1 of 2

অধ্যায় ৫০ : কম্পিউটার কি চিন্তা করতে পারে? – অ্যালান ট্যুরিং এবং জন সার্ল

অধ্যায় ৫০ : কম্পিউটার কি চিন্তা করতে পারে? – অ্যালান ট্যুরিং এবং জন সার্ল

আপনি একটি ঘরের মধ্যে বসে আছেন, সেই ঘরটির দরজার ভিতরে চিঠি ঢুকিয়ে দেবার জন্য একটি লেটারবক্স বা ছিদ্র আছে। আর সেই ছিদ্র দিয়ে মাঝে মাঝে আঁকাবাঁকা দাগের কিছু লেখাসহ কার্ড ভিতরে ঢুকে মেঝের উপর পড়ছে। আর আপনার কাজ হচ্ছে সেই কার্ডগুলোর আঁকাবাঁকা দাগটিকে ঘরের ভিতরে টেবিলের উপর রাখা একটি বইয়ের মধ্যে কোনো প্রতীকের সাথে জোড় করে মেলাতে হবে, মানে বইটির মধ্যে আপনাকে প্রথম সেই আঁকাবাঁকা দাগটা আগে খুঁজে বের করতে হবে, তারপর সেই প্রতীকটাকে খুঁজে দেখতে হবে এর সাথে যার জোড় বাঁধা আছে, তারপর ঘরে রাখা এক বাক্স কার্ড থেকে সেই কার্ডটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে যার উপরে বইয়ের জোড়বাঁধা সেই প্রতীকচিহ্নটি আছে, তারপর সতর্কতার সাথে সেই কার্ডের টুকরোটিকে দরজার চিঠি দেবার ছিদ্র দিয়ে আবার বাইরে ঠেলে দিতে হবে আপনাকে। ব্যস্ এটুকু। আপনি কাজটি কিছুক্ষণ ধরে করলেন এবং ভাবতে লাগলেন কী ঘটছে আসলে। এটাই চাইনিজ রুম (Chinese Room) থট এক্সপেরিমেন্ট বা চিন্তার পরীক্ষা, যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক জন সার্ল (জন্ম ১৯৩২)-এর একটি উদ্ভাবন। কাল্পনিক এই পরিস্থিতি তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন প্রদর্শন করতে যে, কম্পিউটার আসলেই চিন্তা করতে পারে না, এমনকি যদিও মনে হয় যে এটি চিন্তা করছে। আর এখানে কী ঘটছে সেটি বোঝার জন্য আপনার প্রথমে ট্যুরিং টেস্টটিকে (Turing Test) বোঝা দরকার।

অ্যালান ট্যুরিং (১৯১২-১৯৫৪) ছিলেন কেমব্রিজের অসাধারণ একজন গণিতজ্ঞ, আধুনিক কম্পিউটার উদ্ভাবনপ্রক্রিয়ায় যিনি সাহায্য করেছিলেন। তাঁর সংখ্যা নিয়ে কাজ করার যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের ব্রেচলি পার্কে, যে যন্ত্রটি জার্মান সাবমেরিন কম্যান্ডারদের ব্যবহৃত ‘এনিগমা’ কোডের সাংকেতিক অর্থ খুঁজে বের করেছিল। এরপর মিত্রবাহিনী নানা বার্তা গোপনে আড়ি পেতে সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল নাৎসিরা কী পরিকল্পনা করছে তার মর্মোদ্ধার করার জন্য। শুধুমাত্র সাংকেতিক ভাষা বা কোডের মর্মোদ্ধার না, কম্পিউটার একদিন অনেককিছু করবে এবং আসলে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ হবে এমন ধারণায় উৎসাহী হয়ে, ১৯৫০ সালে তিনি একটি টেস্ট প্রস্তাব করেন, যা এই ধরনের কম্পিউটারকে পাস করতে হবে, যদি দাবি করা হয় কম্পিউটারটি বুদ্ধিমান। এটাই পরে পরিচিত হয়েছিল ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য ট্যুরিং টেস্ট’ হিসাবে, কিন্তু মূলত তিনি এটির নাম দিয়েছিলেন; ইমিটেশন গেম; (Imitation Game)। এর উৎস ছিল তার বিশ্বাস যে আমাদের মগজের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দেীপক বৈশিষ্ট্য এটির ঘনত্ব যে ঠাণ্ডা পরিজের মতো বা এর রং ধূসর তা নয়। এবং মাথার খুলি থেকে এটিকে সরিয়ে আনলে এটি যেভাবে নড়াচড়া করে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটির কাজ। কম্পিউটার হয়তো শক্ত কোনো উপাদান আর ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হতে পারে, কিন্তু সেটি একটি মস্তি ষ্ক যা-কিছু করে তার অনেককিছু করতে পারে। কোনো মানুষ বুদ্ধিমান কিনা সেটি যখন আমরা বিচার করার চেষ্টা করি, তাদেরকে করা কিছু প্রশ্নের উত্তর তারা কীভাবে দিচ্ছেন তার উপর ভরসা করি। আমরা কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক খুলে দেখি না কীভাবে তাদের মাথার নিউরোন বা স্নায়ুকোষগুলো সংযুক্ত আছে। সুতরাং বিষয়টি নিরপেক্ষ হবে যখন আমরা কম্পিউটারদের পরীক্ষা করার সময়েও কীভাবে তাদের তৈরি করা হয়েছে সেটি না-দেখে বরং শুধু এর বাইরের প্রমাণটি দেখব। আমাদের দেখা উচিত হবে ইনপুট আর আউটপুট, রক্ত কিংবা স্নায়ু নয়, বা তার কিংবা ভেতরের সংযোগ আর ট্রানজিস্টরগুলোও না। এখানে ট্যুরিং যা প্রস্তাব করেছিলেন সেটি হচ্ছে এমন: একজন পরীক্ষক থাকবেন একটি ঘরে বসে, তিনি একটি কম্পিউটার পর্দায় টাইপ করে কোনো কথোপকথন লিখবেন, সেই পরীক্ষক জানেন না তিনি কি অন্য ঘরে বসে থাকা কোনো মানুষের সাথে কম্পিউটারের পর্দায় কথা বলছেন, নাকি তার প্রশ্নের বিপরীতে কম্পিউটার তার উত্তর নিজে নিজেই তৈরি করছে। এই কথোপকথনের সময় পরীক্ষক যদি নিজে বলতে না পারেন কোনো ব্যক্তি বা মানুষতার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে কিনা, সেই কম্পিউটার তাহলে ট্যুরিং টেস্টে উত্তীর্ণ হয়েছে। যদি কোনো কম্পিউটার সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাহলে যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা যাবে এটি বুদ্ধিমান, শুধুমাত্র রূপকার্থে না, যেভাবে কোনো মানুষ বুদ্ধিমান হতে পারে ঠিক সেই অর্থেই বুদ্ধিমান।

আর সার্লের ‘চাইনিজ রুম’ চিন্তার পরীক্ষাটি যা বলছে, আঁকাবাঁকা দাগসহ কার্ডের দৃশ্যটি, সেটি হচ্ছে দেখানো যে এমনকি যদিও কোনো কম্পিউটার ট্যুরিং টেস্ট পাস করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়, সেটি কিন্তু প্রমাণ করবে না যে এটি আসলেই কী করছে সেটি বুঝতে পারছে। মনে করে দেখুন আপনি সেই ঘরে বসে, অদ্ভুত সব প্রতীক লেটারবক্সের মধ্যে দিয়ে ঘরের মধ্যে আসছে আর আপনি পরিচালিত হচ্ছেন একটি রুলবুক বা নিয়মের বই দ্বারা। আপনার জন্য এটি অর্থহীন কাজ এবং আপনার কোনো ধারণা নেই যে আপনি কী এবং কেন কাজটি করছেন, কিন্তু কোনোকিছু অনুধাবন না করেই, আপনি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন চিনা ভাষায়। কিন্তু আপনি শুধু ইংরেজিতেই কথা বলতে পারেন, এবং চিনা ভাষা আপনার জানা নেই। কিন্তু যে-চিহ্নগুলো ভিতরে আসছে সেগুলো চিনা ভাষায় লেখা প্রশ্ন, আর যে প্রতীকসহ কার্ডগুলো আপনি তাকে ফেরত দিচ্ছেন নিয়মের বইটির সাথে মিলিয়ে সেগুলো সেই প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তর। আপনিসহ এই চাইনিজ রুমটি ট্যুরিং-এর ইমিটেশন গেমে জয়লাভ করবে। আপনি এমনভাবে উত্তর দিয়ে যাবেন যে সেটি বাইরের লোকটিকে বোকা বানাবে এমন ভাবিয়ে যে, আপনি আসলেই বুঝতে পারছেন আপনি কী বলছেন। সুতরাং এটি প্রস্তাব করছে একটি কম্পিউটার যা ট্যুরিং টেস্ট পাস করে, সেটি আসলে বুদ্ধিমান নয়, কারণ রুমের ভিতর থেকে আপনার কোনো ধারণা নেই কী বিষয়ে কথা বা আলোচনা হচ্ছে।

সার্ল ভাবতেন, কম্পিউটার হচ্ছে এমন কেউ যে চাইনিজ রুমে বসে আছে: তাদের আসলে বুদ্ধিমত্তা নেই এবং তারা চিন্তাও করতে পারে না। তারা যা করে, সেটি হলো নিয়ম মেনে প্রতীকগুলো মেলায়, যা তাদের নির্মাতারা তাদের মধ্যে প্রোগ্রাম করে দিয়েছেন। যে প্রক্রিয়াটি তারা ব্যবহার করে সেগুলো সফটওয়্যারের মধ্যে নির্দিষ্ট করা থাকে। কিন্তু সেটি খুবই ভিন্ন কোনোকিছু বোঝা অথবা সত্যিকারের কোনো বুদ্ধিমত্তা থাকার চেয়ে। অন্যভাবে বিষয়টি বলা যেতে পারে: যে মানুষগুলো কম্পিউটার প্রোগ্রাম করেন তারা একটিকে একটি সিনট্যাক্স দেয়; তার মানে তারা কিছু নিয়ম বেঁধে দেয় সঠিক কী অনুক্রমে প্রতীকগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে হবে, কিন্তু তারা কোনো সেমানটিকস তাদের দেয়না, অর্থাৎ তারা এই প্রতীকগুলোর অর্থ দেয় না। মানুষ যখন কথা বলে তারা কিছু বোঝাতে চায়, তার চিন্তাগুলো নানাভাবে পৃথিবীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। কম্পিউটার যা মনে হয় কিছু বোঝাচ্ছে সেটি শুধুমাত্র মানবচিন্তাকে অনুকরণ করছে, কিছুটা কোনো তোতাপাখির মতো। যদিও তোতাপাখি মানুষের কথা অনুকরণ করতে পারে, এটি কখনোই আসলে বুঝতে পারেনা শব্দগুলো দিয়ে কী বোঝাচ্ছে। একইভাবে, সার্লের মতে কম্পিউটারও আসলে বুঝতে পারে না বা কোনোকিছু নিয়ে চিন্তাও করতে পারেনা। আপনি সেমানটিকস পাবেন না শুধুমাত্র সিনট্যাক্স থেকে। সার্লের এই চিন্তার পরীক্ষাটির একটি সমালোচনা ছিল যে, এটি শুধুমাত্র সেই ঘরে বসে থাকা মানুষটি কী ঘটছে সেটি বুঝতে পারছে কিনা সেই প্রশ্নটির দিকে নজর দিয়েছে। কিন্তু এটি ভুল। মানুষটি পুরো সিস্টেমের শুধুমাত্র একটি অংশ। এমনকি যদি সেই মানুষটি নাও বুঝতে পারে কী ঘটছে, হয়তো পুরো সিস্টেম (যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ঘর, কোডবুক, প্রতীক ইত্যাদি) বিষয়টি বুঝতে পারছে। এই অভিযোগের উত্তরে সার্ল তার চিন্তার পরীক্ষাটির খানিকটা পরিবর্তন করেছিলেন, ঘরে একটি ব্যক্তিকে কল্পনা করে, যে-কিনা প্রতীকগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, কল্পনা করুন এই মানুষটি পুরো নিয়মের বইটি মুখস্থ করেছে, এবং তারপর বাইরের একটি মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে সঠিক প্রতীকসহ কার্ড হস্তান্তর করছে। তখনও এই ব্যক্তিটি বুঝবেনা প্রতিটি প্রশ্ন আসলে কী বোঝাচ্ছে, এমনকি যখন চিনা ভাষায় তাকে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর সে দিচ্ছে। সুতরাং বোঝার ব্যাপারটি তাই শুধুমাত্র সঠিক উত্তর দেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

যদিও কিছু দার্শনিক, বিশ্বাস করেন যে, মানুষের মন হচ্ছে শুধুমাত্র একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মতো। তারা বিশ্বাস করেন যে কম্পিউটার সত্যিচিন্তা করতে পারে ও চিন্তা করে। যদি তারা সঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো একদিন মানুষের মস্তিষ্কগুলো থেকে মনকে কম্পিউটারে স্থানান্তর করা সম্ভব হতে পারে। যদি আপনার মন একটি প্রোগ্রাম হয়, তাহলে শুধুমাত্র আপনার মাথার খুলির মধ্যে থাকা আর্দ্র মগজে এটি চলছে মানে এই না যে ভবিষ্যতে কোনো সময় এটি কোনো বিশাল চকচকে কম্পিউটারে চলতে পারবে না। যদি, অতি- বুদ্ধিমান সুপার কম্পিউটারের সহায়তায়, কেউ ম্যাপ করতে সক্ষম হয় হাজার কোটি সংযোগকে, যা দিয়ে আপনার মন তৈরি, তাহলে হয়তো একদিন মৃত্যুর পরও আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। আপনার মনকে কোনো একটি কম্পিউটারে আপলোড করা যেতে পারে যেন আপনার শরীরকে কবরে সমাহিত বা দাহ করার অনেক পরেও সেটি তার কাজ করা অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু সেটি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আদৌ কোনো ভালো উপায় কিনা সেটি আরেকটি প্রশ্ন। যদি সার্ল সঠিক হয়ে থাকেন, কোনো নিশ্চয়তা নেই যে এই আপলোড করা মন আপনি এখন ঠিক যেমন, ঠিক সেভাবে সচেতনতা ধারণ করবে, এমনকি যখন সেটি এমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, যে দেখে মনে পারে সেটি সচেতন।

ষাট বছর আগে লেখার সময় ট্যুরিং অবশ্য বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে একদিন কম্পিউটার সত্যিই চিন্তা করতে পারবে। যদি তিনি সঠিক হয়ে থাকেন, খুব বেশিদিন সময় নেই আমরা তাদের দর্শন নিয়ে ভাবতে দেখব। আমাদের মনকে মৃত্যুর পরও তারা বেঁচে থাকার সুযোগ দেবে এমন কিছু হবার চেয়ে বরং সেটি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমাদের কীভাবে বাঁচা উচিত বা বাস্তবতার প্রকৃতি সম্বন্ধে মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে হয়তো একদিন কম্পিউটারদের কৌতূহলোদ্দীপক কিছু বলার থাকবে, যে-প্রশ্নগুলো নিয়ে দার্শনিকরা ভাবছেন কয়েক হাজার বছর ধরে। যদিও, সেটি হবার আগে, রক্তমাংসের দার্শনিকদের উপর আমাদের নির্ভর করার প্রয়োজন আছে, যারা এই বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমাদের চিন্তাগুলোকে জটমুক্ত করতে পারবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *