1 of 2

অধ্যায় ৩৭ : স্বাধীনতার যন্ত্রণা – জ্যাঁ-পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বুভোয়া, আলবেয়ার্ট কামু

অধ্যায় ৩৭ : স্বাধীনতার যন্ত্রণা – জ্যাঁ-পল সার্ত্র, সিমোন দ্য বুভোয়া, আলবেয়ার্ট কামু

যদি অতীতে, ১৯৪৫ সালের প্যারিসের একটি ক্যাফে, লে দো ম্যাগোতে কোনোভাবে যেতে পারেন আপনি, খুবই সম্ভাবনা আছে কোটর থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসছে এমনবড় বড় চোখবিশিষ্ট ছোটখাটো এক ব্যক্তিকে আপনি সেখানে আবিষ্কার করবেন, দেখবেন মানুষটি তার মুখে পাইপ দিয়ে ধূমপান করছেন আর একটি নোটবইতে একাগ্রচিত্তে লিখে যাচ্ছেন। এই মানুষটি ছিলেন জ্যাঁ-পল সার্ত্র (১৯০৫-১৯৮০), সবচেয়ে বিখ্যাত অস্তিত্ববাদী দার্শনিক। তিনি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও জীবনীকারও ছিলেন। তিনি তাঁর বেশিরভাগ জীবনই কাটিয়েছিলেন হোটেলে বাস করে, আর লেখালেখির বেশিরভাগই করেছিলেন ক্যাফেতে বসে। তাঁকে দেখে কোনো ধর্মগোষ্ঠীর আকর্ষণীয় গুরুর মতো মনে হয় না, তবে এর কিছুদিন পরই তিনি ঠিক তেমনই একটি চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। এবং প্রায়শই সেখানে একজন সুন্দরী এবং খুবই বুদ্ধিমান রমণী তার সাথে যোগ দিতেন, সিমোন দ্য বুভোয়া (১৯০৮-১৯৮৬), তারা পরস্পরকে চিনতেন কলেজজীবন থেকেই। সিমোন ছিলেন সার্ভের দীর্ঘদিনের বান্ধব, যদিও তারা কখনোই বিয়ে করেননি এবং কখনোই একসাথে বাস করেননি। তাদের অন্য প্রেমিক-প্রেমিকাও ছিল, কিন্তু তাদের পারস্পরিক সম্পর্কটাই ছিল দীর্ঘস্থায়ী। তারা এটি বর্ণনা করতেন আবশ্যিক সম্পর্ক হিসাবে, আর বাকি সম্পর্কগুলোকে চিহ্নিত করতেন contingent, বা আবশ্যিক নয় এমন কোনো সম্পর্ক হিসাবে। সার্ত্রের মতো তিনিও ছিলেন একজন দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক। নারীবাদ নিয়ে শুরুর দিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইটি তিনি লিখেছিলেন। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত সেই বইটির নাম The Second Sex।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেশিরভাগ সময়ই প্যারিস দখল করে ছিল নাৎসিরা। ফরাসিদের জন্য জীবন তখন খুব সহজ ছিল না। কেউ কেউ বিদ্রোহীদের সাথে যুক্ত হতে পেরেছিল জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। অন্যরা নাৎসিদের হাতে হাত মিলিয়েছিল, নিজেদের বাঁচাতে বন্ধুদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। খাদ্য ছিল অপ্রতুল, রাস্তায় বন্দুকযুদ্ধ হতো নিয়মিত, মানুষ অদৃশ্য হয়ে যেত, যাদের আর কোনোদিনও দেখা যায়নি। প্যারিসের সব ইহুদিদের পাঠানো হয়েছিল নাৎসি কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পে, যেখানে অধিকাংশকেই হত্যা করা হয়েছিল। মিত্রবাহিনী জার্মানিকে পরাজিত করার পর সময় আসে নতুন করে জীবন শুরু করার। এটি একই সাথে শান্তির সেই পরিস্থিতিও, যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এবং সেই অনুভূতি, এবার সেই অতীতকে পেছনে ফেলে আসতে হবে। এটি ছিল এমন একটি সময় তখন ভাবনার দরকার ছিল, ঠিক কেমন করে নতুনভাবে ফরাসি সমাজটি গড়ে উঠবে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তবে এর অতীতকে মূল্যায়ন করে। যুদ্ধের সময় ঘটা ভয়াবহ ঘটনাগুলোর পর, নানাধরনের মানুষরা নিজেদের প্রশ্ন করেছে, যে-ধরনের প্রশ্ন সাধারণত দার্শনিকরা করে থাকেন। যেমন, বেঁচে থাকার অর্থ কী? আসলেই কি ঈশ্বর বলে কেউ আছেন? আমি কি অবশ্যই সেটাই সবসময় করব, যা অন্যরা প্রত্যাশা করে যে আমি করব?

সার্ত্র ততদিনে একটি বড় আর কঠিন বই লিখে ফেলেছেন, Being andNothingness (১৯৪৩), যুদ্ধের সময়েই এটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ের মুল বিষয়টি ছিল স্বাধীনতা। মানুষ হচ্ছে স্বাধীন। নাৎসিদের দখল করে রাখা ফ্রান্সের জন্য এটি ছিল অদ্ভুত একটি বার্তা, যখন কিনা ফরাসিরা অনুভব করেছিল, অথবা আসলেই অনুভব করেছে, তারা তাদের নিজেদের দেশেই বন্দী। যদিও তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন, তাহলো, ধরুন, একটি ছুরির, ব্যতিক্ৰম, মানুষকে বিশেষ কোনো কাজ করার জন্যে এমন পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। সা বিশ্বাস করতেন না যে কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, যিনি আমাদের পরিকল্পনা করে সৃষ্টি বা ডিজাইন করতে পারেন। সুতরাং তিনি সেই ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে আমাদের জন্য ঈশ্বরের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। ছুরি এমনভাবে পরিকল্পনা করে বানানো হয় যেন এটি কিছু কাটতে পারে। এটাই তার মূল বা ‘এসেন্স’, যে বিষয়টি এটি যা, তাকে সেটি বানায়। কিন্তু মানুষকে কী কাজের জন্যে ডিজাইন করে তৈরি করা হয়েছে? মানুষের কোনো এসেন্স নেই। আমাদের কোনো কারণেই এখানে সৃষ্টি হয়নি, তিনি ভেবেছিলেন। এমন কোনো বিশেষ উপায় নেই মানুষ হবার জন্যে যা আমাদের অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। একজন মানুষ কী করবে, সেটি সে নিজে নির্বাচন করতে পারে। আমরা সবাই স্বাধীন। আর কেউ না, শুধুমাত্র আপনি পারবেন আপনার জীবন নিয়ে কী করবেন সেটি নির্ধারণ করতে। যদি আপনি অন্য মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে দেন, কীভাবে আপনি বাঁচবেন, সেটিও আবারো, আপনার নিজের ইচ্ছা, একটি চয়েস। অন্য কোনো মানুষ যা প্রত্যাশা করে তেমন মানুষ হওয়াটা আপনার নিজের নির্বাচিত সিদ্ধান্তেরই ফল, একটি চয়েস।

অবশ্যই যদি আপনার পছন্দমতো কিছু করার জন্যে সিদ্ধান্ত নেন, আপনি হয়তো সবসময়ই সফল হতে পারবেন না সেটি করতে এবং যে-কারণে আপনি সফল হতে পারবেন না সেটি হয়তো পুরোপুরিভাবে আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু সেটি করার ইচ্ছা পোষণ করার জন্য আপনি নিজে দায়ী, আপনিই দায়ী সেটি করার চেষ্টার জন্যে, এবং সেটি করতে আপনার ব্যর্থতার প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবেন সেটির জন্যেও আপনিও দায়ী। স্বাধীনতা খুব হালকা দায়িত্ব না, এর দায়িত্ব নেয়া বেশ কঠিন, এবং আমরা অনেকেই সেই স্বাধীনতা থেকে পালিয়ে বেড়াই। লুকিয়ে থাকার উপায়গুলোর মধ্যে একটি উপায় হচ্ছে ভান করা যে, আমরা আসলেই স্বাধীন না। যদি সার্ত্র সঠিক হয়ে থাকেন, আমরা তাহলে কোনো অজুহাত দেখাতে পারব না, আমরা পুরোপুরিভাবে দায়ী যা-কিছু প্রতিদিন করছি তার জন্যে এবং যা করছি সে-বিষয়ে যা অনুভব করি তার জন্যে। আমাদের সব আবেগ ও অভিব্যক্তির জন্যেই আমরা দায়ী। সার্ত্রের মতে, যদি আপনি এখন দুঃখিত হয়ে থাকেন, সেটি আপনার নিজের সিদ্ধান্ত বা চয়েস; আপনাকে দুঃখিত হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যদি আপনি দুঃখিত হন, তাহলে তার জন্যে আপনি দায়ী। বহু মানুষের জন্যে এমন কোনো পরিস্থিতি খুবই ভীতিকর এবং কিছু মানুষের মুখোমুখি না-হওয়াই সমীচীন মনে করেন, কারণ এটি খুবই যন্ত্রণাদায়ক। আমাদের অস্তিত্বের দণ্ড হচ্ছে আমরা স্বাধীন, এ বিষয়েই তিনি লিখেছিলেন, তার ভাষায় আমরা condemned to be free, আমাদের শাস্তি হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। আমরা এই স্বাধীনতার সাথে যুক্ত হয়ে আছি, আমাদের চাওয়া বা না-চাওয়ার উপর কিছু যায় আসে না। সার্ত্র ক্যাফেতে একজন ওয়েটারকে বর্ণনা করেছিলেন। এই ক্যাফে-ওয়েটার খুব ফ্যাশনদুরস্ত উপায়ে তার কাজ করে যাচ্ছিল, অভিনয় করছিল যেন সে একধরনের পুতুল। তার ব্যাপারে সবকিছুই ইঙ্গিত করছে যে, নিজেকে সে ভাবছে যেন তার দায়িত্ব দ্বারা সে পুরোপুরিভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে একজন ওয়েটার হিসাবে, অন্য কোনো ব্যাপারে তার নিজস্ব কোনো নির্বাচন বা বাছাই নেই। যেভাবে সে ট্রে ধরে থাকে, যেভাবে সে টেবিলের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে, সবকিছু একটা নাচের মতো, যে নৃত্য পরিচালনা করছে ওয়েটার হিসাবে তার কাজটি, মানুষটি নয়, যে এখানে অভিনয় করছে একটি ভূমিকায়। সার্ত্রের ভাষায় এই মানুষটি একটি bad faith-এ আক্রান্ত, সার্ত্রের bad faith হচ্ছে স্বাধীনতা থেকে পালিয়ে বেড়ানো। এটি একধরনের মিথ্যা, যা আপনি নিজেকে বলবেন এবং প্রায় বিশ্বাসও করবেন: সেই মিথ্যাটি, ইচ্ছামতো আপনার জীবন নিয়ে যা করতে চান তা করার জন্যে আপনি আসলে স্বাধীন না, যখন সার্ত্রের মতে, আপনি পছন্দ করুন বা না করুন, আপনি আসলেই স্বাধীন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, Existentialism is a Humanism, অস্তিত্ববাদ হচ্ছে মানবতাবাদ; যেখানে সার্ত্র বর্ণনা করেন, মানবজীবন পূর্ণ নানা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। এই উদ্বেগ আসে সেই বোঝাপড়া থেকে যে, আমরা আসলেই কোনো অজুহাত দেখাতে পারব না, বরং আমরা যা- কিছু করছি তার সবকিছুর জন্যে আমরাই দায়ী। কিন্তু এই উদ্বেগ আরো খারাপ কারণ সার্ত্রের মতে, আমাদের জীবনের সাথে আমরা যা-কিছু করি না কেন, অন্যরাও তাদের জীবন নিয়ে করবে এটি তারও একটি টেমপ্লেট বা ছাঁচ। যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার জন্যে, আপনি প্রস্তাব করছেন যে সবারই বিয়ে করা উচিত, আপনি যদি অলস হন তার মানে আপনি প্রস্তাব করছেন সবাই সেটাই করুক আপনার মানব-অস্তিত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আপনার জীবনে আপনি যেসব চয়েসগুলো নির্ধারণ করবেন বা সিদ্ধান্ত নেবেন, আপনি যেন একটি দৃশ্য আঁকেন যা প্রদর্শন করে অন্য মানুষের কী করা উচিত সে বিষয়ে আপনি কী চান। যদি আপনি সেটি আন্তরিকভাবে করে থাকেন তাহলে আসলেই এটি অনেক বড় দায়িত্ব। সার্ত্রে ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি anguish of choice বা কোনোকিছু নির্বাচন করার উদ্বেগ বলতে কী বোঝাচ্ছেন। তাঁর একটি ছাত্রের সত্যিকাহিনি বর্ণনা করেছিলেন, যুদ্ধের সময় যে উপদেশ নিতে তাঁর কাছে এসেছিল। এই তরুণের একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে তার বাড়িতে থাকতে পারে তার মায়ের দেখাশুনা করার জন্য, অথবা সে পালিয়ে যেতে পারে ফরাসি বিদ্রোহীদের সাথে যুক্ত হবার জন্য, যেন সে জার্মানদের পরাজিত করে নিজের দেশকে স্বাধীন করতে পারে। এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত এবং সে মনস্থির করতে পারছিল না কী করবে। সে যদি মাকে ফেলে চলে যায় তাহলে তার মা অসহায় হয়ে পড়বে। সে হয়তো জার্মানদের নজর বাঁচিয়ে ফরাসি বিদ্রোহীদের সাথে যুক্ত নাও হতে পারে, সে হয়তো ধরা পড়তে পারে। আর তখন তার মহৎ কিছু করার সার্বিক প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে এবং জীবনও নষ্ট হবে। কিন্তু যদি সে থাকে বাসায় তার মায়ের সাথে, সে তার হয়ে অন্যদের যুদ্ধ করতে দেবে। তার কী করা উচিত? আপনি হলে কী করতেন? আপনি তাকে কোন্ উপদেশ দিতেন?

সার্ত্রের উপদেশটি ছিল বেশ হতাশাজনক। তিনি ছাত্রটিকে বলেছিলেন, সে স্বাধীন এবং তার নিজের সিদ্ধান্ততার নিজেকেই বাছাই করতে হবে। যদি সার্ত্র তাঁর ছাত্রকে কোনো ব্যবহার-উপযোগী উপদেশ দিতেন তার কী করা উচিত সে- বিষয়ে, তাহলে ছাত্রটির তারপরও নিজের থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া লাগত, সেটি সে অনুসরণ করবে কি, করবে না। কোনো উপায় নেই দায়িত্বের সেই ভারটিকে এড়ানো, মানুষ হবার কারণে যা আমাদের জীবনের অপরিহার্য একটি অংশ। সার্ত্রের দর্শনকে অন্য মানুষরা নামটি দিয়েছিলেন Existentialism বা অস্তিত্ববাদ; এই নামটি এসেছিল সেই ধারণা থেকে যে, প্রথম যে বোধটি আমরা অনুভব করি, তাহলো এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব আছে এবং তারপর আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমরা আমাদের জীবন নিয়ে কী করব। এটা অন্যরকমও হতে পারত: আমরা সবাই ছুরি হতে পারতাম, যাদের ডিজাইন করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ করার কারণে। কিন্তু সার্ত্র বিশ্বাস করতেন, আমরা সেরকম কিছুনই। তার ভাষায় বললে, আমাদের অস্তিত্ব আসে আমাদের এসেন্স-এর আগে, কিন্তু পরিকল্পিত করে বানানো যে-কোনোকিছুরই অস্তিত্বের আগে আসে এর এসেন্স। দ্য সেকেন্ড সেক্স- এ সিমোন দ্য বুভোয়া এই অস্তিত্ববাদের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এমন দাবি করে যে, নারীরা নারী হিসাবে জন্মায় না, তারা নারীতে রূপান্তরিত হয়। তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন, নারীদের প্রবণতা আছে একজন নারী বলতে কী বোঝায় সেই বিষয়ে পুরুষদের/বা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ ও আত্তীকৃত করে নেবার। কিন্তু পুরুষরা নারীর কাছে কী প্রত্যাশা করছে সেটি হওয়া কিন্তু নারীর জন্য একটি চয়েস, তার স্বাধীণ নির্বাচনের অংশ। নারী, স্বাধীন হবার কারণে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা কী হতে চায়। তাদের কোনো এসেন্স নেই, প্রাকৃতিকভাবে তাদের কোনো পথনির্দেশনা দেয়া নেই, তাদের যা অবশ্যই হতে হবে।

অস্তিত্ববাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূল ভাবনা ছিল আমাদের অস্তিত্বের অ্যাবসার্ডিটি বা অর্থহীনতা। জীবনের কোনো অর্থ নেই যতক্ষণ-না আমরা এটিকে একটি অর্থ দিচ্ছি আমাদের সিদ্ধান্ত আর নির্বাচন দিয়ে, এবং তারপর খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু আসে এবং সব অর্থকে অপসারণ করে যা আমরা একটি দিতে পারি। এই বিষয়টির সার্ত্রের সংস্করণ হচ্ছে মানুষকে a useless passion হিসাবে বর্ণনা করা। আমাদের এই অস্তিত্বের আসলেই কোনো অর্থ নেই, প্রত্যেকেই ‘চয়েস’ দিয়ে আমরা শুধুমাত্র যে অর্থগুলো সৃষ্টি করি সেগুলো ছাড়া।

আলবেয়ার্ট কামু (১৯১৩-১৯৬০), ঔপন্যাসিক দার্শনিক, যার সাথে অস্তিত্ববাদের সম্পর্ক ছিল, তিনি সিসিফাসের পুরাণকাহিনিটি ব্যবহার করেছিলেন মানবজীবনের অদ্ভুত অর্থহীনতাটা প্রকাশ করতে। দেবতাদের প্রতারণা করার দণ্ড হিসাবে সিসিফাসকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল যে সে একটি বিশাল পাথরের টুকরাকে ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাবে, কিন্তু যখনই সে চূড়ায় পৌঁছাবে, পাথরটি আবার গড়িয়ে পড়বে নিচে এবং সেটিকে নিচ থেকে উপরে তোলার কাজটি সিসিফাসকে আবার শুরু করতে হয়। সিসিফাসকে এই একটি কাজ বারবার করতে হয় আজীবন। মানুষের জীবনটা সিসিফাসের কাজের মতোই পুরোপুরি অর্থহীন। কোনো লক্ষ্য নেই এর, কোনো উত্তরই এটি ব্যাখ্যা করতে পারবে না সবকিছু, খুবই অদ্ভুত। কিন্তু কামু ভাবেননি যে আমাদের হতাশ হওয়া উচিত। আমাদের উচিত না আত্মহত্যা করা। পরিবর্তে আমাদের শনাক্ত করতে হবে যে সিসিফাস আসলে সুখী। কিন্তু কেন সে সুখী? কারণ পাহাড়ের উপর বিশাল পাথর ঠেলে তোলার মতো অর্থহীন সংগ্রামে কিছু আছে যা বেঁচে থাকাকে মূল্যবান করে তোলে। তারপরও এটি মৃত্যুর চেয়ে শ্রেয়।

অস্তিত্ববাদ একটি একটি অনুসারী গোষ্ঠীদের সংগঠন বা কাল্টে রূপান্তরিত হয়েছিল। হাজার হাজার তরুণকে এটি আকর্ষণ করেছিল এবং গভীর রাত অবধি মানব-অস্তিত্বের অর্থহীনতা নিয়ে তারা আলোচনা করে কাটিয়েছিল। বহু উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্র সৃষ্টির প্রক্রিয়া ও অভিব্যক্তিকে এটি অনুপ্রাণিত করেছিল। এটি এমন একটি দর্শন, যা দিয়ে মানুষ পথ চলতে পারে, তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে এটি ব্যবহার করতে পারে। সার্ত্র নিজেও রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং বয়স বাড়ার সাথে তিনি আরো বেশি বামপন্থী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মার্কসবাদের মূল বিষয়গুলোর সাথে তাঁর আগের ধারণাগুলোকে সংশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে কাজটি বেশ কঠিন ছিল। ১৯৪০-এর দশকে তার অস্তিত্ববাদ মূলত কেন্দ্ৰীভূত ছিল একক ব্যক্তিসত্তার উপর, যে নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নেয়। কিন্তু তার পরের কাজে, তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন কীভাবে আমরা আরো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং কীভাবে আমাদের জীবনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিয়ামকগুলো তাদের ভূমিকা পালন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর লেখা আরো অবোধ্য হয়ে উঠেছিল, হয়তো কিছুটা তার কারণ বেশিরভাগ লেখাই তখন লেখা হয়েছে, যখন তিনি অ্যাম্ফিটামিনের নেশায় মত্ত। সার্ত্রের বাবা ছিলেন নৌবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন, কিন্তু শৈশবেই তাকে হারান সার্ত্র, মায়ের খুব সান্নিধ্যে তিনি বড় হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু তার বারো বছর বয়সে এবং তাকে বেশ ব্যথিত করেই তার মা আবার বিয়ে করেন। সার্ত্র তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন প্যারিসে, যেখানে বিশেষ কিছু ক্যাফে এবং জার্দা দ্য লুক্সেমবুর্গে তাকে নিয়মিত দেখা যেত। তাঁর চোখের একটি সমস্যা ছিল, যাকে বলা হয় স্ট্রাবিসমাস, তার চোখগুলো কোনোকিছু দেখার সময় ঠিকমতো তাদের অবস্থানে থাকতে পারত না, বৈশিষ্ট্যসূচক ভারী কাঁচের একটি চশমা পরতেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, কিন্তু তিনি সেটি নিতে অস্বীকার করেন, কারণ তিনি মনে করতেন সেটি পুঁজিবাদী আর বুর্জোয়াদের পুরস্কার। তিনি লম্বায় বেশি দীর্ঘ ছিলেন না (পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি), এবং প্রায়শই নিজেকে বর্ণনা করেছেন কুৎসিত হিসাবে। ব্যাকব্রাশ করে চুল আঁচড়াতে তিনি পছন্দ করতেন। যখন ১৯৮০ সালে তিনি মারা যান (৭৪ বছর বয়সে), প্রায় ৫০ হাজার মানুষ তার শবযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন। অস্তিত্ববাদী দর্শন আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, দর্শন আর চিন্তাকে তিনি আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন তার জনপ্রিয়তার কারণে। তিনি খুব জটিল, সহজে অনুসরণ করা যায় না এমন একটি বই, Being and Nothingness লিখেছিলেন। অনেক দার্শনিক মনে করেন বইটি তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল, মানুষ সেখানে বর্ণিত তার ধারণাগুলোর যতটা বুঝতে পেরেছিল তার জন্যে নয় বরং বইটি তার সুনাম বাড়িয়েছিল কারণ তারা বিষয়টি তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। সার্ত্র ছিলেন সেই সুফল ভোগকারীদের একজন, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যে-সময় কোনো বইকে এর ধারণাগুলোর সুস্পষ্টতার জন্য নয়, বরং তাদের রহস্যময়তার জন্য শ্রদ্ধা করার প্রবণতা শুরু হয়েছিল।

অস্তিত্ববাদ চারটি মূল অন্তর্দৃষ্টির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল

এক. আমরা যতটা ভাবতে পারি সবকিছু তারচেয়ে আরো বেশি অদ্ভুত : সাৰ্ব খুব একাগ্রভাবেই মনোযোগী ছিলেন, সেইসব মুহূর্তগুলোর প্রতি, যখন পৃথিবী নিজেকে উন্মোচন করেছে আরো বেশি বিস্ময়কর আর অদ্ভুতরূপে, সাধারণত আমরা যতটা স্বীকার করি তারচেয়েও বেশি। যে মুহূর্তে প্রাত্যহিক দিনের সাথে যে-যুক্তিগুলো আমরা যুক্ত করি সেগুলো আর পাওয়া যায় না, সবকিছুই তখন খুববেশি অনিশ্চয়তাপূর্ণ এবং অর্থহীন আর ভীতিকর হয়ে ওঠে। সার্ত্রের প্রথম উপন্যাস Nausea প্রকাশ হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। এই উপন্যাসটিতে এ-ধরনের বহু পরিস্থিতির বিবরণ দিয়েছে। একটি মুহূর্তে, বইটির নায়ক, রোকোঁতাঁ, ৩০ বছর বয়স্ক একজন লেখক, যিনি কাল্পনিক একটি সাগরের পাশে একটি বাসায় বাস করতেন, তখন ট্রামে বসে, সিটের উপর তিনি তার হাত রাখেন কিন্তু তারপরই খুব দ্রুত তিনি হাত সরিয়ে নেন। খুব সাদামাটা আর স্বাভাবিক ডিজাইনের অংশ হওয়ার বদলে, যার দিকে মুহূর্তের বেশি মনোযোগ দেবার দরকার নেই, তার কাছে সিটটিকে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় খুব অদ্ভুত কিছু। ‘সিট’ শব্দটি বন্ধনচ্যুত হয়ে পড়ে এর অর্থের। সিট শব্দটি যে তথ্য নির্দেশ করে সেটি তার সব আদিম উদ্ভটতা নিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে, যেন এমন কিছু সে কখনোই আর দেখেননি। এবং এর নির্মাণ উপাদান ও খানিক স্ফীতি সেটি তাকে মনে করিয়ে দেয়া মৃত গাধার ফুলে থাকা পেটের মতো। রোকোঁতা নিজেকে বাধ্য করেন মনে করাতে যে, তার পাশে এই জিনিসটা এমনকিছু যার উপর মানুষ বসে আছে। কিন্তু একটি ভীতিকর মুহূর্তের জন্যে, রোকোঁতা সেটি লক্ষ্য করেছিলেন, যাকে সার্ত্র বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর অর্থহীনতা’। এই মুহূর্তগুলোর অবস্থান আমরা দেখি সার্ত্রের দর্শনের কেন্দ্রে। সার্ত্রীয় হওয়া মানে আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হওয়া, আমাদের দিনযাপনে রুটিনের ফলে পাওয়া সবধরনের পূর্বসংস্কার আর স্থিতিশীল করার মতো ধারণাগুলো থেকে যখন সেটি অনাবৃত করা হয়। আমরা আমাদের জীবনের নানাক্ষেত্রে সার্ত্রের এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যবহার করতে পারি। চিন্তা করুন পরিচিত কারো সাথে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা, এই ধরনের বিবরণ, সবকিছুই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কিন্তু সার্ত্রের উপরিপৃষ্ঠের স্বাভাবিকতাকে সরিয়ে ফেলেন দেখাতে যে কী পরিমাণ বিস্ময়কর অদ্ভুত বিষয় এর নিচে লুকিয়ে আছে। নৈশভোজনের মানে আসলে কী, যখন এই গ্রহের আপনার অংশটি বহুদূরের হাইড্রোজেন বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট শক্তির উৎস থেকে অর্ধেক ঘুরে গেছে, আপনি আপনার হাঁটু ঢুকিয়ে দিচ্ছেন গাছ কেটে বানানো তক্তার নিচে এবং মৃতপ্রাণী ও উদ্ভিদের কিছু অংশ আপনার মুখে নিয়ে চিবাচ্ছেন, যখন আপনার পাশে বসে আছে আরেকটি স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার যৌনাঙ্গ আপনি মাঝে মাঝে স্পর্শ করেন, সেও ঠিক একই কাজ করছে। অথবা আপনার কাজকে সার্ত্রের দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করুন: আপনি এবং অনেকে কাপড়ে শরীর আবৃত করে একটা বড় বাক্সে এসে উপস্থিত হন অনেকের মতোই, যেখানে আপনারা একে অপরের সাথে উত্তেজিত শব্দ বিনিময় করেন, আপনি বহু প্লাস্টিকের বোতাম চাপেন দ্রুততার সাথে কিছু কাগজের টুকরোর বিনিময়ে। তারপর আপনি থামেন ও চলে যান, পরে আবার যখন আকাশ আলোকিত হয়, আপনিও ফিরে আসেন। (হ্যাঁ, অফিসে)।

দুই. আমরা স্বাধীন: এইসব অদ্ভুত মুহূর্তগুলো অবশ্যই আমাদের হতবিহ্বল, বরং খানিকটা শঙ্কিত করে। কিন্তু সার্ত্র চেয়েছিলেন সেই সবকিছু যেন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি প্রধান কারণে: এইসব মুহূর্তগুলোর ক্ষমতা আছে আমাদের মুক্তির অনুভূতি দেবার জন্য। আমরা যা ভাবি জীবন তারচেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত (অফিসে যাওয়া, বন্ধুর সাথে ডিনার খাওয়া, পিতামাতার সাথে দেখা করা, এর কোনোটাই বোধগম্য নয় অথবা কোনোভাবে স্বাভাবিক না) বরং এটি আরো অনেক সম্ভাবনার পরিণতি। যেভাবে সবকিছু আছে ঠিক সেভাবে সবকিছু থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা আমাদের যতটুকু কল্পনা করার অনুমতিদিই সাধারণ প্রতিশ্রুতি আর দায়িত্বের চাপে, আমরা তারচেয়েও বেশি স্বাধীন। শুধুমাত্র গভীর রাতে, হয়তো অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে, অপরিচিত কোনো জায়গায় দীর্ঘ যাত্রাপথে আমরা আমাদের মনকে অনুমতি দিই অপেক্ষাকৃত কম প্রথাগত দিকে আমাদের দিবাস্বপ্নকে উড়তে। এই মুহূর্তগুলো একই সাথে অস্বস্তিকর, আবার নিজেদের মুক্তও করে। আমরা বাসা থেকে বের হয়ে যেতে পারি, সম্পর্ক ভাঙতে পারি এবং যে-মানুষগুলোর সাথে আমরা বাস করছি তাদের আর কখনো নাও দেখতে পারি। আমরা আমাদের চাকরি ছেড়ে দিতে পারি, অন্য দেশে চলে যেতে পারি, নিজেদের পুনরায় পুরোপুরি ভিন্ন কোনো একটি মানুষ হিসাবে আবিষ্কার করতে পারি।

সাধারণত আমাদের কারণেরও কোনো অভাব নেই, কেন এর কোনোটাই সম্ভব হবে না তা ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু সার্ত্র তাঁর সংশয়পূর্ণ মুহূর্তগুলোর বিবরণের মাধ্যমে আমাদের নতুন ধরনের কিছু চিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যা-কিছু স্বাভাবিক, থিতু হয়ে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি ধ্যানধারণা থেকে তিনি আমাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আমাদের কল্পনাকে স্বাধীন করার জন্যে। আমরা হয়তো কাজে যাওয়ার জন্যে আবার বাসে উঠব, আন্তরিক নয় এমন কথাই বলব সেইসব মানুষদের সাথে যাদের আমরা পছন্দ করিনা, কিংবা নিরাপত্তার ভ্রান্ত ধারণার উপর আমাদের প্রাণশক্তিকে বিসর্জন দেব। আমাদের স্বাধীনতার পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে সার্ত্র বলেছিলেন আমরা মুখোমুখি হব উদ্বেগ বা অস্তিত্বের উদ্বেগ বা anguish-এর। সবকিছুই (ভীতিকরভাবেই) সম্ভব কারণ কোনোকিছুরই পূর্ব-নির্দেশিত, ঈশ্বর-প্রদত্ত অর্থ বা লক্ষ্য নেই। মানুষ তাদের জীবনযাপনের সাথেই এগুলো মনের মতো বানিয়ে নেয়, এবং যে-কোনো মুহূর্তে চাইলে সেই শৃঙ্খলগুলো ছুড়ে ফেলতে পারে। বিবাহ কিংবা চাকরির মতো অমানবিক শৃঙ্খলা আর কিছুই নেই পৃথিবীতে। এগুলো শুধু নির্দেশিকা যা নানা জিনিসের উপর আটকে দিয়েছিল, আর সঠিক অস্তিত্ববাদীর মতোই, আমরা স্বাধীন সেগুলোকে আবার ফেলে দেবার জন্যে। এই সবকিছুই আতঙ্কিত করার মতোই নিদারুণ যন্ত্রণার, সেকারণেই anguish বা উদ্বেগ শব্দটির ব্যবহার। কিন্তু সার্ত্র এই anguish- কে দেখেছিলেন পরিণত হবার চিহ্ন হিসাবে, একটি চিহ্ন যে, আমরা পুরোপুরিভাবে বেঁচে আছি আর সঠিকভাবে বাস্তবতা সম্বন্ধে সচেতন আছি, সচেতন আছি এর স্বাধীনতা, এর সম্ভাবনা এবং এর গুরুভার সিদ্ধান্তগুলো সম্বন্ধে।

তিন. আমাদের Bad faith নিয়ে বাঁচা উচিত না: স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করে বাঁচার বিষয়টিকে তিনি নাম দিয়েছিলেন, Bad faith; আমরা ব্যাড ফেইথে তখনই, যখন আমরা বলি সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট নিয়মে হতে হবে আর চোখ বন্ধ করে রাখি বিকল্প পথগুলোর দিকে। এই ব্যাড ফেইথই জোর করে যে, আমাদের অবশ্যই কোনো একটি বিশেষ ধরনের কাজ করতে হবে, বা কোনো একটি বিশেষ মানুষের সাথে বাস করতে হবে, কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসতি স্থাপন করতে হবে। Being and Nothingness বইটিতে আমরা সবচেয়ে বিখ্যাত Bad faith-এর উদাহরণটি পাই। যখন সার্ত্র একজন ওয়েটারকে লক্ষ্য করেছিলেন যাকে দেখে তার মনে হয়েছে সে বেশিমাত্রায় তার ওয়েটার হিসাবে ভূমিকায় নিবেদিত, যেন স্বাধীন মানুষ হবার চেয়ে বরং তিনি প্রথমে ও প্রধানত একজন ওয়েটার, তার নাড়াচাড়া দ্রুত এবং অগ্রসর, একটু বেশি নিখুঁত, সুনির্দিষ্ট, একটি বেশি দ্রুত। সে ক্যাফের অতিথির দিকে এগিয়ে আসে খানিকটা বেশি দ্রুত পদক্ষেপে, একটু বেশি আগ্রহে সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তার কণ্ঠে আর চোখের দৃষ্টি প্রকাশ করে যেন অতিথির নির্দেশ পালনের জন্য খানিকটা বাড়তি আগ্রহ। সার্ত্রে তাকে চিহ্নিত করেন Bad faith -এ আক্রান্ত হিসাবে। মানুষটি (তিনি সম্ভবত সাঁ-জার্মা’র ক্যাফে দো ফ্লোর-এর কেউ হবেন) তার নিজেকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছে যে সে মূলত আবশ্যিকভাবে একজন ওয়েটার, কোনো স্বাধীন মানুষ নয়, যে-কিনা জাজ পিয়ানোবাদক অথবা উত্তর সাগরে মাছ ধরার জাহাজের কোনো জেলে হতে পারতেন। এই মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত, বিকল্পহীন দাসত্ব আজ হয়তো আমরা দেখতে পাই কোনো আইটি ম্যানেজার অথবা স্কুলে সন্তানদের নিতে আসা পিতামাতাদের মধ্যে। তাদের প্রত্যেকেই হয়তো অনুভব করেন: আমি যা করছি তা আমাকে করতে হবে, আমাদের আর কোনো চয়েস বা উপায় নেই, আমি স্বাধীন না, আমার ভূমিকা আমাকে বাধ্য করে করাতে যা আমি করছি। অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে কারো স্বাধীনতা বাস্তবায়ন করার সাথে আমেরিকার নব্য সেলফ-হেল্প ধারণাটিকে নিয়ে কোনো সংশয়ে আক্রান্ত হওয়া উচিত না, যে আন্দোলন এখন দাবি করে যে আমরা সবাই চাইলেই যে-কোনোকিছু হতে আর করতে পারি, তার জন্যে কোনো আত্মত্যাগ বা কষ্ট সহ্য না-করেই। সার্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বিষণ্ন ও ট্র্যাজিক ছিল এই বিষয়ে। তিনি শুধুমাত্র আমাদের দেখাতে চেয়েছিলেন আমরা সাধারণত যতটুকু বিশ্বাস করি, তারচেয়ে বেশি বিকল্প আমাদের আছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রধান বিকল্প (যা সার্ত্র খুবই দৃঢ়ভাবে সমর্থনও করতেন) হতে পারে আত্মহত্যা করা।

চার. পুঁজিবাদকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলার স্বাধীনতা আছে আমাদের: যে একটি নিয়ামক মানুষকে স্বাধীন হিসাবে ভাবতে নিরুৎসাহিত করে সেটি হচ্ছে টাকা। অধিকাংশ মানুষই সম্ভাব্য বেশকিছু বিকল্পকে বাতিল করে (বিদেশ গমন, নতুন কোনো পেশায় চেষ্টা করা, সঙ্গী পরিবর্তন) এমন কিছু বলে, ‘কাজটি আমি করতাম যদি আমার টাকা নিয়ে কোনো চিন্তা না থাকত।’ টাকার সামনে এই নিষ্ক্রিয়তা সার্ত্রেকে ক্ষুব্ধ করেছিল রাজনৈতিক স্তরে। তিনি পুঁজিবাদকে ভাবতেন একটি বিশাল যন্ত্র যা পরিকল্পিত হয়েছে একটি চাহিদার অনুভূতি সৃষ্টি করার জন্য, বাস্তবে আসলেই যার কোনো অস্তিত্ব নেই: এটি আমাদের নিজেদেরকে বলায় আমাদের কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক ঘণ্টা কাজ করতে হবে, কোনো নির্দিষ্ট জিনিস বা সেবা কিনতে হবে, তাদের কাজের জন্য কিছু মানুষকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কম পারিশ্রমিক দিতে হবে। কিন্তু এই সবকিছুতেই শুধুমাত্র আছে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা এবং অন্যভাবে বাঁচার সম্ভাবনাকে আমাদের যতটা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা উচিত সেটি অস্বীকার করা। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সার্ত্রের মার্ক্সবাদের প্রতি দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ ছিল (যদিও তিনি ফরাসি আর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সমালোচক ছিলেন)। তাত্ত্বিকভাবে মনে হতে পারে মার্ক্সবাদ মানুষকে তাদের স্বাধীনতা অনুসন্ধান করার সুযোগ দেয়, তাদের জীবনে বস্তুগত নানা চাহিদা, টাকাপয়সা আর সম্পত্তি যে-ভূমিকা পালন করে সেই ভূমিকাটি হ্রাস করে। যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো লোভনীয় একটি ভাবনা: আমরা কি রাজনীতি পরিবর্তন করতে পারি আমাদের মৌলিক স্বাধীনতাগুলোর সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার জন্যে? কীভাবে পুঁজির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটি বদলাতে পারি আমরা? সপ্তাহে কত ঘণ্টা কারো কাজ করা উচিত? কীভাবে টেলিভিশনে যা দেখানো হচ্ছে, কোথায় মানুষ ছুটি কাটাতে যাচ্ছে অথবা স্কুলে কী পড়ানো আছে তার উন্নতি করা যায়? কীভাবে আমাদের বিষাক্ত আর প্রচারণায় পূর্ণ গণমাধ্যমকে পরিবর্তন করা যেতে পারে। অনেক বেশি পরিমাণ লেখা সত্ত্বেও (তিনি প্রতিদিন প্রায় পাঁচ পাতা করে লিখেছিলেন), সার্ত্র এই বিষয়গুলোয় তাঁর চিন্তা প্রসারিত করেননি। তিনি শুধু সম্ভাবনাগুলোকে দেখিয়ে গেছেন, কিন্তু বাকি কাজটা করার দায়িত্ব আমাদের।

পরিশেষে, কোনোকিছু যেভাবে আছে সেটি সেইভাবে থাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সার্ত্রে তার এই অবস্থানের জন্য আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন। তিনি বিশালভাবে উপস্থিত আমাদের সব অপূর্ণ সম্ভাবনায়, প্ৰজাতি হিসাবে এবং এককজীবনে। তিনি তাগাদা দিয়েছিলেন আমাদের অস্তিত্বের তরলতাটিকে মেনে নিয়ে এবং নতুন প্রতিষ্ঠান, অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি আর ধারণা সৃষ্টি করার জন্য। জীবনকে কোনো পূর্বনির্ধারিত যুক্তি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, এবং অন্তর্গতভাবে এটি অর্থময়ও নয়। আর এটি আমাদের জন্য বড় সান্ত্বনার কারণ হবে যখন প্রথা, ঐতিহ্য, অপরিবর্তনীয় পরিস্থিতি ভারে নিজেদের নির্যাতিত অনুভব করি। বয়ঃসন্ধিকালে সার্ত্র আমাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী, যখন পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশা আমাদের নিষ্পেষিত করতে পারে এবং মধ্যবয়সের কৃষ্ণপর্বটির জন্য, যখন আমরা শনাক্ত করতে পারি এখনও কিছু সময় আছে পরিবর্তন করার জন্য, কিন্তু যদিও পর্যাপ্ত নয় সেই সময়টি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *