1 of 2

অধ্যায় ১২ : শিয়াল এবং সিংহ – নিকোলো মাকিয়াভেলি

অধ্যায় ১২ : শিয়াল এবং সিংহ  – নিকোলো মাকিয়াভেলি 

কল্পনা করুন আপনি হচ্ছেন একজন প্রিন্স (অর্থাৎ রাজা), ষোড়শ শতাব্দীর ইতালির ফ্লোরেন্স কিংবা নেপলসের মতো শহর রাষ্ট্র শাসন করছেন। আপনার হাতে আছে চূড়ান্ত ক্ষমতা। আপনি কোনো নির্দেশ জারি করতে পারেন এবং সেটি সবাই মান্য করতে বাধ্য। আপনার বিরুদ্ধে কথা বলছে, বা আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে এমন কাউকে যদি আপনি কারাগারে বন্দি করতে চান, আপনি সেটি অনায়াসে করতে পারবেন। আপনি যা করতে বলবেন সেটি করার জন্য আপনার সেনাবাহিনীও প্রস্তুত। কিন্তু আপনার রাজ্যটিকে পরিবেষ্টিত করে আছে আরো কিছু রাষ্ট্র যাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকরা আপনার রাষ্ট্র দখল করার জন্যে ফন্দি আঁটছে সারাক্ষণই। আপনার তাহলে কেমন আচরণ করা উচিত? আপনার কি সৎ থাকা উচিত, কথা দিয়ে কথা রাখা উচিত, সবসময় দয়ার সাথে কাজ করা উচিত, মানুষের চরিত্রের মধ্যে সবসময় ভালো জিনিসটার কথাই কি চিন্তা করা উচিত? নিকোলো মাকিয়াভেলি মনে করতেন এমন কিছু করা ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে, যদিও আপনি হয়তো চান সেই অর্থে আপনাকে সবাই সৎ বা ভালো মানুষ মনে করুক। মাকিয়াভেলির মতানুসারে, কখনো কখনো মিথ্যা বলা, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা এবং শত্রুকে হত্যা করাই হবে উত্তম সিদ্ধান্ত। কোনো রাজার তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মাকিয়াভেলির ভাষায় একজন কার্যকরী সফল প্রিন্স বা রাজা ‘কীভাবে ভালো না-হওয়া যায়’ সেটি অবশ্যই শিখতে হবে। কারণ তার জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকা, সেটি নিশ্চিত করার প্রায় যে-কোনো উপায়ই গ্রহণযোগ্য ৷ বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই তাঁর ‘দ্য প্রিন্স’ (The Prince) বইটি, যেখানে তিনি এই সবকিছু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই বইটি ১৫৩২ সালে প্রথম প্রকাশের পর থেকেই কুখ্যাত। কিছু মানুষ এটিকে চিহ্নিত করেছেন এটি অশুভ অথবা নিদেনপক্ষে কোনো গুণ্ডাবাহিনীর প্রধানের জন্যে সহায়ক পুস্তক হিসাবে। অন্যরা মনে করেছিলেন এই বইটি প্রথমবারের মতো সবচেয়ে সঠিকভাবে রাজনীতিতে আসলেই যা ঘটে তারই ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আজও বহু রাজনীতিবিদ বইটি পড়েন, যদিও শুধুমাত্র তাদের অল্প কয়েকজনই সেটি স্বীকার করবেন, হয়তো সেটি তারা প্রকাশ করেন তাদের কাজে যে তারা সেই মূলনীতি বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছেন। 

মাকিয়াভেলির জন্ম হয়েছিল ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্লোরেন্সে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী আইনজীবী। মাকিয়াভেলি নানা বিষয়ে প্রশিক্ষিত হবার সর্বোচ্চ সুযোগই পেয়েছিলেন। শহরের সচিব হিসাবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন, যেখানে তাঁর দায়িত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দলিল রচনা এবং সম্পাদনা করা। কিন্তু তাঁর কর্মজীবন শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই ফ্লোরেন্স ব্যাপক রাজনৈতিক পালাবদলের শিকার হয়, রাষ্ট্রের শাসক মেদিচি পরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যারা ষাট দশক ধরে সেখানে ক্ষমতায় আসীন ছিল। মাকিয়াভেলির জন্য এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন অনুকূল পরিস্থিতির ছিল না। যদিও তিনি বিখ্যাত ছিলেন রাজনৈতিক নেতাদের সফল পরামর্শক হিসাবে, কিন্তু মাকিয়াভেলি নিজে ছিলেন ব্যর্থ রাজনীতিবিদ, এমনকি তার সেই সময়ের একজন ব্যর্থ রাজনৈতিক তাত্ত্বিকও। তবে তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার জন্ম দিয়েছিলেন যা রাজনীতির একটি প্রধান সমস্যাকে বর্ণনা করতে পেরেছিল, সেটি হচ্ছে একই সাথে একজন ভালো রাজনীতিবিদ এবং খ্রিস্টীয় মতবাদ অনুযায়ী একজন ‘ভালো’ মানুষ হওয়া খুব কঠিন এবং এমনকি অসম্ভব। 

মাকিয়াভেলির সেরা কাজ ‘দ্য প্রিন্স’ বইটির মূল বিষয় ছিল কীভাবে ক্ষমতা পাওয়া ও রক্ষা করা যেতে পারে, এবং কার্যকর সফল একজন নেতা হবার জন্য কী গুণাবলি দরকার। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন একজন ভালো রাজ্যপ্রধান বা প্রিন্সের মূল দায়িত্ব হচ্ছে একটি স্থিতিশীল রাজ্যপরিচালনার ক্ষেত্রে যে-কোনো আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরীণ হুমকির মোকাবেলা থেকে দেশকে সুরক্ষা করা। এর অর্থ হচ্ছে তাকে জানতে হবে কীভাবে যুদ্ধ করতে হবে এবং তাকে অবশ্যই তার চারপাশে থাকা প্রতিটি মানুষের সুখ্যাতি কিংবা কুখ্যাতি সম্বন্ধে জানতে হবে এবং অবশ্যই তাকে জানতে হবে কীভাবে সেই মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মানুষ যেন তাকে মনে করতে না পারে যে সে দুর্বল, যাকে সহজেই অবজ্ঞা করা যায়, তেমনি তারা যেন অবশ্যই মনে না করেন যে, তিনি অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর, তার সমাজের কাছে যা ঘৃণ্য প্রমাণিত হবে। তার উচিত হবে আপাতদৃষ্টিতে তিনি যেমন হবেন সহজে অভিযোগ বা অনুযোগ করা সম্ভব নয় এমন কঠোর কিন্তু যৌক্তিক। যখন মাকিয়াভেলি সেই প্রশ্নটির কথা ভেবেছেন, কোনো শাসক প্রিন্সের জন্য কোটি ভালো সবার ভালোবাসায় তিনি নন্দিত হবেন, নাকি সবাই তাকে ভয় করবে, মাকিয়াভেলি লিখেছিলেন যদিও তাত্ত্বিকভাবে ভালো এমন কোনো নেতা যাকে তার অনুসারীরা যেমন ভয় করবে আবার ভালোও বাসবে, মেনে চলবে, সেক্ষেত্রে তার উচিত হবে তিনি যেন তার অনুসারীদের মনে ভয় উদ্ৰেক করতে পিছপা না হন, কারণ সেটাই পারে চূড়ান্তভাবে সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। 

‘দ্য প্রিন্স’ বইটি সবার জন্য গাইডবুক হিসাবে লেখা হয়নি, শুধুমাত্র তাদের জন্য, যারা সম্প্রতি ক্ষমতায় এসেছেন। ফ্লোরেন্স থেকে সাত মাইল দক্ষিণে একটি খামারে বসে মাকিয়াভেলি বইটি লিখেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর ইতালি খুবই বিপদজ্জনক একটি দেশ ছিল। মাকিয়াভেলির জন্ম ও শৈশব কেটেছিল ফ্লোরেন্সে। তরুণ বয়সেই তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন কূটনীতিবিদ হিসাবে। ইউরোপজুড়ে তাঁর ভ্রমণের সময় তিনি বেশকিছু রাজার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন, এছাড়া একজন সম্রাট ও পোপের সাথেও তাঁর দেখা হয়েছিল। তাদের তিনি তেমন বিশেষ কিছু মনে করেননি। শুধুমাত্র একজন নেতাই সত্যিকারভাবে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল; তিনি সেজারে বরজিয়া, খুবই নিষ্ঠুর একজন মানুষ, পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের অবৈধ পুত্র। ইতালির একটি বড় অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে তিনি যেমন তার শত্রুদের সাথে ছলনা করেছিলেন, তেমনি হত্যাও করেছিলেন কোনো ভ্রূক্ষেপ ছাড়াই। মাকিয়াভেলির ভাবনায় বরজিয়া সবকিছুই ঠিক করেছিলেন, কিন্তু তার পরাজয় হয়েছিল শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যের জন্য। একটা পর্যায়ে যখন তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই সময় বরজিয়া শারীরিকভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মাকিয়াভেলির নিজের জীবনেও দুর্ভাগ্য একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল, এই বিষয়টি নিয়ে তিনি অনেক ভেবেছিলেন। যখন অত্যন্ত সম্পদশালী মেদিচি পরিবার, যারা বহুদিন আগেই ফ্লোরেন্সে শাসক হিসাবে রাজত্ব করেছিলেন, পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তারা মাকিয়াভেলিকে কারাগারে বন্দি করে রাখেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মাকিয়াভেলি কারাগারে নানাধরনের নির্যাতন সহ্য করে বেঁচে ছিলেন ও পরে মুক্তি পান। তাঁর বেশকিছু সহকর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর শাস্তি ছিল নির্বাসন কারণ তিনি কোনো দোষ স্বীকার করেননি। তাঁর প্রিয় শহর তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে তিনি রাজনীতির জগৎ থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। নির্বাসনে গ্রামে বসেই তিনি তাঁর সন্ধ্যাবেলা কাটাতেন অতীতের বিখ্যাত চিন্তাবিদদের সাথে কথোপকথন কল্পনা করে। তাঁর কল্পনায় তাঁরা নেতা হিসাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে সেরা উপায়গুলো কী সেই বিষয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করতেন। অনেকেই মনে করেন তিনি সম্ভবত দ্য প্রিন্স বইটি লিখেছিলেন ক্ষমতায় যারা আছে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, যেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে তিনি আবার তাঁর কাজ ফিরে পান। তাহলে হয়তো তিনি ফ্লোরেন্সে, তাঁর প্রিয় ক্ষেত্র রাজনীতির উত্তেজনাপূর্ণ আর বিপদসঙ্কুল জীবনে ফিরতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা কাজে আসেনি। মাকিয়াভেলিকে রাজনীতি ছেড়ে অবশেষে লেখক হিসাবে জীবন কাটাতে হয়েছিল। দ্য প্রিন্স ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি বই তিনি লিখেছিলেন রাজনীতি নিয়ে, এবং একজন সফল নাট্যকার হয়েছিলেন; তাঁর নাটক ‘মান্দ্ৰাগোলা’ (Mandragola) এখনও মাঝে মাঝে মঞ্চস্থ হয় ৷ 

বেশ, তাহলে মাকিয়াভেলি ঠিক কী উপদেশ দিয়েছিলেন, এবং কেন সেই উপদেশগুলো তাঁর অধিকাংশ পাঠককে বড়মাপের একটি ধাক্কা দিয়েছিল? তাঁর মূল ধারণা ছিল, কোনো একজন ক্ষমতাসীন প্রিন্সের যা থাকা প্রয়োজন, তাঁর ভাষায় সেটি হচ্ছে virtu, ইতালীয় ভাষায় এর অর্থ ম্যানলিনেস বা পৌরুষত্ব তথা সাহস কিংবা শৌর্য। কিন্তু আসলেই এর অর্থ কী? মাকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন যে সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে সৌভাগ্যের উপর। তিনি ভাবতেন আমাদের সাথে যা ঘটে তার অর্ধেক ঘটে ভাগ্যক্রমে, আর বাকি অর্ধেক ঘটে আমাদের নিজস্ব নির্বাচনের কারণে। কিন্তু তিনি এও বিশ্বাস করতেন আপনি সাফল্য পাবার সম্ভাবনা বাড়াতে পারেন সাহসিকতা ও দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত নেবার মাধ্যমে। যেহেতু আমাদের জীবনে ভাগ্য একটা বিশাল অংশ জুড়ে থাকে, তার মানে এই না যে আমরা এর শিকার বা ভিক্টিম হিসাবে আচরণ করব। একটা নদীতে বন্যা হতে পারে, এবং সেটি এমন কিছু যা আমরা প্রতিরোধ করতে পারব না। কিন্তু যদি আমরা বাঁধ বা বন্যা-নিরোধক তৈরি করি তাহলে আমরা টিকে থাকার সম্ভাবনাও বাড়াতে পারি। অন্যভাবে যদি বলা হয়, কোনো নেতা যে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে, এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে, তাহলে সে অবশ্যই ভালো করবে, যারা এই কাজটি করবে না তাদের চেয়ে। 

মাকিয়াভেলি স্থির প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তাঁর দর্শনের মূলে থাকবে যা আসলেই ঘটেছে শুধুমাত্র সেটাই। সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে বেশকিছু উদাহরণ ব্যবহার করে, যে উদাহরণগুলোর অধিকাংশ পাত্রপাত্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি তাঁর পাঠকদের দেখিয়েছিলেন তিনি আসলে কী বোঝাতে চাইছেন। যেমন, যখন সেজারে বরজিয়া জানতে পারেন যে অরসিনি-পরিবার তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করছে, বরজিয়া সর্বতো চেষ্টা করেছিলেন তাদের বুঝতে না-দেবার জন্য যে তিনি তাদের পরিকল্পনার কথা জানেন। সিনিগাগলিয়া নামের একটি জায়গায় তিনি এই পরিবারের নেতাদের কৌশলে আলোচনার জন্য ডেকে নিয়ে আসেন। যথারীতি তারা সবাই সেখানে এসেছিল, তিনি তাদের সবাইকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেন। আর মাকিয়াভেলি এই কৌশলের সমর্থন করেছিলেন, তাঁর মতে এটা virtu-র খুব ভালো একটা উদাহরণ। আবারো, যখন বরজিয়া রোমানইয়া বলে একটি জায়গা দখল করেছিলেন, সেখানকার প্রশাসনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারই এক নিষ্ঠুর কমান্ডার রেমিরো দে ওর্কোকে। দে ওর্কো রোমানইয়ার বাহিনী জনগোষ্ঠীর উপর সবধরনের বল প্রয়োগ করে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিলেন। বহু পুরুষদের তাদের পুরো পরিবারের সামনেই শিরশ্চেদ করা হয়েছিল, দখল করা হয়েছিল সম্পত্তি, বিশ্বাসঘাতকতার ন্যূনতম শাস্তি ছিল নুপংসক করে দেয়া। 

কিন্তু যখনই রোমানইয়া শান্ত হয়েছিল বরজিয়া রেমিরো দে ওর্কোর নিষ্ঠুরতার সাথে সম্পর্ক দূরত্ব তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন, এবং তার ছিন্নভিন্ন শরীর শহরের মূল চত্বরে ছড়িয়ে রাখেন সবাই যেন তা দেখতে পায়। বরজিয়ার এই নিষ্ঠুরতা সমর্থন করেছিলেন মাকিয়াভেলি, কারণ বরজিয়া যা চেয়েছিলেন এটি তার উদ্দেশ্য অর্জন করেছিল; রোমানিয়ার জনগোষ্ঠী তাকে সমর্থন দিয়েছিল। কারণ তারা খুশি হয়েছিল যে ওর্কো মারা গেছে, কিন্তু একই সাথে তারা এটাও অনুধাবন করেছিল বরজিয়া অবশ্যই তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছে, এই বিষয়টি তাদের শঙ্কিত করেছিল। যদি বরজিয়া তার নিজের সেনাপতির সাথে এই মাত্রায় হিংস্র হতে পারে, তাহলে আমরা কেউই নিরাপদ নই। এভাবেই বরজিয়া শহরবাসীদের জানান দেন শহরের প্রকৃত ক্ষমতার মালিক আসলে কে। এবং মাকিয়াভেলির মতে যথেষ্ট রক্তপাতের পর সেজারের কিছু পদক্ষেপ, যেমন- কর কমানোর, কম খরচে খাদ্য সরবরাহ, থিয়েটার নির্মাণ এবং ধারাবাহিক বেশকিছু উৎসবের আয়োজন ইত্যাদির উদ্দেশ্য ছিল শহরের মানুষগুলো যেন সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে বেশি সময় মনে না-ধরে রাখতে পারে। মাকিয়াভেলির দৃষ্টিতে বরজিয়ার এই আচরণ পুরুষোচিত: এটি virtu যেমন প্রদর্শন করছে তেমনি জানান দিচ্ছে কোনো বুদ্ধিমান প্রিন্সের কী করা উচিত। 

শুনলে মনে হবে যেন মাকিয়াভেলি হত্যাকে সমর্থন করছেন। তিনি অবশ্যই সেটা করেছিলেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যদি এর ফলাফল পরিকল্পনা মাফিক হয়, যদি পরিণতি যথার্থতা প্রদান করে। কিন্তু এই উদাহরণগুলোর মূল বিষয় সেটি নয়। তিনি যা বোঝাতে চাইছিলেন সেটি হচ্ছে, শত্রুদের এবং তার নিজের কমান্ডার ওকোকে হত্যা করার মাধ্যমে উদাহরণ সৃষ্টি করার বরজিয়ার এই আচরণটি কাজে লেগেছিল। প্রত্যাশিত ফলাফলও পাওয়া গিয়েছিল, যা ভবিষ্যতে বাড়তি হত্যাকাণ্ডও বন্ধ করেছিল। তার দ্রুত আর নিষ্ঠুর কাজের মাধ্যমে বরজিয়া ক্ষমতায় ছিলেন ও রোমানইয়ার জনগোষ্ঠীকেও প্রতিরোধ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা থেকে। মাকিয়াভেলির মতে পরিণতিটা গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে সেটি অর্জিত হলো সেটা না: বরজিয়া তাঁর দৃষ্টিতে একজন ভালো প্রিন্স, কারণ ক্ষমতা রাখার জন্য যে-কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি কোনো ইতস্তত বোধ করেননি। মাকিয়াভেলি অর্থহীন হত্যাকাণ্ডের পক্ষপাতী ছিলেন, কেবল হত্যার উদ্দেশ্যে হত্যা অর্থহীন। কিন্তু তিনি যে খুনিদের বর্ণনা দিয়েছিলেন তারা কেউ এরকম না। সমবেদনার সাথে সেইসব পরিস্থিতি কোনো পদক্ষেপ নিলে, মাকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন, ভয়ংকর পরিণতি সৃষ্টি করত, বরজিয়ার জন্য তো বটেই, রাষ্ট্রের জন্যেও। মাকিয়াভেলি প্রস্তাব করেছিলেন যে এমন নেতা হওয়াই উত্তম যাকে সবাই ভালোবাসার চেয়ে বরং বেশি ভয় করবে। আদর্শ পরিস্থিতি হচ্ছে নেতাকে যেমন ভালোবাসবে, তেমনি তাকে ভয়ও পাবে, কিন্তু সেটি অর্জন করা অনেক কঠিন। নেতা হিসাবে আপনি যদি আপনার জনগণের ভালোবাসার উপর নির্ভর করেন, তাহলে আপনাকে সেই ঝুঁকি নিতে হবে যে তারা বিপদের সময়ে আপনাকে পরিত্যাগ করতে পারে। যদি তারা আপনাকে ভয় পায়, তাহলে বিশ্বাসঘাতকতা করতে তারা ভয় পাবে। এটাই মাকিয়াভেলির চরিত্রের নেতিবাচক নৈরাশ্যবাদিতা, মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর নেতিবাচক ধারণা। তিনি ভাবতেন মানুষের উপর নির্ভর করা কঠিন, তারা লোভী ও অসৎ। আপনি যদি সফল প্রশাসক হতে চান তাহলে আপনাকে সেটা জানতে হবে। খুব বিপদজ্জনক কাউকে বিশ্বাস করা যে, তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, যদি-না তারা সেই প্রতিশ্রুতি না রাখতে পারার পরিণতিটাকে ভয় না পায়। আপনি যদি আপনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন দয়া প্রদর্শন করে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং ভালোবাসা পেয়ে, তাহলে আপনার সেটাই করা উচিত (অথবা কমপক্ষে তেমনটাই করছেন এমন ভান করতে পারেন) কিন্তু যদি সেটা আপনি না পারেন, তাহলে আপনার প্রয়োজন আছে এইসব মানবীয় গুণাবলির সাথে পাশবিক কিছু গুণাবলির মিশ্রণ করতে হবে। 

অন্য দার্শনিকরা যখন নেতাদের মানবিক গুণাবলি বৃদ্ধি করার উপর জোর দিয়েছিলেন, তখন মাকিয়াভেলি ভেবেছেন, কখনো কখনো কোনো কার্যকরী নেতাকে পশুর মতোই আচরণ করা উচিত। তিনি এক্ষেত্রে শিয়াল এবং সিংহের উদাহরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। শিয়াল হচ্ছে ধূর্ত এবং দ্রুত সে ফাঁদ শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু সিংহ হচ্ছে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ভয়ংকর। সবসময় সিংহের মতো আচরণ করা ভালো না, যখন শুধু তীব্র শক্তি দিয়ে কোনো কাজ করার আড়ালে ঝুঁকি থাকে সত্যিকারের ফাঁদ চোখে না-পড়ার। এবং একই সাথে আপনি শুধুমাত্র ধূর্ত শিয়ালও হতে পারবেন না। মাঝে মাঝে আপনার সিংহের মতোই শক্তি দরকার নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য। কিন্তু আপনি যদি আপনার দয়া এবং সুবিচারের প্রতি তাড়নার উপর ভরসা করেন, আপনি বেশিদিন টিকতে পারবেন না। সৌভাগ্যক্রমে মানুষ বিশ্বাসপ্রবণ। তারা বাইরের দৃশ্যটা দেখেই প্রভাবিত হয়। সুতরাং নেতা হিসাবে আপনিও হয়তো পার পেয়ে যাবেন সৎ আর দয়ালু হবার ভান করে যখন আপনি নিষ্ঠুরতার সাথে আচরণ করছেন আর প্রতিশ্রুত ভঙ্গ করছেন। 

এতটুকু পড়ে আপনি সম্ভবত ভাবছেন যে মাকিয়াভেলি পুরোপুরিভাবে একজন অশুভ মানুষ। আর বহু মানুষ সেটি বিশ্বাসও করেছিল, সেকারণে মাকিয়াভেলিয়ান (machiavellian) শব্দটি একটি বিশেষণ হিসাবে ব্যাপকভাবেই ব্যবহৃত হয় এমন কাউকে চিহ্নিত করার জন্য যে-কিনা নানা ছলচাতুরী ও মানুষকে ব্যবহার করতে পারে নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্যে। কিন্তু অন্য দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে মাকিয়াভেলি গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা করেছেন। হয়তো সাধারণ সুআচরণ বিষয়টি নেতাদের জন্য কাজ করেনা। প্রাত্যহিক জীবনে দয়ালু হওয়া আর আপনাকে প্রতি দেয়া মানুষগুলোকে বিশ্বাস করা এক কথা আর আপনি যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, আর বিশ্বাস করেন যে অন্য দেশগুলো আপনার প্রতি ভালো আচরণ করবে, তাহলে আপনার কূটনৈতিক নীতি বেশ ভয়ংকর নীতি। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেইনস অ্যাডলফ হিটলারকে বিশ্বাস করেছিলেন যখন হিটলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জার্মান সীমানা তিনি আর সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করবেন না। সেটি এখন বোকামি আর খুব বিশ্বাসপ্রবণ মনে হতে পারে। মাকিয়াভেলি বেঁচে থাকলে চেম্বারলিনকে দেখিয়ে দিতেন হিটলারের কোনো কারণই নেই সত্যিকথা বলার, বরং বহু কারণ আছে তার সাথে প্রতারণা করার এবং তার উচিত হবে না হিটলারকে বিশ্বাস করা। আবার অন্যদিকে, আমদে তোলা উচিত না যে মাকিয়াভেলি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও শত্রুদের প্রতি চূড়ান্ত নিষ্ঠুর আচরণগুলোকে সমর্থন করেছিলেন। এমনকি ষোড়শ শতকের রক্তাক্ত পর্বে সেজারে বরজিয়ার কর্মকাণ্ডকে উন্মুক্তভাবে সমর্থন করাও বেশ হতবাক করে দেবার মতো। আমরা অনেকেই মনে করি, খুব কঠোরভাবে একটি সীমা থাকতে হবে একজন নেতা তার সবচেয়ে খারাপ শত্রুর সাথে কী আচরণ করতে পারবেন, আর সেই সীমারেখাটি স্থাপিত করা উচিত আইনের মাধ্যমে। যদি সীমারেখা নির্দিষ্ট করা না যায়, তাহলে আমরা বন্য অত্যাচারী স্বেচ্ছাচারী শাসক পাবো; অ্যাডলফ হিটলার, পল পট, ইদি আমিন, সাদ্দাম হুসেইন এবং রবার্ট মুগাবে, সবাই সেজারে বরজিয়ার মতোই কৌশল ব্যবহার করেছেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। অবশ্যই যা মাকিয়াভেলির দর্শনের জন্য খুব একটা ভালো কোনো বিজ্ঞাপন না। মাকিয়াভেলি নিজেকে দেখতেন বাস্তববাদী হিসাবে, এমন কেউ যিনি মানুষকে মৌলিকভাবে স্বার্থপর হিসাবে শনাক্ত করেছিলেন। থমাস হবসও একই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতেন, আর সমাজ কীভাবে গড়ে উঠবে তার সেই ভাবনা ও ব্যাখ্যার মূল ভিত্তি ছিল সেটাই। 

একারণেই রাজনীতিবিদদের নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন সবসময়ই আশা আর হতাশার মধ্যবর্তী টানাপড়েনেরই প্রামাণ্য দলিল। একদিকে, আমাদের সেই আদর্শবাদী ধারণাটি আছে যে রাজনীতিবিদরা হবেন ন্যায়পরায়ণ বীরপুরুষ কিংবা নারী যারা রাষ্ট্রের দুর্নীতিগ্রস্থ অসুস্থ কাঠামোয় আবারো নতুন করে নৈতিকতার বীজ বপন করবেন। তবে, প্রায়শই আমরা বাধ্য হই নৈরাশ্যবাদের অন্ধকার বিষণ্নতায় নিমজ্জিত হতে যখন আমরা অনুধাবন করতে পারি ঠিক কী পরিমাণ গোপন আঁতাতে অংশগ্রহণ কিংবা ভয়াবহ মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতির এই অশুভ দিকটি নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে আমরা আমাদের আদর্শবাদী আশা আর নৈরাশ্যবাদী শঙ্কার মধ্যে দোদুল্যমান একটি অবস্থানে নিজেদের জীবনের বাস্তবতাকে স্পর্শ করি। বিস্ময়করভাবে, যে মানুষটি রাজনীতির বহুব্যবহৃত মাকিয়াভেলিয়ান শব্দটিতে তার নিজের নাম উৎসর্গ করেছিলেন, যে শব্দটি প্রায়শই জঘন্যতম রাজনৈতিক ফন্দিবাজি আর দুরভিসন্ধিকে প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়, তিনি কিন্তু আমাদের এই বহুপুনরাবৃত্তি হওয়া ক্লান্ত বৈপরীত্যের বিপজ্জনক পরিস্থিতিটিকে বুঝতে সহায়তা করেছিলেন। মাকিয়াভেলির লেখা আমাদের জানায় রাজনীতিবিদদের মিথ্যাচার কিংবা ছলনা দেখে আমাদের বিস্মিত হওয়া উচিত না। তাঁর মতে আমাদের উচিত হবে না, – ‘সেইসব কিছু করার জন্য তাদেরকে অনৈতিক বা শুধুমাত্র ‘খারাপ’ হিসাবে চিহ্নিত করা। মাকিয়াভেলির বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন ভালো রাজনীতিবিদ হচ্ছেন, যিনি দয়ালু, বন্ধুসুলভ এবং সৎ এমন কেউ নন, বরং এমন কেউ যিনি, যদিও মাঝে মাঝে তিনি ধূর্ত কিংবা ফন্দিবাজ হতে পারেন ঠিকই, জানেন কীভাবে রাষ্ট্রকে রক্ষা, সমৃদ্ধশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ করা যায়। যখন আমরা এই ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারি, আমরা অপেক্ষাকৃত কম হতাশাগ্রস্থ এবং সুস্পষ্ট হতে পারব রাজনীতিবিদদের কাছে আমাদের প্রত্যাশায় ৷ 

মাকিয়াভেলির সবচেয়ে বৈপ্লবিক আর বৈশিষ্ট্যসূচক অন্তর্দৃষ্টি ছিল নেতা হবার পথনির্দেশিকা হিসাবে খ্রিস্টীয় সদৃদ্গুণাবলির প্রত্যাখ্যান। মাকিয়াভেলির খ্রিস্টীয় সমসাময়িকরা প্রস্তাব করেছেন প্রিন্স বা শাসকের হওয়া উচিত দয়ালু, শান্তিপ্রিয়, উদার এবং সহিষ্ণু। তারা ভেবেছিলেন কোনো একজন ভালো রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য, মূল বিষয় হচ্ছে তাকে ভালো খ্রিস্টানও হতে হবে। কিন্তু মাকিয়াভেলি বেশ দৃঢ়তার সাথে এমন ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি স্থাপনা করেছিলেন। তিনি তাঁর পাঠকদের খ্রিস্টীয় নীতি আর দক্ষভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার বিষয়টির মধ্যে অসঙ্গতিটাকে খতিয়ে দেখতে বলেছিলেন জিরোলামো সাভোনারোলা উদাহরণ ব্যবহার করে। সাভোনারোলা ছিলেন অতি উৎসাহী ধর্মবাদী, আদর্শবাদী খ্রিস্টান যিনি ফ্লোরেন্সে ঈশ্বরের শহর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি তৎকালীন মেদিচি-পরিবারের বাহুল্য আর স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে প্রচারণা করে সফল হয়েছিলেন মেদিচিদের উৎখাত করতে, এমনকি কয়েক বছর তিনি ফ্লোরেন্সকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিছুটা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে, এবং আপেক্ষিকভাবে দুই- এক বছরের জন্য তিনি ফ্লোরেন্সকে একটি সত্রাষ্ট্রে পরিণতও করেছিলেন। তবে তার সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, মাকিয়াভেলির মতে এর কারণ হচ্ছে সবসময়ই তার খ্রিস্টীয় অর্থে ভালো হরার দুর্বলতার কারণে। খুব দ্রুত তার শাসন তৎকালীন দুর্নীতিপরায়ণ পোপ আলেকজান্ডারের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল, তার অনুসারীরা কৌশলেই সাভানোরোলাকে প্রথমে ক্ষমতাচ্যুত, তারপর বন্দি এবং পরে ফ্লোরেন্স- এর কেন্দ্রে তাকে ঝুলিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। মাকিয়াভেলি তাঁর লেখায় দাবি করেন রাজনীতিতে ভালোমানুষের ঠিক এমন পরিণতি ঘটে। 

এই দুর্ভাগ্যজনক খ্রিস্টীয় উদাহরণটি অনুসরণ না করে মাকিয়াভেলি প্রস্তাব করেন, কোনো নেতার জন্য উত্তম হবে যদি তিনি বিবেচনার সাথে, মাকিয়াভেলি যার একটি চমৎকার এবং প্যারাডক্সিকাল শব্দ দিয়ে নামকরণ করেছিলেন, ক্রিমিনাল ভার্চু (দুর্নীতিপূর্ণ সদৃদ্গুণ) ব্যবহার করতে পারেন। মাকিয়াভেলি কিছু পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন, যে পরিস্থিতি এই ধরনের ক্রিমিনাল ভার্চু ব্যবহার করা সঠিক হতে পারে: রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যে যখন এটি অবশ্য প্রয়াজনীয়, কাজটি করতে হবে দ্রুত (প্রায়শই রাতের বেলা) এবং এই কাজটি খুব বেশি পুনরাবৃত্তি করা যাবে না, কারণ সেই ক্ষেত্রে হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার একটি কুখ্যাতি দ্রুত সৃষ্টি হবে। ক্যাথলিক চার্চ প্রায় ২০০ বছর ধরে মাকিয়াভেলির লেখা নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, কারণ অত্যন্ত তীব্রতার সাথে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে একজন ভালো নেতা হবার সাথে ভালো খ্রিস্টান হওয়া কতটা বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু এমনকি নিরীশ্বরবাদীদের জন্যও, আমরা যেমন যারা রাজনীতিবিদ নই, তাদের জন্য মাকিয়াভেলির কিছু অন্তর্দৃষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছিলেন, আমরা সব কাজে অথবা সবকিছুর জন্য ভালো হতে পারব না। আমাদের অবশ্যই সেই ক্ষেত্রটিকে বেছে নিতে হবে যেখানে আমরা শ্রেষ্ঠ হতে চাই এবং বাকি অনেক জায়গা আমাদের ছেড়ে দিতে হবে সেই ক্ষেত্রে যারা ভালো তাদের জন্য। এর কারণ শুধুমাত্র আমাদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা কিংবা সুযোগ নয় বরং নৈতিকতার নীতিমালাগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ। কিছু কিছু ক্ষেত্র যা আমরা বেছে নিয়েছি, যদিও রাজ্য পরিচালক প্রিন্স হিসাবে না, হয়তো অন্য কোনো ধরনের আনুগত্য আর দায়িত্বের ক্ষেত্রে, সেখানে প্রয়োজন আছে সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, যাকে আমরা খানিকটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় নাম দিই ডিফিকাল্ট ডিসিশন বা কঠিন সিদ্ধান্ত, আসলে যার মাধ্যমে আমরা বোঝাতে চাই একটি এথিকাল ট্রেড অফ বা নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোনোকিছুর বদলে অন্য কোনোকিছু ছাড় দেয়া। আমরা হয়তো নব্য-খ্রিস্টীয় দয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে বিসর্জন দিতে পারি ব্যবহারিক পর্যায়ে কার্যকরী কোনো সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। আমরা হয়তো মিথ্যা বলতে পারি কোনো একটি সম্পর্ককে বাঁচাতে। আমরা হয়তো শ্রমিকদের অনুভূতিকে অস্বীকার করতে পারি কোনো ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। সেটাই, মাকিয়াভেলি দাবি করেন, এই পৃথিবী কেমন হবে আমরা যা অনুভব করি সেটি নয় বরং বাস্তবে পৃথিবী যেমন সেইভাবে তাকে সামাল দেবার জন্য আমাদের পরিশোধিত মূল্য। পৃথিবী তাই মাকিয়াভেলিকে একই সাথে ভালোবাসবে আর ঘৃণা করাও অব্যাহত রাখবে সমানভাবে এই অস্বস্তিকর সত্যটিকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার জন্যে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *