1 of 2

অধ্যায় ৩৫ : ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় কি টাক আছে? – বার্ট্রান্ড রাসেল

অধ্যায় ৩৫ : ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় কি টাক আছে? – বার্ট্রান্ড রাসেল

এগারো বছর বয়সে রাসেলকে তাঁর বড়ভাই ফ্র্যাঙ্ক ইউক্লিডের জ্যামিতি দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গণিতের সাথে। তাঁকে যে-বিষয়টি অবাক করেছিল সেটি হলো গণিত বুঝতে হলে তাকে আগে থেকে কিছু অ্যাক্সিয়ম বা স্বতঃসিদ্ধ সূত্র মানতে হয়, যেগুলোর কোনো প্রমাণ লাগেনা। তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন কেন আমরা এর মূল ভিত্তিগুলোকে প্রমাণ করতে পারিনা যা আমরা ব্যবহার করছি প্রমাণের জন্য। তাঁর ভাই বলেছিলেন, না আমরা এগুলো যেমন আছে সেভাবেই ধরে নেব, তা না হলে প্রমাণের দিকে আগাতে পারব না। এই যুক্তি তাঁকে শান্তি দিতে পারেনি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বইটা দেবার সময় তিনি তার ছোটভাইকে বলেছিলেন, ইউক্লিডের ফিফথ প্রোপোজিশনটা সবার জন্য বোঝা কঠিন, কিন্তু রাসেলের কাছে সেটি আদৌ কঠিন মনে হয়নি, তিনি পরে লিখেছিলেন, ‘আমার জন্যে এটাই প্রথম ইঙ্গিত ছিল, আমার হয়তো কিছুটা মেধা আছে।’ তিনি মৌলিক যে অ্যাক্সিয়মগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে ভেবেছিলেন, তিনি মনে করেছিলেন, বেশ আমি মানছি যে তাদের আগে মানতে হবে, কিন্তু আমরা কীভাবে জানতে পারি এইসব অ্যাক্সিয়মগুলো সত্য। পরে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের শেষদিনে আত্মতৃপ্ত রাসেল তার বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘আমি একটি নতুন বিষয় আবিষ্কার করেছি, যা পুরো গণিতকে এর মূল বিষয়টি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছে’। তিনি তাঁর বই দ্য প্রিন্সিপাল অবম্যাথমেটিকস-এর পাণ্ডুলিপি নিয়ে কথা বলছিলেন, যা তিনি কেবলই শেষ করেছেন। তিনি গণিতকে শুধুমাত্র লজিক বা যুক্তির ভাষায় রুপান্তর করেছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতে ব্যাখ্যা করেছিলেন এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন, ইন্টেলেকচুয়াল হানিমুন। দর্শনে তাঁর অবদান সুবিশাল, অ্যানালিটিক দর্শনের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, দর্শনের যে-শাখাটি এখন পশ্চিমে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তাঁর ‘থিওরি অব ডেসক্রিপশন’ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ধারণা। এছাড়াও তিনি নানা সামাজিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, প্রথমবারের মতো একজন দার্শনিক হিসাবে যিনি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিলেন সাবলীলভাবে।

তারুণ্যে তাঁর মূল আগ্রহ ছিল যৌনতা, ধর্ম আর গণিতে, কিন্তু সবই তাত্ত্বিক স্তরে। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে (তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৯৭০ সালে ৯৭ বছর বয়সে) তিনি প্রথম ক্ষেত্রে বিতর্কিত, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক এবং তৃতীয় ক্ষেত্রে কালজয়ী অবদান রেখে গেছেন। যৌনতা নিয়ে রাসেলের দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বেশ সমস্যায় ফেলেছিল। ১৯২৯ সালে তিনি প্রকাশ করেছিলেন Marriage and Morals, এই বইটিতে তিনি সঙ্গী/সঙ্গিনীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার গুরুত্ব সংক্রান্ত খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গিটিকে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন না যে আপনাকে অবশ্যই বিশ্বস্ত হতে হবে। সেই সময়ে বেশকিছু মানুষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু রাসেলের জন্য বিষয়টি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। কারণ ইতিমধ্যে তিনি ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলে (তিনি সবধরনের যুদ্ধবিরোধী ছিলেন) ব্রিক্সটন জেলে ছয় মাস কাটিয়ে এসেছেন। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন Campaign for Nuclear Disarmament, যা পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মতামত প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিল। এই প্রাণচঞ্চল বৃদ্ধ মানুষটিকে এমনকি ষাটের দশকেও নানা আন্দোলনের মিছিলে প্রথম সারিতে দেখা গেছে, তখনও তিনি তীব্রভাবেই সবধরনের যুদ্ধবিরোধী, ঠিক যেমন ছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে তার তারুণ্যে। তিনি যেমন করে বলেছিলেন, Either man will abolish war, or war will abolish man, হয় মানুষ যুদ্ধকে বিলোপ করবে নতুবা যুদ্ধ মানুষকে বিলোপ করবে, আপতত এই দুটির কোনোটাই বাস্তব হয়নি।

ধর্মের ব্যাপারে তিনি যেমন ছিলেন স্পষ্টবাদী তেমনি প্ররোচনাদায়ী। কারণ রাসেল বিশ্বাস করতেন মানবতাকে রক্ষা করতে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ করার কোনোই সম্ভাবনা নেই। মানবতাকে রক্ষা করার একটিমাত্র সুযোগ আছে, আমাদের যুক্তির শক্তি ব্যবহার করতে হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ ধর্মে আকৃষ্ট হয়, কারণ তারা মৃত্যুকে ভয় পায়। ধর্ম তাদের সান্ত্বনা দেয়। ঈশ্বর আছেন যিনি খারাপ লোকগুলোকে শাস্তি দিবেন এমন বিশ্বাস খুবই আশ্বাসদায়ক, এমনকি যদি পৃথিবীতে তারা তাদের খুন কিংবা আরো জঘন্য পাপের শাস্তি থেকে রেহাই পায়। কিন্তু এটি সত্যি নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। এবং ধর্ম সুখের চেয়ে আরো বেশি দুঃখের কারণ হয় প্রায় সবসময়ই। বৌদ্ধধর্ম অন্যসব ধর্ম থেকে আলাদা হতে পারে, এটি তিনি তাঁর চিন্তায় ছাড় দিয়েছিলেন। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, ইহুদিবাদ আর হিন্দুধর্মকে বহু অভিযোগের জবাবদিহি করতে হবে বলেই বিশ্বাস করতেন। এই ধর্মগুলো তাদের ইতিহাসের পুরো সময় ধরে বহু যুদ্ধের কারণ, ব্যক্তিগত দুঃখ আর ঘৃণারও কারণ ছিল, বহু মিলিয়ন মানুষ তাদের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।

এই সবকিছু থেকে একটি জিনিস খুব স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, তিনি যদিও প্যাসিফিস্ট বা শান্তিবাদী ছিলেন, তবে তিনি যা-কিছু সঠিক এবং ন্যায় বলে বিশ্বাস করতেন তার সমর্থনে তিনি সংগ্রাম করতে সদাপ্রস্তুত ছিলেন (বিশেষ করে ধারণার ক্ষেত্রে)। এমনকি চূড়ান্ত প্যাসিফিস্ট হয়েও তিনি ভাবতেন যে কিছু দুর্লভ ক্ষেত্রে, যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ করাই একমাত্র বিকল্প হতে পারে। জন্মগতভাবে তিনি ইংরেজ অভিজাতশ্রেণির সদস্য ছিলেন। তিনি এসেছিলেন খুবই সুপরিচিত একটি পরিবার থেকে। তার আনুষ্ঠানিক উপাধি ছিল 3rd Earl Russell। আপনি হয়তো তাঁকে দেখলে বা তাঁর কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন তিনি অভিজাতশ্রেণির কেউ। তাঁর একটি সুপরিচিত লক্ষ্য করার মতো গর্বিত দৃষ্টি ছিল, উজ্জ্বল চোখ আর দুষ্টুমির একটি হাসিসহ। তাঁর গলার স্বরই বলে দেয় তিনি সমাজের উপরের তলার মানুষ। রেকর্ডিঙে তাঁর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হবে যেন অন্য কোনো শতাব্দীর, সেটি তিনি ছিলেন যদিও, তার জন্ম ১৮৭২ সালে। সুতরাং তিনি আসলেই ভিক্টোরিয়ান। তাঁর দাদা, লর্ড জন রাসেল ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (যার হাত ধরে ১৮৩২ সালে আংশিক সংসদীয় গণতন্ত্ৰ সূচনা হয়েছিল)। বার্ট্রান্ড-এর ‘ধর্মীয় নন’ এমন গডফাদার ছিলেন দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল। দুঃখজনকভাবে তিনি তার সাথে পরিচিত হতে পারেননি, কারণ তার খুব শৈশবে মিল মারা যান। তবে তার মানসিক বিকাশে মিলের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। মিলের আত্মজীবনী পড়েই তিনি ঈশ্বরবিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তিনি আগে First Cause Argument বিশ্বাস করতেন। এই যুক্তিটি টমাস অ্যাকোয়াইনাস বিশেষ সফলতার সাথে ব্যবহার করেছিলেন। যুক্তিটি দাবি করে সবকিছুরই অবশ্যই একটি কারণ থাকে, এবং সবকিছুর,কারণ ও ফলাফলের সুদীর্ঘ শৃঙ্খলে সেই প্রথমতম কারণটি অবশ্যই হবেন ঈশ্বর। কিন্তু মিল প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন, বেশ তাহলে ঈশ্বরের কারণ কী, তাকে সৃষ্টি করেছেন কে? রাসেল এই First Cause Argument-এর যুক্তির সমস্যাটিকে দেখেছিলেন। যদি এমন কোনো একটি জিনিস থাকে যার কোনো কারণ নেই তাহলে সবকিছুর কারণ আছে এমন প্রস্তাবনা সত্যি হতে পারেনা। রাসেলের কাছে বরং যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে ঈশ্বরের অস্তি ত্বেরও পূর্বকারণ আছে, বরং এমন কিছু বিশ্বাস করা যে কোনোকিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে কোনো পূর্বকারণ দ্বারা সৃষ্টি না হয়ে। মিলের মতোই রাসেলের শৈশব ছিল অদ্ভুত, অবশ্যই খুব সুখকর নয়। রাসেলের বাবা-মা দুজনেই মারা গিয়েছিলেন শৈশবে, তার দাদি, যিনি তার দেখাশুনা করেছিলেন তিনি ছিলেন খুব কঠোর আর শীতল প্রকৃতির মানুষ। বিষয়টি তাকে প্রভাবিত করেছিল তার জীবনের প্রথমপর্বে। বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে তার শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এবং তিনি নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করেছিলেন লেখাপড়ায় এবং দারুণ মেধাবী একজন গণিতজ্ঞে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, পরে কেমব্রিজে অধ্যাপনাও করেছিলেন কিন্তু তাকে যা মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল তা হলো গণিতকে সত্য করে কোন্ বিষয়টি? কেন ২ + ২ = ৪ সত্য? আমরা জানি এটা সত্যি, কিন্তু কেন এটি সত্যি, এটাই তাকে গণিত থেকে দর্শনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

দার্শনিক হিসাবে তার সত্যিকার ভালোবাসা ছিল যুক্তিবিদ্যা, লজিক, দর্শন আর গণিতের সীমানার মধ্যে যে-বিষয়টির অবস্থান। লজিসিয়ানরা যুক্তি-প্রক্রিয়ার বা রিজনিং-এর কাঠামো অধ্যয়ন করেন, সাধারণত তারা প্রতীক ব্যবহার করেন তাদের ধারণা প্রকাশ করার জন্যে। তিনি গণিত ও লজিকের একটি শাখা নিয়ে নানাধরনের বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেট থিওরি। সেট থিওরি বেশ প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়েছিল যুক্তি-প্রক্রিয়ার কাঠামোটি ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু রাসেল এই থিওরির একটি বড় সমস্যা শনাক্ত করেছিলেন, যা স্ববিরোধী। তিনি এটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কতগুলো উদাহরণের মাধ্যমে, যা বিখ্যাত ‘রাসেলস প্যারাডক্স’ (Russell’s paradox) হিসাবে। রাসেল প্যারাডক্সের একটি উদাহরণ, যেমন: কল্পনা করুন একটি গ্রাম যেখানে মাত্র একজন নাপিত আছেন, যার কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র যারা নিজেরা দাড়ি কামান না তাদের সবার দাড়ি কামিয়ে দেয়া। ধরুন আপনি সেখানে বাস করেন, আপনি সম্ভবত নিজের দাড়ি নিজেই কামাবেন, যদি সেটি না করেন তাহলে সেখানে নাপিত সেই কাজটি করার জন্য একমাত্র ব্যক্তি। কিন্তু তাহলে নাপিত কী করবে? তাঁর অনুমতি আছে শুধুমাত্র সেই মানুষগুলোকে শেভ করানো যারা নিজেরা শেভ করেন না। এই নিয়ম অনুযায়ী, তিনি নিজের শেভ নিজে করতে পারবেন না, কারণ সে শুধুমাত্র সেইসব মানুষদের দাড়ি কামাতে পারবে যারা নিজেরা দাড়ি কামায় না। এটি তাঁর জন্য বেশ কঠিন হয়ে যাবে। সেই গ্রামে যদি কেউ নিজে দাড়ি কামাতে না পারে, তাহলে নাপিত সেই কাজটি করে দেবে, কিন্তু নাপিতের নিজের বেলায় সেটি করতে দেয় না এই নিয়মটি, কারণ সেটি তাহলে তাকে রূপান্তর করবে এমন একজন হিসাবে যে নিজে দাড়ি কামায়, কিন্তু নাপিত শুধুমাত্র দাড়ি কামিয়ে দেয় তাদেরকেই যারা নিজেরা দাড়ি কামায় না।

এটি একটি পরিস্থিতি যা সরাসরি স্ববিরোধিতার সূচনা করে, যা এমন কিছু বলে যার একই সাথে সত্য এবং মিথ্যা, আর সেকারণে এগুলোকে প্যারাডক্স বলে। বেশ ধাঁধায় ফেলে দেবার মতো। রাসেল যা আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি হচ্ছে যখন কোনো একটি সেট তার নিজের প্রতি তথ্য নির্দেশ করে, তখন এই ধরনের প্যারাডক্সের জন্ম হয়। আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ নেয়া যাক এই ধরনের। This sentence is false বা এই বাক্যটি মিথ্যা, এটিও প্যারাডক্স। যদি ‘এই বাক্যটি মিথ্যা’ বাক্যটির শব্দগুলো বোঝায় যা তারা বোঝাতে চাইছে (এবং যা সত্য) তাহলে এই বাক্যটি মিথ্যা, তাহলে এটি বোঝাবে এটি যা বলছে তা সত্য। বিষয়টি আমাদের ধারণা দেয় যে এই বাক্যটি একই সাথে সত্য ও মিথ্যা। কিন্তু কোনো একটি বাক্য সত্য আর মিথ্যা হতে পারে না একই সাথে। এটাই লজিকের মূল একটি অংশ, সুতরাং এখানে একটি প্যারাডক্স আছে।

বেশ মজার ধাঁধা এগুলো, খুব সহজ কোনো সমাধান নেই এর, একারণে অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু রাসেলের জন্য এগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলো যা উন্মোচন করে তাহলো সারা বিশ্বজুড়ে লজিশিয়ানরা তাদের সেট থিওরি সম্বন্ধে কিছু মূল প্রাকধারণা ধারণ করেন, সেগুলো ভুল। তাদের আবার শুরু করার দরকার হয়েছিল। রাসেলের আরেকটি আগ্রহের বিষয় ছিল আমরা যা- কিছু বলি কীভাবে সেগুলো পৃথিবীর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। যদি তিনি সমাধান করতে পারেন কোন্ বিষয়টি একটি বাক্যকে সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে মানব জ্ঞানের সম্ভারে অবদান রাখার জন্য। আবার তিনি আগ্রহী ছিলেন খুববেশি বিমূর্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে যারা আমাদের সব চিন্তার পিছনে থাকে। বেশিরভাগ কাজই তারা চেষ্টা করছে আমাদের স্টেটমেন্টগুলোর যুক্তিগত কাঠামোটি ব্যাখ্যা করার জন্য। তিনি অনুভব করেছিলেন আমাদের ভাষা যুক্তির চেয়ে অনেক কম নির্ভুল। সাধারণ ভাষার প্রয়োজন আছে বিশ্লেষণ করার, ভাঙার, যেন আমরা এর ভিত্তির যুক্তিগত কাঠামোটি বের করে আনতে পারি। তিনি বিশ্বাস করতেন দর্শনের সব ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য ভাষার এই ধরনের যুক্তিগত বিশ্লেষণ চালিকাশক্তি হতে পারে, যার সাথে সংশ্লিষ্ট এটি সুনির্দিষ্ট শব্দে অনূদিত করা।

যেমন, এই বাক্যটি নিন, The golden mountain does not exist বা সোনা দিয়ে তৈরি পর্বতের অস্তিত্ব নেই। সবাই খুব সম্ভবত একমত হবেন যে, বাক্যটি সত্য। এর কারণ পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো পর্বত নেই যা-কিনা সোনা দিয়ে নির্মিত। তার মানে বাক্যটি মনে হচ্ছে এমন কিছু সম্বন্ধে বলছে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। গোল্ডেন মাউন্টেন বাক্যটি মনে হয় এমনকিছুর প্রতি তথ্য নির্দেশ করছে যা বাস্তব, কিন্তু আমরা জানি তা বাস্তব নয়। লজিশিয়ানদের জন্য এটি একটি ধাঁধা। অস্তিত্বহীন কোনোকিছু নিয়ে আমরা কীভাবে অর্থবহভাবে কথা বলতে পারি? কেন এই বাক্যটি সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়? একটি উত্তর, যা দিয়েছিলেন অস্ট্রীয় লজিশিয়ান আলেক্সিয়াস মেইনং, তিনি বলেছিলেন, সবকিছুই, যা নিয়ে আমরা চিন্তা করতে ও কথা বলতে পারি অর্থপূর্ণভাবে তাদের অস্তিত্ব আছে। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে, সোনালি পর্বতের অবশ্যই অস্তিত্ব আছে, কিন্তু বিশেষভাবে, যে অস্তিত্বকে তিনি নাম দিয়েছিলেন subsistence; তিনি এমনও ভেবেছিলেন যে ইউনিকর্ন আর ২৭ সংখ্যাটি এভাবেই subsist বা বিশেষভাবে অস্তিত্বশীল।

মেইনং-এর লজিক নিয়ে এমন ভাবনা রাসেলের কাছে সঠিক মনে হয়নি। তার কাছে বিষয়টি মনে হয়েছিল অদ্ভুত। এর মানে হচ্ছে পৃথিবী পূর্ণ এমন জিনিস দিয়ে যার এক অর্থে অস্তিত্ব আছে আর আরেক অর্থে নেই। রাসেল একটি সহজতর উপায় উদ্ভাবন করেন, কীভাবে আমরা যা বলি সেগুলো যার অস্তিত্ব আছে তার সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারে। এটাই পরিচিত তার Theory of Descriptions হিসাবে। আরেকটি অদ্ভুত বাক্য নেয়া যাক (এটি রাসেলের সবচেয়ে প্রিয়), The present king of France is bald বা ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় টাক আছে। এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন রাসেল লিখছিলেন, তখন ফ্রান্সে কোনো রাজা ছিল না। ফ্রান্স তাদের সব রাজা রানীকে বর্জন করেছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়। তাহলে এই বাক্য দিয়ে কী বোঝাতে চাইছিলেন তিনি? রাসেলের উত্তরও ছিল সেটাই, সাধারণ ভাষায় ব্যবহৃত বহু বাক্যের মতো এটি যা বোঝাচ্ছে বলে মনে হয় তা নয়। সমস্যা হচ্ছে এখানে। যদি আমরা বলতে চাই সেই বাক্যটি, The present king of France is bald মিথ্যা, এটি মনে হবে আমাদের বাধ্য করছে স্বীকার করে নিতে এমন কিছু বলার জন্য যে, বর্তমানে ফ্রান্সের একজন রাজা আছেন যার মাথায় টাক নেই, there is a present king of France who isn’t bald; কিন্তু নিশ্চয়ই আমরা সেটি বোঝাতে চাইছি না আদৌ। আমরা বিশ্বাস করিনা যে ফ্রান্সে বর্তমানে একজন রাজা আছেন। রাসেলের বিশ্লেষণ ছিল, এমন কোনো বাক্য The present king of France is bald আসলে একধরনের গোপন বিবরণ। আমরা যখন the present king of France নিয়ে কথা বলি আমাদের ধারণাটির যৌক্তিক ভিত্তি হচ্ছে এটা:

(ক) এমনকিছুর অস্তিত্ব আছে যা ফ্রান্সের বর্তমান রাজা বা present king of France;

(খ) শুধুমাত্র একটি জিনিসই আছে যে-কিনা ফ্রান্সের বর্তমান রাজা;

(গ) যে-কোনো কিছু যাকে বলা যেতে পারে ফ্রান্সের বর্তমান রাজা, তার মাথায় টাক আছে।

এই জটিলভাবে সবকিছু ব্যাখ্যা করার উপায় রাসেলকে সুযোগ করে দিয়েছিল প্রদর্শন করতে যে, ‘ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় টাক আছে’ অর্থবোধক হতে পারে এমনকি যখন বর্তমানে ফ্রান্সে কোনো রাজা নেই। এটি অর্থবোধক হবে, তবে মিথ্যা। মেইনং এর ব্যতিক্রম, তার প্রয়োজন ছিল না কল্পনা করা যে ফ্রান্সের বর্তমান রাজার কোনো-না-কোনোভাবে একটি অস্তিত্ব আছে (অথবা subsist করে) যেন আমরা তাকে কথা বলতে ও ভাবতে পারি। রাসেলের জন্য The present king of France is baldএই বাক্যটি মিথ্যা, কারণ ফ্রান্সের বর্তমান রাজার মাথায় কোনো টাক নেই, কারণ ফ্রান্সের বর্তমানে রাজার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এই বাক্যটি প্রস্তব করছে তার অস্তিত্ব আছে, সুতরাং সত্য হবার বদলে এই বাক্যটি মিথ্যা। The present king of France is not bald সেই একই কারণে মিথ্যা। রাসেল যা শুরু করেছিলেন তাকে বলা হয় দর্শনের linguistic turn, যে আন্দোলনে দার্শনিকরা ভাষা ও তার ভিত্তির যৌক্তিক কাঠামো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *