1 of 2

অধ্যায় ২৫ : প্রায়োগিক সুখ – জেরেমি বেনথাম

অধ্যায় ২৫ : প্রায়োগিক সুখ – জেরেমি বেনথাম

যদি আপনি কখনো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে বেড়াতে যান, সেখানে জেরেমি বেনথামকে দেখে বিস্মিত হতে পারেন (১৭৪৮-১৮৩২) বরং বলা উচিত তাঁর অবশিষ্টাংশ দেখে, যা কাঁচ দিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত একটি বাক্সে সুরক্ষিত আছে। সেখানে তিনি বসে আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁর প্রিয় হাঁটার ছড়িটি, যার ডাকনাম ছিল ‘ড্যাপল’, হাঁটুর উপর আড়াআড়িভাবে রাখা, তাঁর মাথাটি অবশ্য মোম দিয়ে তৈরি, কারণ আসল মাথাটি এখন মমিকৃত এবং একটি বিশেষ কাঠের বাক্সে রাখা আছে, যদিও সেটি প্রদর্শনীর জন্যে রাখা ছিল একসময়। বেনথাম ভাবতেন তার আসল শরীর, যাকে তিনি বলতেন auto-icon, যে-কোনো মূর্তির চেয়ে উত্তম স্মারকস্তম্ভ হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং ১৮৩২-এ তিনি মারা যাবার পর, তিনি তার শরীরের অবশিষ্টাংশ নিয়ে কী করতে হবে সেই বিষয়ে নির্দেশনামা দিয়ে যান। তাঁর এই ধারণাটি অবশ্য বেশি জনপ্রিয় হয়নি, যদিও পরে আমরা রুশবিপ্লবের নেতা লেনিনের শরীর একইভাবে সুরক্ষিত হতে দেখেছি একটি বিশেষ মুসোলিয়ামে। বেনথামের অন্যকিছু ধারণা অনেক বেশি প্র্যাকটিকাল বা প্রয়োগিক ছিল। যেমন ধরুন তার বৃত্তাকার জেলখানার পরিকল্পনাটি, Panopticon, তিনি এটি বর্ণনা করেছিলেন নিয়ম না-মানাদের পিষ্ট করে সৎ বানানোর যন্ত্র হিসাবে। মাঝখানের একটি ওয়াচ টাওয়ারে থাকা প্রহরীরা একই সাথে বহু বন্দির দিকে নজর রাখতে পারবেন, বন্দীদের দিকে নজর রাখা হচ্ছে সেই সম্বন্ধে তাদের কোনোকিছু না জানিয়ে। এই ডিজাইন মূলনীতি ব্যবহৃত হয়েছে বেশকিছু আধুনিক কারাগার, এমনকি বেশকিছু লাইব্রেরি নির্মাণে। সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে এটি তার বহু প্রকল্পের একটি।

কিন্তু আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেনথামের আমাদের কীভাবে বাঁচা উচিত সংক্রান্ত তত্ত্বটি। এটি পরিচিত utilitarianism বা উপযোগবাদ সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করার রাজনৈতিক ও শ্রেয়োনীতিক মতবাদ) বা Greatest Happiness Principle; এই ধারণাটি দাবি করেছিল, সবচেয়ে সঠিক কাজটি হবে সেটি, যা সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সুখের কারণ হয়। নৈতিকতার প্রতি এ-ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি প্রথম নন (ফ্রান্সিস হাচেসন, যেমন, এর আগেই তা দাবি করেছিলেন), তবে বেনথামই প্রথম যিনি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে এটি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। তিনি ইংল্যান্ডের আইনের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, যেন সেগুলো সবার জন্য আরো বেশি পরিমাণ সুখের কারণ হয়। কিন্তু এই ‘হ্যাপিনেস’ বা সুখ আসলে কী? ভিন্ন ভিন্ন মানুষ শব্দটিকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করেন। বেনথামের এই বিষয়ে একটি সরাসরি উত্তর ছিল। সুখ হচ্ছে মূলত আপনি কীভাবে অনুভব করছেন সেটি। সুখ হচ্ছে আনন্দ, যেখানে দুঃখের অনুপস্থিতি আছে। আরো আনন্দ বা আরো অনেক পরিমাণে আনন্দ, দুঃখের চেয়ে হচ্ছে আরো বেশি সুখ। বেনথাম মনে করতেন মানুষ খুব সরল প্রাণী। দুঃখ এবং সুখ হচ্ছে আমাদেরকে প্রকৃতির দেয়া দুটি চমৎকার পথপ্রদর্শক, যেগুলো আমাদের শেখায় কীভাবে বাঁচতে হবে। আমরা আনন্দময় অভিজ্ঞতা খুঁজি, যন্ত্রণা আর কষ্টময় অভিজ্ঞতাগুলোকে এড়িয়ে। সুখ হচ্ছে একটিমাত্র জিনিস যা স্বতন্ত্রভাবেই উত্তম। বাকি যা-কিছু আমরা চাই, তার কারণ হচ্ছে আমরা বিশ্বাস করি সেগুলো আমাদের সুখ দেবে, আমাদের সাহায্য করবে দুঃখকে এড়াতে। সুতরাং যদি আপনি একটি আইসক্রিম চান, সেটি শুধুমাত্র সেই কাজটি করার স্বার্থে ভালো কাজ হবে না। আইসক্রিমের উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনি যখন এটি খাবেন এটি সম্ভবত আপনাকে আনন্দ দেবে। একইভাবে আপনি নিজের হাত আগুনে পোড়াতে চাইবেন না, কারণ এটি আপনাকে যন্ত্রণা দেবে।

কিন্তু কীভাবে আপনি সুখের পরিমাপ করবেন? এমন একটি সময়ের কথা ভাবুন যখন আপনি সত্যি খুব সুখী ছিলেন। কেমন ছিল সেই অনুভূতিটি? আপনি কি আপনার সুখের উপর পরিমাণবাচক কোনো সংখ্যাকে আরোপ করতে পারবেন? যেমন, দশের মধ্যে সাত কিংবা আট? কোনো সুখের অভিজ্ঞতাকে এমন কোনো নম্বর দেবার প্রক্রিয়াটিকে খুব অদ্ভুত কিছু মনে হবে না। বেনথাম নিশ্চয়ই বিশ্বাস করতেন যে সুখকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ আর পরিমাপ করা যেতে পারে এবং বিভিন্ন সুখকে তুলনা করা যেতে পারে একই মানদণ্ডে, একই একক ব্যবহার করে। তিনি সুখ পরিমাপ করার সেই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছিলেন Felicific Calculus। প্রথমত, পরিমাপ করুন কোনো একটি বিশেষ কাজ কত বেশি সুখের সৃষ্টি করছে। খেয়াল রাখুন, কতক্ষণ সেই সুখের স্থায়িত্ব থাকে, কতটা তীব্র সেই সুখ, কতটা সম্ভাবনা আছে এই সুখটি আরো বেশি সুখের জন্ম দেয়ার। এরপর আপনার কাজের কারণে সৃষ্ট যে-কোনো পরিমাণ দুঃখ সেখান থেকে বাদ দিন। এরপর আপনার হাতে যা থাকবে তাহলো কোনো কাজের happiness value; বেনথাম এটিকে বলেছেন সেই কাজের utilityবা উপযোগিতা। কারণ কোনো একটি কাজ যত সুখ সৃষ্টি করবে সেটি সমাজের জন্য তত মঙ্গলজনক হবে। সেকারণেই তার এই তত্ত্বটি পরিচিত utilitarianism বা উপযোগবাদ নামে। কোনো একটি কাজের উপযোগিতাকে তুলনা করুন সম্ভাব্য অন্য বহু কাজের উপযোগিতা পরিমাপের সাথে, এবং সেটাই নির্বাচন করুন যেটি সবচেয়ে বেশি সুখের কারণ, খুব সরল। বেশ তাহলে সুখ কিংবা আনন্দের উৎস নিয়ে তার মতামত কী ছিল? নিশ্চয়ই মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে এমন কোনো কাজ, যেমন শিশুসুলভ কোনো খেলার চেয়ে বা আইসক্রিম খাওয়ার চেয়ে কবিতা পড়া থেকে আনন্দ নেয়াই বেশি উত্তম। তাই না? না, বেনথাম সেটি মনে করতেন না। কীভাবে সেই সুখটি সৃষ্টি হচ্ছে সেটি বিবেচ্য বিষয় ছিলনা তার ভাবনায়। দিবাস্বপ্ন দেখাও তার মতে শেক্সপিয়ারের নাটক দেখার মতোই উত্তম হতে পারে যদি সেটি আপনাকে একইভাবে সুখী করে।

তিনি কবিতা ও ‘পুশপিন’ নামক সমসাময়িক জনপ্রিয় একটি ছেলেমানুষি খেলার উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন। যা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো, কী পরিমাণ আনন্দ সেটি তৈরি করে। যদি আনন্দ সমপরিমাণ হয়, তাহলে কাজটির মূল্য একই হবে। উপযোগিতাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে, পুশপিনের মতো কোনো খেলাও কবিতা পড়ার মতো নৈতিকভাবে উন্নত কাজ হতে পারে। আগে যেমন আমরা পড়েছিলাম, ইমানুয়েল কান্ট প্রস্তাব করেছিলেন যে আমাদের কিছু কর্তব্য আছে, যেমন ‘কখনো মিথ্যা না বলা’, যা সব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য। কিন্তু বেনথাম বিশ্বাস করতেন, কোনো একটি কাজের যথার্থতা বা অন্যায্যতা নির্ভর করে এর সম্ভাব্য পরিণতি বা ফলাফলের উপর। পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি ভিন্ন হতে পারে। মিথ্যা বলা তাহলে তার মতে আবশ্যিকভাবে সবসময়ই খারাপ কিছু না। হয়তো কিছু পরিস্থিতি আসতে পারে, যখন মিথ্যা বলাই হতে পারে সঠিক কাজ, যেমন যদি কারো জীবন বাঁচে বা বেনথামের ভাষায় যদি, ভারসাম্য হিসাবে, না-বলার চেয়ে বরং মিথ্যা বললে বেশি সুখ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়, তাহলে সেইসব পরিস্থিতিতে সেটাই হবে নৈতিকভাবে সঠিক কাজ। যেমন কোনো বন্ধু যখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করে তাকে তার নতুন কাপড়ে কেমন দেখতে লাগছে, যারা কান্ট অনুসরণ করেন তাদের সত্যিকথা বলতে হবে, এমনকি যদি সেই সত্য আপনার বন্ধু শুনতে নাও চান। একজন উপযোগবাদী বা বেনথাম-অনুসারী হিসাবে আপনি হয়তো হিসাব-নিকাশ করে বুঝতে পারবেন এই পরিস্থিতিতে মৃদু একটি মিথ্যা বললে বেশি সুখের সৃষ্টি করা সম্ভব কিনা, যদি তাই হয় তাহলে মিথ্যা বলাই সেখানে হবে সঠিক প্ৰতিক্ৰিয়া।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশের মত কোনো সময়ে প্রস্তাব করার জন্য উপযোগবাদ বেশ একটি বৈপ্লবিক তত্ত্ব ছিল। একটি কারণ হচ্ছে তার সুখ পরিমাপের মানদণ্ডে সবার সুখই ছিল সমান। বেনথামের নিজের ভাষায়, Everybody to count for one, nobody to count for more than one; সুখের পরিমাপে কেউ যেন বিশেষ কোনো সুবিধা না পায়। কোনো এক অভিজাত ব্যক্তির সুখ গরিব কোনো শ্রমিকের সুখ থেকে বড় বলে বিবেচ্য হবে না। কিন্তু সেই সময়ে সমাজ সেভাবে সংগঠিত ছিলনা। অভিজাতশ্রেণীদের বিশেষ প্রভাব ছিল কীভাবে ভূমি ব্যবহৃত হবে এবং ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসে বসার অনেকেরই জন্মগত অধিকার ছিল, যারা ইংল্যান্ডের আইন নির্ধারণ করতেন। সুতরাং বিস্ময়কর নয় মোটেই বেনথামের সাম্যবাদের ধারণায় অনেকের জন্যেই অস্বস্তিকর ছিল। হয়তো সেই সময়ে বেনথামের আরো বেশি বৈপ্লবিক ধারণা ছিল, প্রাণীদের সুখও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারাও আনন্দ আর কষ্ট অনুভব করতে পারে, প্রাণীরা তার happiness equation- এর অংশ ছিল। তার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না যে প্রাণী যুক্তি দিতে পারে না, কথা বলতে পারেনা; বেনথামের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের নৈতিকতায় অংশ করে নেবার জন্যে এই বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক না। যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো তাদের আনন্দ আর কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা। আর এটাই বর্তমানে বহু প্রাণীর কল্যাণ আন্দোলনের মূল ভিত্তি।

বেনথামের জন্য দুর্ভাগ্যজনক, বেশকিছু বিধ্বংসী সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় সুখ লাভ করার সম্ভাব্য সব কারণকে সমানভাবে বিবেচনা করার উপর জোর দেয়া তার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিটির কারণে। রবার্ট নজিক (১৯৩৮-২০০২) একটি চিন্তার পরীক্ষা উদ্ভাবন করেছিলেন। কল্পনা করুন একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মেশিন, যা আপনার জন্যে একটি ইল্যুশন বা মায়া তৈরি করবে যে আপনি সেখানে আপনার জীবন কাটাচ্ছেন, এবং সেখান থেকে কোনো ধরনের দুঃখকষ্ট অনুভব করার ঝুঁকি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য একবার যখন আপনি এই মেশিনে প্লাগ ইন করবেন, আপনি ভুলে যাবেন যে আপনি আর সরাসরি বাস্ত বতার সাথে যুক্ত না, আপনাকে পুরোপুরিভাবে আচ্ছন্ন করবে মেশিনটির বিভ্রম। এই মেশিন আপনার জন্য বহু ধরনের আনন্দময় অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করবে। অনেকটাই যেন স্বপ্ন তৈরির যন্ত্রের মতো। এটি আপনাকে কল্পনা করাতে পারে, যেমন, ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে আপনি জয়সূচক গোলটি করছেন বা আপনার প্রিয় বেড়ানোর জায়গায় ছুটি কাটাচ্ছেন। যা-কিছু আপনাকে সুখ দেবে যন্ত্রটি সেটাই কাল্পনিকভাবে সৃষ্টি করছে। কিন্তু, যেহেতু এই যন্ত্রটি আপনার আনন্দময় মানসিক অবস্থাকে সর্ব্বোচ্চ পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবে, আপনার উচিত হবে বেনথামের বিশ্লেষণ মোতাবেক সারাজীবনই এর মধ্যে প্লাগ ইন করে থাকা। সেটাই হবে আনন্দকে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি আর দুঃখকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার উপায়। তারপরও বহু মানুষ, এই ধরনের যন্ত্র মাঝে মাঝে পরীক্ষামূলকভাবে উপভোগ করতে পারেন ঠিকই, কিন্তু কেউই সারাজীবন এই যন্ত্রের সাথে নিজেকে সংযুক্ত রাখতে রাজি হবেন না। কারণ অন্য অনেক কিছুই আছে যা তারা খুব উচ্চমানে মূল্য দেয়, ধারাবাহিকভাবে সুখকর মানসিক অবস্থায় থাকার চেয়েও। এটি যা দেখাচ্ছে তাহলো বেনথাম ভুল ছিলেন এমন কোনো দাবির ক্ষেত্রে, যে একই পরিমাণ সুখ আনতে পারে এমন সব উপায়ই সমানভাবে মূল্যবান, এবং সবাই শুধুমাত্র তাদের সুখকে সর্বোচ্চ করতে আর দুঃখকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামানোর ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হন না। এই ধারণাটিকে আরো বিস্তারিত করেছিলেন তার অসাধারণ ছাত্র ও পরবর্তীতে সমালোচক জন স্টুয়ার্ট মিল। কিন্তু বেনথাম তার যুগের মানুষ ছিলেন, যিনি তীব্রভাবে আগ্রহী ছিলেন তাকে ঘিরে থাকা নানা সামাজিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *