1 of 2

অধ্যায় ৩২ : তাতে কী এসে যায়? – সি. এস. পার্স ও উইলিয়াম জেমস

অধ্যায় ৩২ : তাতে কী এসে যায়? – সি. এস. পার্স ও উইলিয়াম জেমস

একটি বড় গাছের কাণ্ড ধরে শক্ত করে ঝুলে আছে একটি কাঠবিড়ালি। গাছটির অন্যদিকে কাণ্ডের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক শিকারি। যখনই শিকারিটি তার বামদিকে সরে আসছে, কাঠবিড়ালিও দ্রুত তার বামদিকে সরে যাচ্ছে, কাণ্ড আঁকড়ে ধরে সে সরে যাচ্ছে শিকারির দৃষ্টিসীমার বাইরে। শিকারিও চেষ্টা করছেন কাঠবিড়ালিটিকে খুঁজে পেতে, কিন্তু কাঠবিড়ালিটি দ্রুত সরে যাবার মাধ্যমে শিকারির দৃষ্টিসীমার বাইরে অবস্থান করতে সক্ষম হচ্ছে। বহুক্ষণ ধরেই এটি চলতে থাকে, এবং শিকারির পক্ষে একবারও কাঠবিড়ালিটিকে দেখার সুযোগ হয়না। এখন, কেউ যদি বলেন কাঠবিড়ালিটির চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে শিকারি, সেটা কি সত্য হবে? চিন্তা করে দেখুন, আসলেই কি শিকারি তার শিকারের চারপাশে ঘুরছে? সম্ভাবনা আছে যে আপনার উত্তর হবে, ‘কেন এটি জানতে চাইছেন আপনি?’ আমেরিকার দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস (১৮৪২- ১৯১০) একবার তাঁর বন্ধুদের আড্ডায় এরকম একটি ঘটনা নিয়ে আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন। আপনি যে-উত্তরটি দিতে পারেন, সেটি সেই আসরে একমাত্র উইলিয়াম জেমসই সমবেদনার সাথে অনুভব করতে পারতেন। তাঁর বন্ধুরা এর উত্তর কী হবে সে-বিষয়ে একমত হতে পারেননি কিন্তু তারা এমনভাবে এটি আলোচনা করছিলেন যেন তারা এখানে কোনো চরম সত্য কিছু উদ্‌ঘাটন করতে পারবেন। কেউ এর উত্তরে বলছেন, হ্যাঁ, কাঠবিড়ালিটির চারপাশে ঘুরছে শিকারি; অন্যরা বলেছেন না, অবশ্যই সে ঘুরছেনা। তারা ভেবেছিলেন কোনো- না-কোনোভাবে জেমস হয়তো তাদের সাহায্য করতে পারবেন এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে। তবে তার উত্তরটি ছিল তার প্র্যাগম্যাটিস্ট বা প্রয়োগবাদী দর্শনের আলোয়। তিনি যা বলেছিলেন সেটি হচ্ছে এরকম : যদি চারপাশে ঘোরা বা চক্কর দেয়া মানে আপনারা বোঝাতে চান মানুষটি কাঠবিড়ালি সাপেক্ষে প্রথমে উত্তরে, তারপর পূর্বে, তারপর দক্ষিণে, তারপর এর পশ্চিমে অবস্থান নেয়, কোনোকিছুর চারিদিকে ঘোরার একটি অর্থ যা হতে পারে, তাহলে উত্তরটি হচ্ছে, হ্যাঁ, সত্যি শিকারিটি কাঠবিড়ালিটিকে প্রদক্ষিণ করছেন। সেই অর্থে হ্যাঁ, তিনি কাঠবিড়ালির চারপাশে ঘুরছেন। কিন্তু যদি আপনি বোঝাতে চান যে, শিকারিটি প্রথমে কাঠবিড়ালির সামনে, এরপর কাঠবিড়ালির ডানে, এরপর এর পেছনে যায় এবং তারপর এর বামদিকে, চক্কর দেবার আরেকটি অর্থ যেটি হতে পারে, তাহলে উত্তরটি হবে, না, কারণ কাঠবিড়ালির পেটটি সবসময়ই শিকারির দিকে মুখ করে আছে। সেই অর্থে শিকারি কাঠবিড়ালির চারপাশে ঘুরছেন না। তারা সবসময়ই মুখোমুখি পরস্পরের, শুধু মাঝখানে আছে গাছটি, তারা পরস্পরের দৃষ্টি এড়িয়ে শুধু এর চারপাশে ঘুরছিল।

এই উদাহরণের মূল বিষয়টি হচ্ছে প্রদর্শন করা যে প্রয়োগবাদ বা প্রাগম্যাটিজম মূলত সম্ভাব্য প্রায়োগিক পরিণতিগুলো নিয়ে ভাবে, যাকে বলা হয় চিন্তার ‘ক্যাশ ভ্যালু’, cash value; কোনো প্রশ্নের উত্তরের উপর যদি কোনোকিছুই নির্ভর না করে, তাহলে আপনি কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার উপর কিছুই নির্ভর করছে না। এটি শুধুমাত্র নির্ভর করে, কেন আপনি জানতে চাইছেন আর এটা জানলে আসলেই কী পরিবর্তন সেটি ঘটাতে পারে। এখানে, এই প্রশ্নটি সংশ্লিষ্ট মানবীয় চিন্তা ছাড়া আর কোনো বিশেষ সত্য নেই উদ্ঘাটন করার জন্যে, কীভাবে আমরা চারিদিকে ঘোরা বা চক্কর দেওয়া ক্রিয়াপদটি সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করছি, ভিন্ন ভিন্ন প্রাসঙ্গিকতায়। যদি কোনো কার্যত বা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পার্থক্য না থাকে, তাহলে এখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সত্য নেই। এমন কিছু নয় যে কোথাও সেখানে সত্য আছে, আমরা খুঁজে পাব বলে সেখানে অপেক্ষা করছে। জেমসের জন্যে সত্য হচ্ছে শুধুমাত্র সেটি যা কাজ করে, আমাদের জীবনের উপর যার ইতিবাচক একটি প্রভাব আছে।

প্রাগম্যাটিজম বা প্রয়োগবাদ নামের এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিটি ঊনবিংশ শতকের শেষাংশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এটি সূচনা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক ও বিজ্ঞানী চার্লস স্যান্ডারস পার্স (C.S. Peirce)। তিনি দর্শনকে এটি যতটা নয় তারচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। পার্স (১৮৩৯-১৯১৪) বিশ্বাস করতেন যে কোনো একটি প্রস্তাবনাকে সত্যি হতে হলে এটিকে অবশ্যই কোনো সম্ভাব্য পরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। যদি আপনি বলেন যে ‘কাচ ভঙ্গুর’, এর মানে হচ্ছে যদি আপনি কোনো হাতুড়ি দিয়ে কাচের উপর আঘাত করেন, এটি ছোট ছোট বহু টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে। সেটাই এই ‘কাচ ভঙ্গুর’ বাক্যটিকে সত্য প্রমাণ করে। ভঙ্গুরতা বলে কোনো অদৃশ্য বৈশিষ্ট্য কাচের মধ্যে নেই, শুধুমাত্র সেই বাস্তব সত্যটি ছাড়া, যা ঘটে যদি আপনি এটিকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন। কাচ ভঙ্গুর একটি সত্য প্রস্তাবনা, তার কারণ হচ্ছে এইসব প্রায়োগিক পরিণতিগুলো। ‘কাচ স্বচ্ছ’ সত্যি, কারণ আপনি কাচের ভিতর দিয়ে কোনোকিছু দেখতে পান, এর কারণ কাচের কোনো রহস্যময় বৈশিষ্ট্য নয়। পার্স নৈর্ব্যক্তিক বিমূর্ত কোনো তত্ত্ব পছন্দ করতেন না, যা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যদি কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করতে না পারে, তিনি ভাবতেন এগুলো অর্থহীন। তাঁর জন্য সত্য হচ্ছে, আমরা কী পাব যদি আমরা সব পরীক্ষা আর অনুসন্ধান চালাতে পারি, যা আমরা আদর্শ পরিস্থিতিতে করতে চাই। বৃটিশ দার্শনিক এ. জে. আইয়ারের লজিকাল পজিটিভিজমের সাথে তার বেশ মিল আছে। প্র্যাগম্যাটিজমের মূল বিষয় ছিল: চিন্তার কাজ কোনো বাস্তবতাকে বর্ণনা, প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রতিফলন করা নয়, বরং প্রয়োগবাদীরা মনে করতেন চিন্তা হচ্ছে একটি টুল বা উপকরণ যা দিয়ে কোনোকিছু ভবিষ্যদ্বাণী, সমস্যা সমাধান বা কোনো কাজ করা যায়।

পার্স তেমন সুপরিচিত ছিলেন না এবং তাঁর লেখাও ব্যাপকভাবে পড়া হয়নি। কিন্তু উইলিয়াম জেমস সুপরিচিত ছিলেন। তিনি খুবই চমৎকার লেখক ছিলেন, তাঁর বিখ্যাত লেখক ভাইয়ের চেয়েও উত্তম অথবা তার মতোই ছিলেন, যে ভাইয়ের কথা বলা হচ্ছে তিনি বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার হেনরি জেমস। প্রাগম্যাটিজম নিয়ে পার্সের সাথে বহু সময় ধরে আলোচনা করেছিলেন উইলিয়াম, যখন দুজনেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। জেমস নিজস্ব একটি সংস্করণ সৃষ্টি করেছিলেন যা তিনি জনপ্রিয় করেছিলেন তার লেখায় ও বক্তৃতায়। তাঁর জন্যে প্রাগম্যাটিজমের মূলসারটি হচ্ছে : সত্য হচ্ছে সেটি যা কাজ করে। অবশ্য তিনি খানিকটা অস্পষ্ট ছিলেন, ‘যা কাজ করে’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। যদিও তিনি শুরুর দিকের মনোবিজ্ঞানী ছিলেন, তিনি শুধুমাত্র বিজ্ঞানেই আগ্রহ সীমাবদ্ধ করতে চাননি, তিনি কোটি ঠিক এবং কোটি ভুল, ন্যায় অন্যায় এবং ধর্ম নিয়েও আগ্রহী ছিলেন। আসলেই তার বিতর্কিত সব লেখাগুলো ছিল ধর্ম নিয়ে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে যেভাবে সত্যকে দেখা হয় জেমসের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশ ভিন্ন। তার মনে সত্য হচ্ছে বাস্তব বা প্রকৃত ঘটনাগুলো বা ফ্যাক্টের অনুরূপ কিছু। কোনো একটি বাক্যকে যা সত্য করে, correspondence theory of truth অনুযায়ী সেটি হচ্ছে এটি সঠিকভাবেই পৃথিবী কেমন সেটি বর্ণনা করে। ‘মাদুরের উপর বিড়ালটি বসে আছে’ সত্য, যখন বিড়ালটি আসলেই মাদুরের উপর বসে আছে, এবং মিথ্যা যখন সেটি সেখানে বসে থাকেনা। যেমন, যখন এটি হয়তো বাগানে ইঁদুরের সন্ধান করছে। জেমসের প্রস্তাবিত সত্যের প্রাগম্যাটিক তত্ত্ব অনুযায়ী, মাদুরের উপর বিড়ালটি বসে আছে সত্যি, কারণ এটি বিশ্বাস করলে আমাদের জন্যে উপযোগী কোনো বাস্তবসম্মত ফলাফল সৃষ্টি করবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বা আমাদের জন্য এটি কাজে লাগে। যেমন মাদুরের উপর বিড়ালটি বসে আছে তথ্যটি আমাদের এমন ফলাফল দেয় যে আমরা আমাদের পোষা হ্যামস্টারটি নিয়ে সেই মাদুরের উপর খেলব না যতক্ষণ-না বিড়ালটি অন্য কোথায় চলে যায়।

বেশ, তার ব্যবহৃত ‘বিড়ালটি মাদুরের উপর বসে আছে’ এমন উদাহরণটি ব্যবহার করার সময় সত্যের প্র্যাগম্যাটিক তত্ত্বের ফলাফলগুলো মনে হতে পারে বিশেষভাবে সতর্ক হবার মতো বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কিন্তু এই একই পরীক্ষা করে দেখুন ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’ এমন বাক্যটি দিয়ে। উইলিয়াম জেমস এই বিষয়ে কী বলতে পারেন বলে আপনি প্রত্যাশা করছেন? এটা কি সত্যি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে? আপনি কী মনে করেন? এই প্রশ্নটির প্রধান কিছু উত্তর হতে পারে: ‘হ্যাঁ, এটি সত্যি যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’, ‘না, এটি সত্যি না যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’, এবং ‘আমি জানিনা’। ধরে নিচ্ছি যদি কষ্ট করে না পড়ে আপনি উত্তর দেন, তাহলে এই তিনটি উত্তরের কোনো একটি আপনি দিয়েছেন। এই অবস্থানগুলোর নাম, ঈশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ, অজ্ঞেয়বাদ (যথাক্রমে theism, atheism আর agnosticism)। যারা বলবেন, “হ্যাঁ, এটি সত্য যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’, তারা সাধারণত বোঝান যে কোথাও-না-কোথাও একজন সর্বশক্তিমান সত্তা আছেন, এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এমন প্রস্তাবনা সত্যি হবে এমনকি যখন কোনো মানুষ বেঁচে থাকবে না, এমনকি সেই পরিস্থিতিতেও যখন মানুষের কখনোই কোনো অস্তিত্ব ছিলনা। ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’ আর ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই’ হচ্ছে এমন প্রস্তাবনা যা হয় সত্য অথবা মিথ্যা। কিন্তু আমরা এই বাক্যগুলো নিয়ে যা চিন্তা করছি তা এদের সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে না।, আমরা সে-সম্বন্ধে যা- কিছুই ভাবিনা কেন, তারা হয় সত্য কিংবা মিথ্যা। আমরা শুধুমাত্র আশা করি যে আমরা সঠিকভাবে উত্তরে পৌঁছাতে পারব, যখন আমরা প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে ভাবি।

‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’, এই প্রস্তাবনার একটি ভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন উইলিয়াম জেমস। তিনি ভাবতেন এই প্রস্তাবনাটি সত্যি। আর যা একে সত্য করছে তা হলো এটি তার মতে উপযোগী একটি বিশ্বাস, যা ‘কাজে লাগে’। এই উপসংহারে পৌঁছাতে তিনি নজর দেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এমন বিশ্বাসের উপকারিতার উপর। বিষয়টি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিনি এমনকি একটি বইও লিখেছিলেন, The Varieties ofReligious Experience (১৯০২) নামে, যেখানে ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের কী কী প্রভাব থাকতে পারে। জেমস এর মতে, ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’ এমন কিছু বলা একটি সত্যিকারের প্রস্তাবনা, শুধুমাত্রই বলা যে কোনো-না-কোনোভাবে এটি বিশ্বাস করা বিশ্বাসীদের জন্য উত্তম। এই অবস্থানটি নেয়া খুবই বিস্ময়কর। এটি অনেকটাই পাসকালের যুক্তির মতো, অজ্ঞেয়বাদীরা সুবিধা পাবার মতো একটি অবস্থানে থাকবেন যদি তারা বিশ্বাস করেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। পাসকাল যদিও, বিশ্বাস করতেন যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’, আর এটি সত্য করে ঈশ্বরের সত্যিকারের অস্তিত্ব, মানুষ তাকে বিশ্বাস করে ভালো বোধ করে তার মাধ্যমে নয় বা এটি তাদের ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে যদি তারা এমন কিছু বিশ্বাস করেন তার মাধ্যমেও নয়। তার সেই বাজি হচ্ছে অজ্ঞেয়বাদীদের বিশ্বাস করানোর প্রচেষ্টা যে, যা তিনি ভাবছেন সেটি সত্য। জেমস-এর জন্য, এটি হচ্ছে সেই অনুমিত বিষয়টি, যে ঈশ্বরে বিশ্বাস ‘সন্তোষজনকভাবে কাজ করে’ যা ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে’ এমন প্রস্ত বিনাকে সত্যি করে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্যে, আরেকটি বাক্যের কথা মনে করুন, ‘সান্তা ক্লজের অস্তিত্ব আছে’, এটি কি সত্য? বিশাল বপু, হাসিমাখা লালচে মুখের একটি মানুষ প্রতি ক্রিসমাসের দিন রাতে আপনার চিমনি দিয়ে ঘরে ঢোকে থলে ভরা উপহার নিয়ে? এই অনুচ্ছেদটির বাকি অংশটি পড়ার দরকার নেই, যদি আপনি আসলেই বিশ্বাস করেন এমন কোনো ঘটনা সত্যি ঘটে।

যদিও, আমি অনুমান করছি, আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না যে সান্তা ক্লজের অস্তিত্ব আছে, এমনকি যদি আপনি মনে করেন ভালোই হতো যদি তার অস্তিত্ব থাকত। উইলিয়াম জেমস-এর সত্যের প্র্যাগম্যাটিক তত্ত্বটিকে সমালোচনা করেছিলেন বৃটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। তিনি বলেছিলেন, এর মানে জেমসকে সান্তা ক্লজের অস্তিত্ব আছে এটি সত্য হিসাবে বিশ্বাস করতে হবে। তাঁর এই কথা বলার কারণ যে জেমস মনে করতেন যা এই বাক্যটিকে সত্য বানায় তা হলো এটি বিশ্বাস করার কারণে বিশ্বাসীদের উপর এর প্রভাব। এবং বেশিরভাগ শিশুদের জন্য, অন্তত, সান্তা ক্লজকে বিশ্বাস করার মধ্যে আনন্দ আছে। এটি ক্রিসমাসকে তাদের জন্য একটি বিশেষ দিনে পরিণত করে, এটি তাদের ভালো ব্যবহার করতে প্ররোচিত করে, ক্রিসমাসের আগের দিনগুলোয় এটি তাদের অনুসরণ করার মতো একটি লক্ষ্য দেয়। আর সেটাই এটিকে সত্যি করে তোলে জেমসের প্রস্তাবনায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটি সত্যি হলে কী ভালো হতো আর কোটি আসলেই সত্যি তার মধ্যে পার্থক্য আছে। জেমস হয়তো দেখাতে পারেন যে সান্তা ক্লজের অস্তিত্বে বিশ্বাস করাটা শিশুদের জন্য উপকারী হতে পারে, তবে এটি সবার জন্যে কাজ করেনা। যদি বাবা-মা বিশ্বাস করতেন যে সান্তা ক্লজ ক্রিসমাসের দিন এসে উপহার দিয়ে যাবে, তারা তাদের সন্তানদের জন্যে কোনো উপহার কেনার চেষ্টা করতেন না। শুধুমাত্র ক্রিসমাসের সকাল অবধি অপেক্ষা করলে দেখা যাবে, ‘সান্তা ক্লজের অস্তিত্ব আছে এমন বিশ্বাসে সমস্যা আছে। কিন্তু তার মানে কি শিশুদের জন্য এটি সত্য যে সান্তা ক্লজের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু তা মিথ্যা বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য? তাহলে কি সত্য একটি আত্মগত বা সাবজেকটিভ ধারণা হয়ে যায় না, কোনোকিছু সম্বন্ধে আমরা কি অনুভব করি বরং, আসলেই বাস্তব পৃথিবীতে কোনো কিছু কেমন তার বদলে?

আরেকটি উদাহরণের কথা ভাবুন। আমরা কীভাবে বুঝি অন্য মানুষদের আদৌ কোনো মন আছে কিনা? আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝি আমি কোনো জম্বি না, যার কিনা কোনো অন্তর্জগৎ নেই। আমার নিজের চিন্তা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি সবকিছুই আছে। কিন্তু আমি কীভাবে বলতে পারব আমার চারপাশে মানুষদের আদৌ কোনো চিন্তা আছে? হয়তো তারা সচেতন নয়। তারা কি জম্বি হতে পারে না যারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে নিজেদের কোনো মনোজগৎ ছাড়াই? এটাই অন্য মানুষদের মন বা Other Minds-এর সেই দার্শনিক সমস্যা, যা বহুদিন ধরে দার্শনিকদের ভাবিয়েছে। সমাধান করার জন্য কঠিন একটি ধাঁধা। জেমস-এর উত্তর ছিল, অন্য মানুষদের মন আছে এটি অবশ্যই সত্য হতে হবে, অন্যথায় আমরা তাদের শনাক্ত হওয়া ও প্রশংসা পাবার সেই বাসনাকে পরিতুষ্ট করতে পারব না। এটি খুব অদ্ভুত একটি যুক্তি। এটাই কারণ, কেন প্রাগম্যাটিজমকে একধরনের আত্ম-অভিলাষ মনে হয়, বিশ্বাস করা যা আপনি সত্য হবে বলে কামনা করছেন, এটি আসলেই সত্য হোক কিংবা না-হোক কিছুই যায় আসে না, সেটি আসলেই সত্য। কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে যখন কেউ আপনাকে প্ৰশংসা করে তারা সচেতন সত্তা এবং কোনো রোবোট নয়, এমন বিশ্বাস তাদেরকে সচেতন কোনো সত্তায় পরিণত করেনা, তারপরও তাদের অন্তর্জগত নাও থাকতে পারে।

বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার দার্শনিক রিচার্ড রর্টি (১৯৩১-২০০৭) প্র্যাগম্যাটিক ভাবনার এই শৈলীটিকে আরো খানিকটা অগ্রসর করেছিলেন। জেমসের মতোই তিনি ভেবেছিলেন শব্দগুলো হচ্ছে উপকরণ যার মাধ্যমে আমরা নানা কিছু করি, এরা কোনো প্রতীক নয়, যারা কোনো-না-কোনোভাবে সত্যিকারের পৃথিবীর প্রতিফলন। শব্দ আমাদের সুযোগ করে দেয় পৃথিবীর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে, এটিকে অনুকরণ করার জন্য নয়। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে truth is what your contemporaries let you get away with, সত্য হচ্ছে সেটি যা আপনার সমসাময়িকরা আপনাকে সত্য বলে দাবি করার সুযোগ দেবে, এবং ইতিহাসের কোনো পর্বই বাস্তবতাকে সঠিকভাবে ধরতে পারেনি। যখন মানুষ পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করে, রটি বিশ্বাস করেন, যেন তারা সাহিত্যসমালোচক, শেক্সপিয়ারের কোনো একটি নাটকের ব্যাখ্যা করছেন: কোনো একটি একক ‘সঠিক’ উপায় নেই এটি পড়ার জন্য, যে উপায়ের ব্যাপারে সবাই একমত হবেন। বিভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তার লেখা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। রটি সেই ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যা দাবি করে কোনো একটি দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ে সঠিক। অথবা নিদেনপক্ষে তার কাজ সম্বন্ধে এটাই আমার ব্যাখ্যা। রটি সম্ভবত বিশ্বাস করতেন কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই, ঠিক সেইভাবে যেমন কোনো সঠিক উত্তর নেই সেই শিকারিটি কাঠবিড়ালির চারপাশে চক্কর দিচ্ছিল কিনা যখন সে গাছের চারপাশে প্রাণ বাঁচাতে ঘুরছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *