1 of 2

অধ্যায় ২৬ : মিনার্ভার পেঁচা – জর্জ ডাবলিউ. এফ. হেগেল

অধ্যায় ২৬ : মিনার্ভার পেঁচা – জর্জ ডাবলিউ. এফ. হেগেল

‘মিনার্ভার পেঁচা ওড়ে শুধুমাত্র সন্ধ্যাবেলায়’—জর্জ ভিলহেম ফ্রিয়েডরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন। কিন্তু এই বাক্যটি দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? আসলেই এর অর্থকী? এমন প্রশ্ন হেগেলের পাঠকদের হরহামেশাই করতে হয়। কারণ তাঁর লেখা নিষ্ঠুরভাবেই দুর্বোধ্য, আংশিক কারণ, কান্টের মতো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে বেশ বিমূর্ত একটি ভাষায় এবং প্রায়শই তিনি এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা তিনি নিজেই উদ্ভাবন করেছিলেন। কারো পক্ষেই পুরোটা বোঝা সম্ভব হয়নি, হয়তো হেগেল নিজেও সেটা পারেননি। পেঁচা নিয়ে এই প্রস্তাবনাটির মর্মোদ্ধার করা সম্ভব, কারণ এটি তার লেখার অপেক্ষাকৃত সহজতর অংশ। এটি হচ্ছে আমাদেরকে তাঁর বলার একটি উপায় যে মানব-ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে প্রজ্ঞা এবং বোঝাপড়া শুধুমাত্র পূর্ণভাবে আমাদের বোধগম্য হয় অনেক পরের শেষ কোনো পর্যায়ে, যখন আমরা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি যা সত্যিকারভাবে ঘটেছে সেটি বোঝার প্রচেষ্টায়। যেমন রাতের বেলায় যখন কেউ দিনের বেলায় ঘটা ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরান।

মিনার্ভা, রোমানদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী, প্রতীক হিসাবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল ‘জ্ঞানী পেঁচা’। বহু বিতর্ক হয়েছে দর্শনে হেগেলের প্রকৃত অবস্থান নিয়ে, কিন্তু যাই হোক না কেন তিনি অবশ্যই প্রভাবশালী একজন দার্শনিক ছিলেন। ইতিহাস নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি, ‘ইতিহাস উন্মোচিত হবে সুনির্দিষ্ট একটি উপায়ে’, এই ধারণাটি প্রভাবিত করেছিল কার্ল মার্ক্সকে। এবং সেকারণে নিশ্চয়ই প্রভাবিত করেছিলেন পরবর্তীতে নানা ঘটনাপ্রবাহ, কারণ মার্ক্সের ধারণা বিপ্লবের সূচনা করেছিল ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে। কিন্তু হেগেল বিরক্ত করেছিলেন বহু দার্শনিককে। কিছু দার্শনিক এমনকি তার কাজকে ব্যবহার করেছিলেন উদাহরণ হিসাবে, বিশেষ করে শব্দ সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে কী ঝুঁকি হতে পারে সেটি বোঝাতে। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর লেখা অপছন্দ করতেন এবং এ. জে. আয়ার ঘোষণা করেছিলেন, হেগেলের কোনো বাক্যই কিছুই প্রকাশ করে না, তাঁর কাছে হেগেলের লেখা অর্থহীন কবিতার মতো তথ্যপুষ্ট আর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আবেদনহীন মনে হয়েছে। অন্যরা, যেমন পিটার সিঙ্গার, তার চিন্তায় ব্যাপক গভীরতা আবিষ্কার করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁর লেখা কঠিন, কারণ যে-ধারণাগুলো নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন, তা খুবই মৌলিক এবং মর্মোদ্ধার করার জন্য দুঃসাধ্য।

১৭৭০ সালে হেগেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্টুটগার্টে (বর্তমানে যা জার্মানির অংশ), তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের যুগে, যখন রাজতন্ত্র সেখানে বিলুপ্ত করা হয়ছিল নতুন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে। তিনি এটিকে চিহ্নিত করেছিলেন a glorious dawn বা চমৎকার উষালগ্ন হিসাবে, এবং তাঁর সহপাঠীদের নিয়ে ঘটনাটিকে স্মরণ করে রাখার জন্য একটি বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের এই সময়টি তাঁর বাকি জীবনটাকে প্রভাবিত করে রেখেছিল। আসলেই মানুষের মধ্যে সেই সময় একটি বিশ্বাস এসেছিল মৌলিক বহু ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে, যা এতদিন মনে করা হয়েছে চিরন্তন সত্য, সেটি সবসময় অপরিবর্তনীয় থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এখান থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অন্তর্দৃষ্টি আমরা পাই সেটি হচ্ছে আমাদের যে-ধারণাগুলো আছে সেগুলো আসলেই যে-সময়ে আমরা বাস করি সেই সময়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত, এবং ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া তাদের পুরোপুরিভাবে কখনোই বোঝা সম্ভব নয়। হেগেল বিশ্বাস করতেন যে তার নিজের জীবদ্দশায় ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যক্তিগত স্তরে তিনি অপরিচিত থেকে ক্রমেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ধনাঢ্য পরিবারের গৃহশিক্ষক হিসাবে জীবন শুরু করার পর তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন। এবং অবশেষে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়েছিলেন। হেগেলের কিছু বই মূলত তাঁরই লেখা লেকচার নোট, যেন ছাত্ররা তার দর্শন বুঝতে পারে। তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি সুপরিচিত এবং প্রশংসিত দার্শনিক পরিচয়টি অর্জন করেছিলেন। বিষয়টি আসলেই বিস্ময়কর, বিশেষ করে যখন তাঁর লেখা অত্যন্ত জটিল। কিন্তু কিছু উৎসাহী ছাত্র তাদের নিবেদিত করেছিলেন তিনি কী পড়িয়েছেন সেটি বোঝা এবং ব্যাখ্যা করার জন্য। তার দর্শনের রাজনৈতিক আর মেটাফিজিকাল প্রভাব কী হতে পারে এটি তারাই বের করে এনেছিলেন।

হেগেল কান্টের মেটাফিজিক্স (অধিবিদ্যা) দ্বারা দারুণ প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে হেগেল কান্টের noumenal বাস্তবতার ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কান্ট যে বাস্তবতার উপস্থিতিকে চিহ্নিত করেছিলেন আমাদের দৃশ্যমান ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা বা phenomenal world আড়ালে। হেগেল noumena বা যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার সীমার বাইরে থেকে অভিজ্ঞতার কারণ হতে পারে, এমন ধারণা গ্রহণ না করে দাবি করেন মন যে বাস্তবতার রূপ দিচ্ছে সেটাই ‘হচ্ছে’ বাস্তবতা। এর বাইরে কিছু নেই। কিন্তু এর মানে এই না যে বাস্তবতা অপরিবর্তনীয় একটি অবস্থায় স্থিতিশীল থাকে। হেগেল বিশ্বাস করতেন, সবকিছুই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে এবং সেই পরিবর্তন রূপ নিতে পারে আত্মসচেতনতার ক্রমোন্নয়নের একটি রূপ হিসাবে, আর আমাদের আত্মসচেতনতা নির্ধারণ করে সময়ের যে-পর্বে আমরা বসবাস করি তার উপর। গোল ভাঁজ করা দীর্ঘ একটি কাগজ হিসাবে পুরো ইতিহাসকে কল্পনা করুন। আমরা আসলেই বুঝতে পারব না সেখানে কী আছে যতক্ষণ না অবধি সেই ভাঁজ ক্রমশ উন্মোচিত হয়। যেমন আমরা জানতে পারব না কী লেখা আছে কাগজটির শেষপ্রান্তে যতক্ষণ না অবধি কাগজটির শেষপ্রান্তটি উন্মোচিত হয়। হেগেল মনে করতেন, বাস্তবতা নিজেকে বোঝার লক্ষ্য অভিমুখে সতত গতিশীল। ইতিহাস তাই কোনো অর্থেই র‍্যানডোম বা নির্দেশনাহীন নয়, এর একটি লক্ষ্য আছে। আমরা যখন পেছন ফিরে তাকাই আমরা দেখতে পারি এভাবেই এর নিজেকে প্রকাশ করার কথা ছিল। যখন আপনি প্রথম ধারণাটি শুনবেন, আপনার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হবে। আমি সন্দেহ করছি বহু মানুষ যারা এই লেখাটি পড়ছেন তারা হেগেলের সাথে একমত হবেন না। ইতিহাস আমাদের অনেকের কাছে তেমন, যেমন করে হেনরি ফোর্ড এটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, একের পর এক ঘটে যাওয়া অর্থহীন ঘটনাপ্রবাহ ছাড়া আর কিছুই না। সার্বিক কোনো পরিকল্পনা ছাড়া ঘটা কিছু ধারাবাহিক ঘটনা মাত্র। আমরা ইতিহাস অধ্যয়ন করতে পারি এবং আবিষ্কার করতে পারি নানা ঘটনাপ্রবাহের সম্ভাব্য কারণগুলো এবং ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে সেই বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। কিন্তু তার মানে এই না যে এর একটি অবশ্যম্ভাবী প্যাটার্ন আছে, যেমন করে হেগেল ভাবতেন। এর মানে এই না ইতিহাসের কোনো দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তবে অবশ্যই মানে এটা নয় যে ধীরে ধীরে এটি তার নিজের সম্বন্ধে আরো সচেতন হয়ে যাচ্ছে।

হেগেলের ইতিহাসচর্চা তাঁর দর্শন থেকে ভিন্ন কিছু নয়, বরং এটি ছিল তার অংশঃ এর মূল অংশ। তিনি মনে করতেন দর্শন আর ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এবং সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে ভালোকিছুর দিকে। অবশ্যই এটি মৌলিক ধারণা নয়। ধর্ম ইতিহাসকে এমনভাবেই ব্যাখ্যা করে যেন এটি কোনো একটি বিশেষ দিকে পরিচালিত হচ্ছে, যেমন যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন। হেগেল খ্রিস্টান ছিলেন, কিন্তু তার ধারণা প্রচলিত চিন্তা থেকে দূরে ছিল। তাঁর জন্যে, শেষ পরিণতি যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন নয়। তার জন্যে, ইতিহাসের একটি শেষ গন্তব্য বা লক্ষ্য আছে, যা এর আগে আসলেই কেউ অনুধাবন করেননি। সেটি হচ্ছে ‘স্পিরিটের’ ধীর এবং অবশ্যম্ভাবী আত্মসচেতনতা অর্জন, যা আসবে যুক্তির এগিয়ে চলার মাধ্যমে। কিন্তু স্পিরিট কী? আর এর আত্মসচেতন হওয়ার মানেই বা কী? জার্মান ভাষায় স্পিরিট শব্দটি হচ্ছে Geist; বিশেষজ্ঞরা অনেকেই একমত হতে পারেননি এর আসলেই সুনির্দিষ্ট অর্থ কী হতে পারে। কেউ এটিকে অনুবাদ করে Mind হিসাবে, কিন্তু হেগেল আপাতদৃষ্টিতে এটি বলতে বুঝিয়েছিলেন ‘সমগ্র মানবতার একক মন’কে। হেগেল idealist বা আদর্শবাদী ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে এই Spirit বা Mind হচ্ছে মৌলিক এবং এর অভিব্যক্তিকে তিনি ভৌত পৃথিবীতে খুঁজে পেয়েছিলেন (এর ব্যতিক্রম বস্তুবাদীরা বিশ্বাস করেন যে ভৌত বা ফিজিকাল বস্তু হচ্ছে মৌলিক)। হেগেল পৃথিবীর ইতিহাসকে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধীর ক্রমশ বৃদ্ধি হিসাবে। আমরা চলছি একক ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে, কিছু মানুষের স্বাধীনতা কিন্তু অন্যদের না হয়ে এমন পৃথিবীর দিকে যেখানে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রে সবাই স্বাধীন, যা তাদের সুযোগ করে দেবে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার জন্য।

তিনি মনে করতেন একটি উপায়ে আমরা চিন্তার জগতে প্রগতি অর্জন করি : কোনো ধারণা এবং এর বিপরীত ধারণার দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে। হেগেল বিশ্বাস করতেন, আমরা সত্যের কাছাকাছি আসি তার dialectical পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রথমে কোনো একজন একটি ধারণা প্রস্তাব করবেন, একটি থিসিস, এরপর এটি তার বিপরীত ধারণার মূখোমুখি হবে, যা প্রথম ধারণাটিকে চ্যালঞ্জ করবে, অ্যান্টিথিসিস। এই দুটি অবস্থানের দ্বন্দ্ব থেকে, আরো জটিল একটি তৃতীয় অবস্থানের উদ্ভব ঘটে, যা দুটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধারণা সংশ্লেষণ করে, দুটির synthesis। এবং তারপর, বেশির ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে আবার, নতুন synthesis আবার thesis হয় এবং এর বিরুদ্ধে আবার antithesis দাঁড় করানো হয়। এই সবই চলতে থাকে যতক্ষণ-না Spirit পুরোপুরিভাবে নিজেকে বুঝতে পারে। ইতিহাসের মূল ধাক্কাটিকে দেখা যায় নিজের স্বাধীনতাকে বোঝার Spirit- এর নিরন্তর প্রচেষ্টা হিসাবে। হেগেল ইতিহাসের এই প্রগতিকে অনুসরণ করেছিলেন সেইসব মানুষদের থেকে যারা প্রাচীন চিন বা ভারতে অত্যাচারী শাসকের অধীনে বাস করেছিল, তাদের জীবনের পুরোটা সময় জুড়েই যারা জানত না যে তারা স্বাধীন। এই প্রাচ্যের মানুষেরা ভাবতেন, শুধুমাত্র ক্ষমতাবান শাসকেরই স্বাধীনতা আছে। হেগেলের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা সম্বন্ধে কোনো সচেতনতাই ছিলনা। প্রাচীন পারস্যবাসীরা খানিকটা বেশি সচেতন ছিল তাদের স্বাধীনতার বিষয়ে। তারা গ্রিকদের দ্বারা পরাজিত হয়েছিল, এবং সেটি প্রগতি এনেছে। গ্রিক ও পরে রোমানরা আরো বেশি স্বাধীনতা-সচেতন ছিল তাদের আগে যারা এসেছে তাদের থেকে। কিন্তু তারপরও তারা ক্রীতদাস রাখত। এটি প্রদর্শন করেছে যে তারা পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করেনি যে সার্বিকভাবে পুরো মানবতারই স্বাধীন হওয়া উচিত, শুধুমাত্র ধনবান আর ক্ষমতাবানরাই নয়। একটি বিখ্যাত অনুচ্ছেদ তার The Phenomenology of Spirit (১৮০৭) বইয়ে আমরা দেখি, তিনি ক্রীতদাস ও তার মালিকের মধ্যে সংগ্রামের কথা আলোচনা করেছেন। মালিক নিজে আত্মসচেতন হিসাবে শনাক্ত হতে চান এবং তার ক্রীতদাসের দরকার সেটি অর্জন করার জন্যে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেন না যে ক্রীতদাসেরও সেই স্বীকৃতি পাবার যোগ্যতা আছে। এই অসম সম্পর্কই সংগ্রামের উৎস, যেখানে একজনকে হারতে হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। কিন্তু এটি আত্মপরাজয়ের চক্রের সূচনা করে। একসময় মনিব ও ক্রীতদাস দুজনেই শনাক্ত করে তাদের পারস্পরিক প্রয়োজনীয়তা, পারস্পরিক স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করার প্রয়োজনীয়তা।

কিন্তু হেগেল দাবি করেছিলেন, শুধুমাত্র খ্রিস্টধর্ম, যা আত্মিক মূল্যের সচেতনাটি সূচনা করেছিল, যে আসলেই সত্যিকারের স্বাধীনতা সম্ভব হতে পারে। তার নিজের সময় ইতিহাস এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করেছিল। Spirit সেখানে তার নিজের স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতন হয়েছিল এবং সমাজ এর পরিণতিতে নিজেকে সংগঠিত করেছে যুক্তির মাধ্যমে। তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটি সঠিকভাবে সংগঠিত সমাজেই কেবল সত্যিকারের স্বাধীনতার উদ্ভব হতে পারে। হেগেল-এর বহু পাঠকদের যা চিন্তায় ফেলেছিল, সেটি হচ্ছে যে এমন কোনো আদর্শ সমাজে যা হেগেল কল্পনা করেছিলেন, যেখানে যারা সমাজের শক্তিশালী সংগঠকদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না, তারা স্বাধীনতার নামে বাধ্য হবে যুক্তিসঙ্গত উপায়ে বেঁচে থাকাটা মেনে নিতে। রুসোর সেই ধাঁধাপূর্ণ forced to be free বাক্যটির মতো তাদেরকে বাধ্য করা হবে স্বাধীন হবার জন্য। সব ইতিহাসের শেষ পরিণতি দেখা গেছে যে হেগেল নিজেই বাস্তবতার কাঠামোর সম্বন্ধে সচেতন হয়েছেন। তিনি মনে করতেন তার কোনো একটি বইয়ের শেষ পাতাগুলোয় তিনি সেটি অর্জন করেছেন। সেটাই হচ্ছে সেই মুহূর্ত যেখানে Spirit প্রথমবারের মতো নিজেকে বুঝতে পেরেছে। প্লেটোর মতো, তাহলে হেগেল দার্শনিকদের একটি বিশেষ আসনে আসীন করেছিলেন, প্লেটো মনে করতেন দার্শনিক রাজারাই পারে আদর্শ একটি প্রজাতন্ত্র চালাতে। হেগেল, এর বিপরীত, ভাবতেন দার্শনিকরা এটি বিশেষ ধরনে আত্মঅনুধাবন করতে পারবেন যেটি সব ইতিহাসের বাস্তবতার অনুধাবনও। সেই ডেলফির সেই অ্যাপোলোর মন্দিরে খোদাই-করা Know Thyself বাস্তবায়ন করার আরেকটি উপায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, দার্শনিকরাই মানব ঘটনাপ্রবাহের মূল স্বরূপের সেই চূড়ান্ত উন্মোচনটি অনুধাবন করতে পারেন। তারাই কেবল বুঝতে পারেন ডায়ালেকটিক বা দ্বান্দ্বিকতা কীভাবে একটি ধীর বিবেকের জাগরণ সৃষ্টিকরে। হঠাৎ করেই সবকিছু তাদের কাছে স্পষ্ট হয়, মানব ইতিহাসের মূল বিষয়টি তারা অনুধাবন করতে পারেন। স্পিরিটও আত্মবোধ শক্তি সম্পন্নতার একটি নতুন পর্বে প্রবেশ করে। সেটাই ছিল তার তত্ত্ব। হেগেলের বহু ভক্ত ছিল। কিন্তু আর্থার শোপেনহাওয়ার তাদের একজন ছিলেন না। তিনি ভাবতেন হেগেল আসলে দার্শনিক নন মোটেই, কারণ তার সেই ভাবগম্ভীরতা আর সততা ছিল না যে-বিষয়গুলো নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন। হেগেল অবশ্য শোপেনহাওয়ারকে বলেছিলেন অসহ্য এবং অজ্ঞ।

বেশ মধ্যবিত্ত একটি অস্তিত্ব ছিল হেগেলের। নিজের পেশাগত জীবনের আর আয়-রোজগার নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন সারাজীবনই। প্রথমে আমরা তাকে দেখি একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে, পরে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, পরিশেষে তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মাথার চুলগুলোকে তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। বয়স বাড়লে তিনি অপেরার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন, শ্যাম্পেইন পান করতে খুব পছন্দ করতেন। বুদ্ধি বৃত্তিক জগতে অত্যন্ত সাহসী হওয়া সত্ত্বেও বাইরের দিকে তিনি ছিলেন প্রথাগত, শ্রদ্ধাযোগ্য, এবং যার জন্যে তিনি নিজে বেশ গর্বিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাজীবনের সবচেয়ে শীর্ষে তিনি উঠতে পেরেছিলেন, ষাট বছর বয়সে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হয়েছিলেন (এর পরের বছরই অবশ্য তিনি মারা যান)। তার সমালোচকরা দাবি করেন পশ্চিমা দর্শনে হেগেলের প্রভাবটি ভয়াবহ। কারণ তার লেখা ছিল খুবই জটিল এবং সংশয়-উদ্রেককারী, অথচ যখন কিনা তিনি খুব সহজেই আরো বেশি সুস্পষ্ট হতে পারতেন। তিনি মানুষের সেই দুর্বলতার প্রতি, গম্ভীর শোনায় এমন অবোধ্য গদ্যের প্রতি বিশ্বাসপ্রবণতা, খানিকটা নতি স্বীকার করেছিলেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবনাগুলো প্রায়শই এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন মনে হয় গভীর কোনো ভাবনার শনাক্তকারী চিহ্ন হচ্ছে, সেটি কেউ সহজে বুঝতে পারবেন না। এটি তার দর্শনকে অপ্রয়োজনীয় কারণেই খানিকটা দুর্বল করেছিল, আর আরো একটি মূল্য দিতে হয়েছিল, তার মূল্যবান কথাগুলো যা তিনি আমাদের বলতে চেয়েছেন, সেটি বেশ দুর্বোধ্য হয়েছিল।

তবে তার কিছু শিক্ষা স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ আর আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ইতিহাসে পাওয়া যেতে পারে। হেগেল সেই দুর্লভ দার্শনিকদের একজন, ইতিহাসকে যিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কারণ তার সময়ে, ইউরোপীয় গ্ৰহণযোগ্য চিন্তা দাবি করত, অতীতের দিকে তাকানোর একটি উপায় হতে পারে আমরা এটিকে যদি অনগ্রসর, প্রিমিটিভ বা আদিম হিসাবে বিবেচনা করতে পারি— এবং গর্ব বোধ করতে পারি, কী পরিমাণ প্রগতি সৃষ্টি করা হয়েছে আধুনিক যুগে এই উত্তরণের জন্য। কিন্তু হেগেল বিশ্বাস করতে শ্রেয়তর মনে করতেন যে, প্রতিটি যুগকে দেখা যেতে পারে একটি বিশেষ ধরনের প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের উৎস হিসাবে। এটি সেই দুর্লভ সুস্পষ্টতা দিয়ে প্রদর্শন করতে পারে যে খুব উপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধারণাগুলো নিমজ্জিত হয়ে থাকতে পারে অতীতে এবং ইতিহাসের পরবর্তী পর্বে সেগুলো আর পাওয়া যায় না অথবা আরো বেশি অস্পষ্ট বা বিশৃঙ্খলতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। সময়ের অতীতে যাবার তাই প্রয়োজন আছে জিনিসগুলো উদ্ধার করার জন্য, যা এই তথাকথিত অগ্রসর যুগে এমনকি পাওয়াও যায়না। যেমন, আমাদের হয়তো প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসকে ঘাঁটতে হবে, খনি-শ্রমিকের মতো খনন করতে হবে সমাজ কেমন হতে পারে সেই ধারণাটিকে পুরোপুরি অনুধাবন করার জন্য। মধ্যযুগ আমাদের শিক্ষা দিতে পারে, অন্য কোনো যুগই যা তেমন করে পারবেনা, সেটি হলো সম্ভ্রমবোধের ভূমিকা। অর্থ কীভাবে শিল্পকলার জন্য ব্যবহৃত হবে সেই বিষয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক দিকনির্দেশনা আমরা পেতে পারি চতুর্দশ শতকের ফ্লোরেন্সে, এমনকি যদিও সেই সময় নারীদের অধিকার ও শিশুদের প্রতি নিন্দনীয় মানসিকতা প্রদর্শন করেও থাকে।

হেগেল মনে করতেন প্রগতি কখনোই সরলরৈখিক নয়। কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান হয়তো উত্তম, কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এটি অতীতের অন্য অনেক কিছুর চেয়ে অনেক খারাপ হবার সম্ভাবনা আছে। প্রতিটি স্তরে আহরণ করার মতো প্রজ্ঞা আছে, যা আমাদের নির্দেশ করে ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব আর কর্তব্যের প্রতিঃ তাদের দায়িত্ব অতীত থেকে সেই ধারণাগুলো পুনরুদ্ধার করা যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বর্তমানে উপেক্ষিত অংশগুলো বা ব্লাইন্ড স্পটগুলোকে পাল্টা ভারসাম্য দেয়ার জন্য। এর মানে হচ্ছে যা আমরা নস্টালজিয়া বা স্মৃতিবেদনা হিসাবে চিহ্নিত করতে প্রলুব্ধ হই, সেখানে কিছুটা হলেও প্রজ্ঞা আছে। যদি মানুষরা বলেন ১৯৫০-এর দর্শনে জীবন অনেক ভালো ছিল অথবা যদি তারা ভিক্টোরীয় যুগের মিতব্যয়িতা, স্বনিভর্রতা আর কঠোর পরিশ্রমের মূল্যবোধের প্রশংসা, অনেকের জন্য লোভ সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে তাদের জানাতে, যে ঘড়ির কাঁটা পেছন দিকে নেয়া যাবেনা, আর যাই হোক না কেন সেই সময়ে অনেক কিছু ভ্ৰান্তি ও ছিল, সেই সময়ে ফিরে যাওয়াটা খুবই আতঙ্কের আর বিতৃষ্ণাময় হবে। কিন্তু হেগেল তার The Phenomenology of Spirit বইটিতে আরো খানিকটা সহমর্মী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছিলেন। সেটি হচ্ছে প্রতিটি যুগেরই কিছু গুরুত্বপূর্ণ অন্ত দৃষ্টি আছে যেগুলো (দুর্ভাগ্যজনকভাবে) সংশয়াচ্ছন্ন একগুচ্ছ ভুলের পাঁকে ডুবে আছে। সুতরাং, যদিও অবশ্যই, খুবই ভয়ানক হবে পুরোপুরি সেই অতীতে ফিরে যাওয়া, কিন্তু নস্টালজিয়া আটকে আছে সেইসব জিনিসগুলোর সাথে যেগুলো ভালো ছিল। এবং সেই ভালো বিষয়গুলোর দিকে এই বর্তমানেও আমাদের মনোযোগ দেয়া দরকার। হেগেল কল্পনা করেছিলেন আদর্শ ইতিহাস যেখানে সব অতীতের সব ভালো বিষয়গুলো উন্মুক্ত হবে তাদের সাথে সংশিষ্ট দুর্ভাগ্যজনক সবকিছু থেকে। এবং শ্রেষ্ঠ ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে সবগুলোর একটি অ্যমালগাম বা সংমিশ্রণ সৃষ্টি করবে। আমার কিছু শেখার প্রয়োজন আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন শিল্প-উদ্যোক্তা, ১৯৬৮ সালের হিপি, মধ্যযুগীয় বিশপ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি কৃষকের কাছ থেকে। হেগেল বলতেন, পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে আমাদের মনের (তিনি যাকে স্পিরিট বলেছিলেন) নিজেকেই বোঝার প্রচেষ্টারই রেকর্ড। ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্তে, মনের ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। একই জিনিস ঘটে আরো ক্ষুদ্র মাত্রায় আমাদের নিজেদের জীবনেও। শৈশবে, বিশ্বাস এবং বিস্ময় ছিল শক্তিশালী, শৈশবের শেষ হয়তো নানা অনুশাসনের অনুবর্তী হওয়া এবং শ্রেষ্ঠতর মনে করি এমন কাউকে সন্তুষ্ট করার বাসনা গুরুত্ব পেয়েছে, বয়োসন্ধিতে, সংশয় হয়তো প্রধান ভূমিকা পালন করে, এর পরে হয়তো এমন প্র্যাগম্যাটিজম বা প্রয়োগবাদের পর্ব অথবা কর্তৃত্বের অভিজ্ঞতা বা মৃত্যুর ভয়। এই প্রতিটি স্তরের বিভিন্নতায় আমরা ক্রমশ আমাদের সম্বন্ধে জানতে পেরেছি এবং আমাদের প্রয়োজন আছে এইসব স্তর অতিক্রম করা, যদি সত্যিকারভাবে আমরা নিজেদের বুঝতে চাই। পূর্ণতার আদর্শ চিত্র হবে পুঞ্জীভূত প্রজ্ঞা, সেই সবকটি স্তর থেকে আমাদের আহরিত জ্ঞান।

অপছন্দের ধারণাগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। বুদ্ধিবৃত্তিক শত্রু, যাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের মতানৈক্য আছে, তাদের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার ব্যপারে হেগেল বিশ্বাসী ছিলেন। এর কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন সত্যের নানা অংশ ছড়িয়ে থাকে এমনকি অপছন্দনীয় কিংবা অদ্ভুত কোনো জায়গায়, আমাদের উচিত সেগুলো খনন করে বের করে আনা, সবসময়ই প্রশ্ন করে, What sliver of sense and reason might be contained in otherwise frightening or foreign phenomena অর্থাৎ ভীতিকর কিংবা অচেনা কোনো ঘটনার মধ্যে জ্ঞান আর যুক্তির কি টুকরো ধারণ করে থাকতে পারে? যেমন জাতীয়তাবাদের বহু ভয়ংকর প্রকাশ আছে (এমনকি হেগেল-এর সময়েও), সুতরাং, চিন্তাশীল মানুষ প্রলুব্ধ হয় এই ক্ষেত্রটিকে তাদের চিন্তা থেকে পরিহার করার জন্য। কিন্তু হেগেলের প্রস্তাবনা ছিল, আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ভালো কোনো ধারণা অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো সেই প্রয়োজনীয়তা লুকিয়ে থাকতে পারে জাতীয়তাবাদের রক্তাক্ত ইতিহাসরে মধ্যে, যে প্রয়োজনটি এখন অপেক্ষায় আছে স্বীকৃতি ও বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রত্যাশায়। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, কোথা থেকে আমরা এসেছি, মানুষের সেই বিষয়টি নিয়ে গর্ব করার প্রয়োজনীয়তা, তাদের নিজেদের অর্জনের বাইরে বৃহত্তর কিছুর সাথে নিজেদের পরিচিতি অনুসন্ধান, তাদের সেই আত্মপরিচয়কে আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে কোথাও নোঙর করার বাসনা হচ্ছে এটি। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, এমন কোনোকিছু, যা গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান রয়ে যায়, এমনকি যখন কোনো বিশেষ ভয়ংকর আন্দোলন আর রাজনীতিবিদরা এই প্রয়োজনীয়তাকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, এটি পরিচালিত করে সর্বনাশা পরিণতির অভিমুখে। হেগেল সেই ধারণার বড় সমর্থক ছিলেন, আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো সেইসব মানুষের কাছে পাওয়া যায় যারা এমনকি ঘৃণারও অযোগ্য।

হেগেল বিশ্বাস করতেন পৃথিবী প্রগতি অভিমুখে চলে এক চরম অবস্থা থেকে অন্য চরম অবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার মাধ্যমে, যেন সে এর অতীতের ভ্রান্তি শোধরাতে বাড়াবাড়ি করে ফেলার চেষ্টা করছে। তিনি প্রস্তাব করেন যে সাধারণত প্রায় তিনটি বড় পরিবর্তন দরকার হয় কোনো একটি বিষয়ে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পেতে, এই প্রক্রিয়াটির তিনি নাম দিয়েছিলেন dialectic; হেগেলীয় ডায়লেকটিক, যা ব্যাখ্যা করেছিলেন হাইনরিশ মরিৎস শালিবাউস, তিনটি ডায়লেকটিক স্তরের বিকাশ হিসাবে : একটি থিসিস, যা এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে; একটি অ্যান্টিথিসিস, যা থিসিসটির বিরোধিতা বা নাকচ করে; এই দুটি অবস্থানের টানাপড়েনের সমাধান হয় একটি সিনথেসিস বা সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়। যদিও মডেলটি হেগেলের নামে, তিনি নিজে এটা এভাবে ব্যবহার করেননি। হেগেল কান্টকে এই শব্দগুলো সৃষ্টি করার কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। হেগেলের নিজের মডেলটি ছিল Abstract-Negative-Concrete; thesis-antithesis-synthesis-এর মডেলটি ব্যাখ্যা দেয়না কেন কোনো থিসিসের একটি অ্যান্টিথিসিস দরকার, তবে Abstract-Negative-Concrete মডেলটি প্রস্তাব করে যে-কোনো থিসিসের একটি ভ্রান্তি বা অসম্পূর্ণতাকে, যে-কোনো থিসিস শুরুতে, খুবই বিমূর্ত, সেখানে নিরীক্ষা, ভুল অথবা অভিজ্ঞতালব্ধ নেতিবাতক বিষয়গুলো চিহ্নিত থাকে না। হেগেল-এর মতে concrete, synthesis বা absolute, এবং অবশ্যই নেগেটিভ পর্যায় অতিক্রম করতে হবে এর পূর্ণতা পেতে হলে।

তাঁর নিজের সময়ে, তিনি দেখিয়েছিলেন যে সরকারব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সেটি প্রত্যক্ষভাবে না। ত্রুটিপূর্ণ, দমবন্ধ করা, পক্ষপাতদুষ্ট অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই সিস্টেমটি উত্তরাধিকারসূত্রে এসেছিল প্রথাগত রাজতন্ত্র থেকে যা অবলুপ্ত করেছিল ফরাসি বিপ্লব—যে বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সত্যিকারের কণ্ঠ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের শান্তিপূর্ণ উত্থান হবার কথা ছিল সেটি রূপান্তরিত হয়েছিল অরাজকতা, বিশৃঙ্খলতা আর সন্ত্রাসে। এটি সুযোগ করেছিল নেপোলিয়নকে ক্ষমতা দখল করার জন্যে। যিনি শৃঙ্খলা এনেছিলেন, সুযোগ করে দিয়েছিলেন প্রতিভা আর যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ পাওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি ক্ষমতার সীমানা অতিক্রম করেছিলেন, রূপান্ত রিত হয়েছিলেন একজন সামরিক দুঃস্বপ্নের, যা বাকি ইউরোপকে ত্রাসের মধ্যে রেখেছিল, যে স্বাধীনতাকে তিনি ভালোবাসেন বলে প্রচার করতেন সেটাকেই তিনি পদদলিত করেছিলেন। অবশেষে আধুনিক ভারসাম্যময় সংবিধানের আবির্ভাব ঘটে, এমন একটি বন্দোবস্ত যা বুদ্ধিমত্তার সাথে ভারসাম্য খুঁজে পেয়েছিল জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্বের সাথে সংখ্যালঘুদের অধিকারের এবং একটি মোটামুটি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায়। কিন্তু এখানে পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল কমপক্ষে চল্লিশ বছর এবং অপরিমাপযোগ্য রক্তপাত ও সংঘাত। আমাদের নিজের সময়ে, চিন্তা করে দেখুন যৌনতার প্রতি গঠনমূলক মানসিকতাটি গড়ে ওঠার মন্থর প্রক্রিয়াটির কথা। ভিক্টোরীয় পর্বে অনুশাসন ছিল তীব্র মাত্রায়, কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে দেখা যায় বেশিমাত্রায় উদার, দুটি চূড়ান্ত পর্যায়ের মধ্যে একটি ভারসাম্যের দিকে হয়তো আমরা অগ্রসর হচ্ছি। হেগেল কিছুটা ভারমুক্ত করেন দাবি করে যে প্রগতি সবসময়ই মন্থর এবং সমস্যাসংকুল। তিনি যোগ করেন যা ইতিহাসে ঘটে, সেটি ব্যক্তিজীবনেও ঘটেও। আমরাও খুব ধীরে শিখি অনেক বড়মাত্রায় সংশোধনীসহ। আমাদের আবেগীয় জীবনের বিকাশের কথা ধরুন। আমাদের বিশের দশকে হয়তো এমন কারো সাথে ছিলাম যে-কিনা তীব্র আবেগীয়। আমাদের নিজেদের শ্বাসরুদ্ধ মনে হয়েছিল, সেকারণে আমরা নিজেদের মুক্ত করি এবং বেছে নিই এমন কেউ যে শীতল অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত আবেগে। কিন্তু তাদের সেই দূরত্বও মনে হতে পারে নিপীড়নমূলক। আমাদের বয়স হয়তো পঞ্চাশ অতিক্রম করতে হবে এই বিষয়টি মোটামুটি একটি ভারসাম্যে আনতে।মনে হতে পারে হতাশাজনকভাবে সময় নষ্ট করছি আমরা। কিন্তু হেগেল দাবি করেছিলেন যে একটি ভুল থেকে অন্য একটি ভুলে যন্ত্রণাময় পদক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী, যা আমাদের প্রত্যাশা ও যার সাথে সমঝোতা করতে হবে যখন আমরা আমাদের জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করব অথবা ইতিহাস বইয়ের অথরা রাতের খবরের বিশৃঙ্খল জটিলতা নিয়ে ভাবব।

হেগেল বিশ্বাস করতেন শিল্পকলার উদ্দেশ্য আছে, art for art’s sakeবা শিল্পের জন্য শিল্প ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হেগেল; তার গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ the Introductory lectures on Aesthetics-এ তিনি দাবি করেন যে চিত্রকর্ম, সংগীত, স্থাপত্য, সাহিত্য ও ডিজাইন সবকিছুরই একটি বড় দায়িত্ব আছে। শিল্পকলা হচ্ছে the sensuous presentation of ideas; শিল্পকলার উদ্দেশ্য হেগেল-এর মতে সবসময়ই চমকে দেবার মতো অথবা নতুন কোনো ধারণা সৃষ্টি করা নয়, বরং ভালো, গুরুত্বপূর্ণ এবং সহায়ক ভাবনাগুলো আমরা প্রায়শই যা ইতিমধ্যে জানি, সেটিকে আমাদের মনের আরো গভীরে প্রোথিত করা।

প্রতিষ্ঠান এবং এর শক্তি সম্বন্ধে হেগেলের ইতিবাচক ধারণা ছিল। একজন মানুষের অন্তর্দৃষ্টি গভীর হতে পারে, কিন্তু সেটি অকার্যকর এবং ক্ষণস্থায়ী হবে যদি তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায়। যিশুখ্রিস্টের যন্ত্রণাভোগ ও সহমর্মিতার প্রয়োজন হয়েছিল ক্যাথলিক চার্চের, যা বিশ্বের কাছে সেটি উপস্থাপন করেছিল। শৈশবে জটিলতা-সংক্রান্ত ফ্রয়েডের ধারণা সত্যিকারভাবে গঠনমূলক শক্তি হতে পারেনি, যতদিন না সেগুলো সংগঠিত, সম্প্রসারিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল লন্ডনের টাভিস্টোক ক্লিনিকে। বিষয়টি হচ্ছে কোনো ধারণাকে সক্রিয় এবং কার্যকরী হতে হলে অনেককিছুর প্রয়োজন আছে, সেগুলো শুধুমাত্র সঠিক সেটি ছাড়াও। এই লক্ষ্যটাই হেগেল বারবার বহুভাবেই বলেছিলেন। কোনো একটি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হলে এর একটি প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দেয়া জরুরি। কারণ প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তিবিশেষের চেয়ে বেশি সময় দিতে পারে সেই ধারণাটির পূর্ণতা পাবার সময় দেবার ক্ষেত্রে। তার মতে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হচ্ছে সমাজে মূল সত্যিগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলা, এবং কোনো একটি প্রতিষ্ঠান তার পথ হারায় যখন গভীর কোনো উদ্দেশ্য থাকেনা, সুতরাং কোনো একটি সমাজের নতুন প্রয়োজনগুলো যখনই শনাক্ত করা হয়, আদর্শ উপায় হবে তাদের নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করা। ইদানীং যেমন আমরা বলতে পারি আমাদের বড় নতুন প্রতিষ্ঠানের দরকার আছে যারা পারস্পরিক সম্পর্ক, ভোক্তাদের শিক্ষা, পেশা নির্বাচন, মানসিক অবস্থা ব্যবস্থাপনা কিংবা কীভাবে আমরা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্থ শিশুদের প্রতিপালন করতে পারি।

হেগেল আধুনিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের উপর নজর দিয়েছিলেন, আমরা প্রগতি আর উন্নতি চাই কিন্তু আমরা সারাক্ষণই মুখোমুখি হই দ্বন্দ্বের এবং ব্যর্থতার। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে বৃদ্ধির জন্য দরকার ভিন্ন ভিন্ন ধারণার সংঘর্ষ, সেকারণে এটি কষ্টকর আর ধীর। কিন্তু একবার যখন আমরা সেটি জানতে পারি, আমাদের সমস্যাকে আর জটিল করার প্রয়োজন নেই তাদের অস্বাভাবিক ভেবে। হেগেল আমাদের আরো সঠিক এবং তারপরও আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিলেন আমাদের জন্যে, আমাদের সমস্যার জন্য এবং ইতিহাসে আমাদের অবস্থানের জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *