1 of 2

অধ্যায় ৩৪ : ছদ্মবেশী চিন্তা – সিগমন্ড ফ্রয়েড

অধ্যায় ৩৪ : ছদ্মবেশী চিন্তা – সিগমন্ড ফ্রয়েড

আসলেই কি আমরা আমাদের নিজেদের জানতে পারি? প্রাচীন দার্শনিকরা অবশ্য মনে করতেন যে আমরা পারি। কিন্তু যদি তাদের সেই ভাবনাটি ভুল হয়, তাহলে? যদি আপনার মনের কিছু অংশ থাকে, যেখানে আপনি কখনোই সরাসরি পৌছাতে পারবেন না, সেইসব ঘরের মতো, যা চিরস্থায়ীভাবে তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করা যেন আপনি আর কখনোই সেখানে ঢুকতে না পারেন? বাইরের রূপ খুব বিভ্রান্তিকর হতে পারে। খুব সকালে আপনি যখন সূর্যের দিকে তাকান, মনে হয় এটি দিগন্তরেখার উপর দিয়ে উঠে আসছে, সারাদিন ধরে এটি আকাশ অতিক্রম করে এবং অবশেষে অস্ত যায়। খুব সহজেই এই দৃশ্য আমাদের প্ররোচিত করতে পারে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে। আর বহু শতাব্দী ধরে মানুষ আসলে দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাসও করেছে সত্য বলে। কিন্তু আসলেই তা ঘটে না। ষোড়শ শতাব্দীতে নিকোলাউস কোপার্নিকাস এটি অনুধাবন করেছিলেন, যদিও তার আগে বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। কোপার্নিকাসের এই বিপ্লব, আমাদের গ্রহটি যে সৌরজগতের কেন্দ্রবিন্দু নয়, এমন ধারণাটি বেশ বড় একটি ধাক্কা দিয়েছিল। মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দী আরো একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিল, এতদিন অবধি মানুষকে দেখা হতো অন্য সব প্রাণী থেকে ভিন্ন কিছু হিসাবে যাকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন কোনো অতিপ্রাকৃত ঈশ্বর। কিন্তু ডারউইন (এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস) সেই ভাবনাটি ভেঙে দিয়েছিলেন তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্বটি দিয়ে। এইপ বা নরবানরদের সাথে আমরাও একটি সাধারণ পূর্বসূরি থেকেই বিবর্তিত হয়েছি, ঈশ্বরের বিশেষ পরিকল্পিত কোনো প্রাণী হিসাবে আমাদেরকে ভাবার কোনো কারণ নেই। এটি নৈর্ব্যক্তিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার জন্যে দায়ী। ডারউইনের (ও ওয়ালেস) প্রস্তাবনা ব্যাখ্যা করেছিল আমরা বিবর্তিত হয়েছি এইপ সদৃশ প্রাণী পূর্বসূরিদের থেকে এবং আমরা জীবিত এইপদের কতটাই নিকটবর্তী আত্মীয়। ডারউইনের বৈপ্লবিক চিন্তার প্রভাব আমরা এখনও অনুভব করছি।

সিগমন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) নিজেও মনে করতেন, মানবচিন্তার তৃতীয় বিপ্লবটি এসেছে তাঁর নিজস্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে: অবচৈতন্য বা the unconscious; তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমরা যা-কিছু করি তার বেশিরভাগই পরিচালিত করে সেইসব কামনাগুলো যা আমাদের কাছ থেকেও লুকানো। আমরা তাদের কাছে সরাসরি পৌঁছাতে পারিনা, কিন্তু আমরা যা করি, সেই সবকিছুর উপর প্রভাব ফেলার জন্য বিষয়টি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনা। কিছু জিনিস আছে আমরা যা করতে চাই, কিন্তু আমরা যে সেগুলো করতে চাই সেটি আমরা অনুধাবন করতে পারিনা। অবচেতন মনের এই কামনাগুলো আমাদের পুরো জীবনের উপর তাদের গভীর প্রভাব ফেলে যায়, এটি প্রভাব ফেলে কীভাবে আমরা সমাজকে সংগঠিত করি। এবং এরাই মানবসভ্যতার সেরা আর নিকৃষ্টতম দিকগুলোর উৎস। ফ্রয়েড এই আবিষ্কারের জন্যে দায়ী, যদিও এ-ধরনের কিছু ধারণা ফ্রিয়েডরিখ নিচাহর লেখায় আমরা লক্ষ করেছিলাম।

ফ্রয়েড, একজন মনোচিকিৎসক, নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ুরোগ-বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন ভিয়েনায়, আর ভিয়েনা তখন অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবারের ছেলে ফ্রয়েড, ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা এই কসমোপলিটান শহরে অন্য বহু বৈশিষ্ট্যসূচক সুশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত তরুণদের মতোই ছিলেন। তবে বেশকিছু রোগীর সাথে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা ক্রমেই মনোজগতের সেই অংশটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তিনি বিশ্বাস করে শুরু করেছিলেন যে সেই অংশটি তাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের মনোজগতে সমস্যা সৃষ্টি করছে এমন প্রক্রিয়ার ব্যপারে তারা নিজেরাও সচেতন নয়।

হিস্টেরিয়া ও কিছু অন্য ধরনের নিউরোসিস (স্নায়ুবৈকল্য) তাঁর চিন্তাকে প্ররোচিত করেছিল এর কারণ অনুসন্ধানে। হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা, যারা মূলত ছিলেন নারী, প্রায়শই তাদের ঘুমের মধ্যে হাঁটে, বিভ্রমে আক্রান্ত হয়, এমনকি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত কোনো রোগীর মতো অসাড়ও হতে পারে। কিন্তু তারপরও কারোই জানা ছিল না কেন এমনটি ঘটছে। এইসব উপসর্গের কোনো শারীরিক কারণ বিজ্ঞানীরাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু রোগীর মুখে তাদের উপসর্গগুলোর বিবরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাসের দিকে নজর দিয়ে ফ্রয়েড সেই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন,এইসব রোগীর সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে কোনো ধরনের অস্বস্থিকর স্মৃতি অথবা অবদমিত কামনা। এই স্মৃতি অথবা কামনা অবচেতন মনেই সৃষ্টি হয় এবং তাদের কোনো ধারণাই নেই যে তাদের সেই স্মৃতি বা কামনা আছে।

ফ্রয়েড তাঁর রোগীদের একটি কাউচে (একধরনের সোফা) শুইয়ে তাদের মনে যেটাই আসছে সেগুলো বলতে বলতেন। আর প্রায়শই তারা বেশ ভালো অনুভব করতেন তাদের কথাগুলো বলতে পেরে। কারণ, এটি তাদের সেইসব অবচেতনে থাকা ধারণাগুলোকে বের হবার একটি পথ করে দিত। আর এই ‘ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন’, ধারণা বা চিন্তাগুলোকে স্বাধীনভাবে প্রবাহিত হতে দেয়ার প্রক্রিয়াটি, যা অবচেতনে ছিল সেগুলোকেই সচেতন স্তরে নিয়ে আসার এই উপায়টি বিস্ময়কর ফলাফলের কারণ হয়েছিল। তিনি তাঁর রোগীদের তাদের দেখা স্বপ্নগুলোকে বর্ণনা করতে বলতেন। কোনো-না-কোনোভাবে এই ‘টকিং কিউর’ বা কথা বলার মাধ্যমে নিরাময় করার পদ্ধতি তাদের জন্যে সমস্যা সৃষ্টিকারী চিন্তাগুলোকে উন্মুক্ত করে দিত, তাদের বেশকিছু উপসর্গের নিরাময়ও করত। মনে হতো যেন এই কথাবলার প্রক্রিয়া সেই চাপটিকে অবমুক্ত করে দিয়েছে, যা সৃষ্টি করেছিল সেইসব চিন্তাগুলো, যে চিন্তাগুলোর মুখোমুখি তারা হতে চায় না। এটাই ছিল সাইকোঅ্যানালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণের জন্মলগ্ন।

শুধুমাত্র নিউরোটিক বা হিস্টেরিকাল রোগীরাই না, যাদের অবচেতন ইচ্ছা বা স্মৃতি আছে, ফ্রয়েডের মতে, আমাদের সবারই তা আছে। কারণ কেবল অবদমন করেই এই সমাজে জীবন কাটানো সম্ভব। নিজেদের কাছ থেকেই আমরা লুকিয়ে রাখি আমরা আসলে কী অনুভব করি, আর কী করতে চাই। এসবের কিছু চিন্তা হিংস্রআর কিছু যৌনতানির্ভর। সেগুলো প্রকাশ করা খুবই বিপজ্জনক। আমাদের মন তাদের রিপ্রেস বা অবদমিত করে রাখে, সেটিকে অবচৈতন্যে বন্দী করে রাখে। এই চিন্তাগুলোর অধিকাংশ তৈরি হয়েছিল আমাদের শৈশবে। শিশুর জীবনের খুব শুরুর কোনো ঘটনা পুনরায় আবির্ভূত হতে পারে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যায়ে। যেমন, ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন যে পুরুষদের সবার অবচেতনে তাদের বাবাকে হত্যা করার ও তাদের মায়ের সাথে সঙ্গম করার একটি ইচ্ছা আছে। এটাই তাঁর বিখ্যাত ইডিপাস-কমপ্লেক্স, এটির নামকরণ হয়েছে ইডিপাসের নামানুসারে, যিনি গ্রিক পুরাণে সেই ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করেছিলেন, যে কিনা তার বাবাকে হত্যা এবং মাকে বিয়ে করবেন (আর হ্যাঁ, উভয় ক্ষেত্রে ইডিপাসের নিজের অজান্তেই ঘটনাগুলো ঘটবে)। কিছু মানুষের জন্যে, জীবনের শুরুর এই অদ্ভুত কামনা পুরোপুরি তাদের জীবনে রূপ দেয় তাদের অজান্তেই। তাদের মনের মধ্যে কিছু এই অস্বস্তিকর চিন্তাকে প্রতিহত করে রাখে শনাক্তযোগ্য কোনোরূপে প্রকাশ হওয়া থেকে। কিন্তু আমাদের মধ্যে যা-কিছুই এটিকে থামিয়ে রাখে এবং অন্য কোনো অসচেতন কামনাগুলোকে সচেতন হওয়া থেকে, তারা পুরোপুরিভাবে সফল হতে পারেনা। চিন্তাগুলো তারপরও পালাবার সুযোগ পায়, কিন্তু ছদ্মবেশে। যেমন তারা আবির্ভূত হতে পারে স্বপ্ন হিসাবে। ফ্রয়েড মনে করতেন স্বপ্ন হচ্ছে the royal road to the unconscious, বা ‘অবচেতন অভিমুখে মহাসড়ক’, আমাদের গোপন চিন্তাগুলোকে খুঁজে বের করার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি উপায়। যা-কিছু আমরা স্বপ্নে দেখি বা অভিজ্ঞতা লাভ করি তাদের যা আপাতদৃষ্টি মনে হয় তারা আসলে তা নয়। উপরিদৃষ্টিতে এর বিষয়বস্তু বা surface content, যা ঘটছে বলে মনে হয়, কিন্তু এর গভীরের বিষয়বস্তু বা latent content হচ্ছে স্বপ্নের আসল অর্থ। সেটাই মনোবিশ্লেষকরা বোঝার চেষ্টা করেছেন। আমরা স্বপ্নে যা দেখি সেগুলো আসলে প্রতীক। সেগুলো সেইসব কামনারই প্রতিনিধিত্ব করে যা আমাদের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে। সুতরাং, যেমন কোনো একটি স্বপ্নে যদি একটি সাপ বা ছাতা বা কোনো তলোয়ার দেখেন সেটি হবে ছদ্মবেশী যৌনস্বপ্ন। সাপ, ছাতা আর তলোয়ার হচ্ছে ধ্রুপদী Freudian symbols বা ফ্রয়েডীয় প্রতীক, তার মতে এটি পুরুষাঙ্গের প্রতীক। একইভাবে কেউ যদি কোনো গুহা বা পয়সা রাখা থলে বা পার্সের স্বপ্ন দেখেন সেটি যোনিকে প্রতিনিধিত্ব করে। আপনার যদি এই ধারণাটিকে খুব বেশি অদ্ভুত আর হতবাক করে দেবার মতো মনে হয়, ফ্রয়েড সম্ভবত আপনাকে বলতেন, এর কারণ হচ্ছে আপনার ভিতরের এইসব যৌন চিন্তাগুলোকে শনাক্ত করা থেকে আপনার মন আপনাকে রক্ষা করছে।

ফ্রয়েড মনে করতেন আরেকটি উপায়ে আমরা আমাদের অবচেতন মনের কামনাগুলোর দেখা পাই, সেটি হচ্ছে ভুল করে কিছু বলে ফেলার মাধ্যমে, যাকে বলে slips of the tongue অথবা Freudian slips, যখন আমরা ঘটনাচক্রে সেইসব ইচ্ছাগুলোকে উন্মোচন করি যা আমরা অনুধাবন করি না আমাদের ভিতরে আছে। বহু টেলিভিশন খবর-পাঠকরা কোনো একটি নাম বা বাক্যে হোঁচট খেতে পারেন, দুর্ঘটনাবশত কোনো অশ্লীলতা উচ্চারণ করার মাধ্যমে। একজন ফ্রয়েডবাদী হয়তো বলতে পারেন, এটি ঘটবার হার অনেক বেশি সুতরাং শুধুমাত্র ঘটনাচক্রে এমন কিছু ঘটেছে বলে ভাবা যাবে না। তবে সব অবচেতন ইচ্ছাই যৌনতা বা সহিংসতা বিষয়ক নয়। কিছু কোনো একটি মৌলিক দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করে। সচেতন স্তরে আমরা হয়তো একটি জিনিস চাই অথচ অবচেতন মনেই আমরা সেটি চাইছি না। কল্পনা করুন আপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আছে যা আপনাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে। সচেতনভাবে আপনি আপনার ক্ষমতায় যা-কিছু আছে তা করে প্রস্তুত হলেন। আপনি এর আগের সব পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান করলেন, প্রশ্নের উত্তর তৈরি করলেন, নিশ্চিত করলেন যে আপনার অ্যালার্মঘড়ি ঠিকমতো বাজবে কিনা, যেন আপনি সময়মতো পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে পারেন। সবকিছুই ঠিকমতো হলো, আপনি সময়মতো উঠলেন, খেলেন, বাস ধরলেন, বুঝতে পারলেন যে আপনি সময়ের আগেই সেখানে পৌছে যাবেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনি বাসে বেশ আনন্দের সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন, কিন্তু যখন আপনার ঘুম ভাঙল, আপনি আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করলেন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে এবং পরীক্ষার হলে সময়মতো পৌঁছাবার কোনো উপায় নেই। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরিণতি নিয়ে আপনার ভয় আপনার সচেতন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করেছে বলে মনে হচ্ছে। গভীর একটি স্তরে আপনি চাননি সফল হতে, কিন্তু নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতে আপনি অনেক বেশি আতঙ্কিত, কিন্তু আপনার অবচেতন মন আপনার কাছে সেটি উন্মোচন করে দেয়।

শুধুমাত্র নিউরোটিক বা স্নায়ুবৈকল্যে আক্রান্ত ব্যক্তির উপরেই ফ্রয়েড তাঁর তত্ত্ব প্রয়োগ করেননি বরং সাধারণ সাংস্কৃতিক বিশ্বাসগুলোর উপরেও তিনি তার তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন। বিশেষ করে তিনি একটি মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রস্তাব করেছিলেন কেন মানুষ ধর্মের ধারণার প্রতি এত মোহাবিষ্ট। আপনি হয়তো ঈশ্বর বিশ্বাস করেন। হয়তো আপনার জীবনে ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পান। কিন্তু ফ্ৰয়েড ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, আপনার ঈশ্বরবিশ্বাস কোথা থেকে আসতে পারে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আপনি ঈশ্বরবিশ্বাস করেন, কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ফ্রয়েড ভাবতেন আপনার ঈশ্বরবিশ্বাসের কারণ আপনি এখন সেই নিরাপত্তা পাবার প্রয়োজন অনুভব করেন যা একসময় আপনি যখন শিশু ছিলেন তখন অনুভব করতেন। ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরো সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে এই বিভ্ৰম, বিভ্রমটি হচ্ছে কোথাও-না-কোথাও একটি পিতৃসুলভ চরিত্র আছে যে আপনার নিরাপত্তা পাবার জন্যে অপূর্ণ প্রয়োজনটি মেটাতে পারবে। খুবই অভিলাষী আত্মপ্রশ্রয়ী ভাবনা, এমন কিছু বিশ্বাস করা যে, এমন ঈশ্বরের সত্যি অস্তিত্ব আছে, কারণ আপনার মনে তীব্র ইচ্ছা আছে যে তার অস্তিত্ব থাকা উচিত। এর উৎস সুরক্ষা আর প্রতিপালিত হবার অবচেতন বাসনা, যার সূচনা হয় শৈশবে। সেইসব প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ঈশ্বর-ধারণাটি স্বস্তিদায়ক সেকারণেই, যারা এখনও এইসব অনুভূতি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি। এমনকি যদিও তারা সাধারণত পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনা এই অনুভূতিটি কোথা থেকে এসেছে, এবং তারা সক্রিয়ভাবে সেই ধারণাকে চেপে রাখে যে তাদের ধর্মবিশ্বাস এসেছে পুরোপুরিভাবে গভীরভাবে অনুভূত সেই অপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনীয়তা থেকেই, ঈশ্বরের সত্যিকার অস্তিত্ব থেকে না। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ফ্রয়েডের প্রস্তাবনা রেনে দেকার্ত-এর মতো দার্শনিকদের প্রস্তাবনা ও ধারণাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, যেমন দেকার্ত মন সম্বন্ধে যা বলেছিলেন। দেকার্ত বিশ্বাস করতেন যে মন হচ্ছে এর নিজের কাছে স্বচ্ছ। তিনি বিশ্বাস করতেন যদি আপনার কোনো চিন্তা মনে থাকে আপনি অবশ্যই সেই চিন্তার ব্যাপারে সচেতন থাকবেন। কিন্তু ফ্রয়েডের পরে অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড থাকার সম্ভাবনাটি স্বীকৃতি পাবার দাবি সংহত করেছিল। তবে সব দার্শনিক ফ্রয়েডের দাবির ভিত্তি মেনে নেননি, যদিও অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন অবচেতন ভাবনার যে সম্ভাবনা আছে সেটি নিয়ে তার ধারণা সঠিক। কেউ দাবি করেছেন তার তত্ত্বগুলো অবৈজ্ঞানিক। বিশেষ করে কার্ল পপার দাবি করেছিলেন সাইকোঅ্যানালাইসিসের বহু ধারণাই unfalsifiable, মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আর এটি কোনো প্রশংসা না, এটি সমালোচনা। পপার দাবি করেছিলেন, কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূল বিষয় হচ্ছে এটি পরীক্ষা করে দেখা যাবে। মানে কিছুসম্ভাব্য পর্যবেক্ষণ থাকবে যা দেখাতে পারে এটি ভুল। পপারের উদাহরণে, একজন মানুষের কাজ, যে কিনা একটি শিশুকে নদীতে ফেলে দিয়েছে ডুবিয়ে মারার জন্য, এবং অন্য আরেকজন মানুষের কাজ, যে কিনা পানিতে ঝাঁপিয়ে ডুবন্ত শিশুকে বাঁচিয়েছে, সব মানব-আচরণের মতো, দুটোই সমানভাবে উন্মুক্ত ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যার কাছে। কেউ কোনো একটি শিশুকে পানিতে ডোবাতে, নাকি বাঁচানোর চেষ্টা করতে চাইছে, ফ্রয়েডের তত্ত্ব তা ব্যাখ্যা করতে পারে। তিনি সম্ভবত বলবেন প্রথম মানুষটি তার ইডিপাস কমপ্লেক্সের কোনো একটি দিককে দমন করার প্রচেষ্টায়, যা তার সহিংস আচরণের কারণ, অন্যদিকে দ্বিতীয় মানুষটি তার অবচেতন ইচ্ছাকে সাবলিমেট বা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পেরেছে, সামাজিকভাবে উপযোগী কাজে, যদি সব সম্ভাব্য পর্যবেক্ষণকে গ্রহণ করা হয় তত্ত্বটির সপক্ষে বাড়তি প্রমাণ হিসাবে, সেই পর্যবেক্ষণটি যাই হোক না কেন এবং কল্পনা করা সম্ভব কোনো প্রমাণ এটি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবেনা, পপার মনে করতেন, এমন কোনো তত্ত্ব আদৌ বৈজ্ঞানিক হতে পারে না। অন্যদিকে ফ্ৰয়েড হয়তো যুক্তি দেখাতে পারতেন যে পপারের কোনো ধরনের অবদমিত কামনা আছে যা তাকে মনোবিশ্লেষণের প্রতি এত আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। আমাদের কাছাকাছি অতীতে ফ্ৰয়েড ছিলেন সেইসব দার্শনিকদের অগ্রদূত যারা ভেবেছিলেন কেন আমাদের জীবন আর সম্পর্কগুলো এত জটিল, সংশয়পূর্ণ আর কষ্টদায়ক। ফ্রয়েড বলেছিলেন কেন আমাদের জীবন কঠিন, কীভাবে আমরা এর সামাল দিতে পারি। তঁর নিজের জীবনেও বহু দুশ্চিন্তা ছিল। তিনি নিজেকে বর্ণনা করছিলেন, একজন ‘অবসেশনাল নিউরোটিক’ হিসাবে, যদিও আমাদের ভিতরের জীবন নিয়ে বহু কথা বলেছিলেন, তিনি নিজেও বাকি সবার মতোই খুব করুণভাবে অরক্ষিত ও আক্রম্য ছিলেন।

সিগমন্ড শ্লোমো ফ্রয়েড মধ্যবিত্ত ইহুদি-পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৫৬ সালে। তার জন্মস্থান বর্তমান চেক রিপাবলিকের অংশ (সেই সময় যা অস্ট্রো- হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল)। মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল তার, যিনি তাকে গোল্ডেন সিগি বলে ডাকতেন, একই সাথে বাবার প্রতি তীব্র বৈরিতা ছিল, যিনি একবার শিশু সিগিকে হুমকি দিয়েছিলেন তার পুরুষাঙ্গ কেটে দেবেন যদি সেটা নিয়ে তিনি নাড়াচড়া বন্ধ না করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পেশাগত জীবন তার সফল হয়নি রাতারাতি, তরুণ মেডিকেল ছাত্র হিসাবে তিনি বহু শত পুরুষ ইল মাছ ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন তাদের জননাঙ্গ শনাক্ত করার অসফল প্রচেষ্টা হিসাবে, বিষয়টি নিয়ে তিনি থিসিস প্রকাশ করতে পারেননি। এরপর তিনি গবেষণা করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে অন্যান্য ক্ষেত্রে একটি নতুন চেতনানাশক ঔষধের ব্যবহার নিয়ে, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ঔষধটি ছিল কোকেন, যা প্ৰমাণিত হয়েছিল বিপজ্জনক এবং আসক্তি-সৃষ্টিকারী মাদক হিসাবে। ফ্রয়েড সেটির ব্যবহার করার উপদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এর কয়েকবছর পর অবশেষে তিনি সেই বিশেষ ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ শুরু করেন যা তাকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছে। একটি নতুন মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, সাইকোঅ্যানালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণ। এই বিষয়ে তার যুগান্তকারী গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০০ সালে একটি বই হিসাবে, The Interpretation of Dreams, এরপরে তার আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়, বিশেষভাবে The Psychopathology of Everyday Life (১৯০১), The Cases of ‘Little Hans’ and ‘the Rat Man’ (১৯০৯), Beyond the Pleasure Principle (১৯২০), Civilisation and Its Discontents(১৯৩০)। ডাক্তার হিসাবে তাঁর সুনাম থাকলেও তিনি অসুখী মানুষ ছিলেন। কাজপাগল ছিলেন, এক বন্ধুকে বলেছিলেন, কাজ ছাড়া জীবন যে স্বস্তি কর হতে পারে সেটি তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তাঁর গবেষণার একটি বিশেষ জটিল অংশে তিনি লেখেন, ‘প্রধান যে রোগীটিকে নিয়ে আমি ব্যস্ত সেটি হচ্ছি আমি।’ সহকর্মীদের প্রতি বেশ ঈর্ষা তিনি অনুভব করতে পারতেন। একবার তিনি কার্ল ইউংকে বক্তৃতা দিতে শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর সব ছাত্রকে তিনি নিষেধ করেছিলেন তারা যেন আলফ্রেড অ্যাডলারের কোনো বক্তৃতা না শোনে, এমনকি তাঁকে চোখেও না দেখে। এছাড়াও তিনি বিশ্বাস করতেন ৬১ ও ৬২ বছরের মধ্যে মারা যাবেন, এই দুটি সংখ্যাকে তিনি খুব ভয় করতেন (অবশ্য তিনি মারা গিয়েছিলেন ৮৩ বছর বয়সে)। তিনি একবার দারুণ ভয় পেয়েছিলেন এথেন্সে থাকার সময়, কারণ তার রুম নং ছিল ৩১ যা ৬২-র ঠিক অর্ধেক। তাঁর এই সমস্যাগুলোর সময় তিনি ভরসা করতেন প্রিয় সিগারের উপর, কিন্তু তিনি এই বিষয়ে খুব আত্মসচেতন ছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন এটি তার আগের হস্তমৈথুনের অভ্যাসের প্রতিস্থাপন। তারপরও তার ব্যক্তিগত দুঃখ, দুশ্চিন্তাগুলো বাস্তবিকভাবেই তাঁর সবচেয়ে বড় অবদানেরই অংশ: মানবমনের অদ্ভুত দুঃখগুলো নিয়ে তার গবেষণা। তার কাজ আমাদের দেখিয়েছে যে সচেতনতা, মনের যৌক্তিক অংশটি, তার নিজের ভাষায় not even master in its own house (এমনকি তার নিজের বাড়ির কর্তা নয়), বরং আমরা পরিচালিত আমাদের মনের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো দিয়ে, যার কিছু আমাদের সচেতন উপলব্ধির সীমানার বাইরে। ফ্রয়েড সম্বন্ধে আমাদের জানা উচিত, তার তত্ত্ব আমাদের অবাক, ব্রিতকর, কিছুটা হাস্যকর মনে হোক না কেন, তিনি আমাদের চমৎকারভাবে আলোকিত করেছেন ব্যাখ্যা করে কেন মানুষ আসলেই এত বেশি জটিল।

এই ভিতরের দ্বন্দ্ব নিয়ে তার প্রস্তাবিত প্রথম তত্ত্বটিকে আমরা দেখি তার Formulations on the Two Principles of Mental Functioning এখানে তিনি তার pleasure principle প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন এই pleasure principle-ই আমাদের পরিচালিত করে, যা আমাদের সহজ শারীরিক আর মানসিক সুখের দিকে পরিচালিত করে। এই মূলনীতি আমাদের পরিচালিত করে সুখ দেয় এমন সব জিনিসের দিকে, যেমন যৌনতা, চিজ বার্গার এবং দূরে রাখে আনন্দ দেয়না এমন সবকিছু থেকে, যেমন কঠোর পরিশ্রম, বিরক্তিকর মানুষ ইত্যাদি। আমাদের এই জীবন পরিচালিত হয় শুধুমাত্র এই প্রবৃত্তির দ্বারা। আমরা যতই বৃদ্ধ হই, আমাদের অবচেতন একইভাবে কাজ করে, কারণ তাঁর মতে the unconscious is always infantile, অবচেতন সবসময়ই শিশুসুলভ। সমস্যাটি হচ্ছে, ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন, আমরা যতই বড় হতে থাকি আমরা শুধুমাত্র আর এই প্লেজার প্রিন্সিপাল অনুসরণ করে চলতে পারিনা, কারণ এটি তাহলে আমাদেরকে ভয়ংকর অদ্ভুত সব কাজ করাবে, যেমন নিজেদের পরিবারের কারো সাথে সঙ্গম করা, অন্য মানুষের খাওয়া চুরি করা, সেই মানুষগুলোকে হত্যা করা যারা কিনা আমাদের বিরক্ত করে। আমাদের তখন খেয়াল রাখতে হয় reality principle-এর। আদর্শভাবে, রিয়েলিটি প্রিন্সিপাল দাবির সাথে আমরা খাপ খাইয়ে নিই উপযোগী গঠনমূলক উপায়ে: ‘ক্ষণিকের কোনো আনন্দ, এর পরিণতিতে অনিশ্চিত, বিসর্জন দেয়া হয় কিন্তু এর সাথেই আমরা পাই ভবিষ্যতের কোনো সময়ের জন্য সুনিশ্চিত আনন্দ।’ বহু ধর্ম, শিক্ষা আর বিজ্ঞানের এটাই মূলনীতির ভিত্তি: আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি, স্বল্পমেয়াদি সুখ আমরা পরিত্যাগ করি অনেক বড় (এবং সাধারণত আরো বেশি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য) আনন্দের জন্য যা আমরা পরে পাব বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু ফ্রয়েড তাঁর পেশায় লক্ষ্য করেছিলেন, আমাদের প্রায় সবাই বিষয়টি নিয়ে সংগ্রাম করছি। তিনি বিশ্বাস করতেন বাস্তবতার এই সমঝোতার ভালো আর খারাপ উপায় আছে, সমস্যাপূর্ণগুলোকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন নিউরোসিস হিসাবে। নিউরোসিসের ক্ষেত্রে সুখ খোঁজার তাড়নাটিকে বা প্লেজার প্রিন্সিপালকে আমরা একপাশে সরিয়ে রাখি বা অবদমিত করে রাখি, কিন্তু এর বিনিময়ে আমাদের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আমরা অসুখী হই অথবা এক অর্থে পাগল হয়ে যাই, কিন্তু আমরা আমাদের সমস্যার উপসর্গগুলো বুঝি না। যেমন, আমরা হয়তো সংগ্রাম করি মানুষের প্রতি আমাদের আকর্ষণকে অবদমিত করার জন্য যারা আমাদের সঙ্গী না। তবে সরাসরিভাবে এই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বড়ই কষ্টকর, সুতরাং আমরা সচেতনভাবে সেটি অবদমিত করে রাখি। ফলে, আমরা আমাদের সঙ্গী সম্বন্ধে ঈর্ষা আর সন্দেহের শিকার হই এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি তারা আমাদের সাথে প্রতারণা করছে। এটি আমাদের সত্যিকারের চিন্তার একটি প্রজেকশন। এটি আমাদের এদিক-সেদিক চোখ দিয়ে তাকানোর অপরাধবোধকে খানিকটা প্রশমন করে। কিন্তু এটি আমাদের পাগল করেও দিতে পারে। এটি আমরা যে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছি তার প্রতি খাপ খাইয়ে নেয়ার একটি কৌশল, অবশ্যই তবে আসলেই এটি তেমন ভালো কৌশল নয়।

ফ্রয়েড মনে করতেন, নানা ধরনের নিউরোসিসে পূর্ণ আমাদের জীবন, যার কারণ আমাদের ইদ ও ইগোর মধ্যে দ্বন্দ্ব। ইদ (id), প্লেজার প্রিন্সিপাল দিয়ে যা পরিচালিত এবং ইগো (ego), যা যৌক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আমরা কী করব ‘ইদ’-এর তাড়নাগুলো নিয়ে। অন্যসময় নিউরোসিসের সূচনা হয় ইগো আর সুপার ইগোর (Super Ego) দ্বন্দ্বে, যা আমাদের নৈতিকতার দিক। আর এদের সম্পর্কগুলো বুঝতে সাধারণত আমাদের যেতে হবে আমাদের জীবনের অতীতের সেই সময়ে, যা আমাদের বহু নিউরোসিসের জন্ম দিয়েছিল। বাস্তবতার (তাঁর রিয়েলিটি প্রিন্সিপাল) সাথে নানাভাবে খাপ খাইয়ে নিতে সত্যিকারের উপযোগী সময়টি হচ্ছে শৈশব, ভালো কিংবা খারাপ যাই হোক না কেন। শিশু অবস্থায়, আমাদের আবির্ভাব হয় একেবারে আদিম আর নীতিহীন কামনাগুলো নিয়ে, যখন আমরা প্রতিপালিত হই, আমরা সভ্য হয়ে উঠি, সামাজিক বাস্তবতার সাথে আমরা সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠি। আমরা যদি ঠিকমতো খাপ খাইয়ে নিতে পারি, সমস্যার সূচনা হয়। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাসে প্রথম যে পর্বটি আসে, ফ্রয়েড তার নাম দিয়েছিলেন ওরাল ফেজ oral phase. যেখানে আমরা মূলত ব্যস্ত খাওয়া ও সেই সংক্রান্ত সব অনুভূতিগুলো নিয়ে। যখনই ইচ্ছা হয় তখনই মায়ের বুকের দুধ পান করার তাড়না নিয়ে আমাদের জন্ম হয়। কিন্তু সময়ের সাথে আমাদের সেই অভ্যাসটি পরিত্যাগ করতে হয়। আমাদের জন্য সেটি বেশ কঠিন। যদি আমাদের বাবা-মা সতর্ক না হন (অথবা আরো খারাপ তারা যদি খানিকটা স্যাডিস্ট বা ধর্ষকামী হয়ে থাকেন), আমরা নানাধরনের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারি, যেমন নিজের ভিতরে আত্তীকৃত আত্মবঞ্চনা, নিজেদেরকে শান্ত করার জন্যে খাদ্যের ব্যবহার অথবা স্তনের প্রতি শত্রুভাবাপন্নতা নিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমরা আমাদের নির্ভরশীলতা নিয়ে সংগ্রাম করি। যদি আমাদের মা বেশি দেরি করেন, আমরা হয়তো বড় হতে পারি বেশি চাহিদাপূর্ণ হয়ে, এবং আমরা অবাক হই যখন বাইরের পৃথিবী আমাদের সেই চাহিদায় সাড়া দেয় না। অথবা অন্য কারো উপর ভরসা করতে অবিশ্বাস করা শিখতে পারি পুরোপুরিভাবে। এর পরে আসে অ্যানাল ফেজ (Anal phase সাধারণত যা পরিচিত potty-training হিসাবে), যেখানে আমরা মলত্যাগ করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করি। আমাদের বাবা-মা আমাদের বলেন, কী করতে হবে, কখন যেতে হবে, তারা আমাদের বলেন কীভাবে ভালো হতে হবে। এই পর্যায়ে আমরা কর্তৃত্বের সীমানা কতটুকু সেটি পরীক্ষা করতে শুরু করি। যেমন আমরা হয়তো বিরুদ্ধাচরণ করে কোনোকিছু মানতে অস্বীকার করতে পারি। তাহলে আমরা হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক হলে anally retentive হতে পারি এবং অতিমাত্রায় পরিষ্কার পরিছন্ন প্রীতিসহ। আমরা হয়তো টাকাপয়সা খরচ করার ব্যাপারেও বেশি সতর্ক হই। বিকল্পভাবে যদি আমাদের বাবা-মা বেশি সহনশীল ও উদার হন, আমরা হয়তো কর্তৃত্ব ও অন্য মানুষের সীমানা কতটুকু তা প্রায়শই পরীক্ষা করে দেখতে পারি, এটি আমাদের শৈশবে আমাদের শুধু বেশি উচ্ছৃঙ্খলই করেনা, এছাড়া বড় হলে অপচয়কারী আর স্বার্থপরও হয়ে উঠি।

ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন কীভাবে আমাদের পিতামাতা প্রতিক্রিয়া দেখান সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি আমাদের লজ্জা দেয় যখন আমরা তাদের নিয়ম মানতে ব্যর্থ হই, আমরা পরবর্তীতে নানাধরনের ভয় আর চিন্তায় আক্রান্ত হই। কিন্তু একই সাথে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ আর সীমানাও আমাদের শেখার দরকার। সংক্ষেপে এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের নিজেদের সুখ খোঁজার প্রচেষ্টা আর আমাদের উপর বাবা-মার করা দাবির মধ্যে সংঘর্ষটিকে মোকাবেলা করার জন্য। এইসব দাবির প্রতি আমাদের সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হবে নয়তো নানা সমস্যা নিয়ে আমাদের বড় হতে হবে। এর পরে আসে ফ্যালিক ফেস (phallic phase- প্রায় ৬ বছর অবধি), যখন আমরা জননাঙ্গের চাহিদা আর নতুনভাবে আবিভূত হওয়া অসম্ভব যৌনতাড়না মোকাবেলা করি। স্পষ্টতই ফ্রয়েড তার সমসাময়িকদের হতবাক করে দিয়েছিলেন ছোট শিশুদের যৌনতা আছে এমন ধারণা প্রস্তাব করে: তাদের যৌনতাড়না আছে, তাদের লিঙ্গোত্থান হয়, তারা হস্তমৈথুন করে, তারা চায় বিভিন্ন জিনিসের কিংবা মানুষের সাথে নিজেদের ঘষতে (হ্যাঁ এখনও ফ্রয়েডে এমন প্রস্তাবনাগুলো এখনও মানুষকে বিব্রত করে), ফ্রয়েডের সময়, এই শিশুদের প্রতি সহিংস আচরণের দ্বারাই এইসব করতে নিষেধ করা হতো, এখন আমরা তাদের নম্রভাবে বলি। কিন্তু মূল বিষয় একটি, আমরা শিশুদের যৌনতাকে অনুমতি দিতে পারিনা। আর শিশুর জন্য, এর অর্থ হচ্ছে তাদের তরুণ সত্তার একটি শক্তিশালী অংশকে অবদমিত করে রাখা হয়।

এটি এমনকি আরো বেশি জটিল, কারণ শিশুরা তাদের যৌনতাড়না পরিচালিত করে তাদের পিতামাতার প্রতি। ফ্রয়েড যাকে বলেছিলেন ইডিপাস কমপ্লেক্স, যেখানে আমাদের সবারই অবচেতন মনে বাবা-মার যে-কোনো একজনকে ভালোবাসা ও অন্যজনকে ঘৃণা করার প্রবণতা আছে। শুনতে খুবই বিস্ময়কর, কিন্তু এটি জানাও গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুরু হয় এভাবে: শৈশবে, আমরা প্রায় সবাই খুব বেশি যুক্ত থাকি আমাদের মায়েদের সাথে, বাস্তবিকভাবে ফ্রয়েড বলেন ছোট ছেলেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের আদিম যৌনতাড়নাগুলো পরিচালিত করে তাদের দিকে। কিন্তু যতই সে তাকে ভালোবাসুক না কেন, মায়েদের সবসময়ই অন্য আরেকটি জীবন আছে। সম্ভবত তার আরেকটি সম্পর্ক আছে (খুব সম্ভবত সেটি আমাদের বাবার সাথে) অথবা যদি তা নয়, তার অন্যকিছু অগ্রাধিকার আমাদের মাঝে মাঝেই হতাশ করে, শিশু হিসাবে পরিত্যক্ত হবার অনুভূতির জন্ম দেয়। এটি তাদের সেই শিশুসত্তাকে ঈর্ষান্বিত ও ক্ষুব্ধ করে। কোনো ছোট পুরুষশিশু বিশেষভাবে ঘৃণা অনুভব করে সেই ব্যক্তির প্রতি যে তার মাকে নিয়ে যায়, এবং একই সাথে ভয় পায় সেই মানুষটি তাকে হত্যা করবে বলে। এই পুরো জটিলতাটি ইতিমধ্যে ছোট শিশুর মনে প্রচুর পরিমাণে চিন্তারসৃষ্টি করে। ( ফ্রয়েডের দৃষ্টিতে, ছোট মেয়েরাও এই সমস্যা থেকে মুক্তি পায় না, তাদেরও খানিকটা ভিন্নধরনের জটিলতা আছে)। এরপর আসে আসল সত্যিকারের অজাচার বা ইনসেস্টের সমস্যাগুলো। প্রাপ্তবয়স্কদের উচিত না শিশুদের সাথে যৌনসঙ্গম করা, এটি খুবই গুরুতর একটি বিষয় ইনসেস্ট ট্যাবু বা প্রতিষিদ্ধতা, যার উপর সমাজ নির্ভর করে। আমাদের এমন কারো সাথে যৌনসঙ্গম করা উচিত না যারা আমাদের আত্মীয়। কিন্তু এমনকি যদি আমরা সবাই দাবি করি, আমরা ভয়ানকভাবে শঙ্কিত হই এমন কিছুর দ্বারা, যেন ইনসেস্ট-এর আমাদের মনে কোনো জায়গা নেই, ফ্রয়েড আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, কোনোকিছুকে প্রতিষিদ্ধ বা ট্যাবু হিসাবে চিহ্নিত করা হয় না যদি-না বহু মানুষ সেই ট্যাবু ভাঙার ব্যাপারে আগ্রহী হয় তাদের অবচেতনে। এটাই ব্যাখ্যা করে ইনসেস্ট আর শিশুদের সাথে যৌনতা ঘিরে এত হিস্টেরিয়া, এই ধারণা আমাদের মনের কোথাও গোপনে লুকিয়ে থাকে।

পরিবারের মধ্যে যৌনতা ঠেকাতে শিশুকে মা অথবা বাবার সাথে যৌনতার ইচ্ছাকে ধীরে ধীরে সরিয়ে আনতে হবে, মা বা বাবাকে অবশ্যই দয়ালু হতে হবে এবং তাদেরকে কিছুতেই অপরাধবোধে ভুগতে দেবেন না যৌনবিষয়ে। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই অনেক বড় ভুল হতে পারে। আমরা প্রায় সবাই আমাদের বাবা-মার কাছ থেকে যৌন সংশয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করি, যার সাথে পরে আমরা ভালোবাসার ধারণাটি যুক্ত করি। বাবা-মা দুজনে আমাদের ভালোবাসা দেন, কিন্তু তার সাথে তারা মিশিয়ে দেন নানা ধরনের সমস্যামূলক আচরণ। তারপরও যেহেতু আমরা তাদের ভালোবাসি আর তাদের উপর নির্ভর করি, আমরা তাদের প্রতি অনুগত থাকি, এবং তাদের ধ্বংসাত্মক আচরণের প্যাটার্নের প্রতিও। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ, যদি আমাদের মা শীতল হন আর আমাদের ছোট করার উদ্দেশ্যে কোনো মন্তব্য করে থাকেন প্রায়শই, তারপরও আমরা দক্ষ তার প্রতি টান অনুভব করার জন্য অথবা এমনকি তাকে খুবই ভালো মনে করার জন্য। ফলাফলে আমাদেরও সম্ভাবনা থাকে ভালোবাসার সাথে শীতলতার অনুভূতি সংযুক্ত করার। ফ্রয়েড মনে করতেন প্রাপ্তবয়ষ্ক হবার পর আদর্শ পরিস্থিতিতে কোনো সমস্যা ছাড়াই আমাদের শারীরিকভাবে মিলিত হতে পারার কথা এবং একপর্যায়ে ভালোবাসা আর যৌনতাকে যুক্ত করতে পারি এমন কারো সাথে যারা আমাদের প্রতি দয়ালু। অবশ্যই এটি কদাচিৎ ঘটে। সাধারণত যা ঘটে তা হলো আমরা যৌনতা আর ভালোবাসাকে যুক্ত করতে পারি না। আমাদের একটি ধারণা আছে যৌনতা কোমল কোনো অনুভূতির সাথে সংযুক্ত নয়। ফ্রয়েড যেমন বলেছিলেন, ‘এই ধরনের কোনো পুরুষ আবেগময় উৎসাহ দেখায় সেই রমণীদের প্রতি যাদের সে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তারা তাকে যৌনকামনায় তাড়িত করেনা।’ ফ্রয়েড মনে করেন, ‘সেই পুরুষটি সেইসব রমণীর সাথে মিলনে সক্ষম হয় যাদের সে ভালোবাসে না বরং তাদের শ্রদ্ধাও করে না, এমনকি ঘৃণা করে।’ ফ্রয়েড ইন্টিমেসি বা অন্তরঙ্গতা-সংক্রান্ত আমাদের প্রায়শই অনুভূত সমস্যাগুলো তুলনা করেছিলেন শীতের দিনে হেজহগ বা সজারুর সাথে, তাদেরকে উষ্ণতার জন্য কাছাকাছি আসতে হবে, কিন্তু তারা খুব কাছে আসতে পারবে না, কারণ তাদের গায়ে বেশ কাঁটা আছে। তিনি এই তুলনাটি পেয়েছিলেন আরেকজন মহান দার্শনিকের কাছ থেকে, শোপেনহাউয়ার।

নিউরোসিস শুধুমাত্র কোনো একক ব্যক্তির মধ্যেই সৃষ্টি হয় না, পুরো সমাজ আমাদের নিউরোটিক করে রাখে। তার বই Civilisation and its Discontents- এ ফ্রয়েড লিখেছিলেন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অবদমন আর মনস্তাত্ত্বিক বৈকল্য হচ্ছে শুধুমাত্র সমাজে বাস করার মূল্য। সমাজ যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করে, ইনসেস্ট ট্যাবু আরোপ করে, আমাদের তাৎক্ষণিক ইচ্ছাগুলো সরিয়ে রাখতে বলে, দাবি করে আমাদের অবশ্যই কর্তৃত্বকে মানতে হবে, কাজ করে টাকা উপার্জন করতে হবে। অবদমন করেনা এমন সভ্যতার ধারণা আসলে পরস্পরবিরোধী। ফ্রয়েড নিউরোসিসে নিরাময় আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন: সাইকোঅ্যানালাইসিস। কিন্তু শুরু থেকে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আরোপ করেছিলেন তিনি। তিনি মনে করতেন এই চিকিৎসা পেতে হলে রোগীদের বয়স হতে হবে পঞ্চাশের নিচে, কারণ তিনি মনে করতেন এর চেয়ে বেশি বয়সে মানুষের মন অনমনীয় হয়ে যায় বলে এবং বেশ ব্যয়বহুল ছিল সেই চিকিৎসা, কারণ তিনি আশা করতেন তার রোগীরা তার চেম্বারে সপ্তাহে মোট চারবার আসবে। আর চিকিৎসার ফলাফল নিয়ে তিনি খুব আশাবাদীও ছিলেন না, তিনি বিশ্বাস করতেন অতিমাত্রায় অসুবিধা সৃষ্টিকারী দুঃখবোধ আর যন্ত্রণাগুলোকে শুধুমাত্র প্রাত্যহিক সহনযোগ্য কষ্টে রূপান্ত রিত করা সম্ভব হতে পারে। যাই হোক, তিনি ভেবেছিলেন, কিছুটা সঠিক বিশ্লেষণের ফলে মানুষ তাদের নিউরোসিসের কারণগুলো অন্তত খুঁজে পাবে, এবং সেই বাস্তবতার কঠিন পরিস্থিতির সাথে অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে তাদের নিজেদের জীবন খাপ খাইয়ে নেবে।

মনোবিশ্লেষণের সময় ফ্রয়েড যে বিষয়গুলোতে নজর দিতেন:

স্বপ্ন : ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন সচেতন থাকাকালীন নানা সমস্যা থেকে আমাদের শিথিল হবার জন্যে ঘুম বিশেষ সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে সেই অভিজ্ঞতাগুলোর প্রতি যাদের তিনি বলেছিলেন wish-fulfilment, ইচ্ছাপূরণ। প্রথমে বিষয়টি খুব স্পষ্ট নাও হতে পারে। যেমন, আমরা যদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবার স্বপ্ন দেখি, এর কারণ আমরা হয়তো ভাবতে পারি আমরা কাজে খুব চাপে আছি। কিন্তু ফ্ৰয়েড আমাদের বলেন আমরা আসলে এই ধরনের স্বপ্ন দেখি, কারণ আমাদের মনের একটি অংশ চায় আমরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হই, এবং প্রাপ্তবয়স্ক হবার সব দায়িত্ব যেন আমাদের না বহন করতে হয়। অবশ্যই ফ্রয়েড মনে করতেন আমরা অন্য ধরনেরও wish-fulfilment স্বপ্নও দেখি, যেমন আমরা কোনো আকর্ষণী সহকর্মীদের সাথে মিলিত হবার স্বপ্ন দেখতে পারি, যাকে দিনের বেলায় হয়তো কখনোই পছন্দ করিনা। একবার যখন আমরা জেগে উঠি, আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়, সুপার ইগোর নৈতিকতাবাদী নির্দেশ মেনে। সেকারণে নানাধরনের উত্তেজনাপূর্ণ স্বপ্নগুলো আমরা দ্রুত ভুলে যাই।

প্যারাপ্রাক্সিস : ফ্রয়েড ভালোবাসতেন লক্ষ্য করতে কীভাবে তার রোগীরা শব্দ ব্যবহার করে কথা বলার সময়। তিনি ভাবতেন বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন তাদের সেই slip of the tongue হয় বা প্যারাপ্রাক্সিস। আমরা এখন এইসব উন্মোচনকারী ভুলগুলোকে বলি Freudian slips। যেমন ফ্রয়েড এক ব্যক্তির কথা লিখেছিলেন যিনি তার স্ত্রীকে আমেরিকায় চলে আসার জন্য চিঠি লিখেছিলেন (যে স্ত্রীকে তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না), ভদ্রলোক বোঝাতে চেয়েছিলেন সে যেন Mauretania জাহাজটি নেয়, কিন্তু বাস্তবিকভাবে তিনি লিখেছিলেন তার চিঠিতে, তার আসার জন্য Lusitania জাহাজটি বেছে নিতে, যে জাহাজটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে ডুবে গিয়েছিল, মৃত্যু হয়েছিল সব যাত্রীর।

হাস্যরস: ফ্রয়েড ভাবতেন যে হাস্যরস হচ্ছে psychological survival mechanism, তার Jokes and their Relation to the Unconscious বইটিতে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, হাস্যরস কোনো একটি প্রবৃত্তির সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারে (সেটি সহিংস কিংবা কামনা আর্দ্র, যাই হোক না কেন) যখন কিনা সেটি পূর্ণ করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। সংক্ষেপে, হাস্যরস, স্বপ্নের মতোই আমাদের কর্তৃত্ব আর নিয়ন্ত্রণকে পাশ কাটিয়ে যেতে ও ইচ্ছাপূরণে সহায়তা করে।

১৯৩৩ সালে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসলে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘কী প্রগতিই না আমরা অর্জন করেছি, মধ্যযুগে তারা হয়তো আমাকে পুড়িয়ে মারত, ইদানীং তারা আমার বই পুড়িয়ে সন্তুষ্ট।’ কিছু মানুষের সহায়তায় তিনি (যার মধ্যে একজন সহমর্মী নাৎসি-অফিসারও ছিলেন) সপরিবারে লন্ডনে আসেন। বাকি জীবন তিনি লন্ডনেই ছিলেন, যেখানে ১৯৩৯ সালে চোয়ালের ক্যান্সারে তিনি মারা যান।

ফ্রয়েডের পদাঙ্ক অনুসারে, অন্য মনোবিজ্ঞানীরাও নতুন সাইকোঅ্যানালাইসিস পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, এবং একসময় তা রূপ পেয়েছে বিশাল আর বৈচিত্র্যময় আধুনিক মনোচিকিৎসাবিদ্যায়। আধুনিক সব থেরাপির অধিকাংশই খুব ভিন্ন ফ্রয়েডের পদ্ধতির তুলনায়। কিন্তু এটি শুরু হয়েছিল মনের গভীরে অংশগুলো তার দ্বারা চিহ্নিত হবার মাধ্যমে। আমরা হয়তো ভাবতে পারি তাকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই, তার প্রস্তবনাগুলোও হাস্যকর। এমনকি আমরা প্ররোচিত হতে পারি ভাবতে যে পুরো বিষয়টি তিনি নিজের কল্পনায় সৃষ্টি করেছিলেন, আসলেই জীবনটা এত কঠিন না, তিনি যেমন দাবি করেছিলেন। কিন্তু যখনই কোনো সকালে ঘুম ভেঙ্গে অনুভব করি আমাদের মন ভরে আছে আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি ব্যাখ্যাতীত কোনো ক্রোধে, অথবা কাজে ছুটে যাওয়ার পথে পোষ-না-মানা গভীর দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠা আমাদের আক্রমণ করে… আমাদের স্মরণ করতে হয় আসলেই কতটাই কঠিন, পলায়নপর আর ফ্রয়েডীয় আমাদের মনের গঠনটি। অবশ্যই আমরা তাঁর কাজকে বর্জন করতে পারি এখন, কিন্তু যেমন ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘চাবিকে ঘৃণা করে কেউ কোনো দরজার তালা খুলতে পারেনি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *