞ আর সংগীতশিল্পীরা তাকে ভালোবাসেন, কারণ তিনি সংগীতকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করতেন। তার আবেদন ছিল ঔপন্যাসিকদের মধ্যে, যেমন টলস্টয়, মার্সেল প্রস্ত, টমাস মান এবং টমাস হার্ডি। ডিলান টমাসের কবিতা The force that through the green fuse drives the flower অনুপ্রেরণা ছিল শোপেনহাউয়ারের World as Will-এর ব্যাখ্যা।

শোপেনহাউয়ার শুধুমাত্র বাস্তবতাকে এবং এর সাথে আমাদের সম্পর্কটাকেই ব্যাখ্যা করেননি, আমরা কীভাবে বাঁচব সেই বিষয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যখন একবার আপনি অনুধাবন করবেন যে আমরা সব একটি শক্তির অংশ এবং প্রতিটি একক মানুষ বাস করে শুধুমাত্র World as Representation স্তরে, এটি আপনার কী করা উচিত সেই বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে পারে। শোপেনহাউয়ারের জন্যে, অন্য মানুষকে আঘাত মানে নিজের ক্ষতি। এটাই সব নৈতিকতার ভিত্তি। আমি যদি আপনাকে হত্যা করি, আমি জীবনশক্তির একটি অংশকে ধ্বংস করব যা আমাদের দুজনকে যুক্ত করে। যখন কেউ অন্য একজনকে আঘাত করে, এটি অনেকটা কোনো সাপের নিজের লেজে কামড় দেবার মতো, যখন সে-কিনা জানছেই না সে তার বিষদাঁত প্রবেশ করাচ্ছে নিজের মাংসে। সুতরাং শোপেনহাউয়ারের শেখানো মৌলিক নৈতিকতা হচ্ছে সহমর্মিতা, ভালোভাবে বিষয়টি বুঝলে, অন্য মানুষরা আসলে আমাদের বাইরের অংশ না। আমি অবশ্যই ভাবব আপনার সাথে কী হবে কারণ একটি উপায়ে আপনিও সেই জিনিসটির অংশ, যার অংশ আমরা সবাই: World as Will; এটাই তাঁর আনুষ্ঠানিক নৈতিক অবস্থান। এটি অবশ্যই প্রশ্ন জাগায়, তিনি নিজে কি আদৌ সেই মাত্রায় অন্য কোনো মানুষের জন্য চিন্তিত হয়েছিলেন। একটি ঘটনা বলছে, একজন বৃদ্ধ মহিলা তার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, এবং এটি তাকে এত ক্ষিপ্ত করেছিল যে তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মহিলা আহত হয়েছিল এবং আদালত শোপেনহাউয়ারকে নির্দেশ দিয়েছিল আজীবন তাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাবার জন্য। কয়েক বছর পর বৃদ্ধা মারা গেলে তিনি কোনো সহমর্মিতা দেখাননি, বরং একটি ঠাট্টার ছড়া লিখেছিলেন তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে, obit anus, abit onus, যার অর্থ বৃদ্ধ মহিলা মারা গেলেন, বোঝাও চলে গেল।

আরো একটি চূড়ান্ত উপায় আছে বাসনার চক্রটির সাথে সমঝোতা করার, এর মধ্যে বন্দি হতে না চাইলে পুরোপুরিভাবে আমাদের পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে, এবং সন্নাসী হতে হবে, দরিদ্রতায় আর যৌনতা পরিহার করে জীবন কাটাতে হবে। এটি, তিনি মনে করতেন, আদর্শ উপায় আমাদের অস্তিত্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য। এই সমাধানও একটি বিকল্প পথ হিসাবে চিহ্নিত করেছে প্রাচ্যের ধর্মগুলো। তবে তিনি কখনোই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেননি, যদিও বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মানুষের সঙ্গ উপভোগ করেছেন, প্রেম করেছেন, ভালো খেয়েছেন। তার পাঠকরা তাকে ভণ্ড হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য খুবই প্ররোচনা বোধ করতে পারেন। আসলে, হতাশাবাদের মূল সুর যা তার লেখার মধ্যে আমরা দেখি তা এতবেশি তীব্র কোনো-কোনো জায়গায়, অনেক পাঠকই ভেবেছেন যদি তিনি সত্যি সৎ হতেন তাহলে আত্মহত্যা করতেন। ‘আমার ১৭তম জন্মদিনে’, শোপেনহাউয়ার তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘তীব্র হতাশা আমাকে আক্রান্ত করেছিল, ঠিক যেমন বুদ্ধকে তার তারুণ্যে আক্রান্ত করেছিল, যখন তিনি অসুখ, বার্ধক্য, দুঃখ আর মৃত্যু দেখেছিলেন প্রথমবারের মতো। সত্যিটা হচ্ছে এই পৃথিবী কোনোভাবেই সবচেয়ে দয়ালু কোনো সত্তার কাজ হতে পারেনা, বরং এটি কোনো শয়তানের সৃষ্টি, যিনি জীব সৃষ্টি করেছেন তাদের যন্ত্রণায় ভুগতে দেখে তৃপ্তি পাবার বাসনায়।’ এবং বুদ্ধের মতো, এটাই তার লক্ষ্য ছিল এই দুঃখ আর যন্ত্রণার ব্যবচ্ছেদ করা, এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবার জন্য কোনো সমাধান খুঁজে বের করা।

বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে শোপেনহাউয়ারকে যেভাবে পড়ানো উচিত সেভাবে পড়ানো হয়নি বরং বেশ অ্যাকাডেমিকভাবে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে জটিলতর ব্যাখ্যায়। অনেকেই মনে করেন এটি তার পরিচিতি বেশ সীমিত করেছিল, কিন্তু তিনি আসলে বুদ্ধের মতোই আরো বেশি অনুসারী পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। খুব সহজভাবে তার দর্শন শুরু হয়েছিল সেই প্রাথমিক বা মৌলিক শক্তিকে নাম দেবার মাধ্যমে, যা আমাদের সবার মধ্যেই আছে, তার মতে যা অন্য যে-কোনোকিছুর চেয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী, আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তি, নৈতিকতাবোধ : যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন Will-to-Life, এটি সেই নিরন্তর শক্তি যা আমাদের সামনের দিকে চালিত করে, আমাদের অস্তিত্বে আঁকড়ে থাকে, আমাদের সুবিধাগুলোর দিকে নজর করে। এটি অন্ধ, খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার মনে এই Will- to-Life আমাদের মনকে যেদিকে বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য করে সেটি হচ্ছে যৌনতা। কৈশোর থেকেই, এই Will আমাদের ভিতরে একটানা তাড়না সৃষ্টি করে, আমাদের ভাবনাকে যৌনতার দিকে পরিচালিত করে, বাধ্য করে আমাদের অদ্ভুত সব কাজ করাতে, শোপেনহাউয়ারের মতে সবচেয়ে অদ্ভুততম কাজটি হচ্ছে প্রেমে পড়া। শোপেনহাউয়ার ভালোবাসাকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন, যেমন শ্রদ্ধা আমাদের দেখানো উচিত ঘূর্ণিঝড় অথবা কোনো বাঘকে। তিনি খুবই অপছন্দ করতেন বুদ্ধিমান মানুষের জীবনে যখন এই ধরনের প্রেমান্ধতা ব্যাঘাত সৃষ্টি করত। কিন্তু তিনি এগুলো দুর্ঘটনা বা আসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু ভাবতে অস্বীকার করেছেন, তাঁর দৃষ্টিতে ভালোবাসা যুক্ত Will-to-Life-এর সাথে, তথা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (এবং দুর্বিষহ) মূল প্রকল্পটির সাথে, সন্তানের জন্ম দেয়া।

ভালোবাসা নিয়ে এত হট্টগোল কেন? কেন এত অত্যাবশ্যকীয়তা, শোরগোল, পরিশ্রম আর উদ্বেগ? তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কারণ সকল প্রেমের চূড়ান্ত লক্ষ্য আসলে আরো গুরুত্বপূর্ণ কারো জীবনের অন্য সব লক্ষ্যের চেয়ে, এবং সেকারণে এটি অনুসরণ করার কাজটি করতে হবে গভীর ভাবনাসহ। রোমান্টিকরা জীবনে আধিপত্য বজায় রাখে, কারণ তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম কেমন হবে সেটি অন্তত নির্ধারিত হয়, অর্থাৎ অনাগত সময়ের মানবজাতির বিশেষ গঠন আর অস্তিত্ব। অবশ্যই, আমরা ভবিষ্যৎ শিশুদের নিয়ে কদাচিৎ ভাবি, যখন কারো প্রতি আমরা আকর্ষণ অনুভব করি। কিন্তু শোপেনহাউয়ার ভাবতেন এর কারণ, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিচ্ছিন্ন থাকে এর নিজের Will-এর সত্যিকার প্রতিজ্ঞা আর গোপন সিদ্ধান্তগুলো থেকে। কিন্তু কেন এই প্রতারণার আদৌ দরকার পড়ে? কারণ, তার মতে, আমরা কখনোই নির্ভরযোগ্যভাবে প্রজনন করি না, যদি-না প্রথমে এবং আসলেই আক্ষরিকভাবে, আমাদের কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এটাই হচ্ছে সেই মানুষটি যিনি কিনা কোনো ধরনের একঘেয়েমি, আটপৌরতা, খরচ, সন্তান প্রতিপালন করার মতো তীব্রতম আত্মবিসর্জনের তীব্র বিরোধী ছিলেন। উপরন্তু তিনি বেশিরভাগ সময় যুক্তি দিতেন, যদি আমরা আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারতাম ভালোবাসার পাত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে, তাহলে আমরা সাধারণত যে-মানুষগুলোকে বেছে নিই তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়তো কাউকে বেছে নিতাম। কিন্তু পরিশেষে আমরা এমন মানুষের প্রেমে পড়ি না, যাদের সাথে কিনা আমরা সঙ্গতিপূর্ণ, বরং সেইসব মানুষদের সাথে যাদের Will- to-Life শনাক্ত করে আদর্শ সঙ্গী হিসাবে, যেমন শোপেনহাউয়ার স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, আমরা যাদের সাথে ভারসাম্যময় সন্তান উৎপাদন করতে পারব। আমরা সবাই কমবেশি একটু ভারসাম্যহীন, তিনি ভাবতেন, আমরা হয় বেশি পুরুষালী অথবা বেশি রমণীয়, বেশি লম্বা অথবা বেশি খাটো, বেশি যুক্তিবাদী অথবা বেশি আবেগপ্রবণ। যদি এইসব ভারসাম্যহীনতাকে টিকে থাকতে অনুমতি দেয়া হয় বা বাড়িয়ে তোলা হয়, পরের প্রজন্মে, মানবজাতি, খুব দ্রুততম সময়ে অদ্ভুত হয়ে যাবে। Will-to-life- কে অবশ্যই তাই আমাদের সেইসব মানুষের দিকে ঠেলে দেবে, যারা পারে, তাদের ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করার কারণে আমাদের নিজেদের ভারসাম্যহীনতাগুলোকে সঠিক করতে। এ বড় নাক, ছোট নাকের সাথে মিলে ত্রুটিহীন একটি নাকের প্রতিশ্রুতি দেয়। তিনি যুক্তি দেন যে ছোট আকারের মানুষগুলো অনেক সময় লম্বা মানুষের প্রেমে পড়ে, বেশি রমণীয় পুরুষরা আরো বেশি পুরুষালী রমণীর প্রেমে পড়ে

দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার এই আকর্ষণতত্ত্বের পরিণতিতে শোপেনহাউয়ার খুব হতাশাময় একটি উপসংহারে আসেন, যেটি হচ্ছে, কোনো একটি ব্যক্তি যে-কিনা ভারসাম্যময় সন্তান উৎপাদনে খুবই যোগ্য, প্রায় কখনোই (যদিও আমরা সেই সময় বিষয়টি অনুধাবন করিনি কারণ Will-to-life আমাদের অন্ধ করে রাখে) আমাদের জন্য খুব বেশি যোগ্য নয়: ‘আমাদের খুব অবাক হলে চলবে না যে বন্ধু নয় এমন মানুষের মধ্যে বিবাহে’, তার মনে ভালোবাসা সেইসব মানুষদের উপর এর প্রভাব ফেলে, যৌনতা ছাড়া, যারা ঘৃণাপূর্ণ এবং আমরা এমনকি পছন্দও করব না, কিন্তুপ্রজাতির Will এতবেশি শক্তিশালী সেই একক ব্যক্তির চেয়ে যে, প্রেমিকযুগল সবকিছুই উপেক্ষা করে, ভুল বিচার করে, দুর্বিষহ একটি বিষয়ের প্রতি চিরকালই তারা অন্ধ হয়ে থাকেন।’ আমাদের সুখ না, Will-to-life-এর নিজের উদ্দেশ্য সফল করার ক্ষমতা, শোপেনহাউয়ারের তত্ত্ব ইঙ্গিত দেয় আমরা বিশেষ সুস্পষ্টতার সাথে অনুভব করতে পারি অর্গাজম বা চরম সুখের পরবর্তী ভীতিকর আর নির্জন মুহূর্তে, তার ভাষায়, ‘সঙ্গমের ঠিক পরে শয়তানের হাসি শোনা যায়।’

মানবজীবনের নানা দৃশ্য শোপেনহাউয়ারকে ব্যথিত করেছিল। ‘আমরা পশুর মতো, শুধুমাত্র, আমাদের বৃহত্তর আত্মসচেতনতার কারণে; আরো বেশি দুঃখী।’ তিনি বিভিন্ন প্রাণীদের নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, বিশেষ করে মোল, মাটির নিচে অন্ধকার সুড়ঙ্গে যাদের বসবাস, যারা কদাচিৎ দিনের আলো দেখে, যাদের সন্তানরা আঠালো কেঁচোর মতো দেখতে। কিন্তু সে তার ক্ষমতায় সবকিছু করে টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য। আমরাও তাদের মতোই আরো বেশি করুণ, আমরা উন্মত্তের মতো নিজেদের উন্নতির দিকে নিয়ে যাই, ভালো বেতনের কাজ খুঁজি, যা সবাইকে বিশেষ করে সঙ্গিনীকে মুগ্ধ করার জন্য, সারাক্ষণই ভাবি, সেই একটি মানুষকে খুঁজতে (কল্পনা করি তারা আমাদের সুখি করবে), এবং অবশেষে একসময় কারো দ্বারা প্ররোচিত হই যথেষ্ট দীর্ঘ সময় কোনো সন্তান-উৎপাদন করার জন্য এবং পরবর্তী ৪০ বছর দুর্বিষহ জীবন কাটাই একটা ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে। শোপেনহাউয়ার খুব সুন্দরভাবে ও রসিকতার সাথে মানবপ্রকৃতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণাগুলো লিখেছিলেন। যেমন, ‘একটি মাত্র জন্মগত ত্রুটি আছে, সেটি হচ্ছে সেই ধারণা পোষণ করা, আমাদের অস্তিত্ব আছে কারণ আমরা সুখী হব তাই। যতক্ষণ এই জন্মগত ত্রুটি নিয়ে আমরা টিকে থাকব, এই পৃথিবী আমাদের কাছে সবসময়েই স্ববিরোধিতাপূর্ণ মনে হবে। কারণ প্রতিটি পদক্ষেপের জন্যে, ছোট কিংবা বড়, আমরা সেই অভিজ্ঞতায় বন্দি যেখানে এই পৃথিবী ও জীবন অবশ্যই আমাদের সন্তুষ্ট করার জন্য সজ্জিত নয়। সেকারণে আমরা এতবেশি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ দেখি যাদের মুখে হতাশার ছাপ সুস্পষ্ট।’

শোপেনহাউয়ার দুটি সমাধান প্রস্তাব করেছিলেন অস্তিত্বের এই সমস্যাগুলোর সমাধানে। প্রথমটি বরং সেইসব দুষ্প্রাপ্য মানুষদের জন্য, যাদের তিনি বলছেন sage বা প্রাজ্ঞ। এই প্রজ্ঞাবানরা পারেন, তাদের বীরোচিত প্রচেষ্টায় Will-to-life- এর দাবির উপরে উঠতে, তারা সেই প্রাকৃতিক তাড়নাটি তাদের ভিতরে দেখতে পান স্বার্থপরতা, যৌনতা, অহংকারের প্রতি, এবং তারা সেটি অতিক্রম করেন, তারা তাদের কামনাগুলোকে জয় করেন, একা থাকেন (প্রায়শই বড় শহর থেকে দূরে), কখনো বিয়ে করেন না, তাদের খ্যাতি আর সামাজিক মর্যাদার বাসনাকে তারা দমন করেন। বৌদ্ধ দর্শনে, শোপেনহাউয়ার দেখিয়েছিলেন, এই মানুষটি পরিচিত মঙ্ক বা সাধু হিসাবে, কিন্তু তিনি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, আমাদের মধ্যে খুব মানুষই এভাবে জীবন কাটাতে পারে। তবে তার দ্বিতীয় এবং আরো সহজেই পালনযোগ্য এবং বাস্তবসম্মত বিকল্প হচ্ছে যতটা দীর্ঘতম সময় সম্ভব, শিল্পকলা ও দর্শন নিয়ে কাটানো, যার কাজ হচ্ছে আমাদের সব উন্মত্ত প্রচেষ্টা আর অসুখী সময় যা আমাদের ভিতর সৃষ্টি করেছে Will-to-Life, তার সামনে আয়না মেলে ধরা। আমরা হয়তো প্রায়শই তাকে জয় করতে পারব না, কিন্তু সন্ধ্যায় মঞ্চে অথবা কবিতার বই নিয়ে হাঁটতে বের হলে, আমরা দৈনন্দিন জীবন থেকে বের হতে পারে এবং কোনো বিভ্রম ছাড়াই জীবনের দিকে তাকাতে পারি। যে শিল্পকলা তিনি মনে করতেন ভাবালুতা সবচেয়ে বিপরীত, সেটি হচ্ছে গ্রিক ট্র্যাজেডি, ল্যা রোশফুকোর অ্যাফোরিজম ও হবস আর মাকিয়াভেলির রাজনীতিতত্ত্ব। এই কাজগুলো আমাদের আত্মম্ভরিতা নিয়ে কষ্ট, স্বার্থপরতা আর বৈবাহিক জীবনের ভীতি সরাসরি কথা বলে, এবং মানবজাতির প্রতি একটি ট্র্যাজিক, সম্মানসূচক, বিষণ্ণ সমবেদনার হাত সম্প্রসারণ করে। শোপেনহাউয়ার-এর নিজের কাজগুলোই শিল্পকলা ও দর্শনের কী করা উচিত সেই সংক্রান্ত নিজের বিবরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ভয়ংকর তিক্ত হতাশাবাদে এটি গভীরভাবে আমাদের সান্ত্বনা দেয়। যেমন তিনি বলেন: “বিয়ে করা মানে পরস্পরের কাছে ঘৃণ্য হবার জন্য সবকিছু করার প্রচেষ্টা’ বা ‘প্রতিটি জীবনকাহিনি দুঃখের’, ‘জীবনের নিজস্ব কোনো মূল্য নেই, শুধুমাত্র চাহিদা আর মায়া এটিকে চলমান রাখে।’

বহু সময় চেষ্টা করে কাটানোর পর, তারপরও বিখ্যাত হতে ব্যর্থ হবার পর, এবং চেষ্টা করেও ভালো সম্পর্ক পেতে ব্যর্থ হবার পর, তার জীবনের শেষে, শোপেনহাউয়ার ধীরে ধীরে পাঠক পেয়েছিলেন যারা তাঁর লেখা ভালোবেসেছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টে একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে ছোট একটা কুকুরকে নিয়ে তাঁর জীবন কেটেছে, যার নাম দিয়েছিলেন আত্মা, বৌদ্ধদর্শনের বিশ্বআত্মা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। কুকুরটি তার প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ডাকত মিসেস শোপেনহাউয়ার নামে। ৭২ বছর বয়সে, নীরবে তিনি মারা যান। তিনি আমাদের সময়ের প্রাজ্ঞ ছিলেন, এমন কেউ যার আবক্ষ মূর্তি তার প্রিয় বুদ্ধের মূর্তির মতোই সর্বব্যাপী ও শ্রদ্ধেয় হবার দাবি রাখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *