1 of 2

অধ্যায় ২২ : কাল্পনিক ঘড়িনির্মাতা – ডেভিড হিউম

অধ্যায় ২২ : কাল্পনিক ঘড়িনির্মাতা – ডেভিড হিউম 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার যে-কোনো একটি চোখকে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখুন। এর একটি লেন্স আছে যা কোনো ইমেজ বা ছবিকে ফোকাস করতে পারে, একটি আইরিস বা পর্দা আছে যা আলোর তীব্রতার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, চোখের পর্দা আর পাপড়ি আছে একে রক্ষা করার জন্য। আপনি যদি অন্যদিকে তাকান আপনার চোখের কোটরের মধ্যে চোখটাও ঘুরে যায়, আর অবশ্যই দেখতেও খুব সুন্দর। কিন্তু কীভাবে এটি সৃষ্টি হলো? কোনো সন্দেহ নেই যে চোখ অসাধারণ একটি প্রকৌশলী অর্জন। কিন্তু কীভাবে শুধুমাত্র দৈবক্রমে বা ঘটনাচক্রে এমন কোনো একটি জিনিসের সৃষ্টি হয়েছিল? কল্পনা করুন পরিত্যক্ত কোনো দ্বীপের জঙ্গলের মধ্যদিয়ে আপনি হাঁটছেন, আপনি একটি প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের মুখোমুখি হলেন, যেখানে দেয়াল, দরজা, বারান্দা, উঠান আর সিঁড়ি আছে, আপনি জানেন যে কিছুতেই বিষয়টি হঠাৎ এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। কেউ নিশ্চয় এর পরিকল্পনা করেছে, কোনো একধরনের স্থপতি নিশ্চয়ই আছে। এভাবে রাস্তায় হাঁটতে বের হলে আপনি যদি একটা ঘড়ি খুঁজে পান, ভাবা খুবই যুক্তিসংগত হবে যে কোনো ঘড়িনির্মাতাই এটি বানিয়েছেন এবং বিশেষ কোনো একটি উদ্দেশ্যে এটি বানানো হয়েছে : সময় পরিমাপ করার জন্যে। ঘড়ির সব অসংখ্য ক্ষুদ্র লিভার, স্প্রিং আর কগহুইলগুলো নিজেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই কাজ করার জন্য নিজেদের সজ্জিত করতে পারেনা। কেউ নিশ্চয়ই আগে থেকে পুরো পরিকল্পনাটি ভেবেছে। এইসব উদাহরণই একটি বিষয় নির্দেশ করছে, যে জিনিসগুলো দেখলে মনে হয় তাদের ডিজাইন করা হয়েছে, প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যেতে পারে তাদের আসলেই ডিজাইন করা হয়েছে। 

বেশ, তাহলে প্রকৃতির দিকে তাকান: গাছ, ফুল, স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, পোকামাকড়, এমনকি অ্যামিবা। এসব কিছুও দেখলে মনে হয় তাদের ডিজাইন করে সৃষ্টি করা হয়েছে, জীবিত কোনো প্রাণী কোনো ঘড়ির চেয়ে অনেক বেশিমাত্রায় জটিল। স্তন্যপায়ীদের জটিল স্নায়ুতন্ত্র আছে, তাদের শরীরের রক্ত পাম্প করে পরিসঞ্চালন করতে হয় এবং তারা যেখানে বসবাস করে সেই পরিবেশের সাথে তারা সুঅভিযোজিত। সুতরাং নিশ্চয়ই কোনো একজন অবিশ্বাস্য শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই তাদের বানিয়েছেন, সেই সৃষ্টিকর্তা একজন স্বর্গীয় ঘড়িনির্মাতা বা স্বৰ্গীয় স্থপতি, অবশ্যই ঈশ্বর হবেন। অথবা, এটাই অষ্টাদশ শতকে বহু মানুষ ভাবতেন যখন ডেভিড হিউম লিখছিলেন, এখনও যা অনেকেই বিশ্বাস করেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে এই যুক্তি সাধারণত পরিচিত ডিজাইন আর্গুমেন্ট হিসাবে। সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতাব্দীর নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো দেখে মনে করা হতো সেগুলো এই বিষয়টিকে সমর্থন করছে। আণুবীক্ষণিক যন্ত্র পুকুরের ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণীকে দেখিয়েছে, দূরবীক্ষণ যন্ত্র মিল্কি ওয়ে এবং সৌরজগতের সৌন্দর্য এবং নিয়মমাফিকতা দেখিয়েছে। এই সবকিছু দেখলে মনে হয় তাদের নিখুঁত দক্ষতায় সাজানো হয়েছে। স্কটল্যান্ডের দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১-১৭৭৬) যুক্তিটি বিশ্বাস করতে পারেনি। জন লকের দর্শনে প্রভাবিত হিউম মানবতার প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন প্রথমত বিবেচনা করে যে, কীভাবে আমরা জ্ঞান অর্জন করি, যুক্তি ব্যবহার করে কোনোকিছু জানার সীমানাই বা কতটুকু। লকের মতোই তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান আসে পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতা থেকে, সুতরাং তিনি বিশেষভাবে কৌতূহলী ছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের জন্য একটি যুক্তির অনুসন্ধানে, যার সূচনা হয়েছিল বাস্তব পৃথিবীর কিছু বিষয় পর্যালোচনা করার মাধ্যমে। 

তিনি বিশ্বাস করতেন এই ডিজাইন প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আছে দুর্বল একটি যুক্তি। তাঁর Enquiry Concerning Human Understanding (১৭৪৮) বইয়ে একটি অধ্যায় ছিল যেখানে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য ডিজাইন যুক্তিকে আক্রমণ করেছিলেন। বইটি এই অধ্যায় এবং আরেকটি অধ্যায়ে, যেখানে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন কোনো অলৌকিক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষীকে বিশ্বাস করা কেন যুক্তিযুক্ত হবে না, অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। সেই সময় ব্রিটেনে প্রকাশ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন ছিল। এর পরিণতিতে তাঁর সময়ে সেরা দার্শনিক হয়েও হিউম কোনোদিনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করার চাকরি পাননি। তাঁর বন্ধুরাও তাকে ভালো উপদেশ দিয়েছিলেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে প্রস্তাবিত প্রচলিত যুক্তিগুলোর বিরুদ্ধে তার শক্তিশালী আক্রমণ সংক্রান্ত Dialogues Concerning Natural Religion (১৭৭৯) বইটি যেন তিনি তার মৃত্যুর আগে প্রকাশ না করেন। ডিজাইন আর্গুমেন্ট কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে? হিউম মনে করতেন, অবশ্যই না। এই যুক্তি যথেষ্ট পরিমাণ প্ৰমাণ দেয়না এমন কোনো উপসংহারে আসতে যে, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সবচেয়ে ভালো সত্তার অবশ্যই অস্তিত্ব থাকতে হবে। হিউমের দর্শন মূলত ঘনীভূত সেইসব প্রমাণের উপর, যা আমরা আমাদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে দিতে পারি। ডিজাইন আর্গুমেন্টের ভিত্তি হচ্ছে সেই বাস্তবতা যে মহাবিশ্বকে আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় ডিজাইন করা হয়েছে, কিন্তু হিউম প্রস্তাব করেন, শুধুমাত্র দেখলে এটিকে ডিজাইন করা হয়েছে বলে মনে হলেও কিন্তু এমন কোনো দাবি করা যায় না এটি সত্যি সত্যি ডিজাইন করা হয়েছে। এছাড়া এটা প্রমাণ করেনা যে ঈশ্বর হচ্ছেন সেই ডিজাইনার। কিন্তু কীভাবে তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন? 

হিউম আমাদের একটি চিন্তার পরীক্ষা করতে আহ্বান জানান। কল্পনা করুন একটি পর্দার পেছনে পুরোনো ফ্যাশনের ওজন মাপার যন্ত্র বা একটি দাঁড়িপাল্লা রাখা আছে। আপনি শুধু দুটি পাল্লার একটিকে দেখতে পাচ্ছেন। যদি দেখতে পান পাল্লাটি উপরে উঠছে, আপনি শুধু বলতে পারবেন যে অন্য পাল্লায় যাই থাকুক না কেন সেটা আপনি যেটা দেখতে পারছেন তার চেয়ে ভারী। আপনি আর কিছুই বলতে পারবেন না, যেমন এর রঙ কী, এটি ঘন নাকি গোলাকৃতির, এর উপরে কিছু লেখা আছে কিনা, অথবা এটি লোম দিয়ে ঢাকা, বা অন্য কোনো কিছু। 

এই উদাহরণে আমরা কজ (কারণ) আর ইফেক্টস (প্রভাব) নিয়ে ভাবছি। ‘কোন্ জিনিসটি পাল্লাটিকে উপরে টেনে তোলে?’ সেই প্রশ্নের উত্তরে আপনি যা বলতে পারবেন সেটি হচ্ছে, ‘এর কারণ হচ্ছে অন্য পাল্লায় নিশ্চয়ই ভারী কিছু আছে।’ এটাই কজ বা কারণ, আর আপনি দেখছেন ইফেক্ট বা পরিণতিটা, পাল্লাটা উপরে ওঠে। এখান থেকে কারণটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। কিন্তু আর কোনো প্রমাণ ছাড়া আপনি খুব বেশিকিছু আর বলতে পারবেননা। কারণ আপনি যা-কিছুই বলবেন তা বিশুদ্ধভাবে অনুমাননির্ভর ধারণা ছাড়া কিছু হবেনা। আর সেই ধারণাটি সত্য কিনা সেটি আমাদের পক্ষে বলার কোনো উপায় নেই যদি-না আমরা পর্দার পেছনে দেখতে পারি। হিউম মনে করতেন, চারপাশের পৃথিবী সম্বন্ধে আমাদের পরিস্থিতিও ঠিক একই রকম। আমরা বহুবিধ কারণের শুধু পরিণতিগুলো দেখছি, এবং সেইসব পরিণতিগুলো দেখে তাদের কারণগুলোর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছি। আমরা মানবচোখে দেখি, একটি গাছ, পর্বত,আর সেগুলো সব দেখলে মনে হয় তাদের ডিজাইন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য ডিজাইনার সম্বন্ধে আমরা আসলেই কি বলতে পারি? চোখ দেখলে মনে হবে যেন সেই চোখ-নির্মাতা ভালো করে ভেবেছেন কীভাবে এটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে সেটি বের করার জন্যে। কিন্তু এখান থেকে আমরা এই উপসংহারের আসতে পারব না যে, চোখ-নির্মাতাই হচ্ছেন ঈশ্বর। কেন পারব না? ঈশ্বরকে সাধারণত ভাবা হয় তিনটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা হিসাবে, যে ক্ষমতাগুলো ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি: তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বোত্তম। এমনকি যদি আপনি এমন কোনো উপসংহারে পৌঁছান যে খুব শক্তিশালী কোনো সত্তা মানবচোখ নির্মাণ করেছেন, আপনি কিন্তু কোনো প্রমাণ পাবেন না যে সেই সত্তা আসলেই সবচেয়ে ক্ষমতাবান। আমরা জানি চোখের ডিজাইনে বেশকিছু ত্রুটি আছে। এটি মাঝে মাঝে তার কাজ করতে পারে না, যেমন বহু মানুষের চশমার প্রয়োজন হয় ভালোভাবে দেখার জন্যে। তাহলে কি সবচেয়ে শক্তিশালী আর সর্বোত্তম কোনো ঈশ্বর শুধুমাত্র এভাবেই চোখের ডিজাইন করেছেন? সম্ভবত। কিন্তু চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা যে প্রমাণগুলো পাই সেগুলো কিন্তু সেই প্রস্তাবনাটিকে সমর্থন করছে না। বড়জোর এটি প্রদর্শন করতে পারে খুবই বুদ্ধিমান এবং খুবই শক্তিশালী ও দক্ষ কেউ এটি বানিয়েছেন। 

কিন্তু আসলেই কি এটি প্রদর্শন করছে তেমন কিছু? সম্ভাব্য অন্য ব্যাখ্যাও কিছু আছে। কীভাবে আমরা জানব যেহয়তো অপেক্ষাকৃত কম-শক্তিশালী দেবতাদের একটি দল সম্মিলিতভাবে চোখ ডিজাইন করেছেন? বেশিরভাগ জটিল যন্ত্রকে কর্মোপযোগী করে বানানোর জন্যে বেশকিছু মানুষের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ দালানই একদল নির্মাণকর্মী একসাথে কাজ করে সাধারণত তৈরি করেন। তাহলে চোখের ক্ষেত্রে কেন সেটি ভিন্ন হবে? অথবা আমাদের চোখ বানিয়েছিলেন খুবই পুরোনো কোনো দেবতা, যিনি আর বেঁচে নেই। অথবা খুব তরুণ ঈশ্বর যে-কিনা এখনও শিখছে কীভাবে ত্রুটিহীন চোখ ডিজাইন করা যেতে পারে। যেহেতু এইসব ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে কোনটা সঠিক সেটা বাছাই করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে নেই, সেকারণে শুধুমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারব না, আপাতদৃষ্টিতে ডিজাইন করা একটি বস্তু, অবশ্যই একক কোনো জীবিত ঈশ্বরের সৃষ্টি, যার সেই প্রস্তাবিত ক্ষমতাগুলো (সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বোত্তম) আছে। আপনি যদি এই বিষয়ে স্পষ্টভাবে চিন্তা করতেন, হিউম বিশ্বাস করতেন, খুব সীমিত একটি উপসংহারে পৌঁছাতে পারতেন। 

হিউম আরেকটি যুক্তিকে আক্রমণ করেছিলেন, সেটি ছিল অলৌকিক ঘটনাগুলো থেকে নিয়ে যুক্তি। অধিকাংশ ধর্মই দাবি করে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। মৃত মানুষকে জীবিত করা হয়েছে, পানির উপর হাঁটা অথবা কোনো অসুখ থেকে বিস্ময়করভাবে আরোগ্য লাভ করা, কোনো পাথরের বা কাঠের মূর্তির কথা বলা বা চোখের পানি ফেলা ইত্যাদি নানা ঘটনার দীর্ঘ তালিকা আছে। কিন্তু আমাদের কি বিশ্বাস করা উচিত এইসব অলৌকিক ঘটনা ঘটছে, কারণ অন্য মানুষরা বলেছে যে সেগুলো ঘটেছে? হিউম তেমন ভাবতেন না, খুবই সংশয় ছিল তার এই ধারণায়। যদি কেউ আপনাকে বলে যে একটা মানুষ অলৌকিকভাবে কোনো একটি অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করেছে, এর মানে কী হতে পারে? কোনোকিছু অলৌকিক বা মিরাকল হবার জন্য, ঘটনাটিকে অবশ্যই প্রাকৃতিক নিয়ম ভাঙতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়ম কিছুটা এরকম, ‘কেউই মরে গেলে আবার জীবিত হয়ে ফিরে আসে না’ বা ‘পাথরের মূর্তি কখনো কথা বলে না’ বা ‘কেউই পানির উপর হাঁটতে পারেনা’। আর এই প্রাকৃতিক নিয়মগুলো অবিশ্বাস্যরকম সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যদি কেউ অলৌকিক কোনো ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হিসাবে দাবি করে, কেন তাহলে আমাদের তাকে বিশ্বাস করা উচিত না? চিন্তা করুন আপনি কি বলতে পারেন, যদি আপনার বন্ধু এই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে আপনাকে বলে যে সে একজনকে পানির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখেছে? 

হিউমের দৃষ্টিভঙ্গিতে যা ঘটছে সবসময়েই তার বেশকিছু সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে। যদি আপনার বন্ধু বলে যে সে কাউকে পানির উপর দিয়ে হাঁটতে দেখেছে, সবসময়ই সম্ভাবনা আছে যে সে আপনার সাথে ছলনা করছে অথবা নিজেই দেখতে ভুল করেছে; সত্যিকারের কোনো অলৌকিক ঘটনা দেখার চেয়ে বরং এই বিকল্প ব্যাখ্যাগুলো সত্য হবার সম্ভাবনা বেশি। আমরা জানি কিছু মানুষ সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে ভালোবাসে, এবং সেই অবস্থানে পৌঁছাতে মিথ্যা বলতেও দ্বিধা করে না। সুতরাং এটাও একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা। কিন্তু আমরা আরো জানি যে-কোনো বিষয়ে আমরা সবাই কিন্তু ভুল করতে পারি। আমরা কী দেখলাম আর শুনলাম এই বিষয়েই হরহামেশাই ভুল করছি। মাঝে মাঝে আমরা বিশ্বাস করতে চাই আমরা অদ্ভুত কিছু দেখছি, যেন সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আমরা এড়াতে পারি। এমনকি আজও বহু মানুষই আছেন যারা রাতের বেলায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় এমন শব্দকে দাবি করেন অতিপ্রাকৃত কর্মকাণ্ড হিসাবে, যেমন ভূতের হাঁটাচলা, খুব সাধারণ কোনো ব্যাখ্যা, যেমন ইঁদুর কিংবা বাতাসকে বাদ দিয়ে। হিউম বলেছিলেন, একটি অলৌকিক ঘটনাকে সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণই যথেষ্ট নয়, যদি-না সেই প্রমাণ এমন ধরনের হয় যে এর অসত্যতা যে-ঘটনাটিকে এটি সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে তার চেয়ে আরো বেশি অলৌকিক হবে। 

যদিও তিনি ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যবহৃত যুক্তিগুলোকে নিয়মিত সমালোচনা করতেন, হিউম প্রকাশ্যে কখনোই ঘোষণা দেননি যে তিনি নিরীশ্বরবাদী। হয়তো তিনি তা ছিলেন না। তার প্রকাশিত দৃষ্টিভঙ্গি দেখলে মনে হতে পারে, তিনি হয়তো মহাবিশ্বের সবকিছুর পেছনে স্বর্গীয় কোনো বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব বিশ্বাস করতেন, শুধুমাত্র আমরা কখনোই এই স্বর্গীয় বুদ্ধিমত্তার গুণাবলি নিয়ে বেশিকিছু বলতে পারবনা। আমাদের যুক্তির ক্ষমতা, যখন যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করা হয়, ঈশ্বরের অবশ্যই আছে এমন গুণাবলি সম্বন্ধে সেটি আমাদের কোনো ধারণা দেয়না। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে বেশকিছু দার্শনিক ভাবতেন তিনি হলেন অ্যাগনিস্টক বা অজ্ঞেয়বাদী। কিন্তু সম্ভবত তার জীবনের শেষে তিনি অবিশ্বাসী ছিলেন, এমনকি যদিও এর আগে তিনি পুরোপুরি নাস্তিক হয়ে যাননি। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে, যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়, তার বন্ধুরা তার সাথে এডিনবরায় দেখা করতে এসেছিলেন এবং তিনি স্পষ্টভাবে তাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন মৃত্যুশয্যায় ধর্মান্ত রিত হবার কোনো ইচ্ছা তার নেই। এমনকি ধর্মভীরু জেমস বসওয়েল, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মৃত্যুর পর কী হবে সে-ব্যাপারে তিনি চিন্তিত কিনা। হিউম তাকে বলেছিলেন তিনি আদৌ এমন কোনো আশা করেন না যে মৃত্যুর পরও তার কোনো অংশের অস্তিত্ব টিকে থাকবে, এপিকিউরাস যেমন উত্তর দিতেন তিনি সেভাবে বলেছিলেন, মৃত্যুর পরের সময় নিয়ে তিনি, তার জন্মের আগের সময় নিয়ে যতটা ভাবেন তার চেয়ে বেশি চিন্তিত নন। হিউমের সমসাময়িক বেশকিছু অসাধারণ দার্শনিক ছিলেন, যারা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তাদের একজন ছিলেন জ্যা জাক রুসো, রাজনৈতিক দর্শনে যার অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

ডেভিড হিউম নিঃসন্দেহে অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দখল করে আছেন। তিনি মানবচরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করতে পেরেছিলেন : যুক্তি না বরং আবেগ দ্বারাই আমরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হই। এটি, একটি স্তরে আমাদের নিজস্ব ভাবমূর্তির জন্য বড় মাপের অপমান, কিন্তু হিউম ভেবেছিলেন বিষয়টিকে অস্বীকার না করে যদি আমরা এই বিস্ময়কর সত্যটাকে অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারি, আমরা (একক ও সমষ্টিগতভাবে) অনেক বেশি প্রশান্তি আর সুখ খুঁজে পাব। ১৭১১ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত তবে বিত্তবান নয় এমন একটি পরিবারে। পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি, অনেক আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাকে একটা কাজ খুঁজতে হবে, কিন্তু কোনো কাজই তার পছন্দের ছিল না। প্রথমে আইনজীবী হবার চেষ্টা করেছিলেন (তার বাবা ও বড়ভাইয়ের যেটি ছিল পেশা), কিন্তু দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে পেশাটি তার জন্যে উপযুক্ত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সুযোগ নেবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বুদ্ধিজীবী লেখক হবেন, এমন কেউ যিনি সাধারণ মানুষের কাছে বই বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করবেন। 

কাজটা সহজ ছিল না স্পষ্টতই। তাঁর প্রথম বই A Treatise of Human Nature, যে বইটা নিয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি আশা করেছিলেন, সেটি তেমন পাঠকপ্রিয়তা পায়নি, দুঃখ করে লিখেছিলেন, ‘এর আগে কোনো লেখার প্রচেষ্টা এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ছিলনা, প্রেস থেকেই মৃতশিশুর মতো এটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’ কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, তিনি মনে করেছিলেন এর কারণ সম্ভবত যেভাবে তিনি তার ধারণাগুলো প্রকাশ করছেন। নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তুললেন আরো সহজবোধ্য জনপ্রিয় ভাষা-ব্যবহারে। একপর্যায়ে তার পরিশ্রম সফল হয়েছিল, সেই সময়ের জনপ্রিয় বেশকিছু বই তিনি লিখেছিলেন। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি লিখেছিলেন: ‘বই বিক্রেতারা আমাকে যে টাকা দিয়েছেন, ইংল্যান্ডে ইতিপূর্বে অভূতপূর্ব। আমি শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নই, ধনীও।’ 

হিউমের দর্শনভাবনা গড়ে উঠেছিল একটি একক শক্তিশালী পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে: তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, মূল যে-বিষয়টি আমাদের জীবনে সঠিকভাবে অনুসরণ করা দরকার সেটি যৌক্তিকতা নয় বরং আমাদের অনুভূতি, আমরা কী অনুভব করছি। মনে হতে পারে খুব অদ্ভুত একটি উপসংহার। সাধারণত আমরা মনে করি আমাদের যা করা প্রয়োজন তা হলো আমাদের মনকে যতটা সম্ভব ততটাই যৌক্তিক করে প্রশিক্ষিত করে তোলা: প্রমাণ এবং যৌক্তিক প্রক্রিয়ার প্রতি একনিষ্ঠ থাকা, যেন আমাদের অনুভূতিগুলো কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। কিন্তু হিউম জোর দিয়েছিলেন যা-কিছুই আমাদের লক্ষ্য থাকুক- না কেন, যুক্তি হচ্ছে আমাদের তীব্রতম আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগেরই দাস (reason is the slave of passion), কোনো বিশ্লেষণ আর যুক্তি দ্বারা আমরা যতটুকু প্ররোচিত হই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে, তারচেয়ে অনেক বেশি প্রণোদনা জোগায় আমাদের অনুভূতিগুলো। আমাদের ধারণ করা প্রধানতম বিশ্বাসগুলো খুব কমই পরিচালিত হয় বাস্তব তথ্যের যৌক্তিক অনুসন্ধানের আলোকে। সিদ্ধান্তগুলো যেমন, কেউ প্রশংসা পাবার দাবি রাখে কিনা, আমাদের অবসর সময়ে আমরা কী করব, সফল পেশা বলতে কী বোঝায়, কাকে আমরা ভালোবাসব, এসবের ভিত্তিতে সবচেয়ে উপরে আছে অনুভূতি। যুক্তি আমাদের খুব কম সহায়তা করে, কিন্তু নির্ধারণী নিয়ামকগুলো সব জড়িত আমাদের আবেগীয় জীবনের সাথে, আমাদের তীব্রতম ইচ্ছার সাথে, হিউম যা মনে করতেন। 

হিউম জীবিত ছিলেন এমন একটি যুগে যাকে বলা হতো Age of Reason বা যুক্তির যুগ, যখন বহু মানুষই দাবি করেছে মানুষ হবার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তাদের যৌক্তিকতায়। কিন্তু হিউম মনে করতেন, মানুষ শুধুমাত্র আরেক ধরনের জন্তু মাত্র। হিউম খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন, আমাদের যুক্তিতে পৌঁছানোর অদ্ভুত উপায়গুলোকে। আমরা যখন কোনো একটি ধারণাকে হৃদয়গ্রাহী মনে করি বা শঙ্কা বোধ করি, আর শুধুমাত্র তার উপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত দিই এটা সত্য অথবা মিথ্যা। মূল দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে পরে কেবল সহায়তা করে যুক্তি, সবকিছুই যুক্তিযুক্ত করার আমাদের উদ্ভাবনপটুতা বিস্ময়কর। 

তবে, যা হিউম বিশ্বাস করতেন না সেটি হচ্ছে, আমাদের সব অনুভূতিগুলোই সমান আর গ্রহণযোগ্য। সেকারণে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন আমাদের তীব্রতম আবেগগুলোর প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ। আমাদের মানুষকে শেখাতে হবে কীভাবে সহমর্মী হতে হয়, পরোপকারী হতে হয়, আরো বেশি ধৈর্যশীল হতে হয়, কীভাবে নিজের সাথে সহজ আর অন্যদের কম ভয় করতে হয়। কিন্তু এইসব শেখার জন্যে, তাদের প্রয়োজন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা সেটি অনুভূতির বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখবে, শুধুমাত্র যুক্তি নয়। সেকারণে হিউম আবেগপ্রবণ ছিলেন সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা আর গুরুত্বের ব্যাপারে: হিউম বিশ্বাস করতেন, এরাই হচ্ছে সেই মানুষগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ব্যতিক্রম, হিউম যাদের বেশ অপছন্দ করতেন, পারেন নানা ধারণার প্রতি আবেগময় সংশ্লিষ্টতা, জ্ঞান আর অন্তর্দৃষ্টি প্ররোচিত করতে (এবং শুধুমাত্র যদি তারা সফল হয়, কেবল তখনই তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হয়)। আর এই কারণে তাদের ভালো করে লিখতে হবে, সুস্পষ্ট আর বৈচিত্র্যময় উদাহরণ ব্যবহার করতে হবে বুদ্ধিমত্তা আর আকর্ষণীয়তার একটি উপযুক্ত মিশ্রণে। হিউমের অন্তর্দৃষ্টি ছিল, আপনি যদি মানুষের বিশ্বাসকে পরিবর্তন করতে চান, সাধারণ দর্শনের অধ্যাপকের মতো তার সাথে যুক্তিভিত্তিক আলোচনা করা সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হতে পারেনা। তিনি প্রস্তাব করেন যে, মানুষের আবেগ, মতামতকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করতে হবে সহমর্মিতা, আশ্বাস, উৎসাহ এবং ভালো উদাহরণ ব্যবহার করে, যাকে তিনি বলেছিলেন একটি শিল্প, এবং শুধুমাত্র পরের ধাপে, যারা খুব দৃঢ়সংকল্প তারা চেষ্টা করতে পারেন বাস্তব তথ্য আর যুক্তি ব্যবহার করে। 

যুক্তির চেয়ে অনুভূতির অগ্রাধিকারের প্রাধান্য যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয়, হিউম তাদের মধ্যে ধর্মকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। হিউম কখনো ভাবেননি, ঈশ্বরবিশ্বাস যৌক্তিক হতে পারে, তার মানে স্বর্গীয় কোনো সত্তার অস্তিত্বের স্বপক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি আছে। তিনি নিজেই মৃদু অজ্ঞেয়বাদ, ‘ঈশ্বর থাকতেও পারে, আ মিনিশ্চিত না’, এবং মৃদু ঈশ্বরবাদের, “ঈশ্বর থাকতে পারেন, তবে তার থাকা বা আসাতে আমার কিছু যায় আসেনা’, এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ কোনো ঈশ্বরকে, যে কিনা মানুষকে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে শাস্তি দেবার জন্য প্রস্তুত, যদি তাকে অবিশ্বাস করা হয়, তিনি নিষ্ঠুর কুসংষ্কার হিসাবে বিবেচনা করতেন। হিউমের মূল বক্তব্য ছিল যে ধর্মীয় বিশ্বাস কোনো যৌক্তিক প্রক্রিয়ার ফসল নয়। সুতরাং এর পক্ষে বা বিপক্ষে বাস্তব তথ্যনির্ভর কোনো বিতর্ক আসলেই মূল বিষয়টিকে স্পর্শ করে না। কাউকে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস করানোর প্রচেষ্টায় খুব সূক্ষ্ম যুক্তি ব্যবহার, হিউম মনে করতেন সুনির্দিষ্টভাবেই নির্বুদ্ধিতা। সেকারণে হিউম ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ধারণার অন্যতম প্রধান সমর্থক হিসাবে আজো সুপরিচিত। তিনি বলতেন ধর্ম নিয়ে আমাদের সাথে মতানৈক্য হয় এমন কাউকে যৌক্তিক কোনো মানুষ হিসাবে আমাদের মনে করা উচিত না, যারা কিনা যুক্তির বিভ্রান্তিতে ভুগছে (সুতরাং তাদের যুক্তিটি আমাদের শুধরে দিতে হবে), বরং আমাদের ভাবা উচিত তাদের আবেগপ্রবণ, অনুভূতি-তাড়িত প্রাণী হিসাবে, যাদের তারা যতদিন আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে,আমাদেরও উচিত হবে তাদের শান্তিতে থাকতে দেয়া। ধর্ম নিয়ে যুক্তিনির্ভর কোনো তর্ক, হিউমের জন্য ঔদ্ধত্য আর পাগলামির চূড়ান্তরূপ। 

দর্শনের ছাত্রদের কাছে হিউম টেকনিকালি একজন সংশয়বাদী হিসাবে পরিচিত, যিনি কিনা দৈনন্দিন জীবনের বহু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞাননির্ভর ধারণাকে সংশয়নির্ভর প্রশ্ন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হিউমের সন্দেহের তালিকায় একটি বিষয় ছিল, যাকে টেকনিক্যালি বলা যেতে পারে ব্যক্তিগত পরিচয়, সেই ধারণাটি যা আমরা ধারণ করি, আমরা আমাদের নিজেদেরকে বুঝতে পারি এবং কমবেশি সারাজীবন ধরেই বোধগম্য একটি আত্মপরিচয় টিকে থাকে। হিউম প্রস্তাব করেছিলেন, আত্মপরিচয়ের ধারণা বলে আসলে কোনোকিছু নেই: ‘যখন আমি, যাকে আমি বলি, সেই অন্তরঙ্গতায় প্রবেশ করি’, তিনি বিখ্যাতভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ‘আমি সবসময়ই সেখানে কোনো-না-কোনো সুনির্দিষ্ট উপলব্ধিতে হোঁচট খাই, গরম অথবা ঠাণ্ডা, আলো অথবা অন্ধকার, ভালোবাসা অথবা ঘৃণা, বেদনা এবং আনন্দ। আমি কখনো আমার নিজেকে খুঁজে পাইনি উপলব্ধি ছাড়া।’ হিউম উপসংহারে পৌঁছান যে, আমরা আসলে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত কোনো ব্যক্তি নই, যা আমাদের যেভাবে বলে বা প্ররোচিত করে বিশ্বাস করতে যখন আমরা আয়নায় আমাদের দিকে তাকাই, অথবা ভাবনাচিন্তা না করে সুবিশাল ভ্রান্ত ধারণার ইঙ্গিতবহ ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করি। আমরা আসলে, ‘একগুচ্ছ ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির সমষ্টি ছাড়া আর কিছু না, যা অকল্পনীয় দ্রুততার সাথে একটি অনুসরণ করে আরেকটি আসে এবং চিরন্তন একটি নিরন্তর পরিবর্তন-পরম্পরায় যা গতিময়। 

কিন্তু মানসিক অবস্থা নিয়ে সন্দিহান হওয়া সত্ত্বেও হিউম আমাদের জন্য খুশি বেশিরভাগ কাণ্ডজ্ঞাননির্ভর বিশ্বাসকে আমরা ধরে রাখি বলে, কারণ তার মতে এই ধারণাগুলো পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে। সবকিছুর ব্যাপারে যৌক্তিক হওয়া বিশেষ ধরনের পাগলামো। এখানে হিউম খুব ধূর্ত তিরস্কার করেছেন দেকার্তকে। হিউমের জন্মের ৬০ বছর আগে এই ফরাসি দার্শনিকের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব তখনও সুস্পষ্ট। দেকার্ত যুক্তি দিয়েছিলেন আমাদের মনে প্রতিটি ধারণাকে পরিত্যাগ করা উচিত যেগুলো যৌক্তিক না। কিন্তু হিউম প্রস্তাব করেন আমরা কদাচিৎ এমন কিছু করি যা আসলেই ত্রুটিহীনভাবে যৌক্তিক হতে পারে। এবং তারপরও তিনি প্রস্তাব করেন যে বেশিরভাগ বিশ্বাসই যুক্তিযুক্ত শুধুমাত্র তারা কাজ করে বলে। তারা আমাদের জন্য উপযোগী। সেগুলো আমরা যা করতে চাই তা করতে সাহায্য করে। কোনো বিশ্বাসের পরীক্ষা কিন্তু এটি প্রমাণযোগ্য সত্যি কিনা সেটা যাচাই করা না বরং এর উপযোগিতা। হিউম এখানে একটি সংশোধন প্রস্তাব করেন, যা আমাদের মাঝে মাঝে দরকার হয়, মর্যাদাকর কোনোকিছুর প্রতি আমাদের মোহ, কিন্তু আসলেই যা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, যৌক্তিক ধাঁধা। অ্যাকাডেমিক দর্শনের ক্রিয়াকাণ্ডের ব্যতিক্রম, তিনি ছিলেন সংশয়বাদী দার্শনিক, যিনি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের পক্ষে ছিলেন, সাধারণ অশিক্ষিত মানুষদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। 

হিউমের বিশেষ আগ্রহ ছিল প্রথাগত দর্শনের এথিক্স বা নীতিশাস্ত্রের বিষয়টি, সেই ধাঁধাটি, কীভাবে মানুষ ভালো হতে পারে। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, নৈতিকতা মানে শুধুমাত্র ভালো নৈতিক ধারণা ধারণ করা না। এখানে প্রয়োজন আছে প্রশিক্ষণের, শৈশব থেকে শিক্ষার প্রয়োজন আছে আবেগের মাধ্যমে শ্লীল থাকার রুচি শিক্ষায়। ভালো হওয়া মানে অনুভব করা, ভালো অভ্যাস রপ্ত করা। হিউম বুদ্ধিমত্তা, শিষ্টাচার, সহমর্মিতা ইত্যাদি গুণাবলির সমর্থক ছিলেন, কারণ এইসব বিষয়গুলো ভালো হবার যৌক্তিক পরিকল্পনার পরিমণ্ডলের বাইরে মানুষকে ভালো আচরণ করায়। তিনি ভীষণ আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেই বাস্তব তথ্যটি দ্বারা, যে-কোনো এক ব্যক্তি, আর আবারো এখানে তিনি দেকার্তের কথা ভাবছিলেন, বাহ্যত যৌক্তিক হতে পারে, কিন্তু তারপরও সে খুব বেশি ভালো নাও হতে পারে, কারণ কোনো জটিল তর্ক অনুসরণ করার ক্ষমতা বা কোনো উপাত্ত থেকে কোনো উপসংহার ধারণা করতে পারা আপনাকে অন্যদের প্রতি সংবেদনশীল করবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই অথবা আপনাকে আপনার মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে দক্ষ করে তুলেবে এমন কথাও নেই। হিউম মনে করতেন, এইসব গুণগুলোই, বরং, আমাদের অনুভূতির উৎপাদন। সুতরাং আপনি যদি চান মানুষ সুআচরণ করবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কথা আবার ভাবতে হবে, তাদের অনুভূতিকে আমাদের প্রভাবিত করতে হবে, শুষ্ক যৌক্তিক বক্তৃতা না দিয়ে বরং আমাদের সহমর্মিতা, দয়াশীলতা, পর দুঃখকাতরতা এবং লজ্জার অনুভূতিকে উৎসাহিত করতে হবে আমাদের চরিত্রের আবেগময় দিকটিকে প্ররোচিত করার মাধ্যমে। 

হিউমের দর্শন সবসময় আবির্ভূত হয়েছে একটি ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রচেষ্টায়, ভালো জীবন বলতে কী বোঝায়? তিনি তার নিজের ও তার আশেপাশে যারা আছেন তাদের চরিত্রকে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে সেটি উত্তম লক্ষ্যে প্রভাবিত করা যেতে পারে। দার্শনিকদের মধ্যে তিনি সেই ব্যতিক্রমদের একজন, দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনো অনুভব করেননি যে প্রথাগত দর্শনচর্চা আসলে সাহায্য করতে পারে। যদিও তিনি বিদ্বান, কিন্তু আসলেই বাস্তবজীবনের নানা অভিজ্ঞতা তাকে নির্মাণ করেছিল। যেমন তিনি কিছুদিনের জন্য প্যারিসে বৃটিশ রাষ্ট্রদূতের উপদেষ্টা ছিলেন, যিনি তার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার তারিফ করেছেন। তার সঙ্গীরা তাকে খুবই পছন্দ করত, ফরাসিরা তাকে ডাকতেন le bon David: দয়ালু, ভদ্র, বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথনে পারদর্শী, যাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মধ্যমণি হবার জন্য প্রচুর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘দার্শনিক হন, কিন্তু আপনার সব দর্শনের মধ্যে, প্রথমে একজন মানুষ হয়ে উঠুন।’ হিউম সেভাবেই তার জীবন কাটিয়েছিলেন, কোনো জনবিচ্ছিন্ন জীবন না বরং মানুষের সঙ্গে। ১৭৭৬ সালের আগস্টে তিনি এডিনবরায় মৃত্যুবরণ করেন। হিউমের চিকিৎসক প্রিয় বন্ধু অ্যাডাম স্মিথকে জীবনের শেষ মূহূর্তগুলো লিখেছিলেন এভাবে, ‘শেষ মুহূর্ত অবধি তিনি সজ্ঞানে ছিলেন, কষ্ট কিংবা হতাশার অনুভূতি থেকে মুক্ত, সামান্যতম অধৈর্য অভিব্যক্তি তিনি প্রকাশ করেননি। যখন তিনি তাকে দেখতে আসা মানুষদের সাথে কথা বলেছেন, তিনি স্বভাবসুলভ কোমলতায় আর স্নেহের সাথেই বলেছেন। তিনি যে মনের প্রশান্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেটিকে অতিক্রম করতে পারবে না কোনোকিছুই।’ হিউম এখনও সেই আসাধারণ পরিচয়ে পরিচিত রয়েছেন, একজন দার্শনিক যিনি বেঁচে ছিলেন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে দর্শন যে কতকিছু শিখতে পারে তার স্মারক হয়ে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *