1 of 2

অধ্যায় ১৬ : আপনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? – রেনে দেকার্ত

অধ্যায় ১৬ : আপনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? – রেনে দেকার্ত 

আপনি ঘড়ির অ্যালার্ম বাজা শুনতে পেলেন, সেটি বন্ধ করে দিলেন, বিছানা থেকে উঠলেন, কাপড় পরলেন, সকালের নাস্তা সারলেন, দিনের অন্যান্য সব কাজের জন্যে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু তারপর অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা ঘটল : আপনি জেগে উঠলেন এবং বুঝতে পারলেন যে পুরোটাই একটি স্বপ্ন ছিল। আপনার স্বপ্নে আপনি জেগে আছেন, জীবনের নানা কাজে ব্যস্ত আছেন, কিন্তু বাস্তবতায় আপনি এখনও আপনার কম্বলের নিচে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছেন, নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আপনার যদি এই ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা কোনোদিন হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে পারবেন আমি কী বোঝাতে চাইছি। সাধারণত এই ঘটনাগুলোকে বলা হয় false awakenings বা ‘ভুল করে সজাগ হওয়া’, এবং অভিজ্ঞতাগুলো খুবই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০)-এর একবার এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আর বিষয়টি তাকে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিল, কীভাবে তিনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে, তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন না! 

দেকার্তের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহলের নানা বিষয়ের মধ্যে একটি ছিল দর্শন। তিনি খুবই মেধাবী গণিতজ্ঞ ছিলেন, হয়তো সবচেয়ে বেশি পরিচিত Cartesian co-ordinates আবিষ্কার করার জন্য। বলা হয়ে থাকে এটি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ছাদে একটি মাছিকে হাঁটতে দেখে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমরা কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে এর অবস্থান নির্ণয় করতে পারি। বিজ্ঞানও তার প্রিয় বিষয় ছিল, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানী দুটোই ছিলেন তিনি। দার্শনিক হিসাবে তার সুনাম মূলত নির্ভরশীল ছিল তাঁর Meditations এবং Discourse on Method বইদুটোর উপর, যেখানে তিনি তার সম্ভাব্য জানার পরিধি কতটুকু হতে পারে তার অনুসন্ধান করেছিলেন। 

বেশিরভাগ দার্শনিকদের মত, দেকার্ত কোনোকিছু সহজে বিশ্বাস করতে পছন্দ করতেন না, কেন তিনি সেটি বিশ্বাস করবেন, আগে সেটি যাচাই না করে বিশ্বাস করতে তার অনীহা ছিল। তিনি বহু প্রশ্ন করতেন, অদ্ভুত সব প্রশ্ন করতে তিনি পছন্দ করতেন, যে প্রশ্নগুলো অন্যরা করেননি। অবশ্যই দেকার্ত শনাক্ত করেছিলেন সারাক্ষণই সবকিছুকে প্রশ্ন করে আমরা আমাদের জীবন কাটাতে পারব না। বেঁচে থাকা খুবই কঠিন হবে যদি আপনি অধিকাংশ সময় কিছু জিনিস বিশ্বাসের সাথে মেনে নিতে না পারেন, কোনো সংশয় নেই প্রাচীন সংশয়বাদী দার্শনিক পিরো যেমন বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু দেকার্ত ভাবতেন তার জীবনে অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা অর্থহীন হবে না কোন্ বিষয়টি (যদি কিছু থাকে) তিনি আসলেই নিশ্চিতভাবে জানতে পারেন। আর এটা করার জন্য তিনি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা পরিচিত Method of Cartesian Doubtবা কার্তেসীয় সংশয় প্রক্রিয়া। 

চিন্তার কাজটি সফলভাবে করার জন্যে কীভাবে আমাদের মনকে আরো বেশি দক্ষ করে তোলা যায় মূলত এটাই ছিল তার জীবনের প্রধান প্রচেষ্টা। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সমাধান করার জন্য দেকার্ত প্রস্তাব করেছিলেন যে, আমাদের সবসময় উচিত হবে ধারালো প্রশ্ন ব্যবহার করে বড় সমস্যাগুলোকে বোধগম্য ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করে নেয়া, আর এটাকেই তিনি বলেছিলেন তার method of doubts বা সংশয় পদ্ধতি। কিছু প্রশ্ন আমাদের চিন্তাকে জট পাকিয়ে দেয়; যেমন, জীবনের অর্থ কী? ভালোবাসা কী? কারণ আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সতর্ক না কীভাবে এই বড় প্রশ্নগুলোকে ক্ষুদ্রতর অংশে বিভাজন করা যায়। তিনি তার সংশয়-পদ্ধতির সাথে তুলনা করেছিলেন একটি আপেলভর্তি ব্যারেল বা কাঠের পিপার সাথে, যেখানে ভালো আর খারাপ আপেল মিশ্রিত হয়ে আছে। দার্শনিক হওয়া মানে পুরো ব্যারেলের প্রতিটি আপেলকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, যেন খারাপ আপেলগুলো বাতিল করে শুধুমাত্র ভালো আপেলগুলো সেখানে থাকে সেটি নিশ্চিত করা। পদ্ধতিটি বেশ সুস্পষ্ট: কোনোকিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করবেন না যদি সামান্যতম সম্ভাবনা থাকে যে এটি সত্য নয়। বড় একটা থলেভর্তি আপেলের কথা ভাবুন। আপনি জানেন সেই থলেতে কিছু পচা আপেল আছে, কিন্তু আপনি নিশ্চিত না কোনগুলো পচা। আপনি চান নষ্ট কোনো আপেল ছাড়া এক থলে আপেল। কিন্তু কীভাবে সেটা আপনি পেতে পারেন? একটি উপায় হচ্ছে সব আপেল মাটিতে বিছিয়ে, একটা একটা করে পরীক্ষা করে দেখা, শুধুমাত্র ভালোগুলোকে নিশ্চিতভাবে বেছে থলেতে ভরা। এই প্রক্রিয়ায় আপনি হয়তো কিছু ভালো আপেল ফেলে দিতে পারেন কারণ তাদের দেখতে হয়তো মনে হতে পারে ঠিক আছে, কিন্তু ভিতরে হালকা পচন ধরেছে। কিন্তু ফলাফল হবে শুধুমাত্র ভালো আপেলগুলো আপনার থলেতে ঢুকবে। এটাই কমবেশি দেকার্তের সন্দেহ করার পদ্ধতি। যখন আপনি কোনো একটি বিশ্বাস নিয়ে ভাববেন, যেমন, ‘এখন আমি জেগে আছি আর এই বাক্যটি পড়ছি’, ভালো করে পরীক্ষা করুন, এবং শুধুমাত্র সেটাই মেনে নিন যদি আপনি নিশ্চিত যে এটা ভুল হতে পারবে না বা বিভ্রান্তিকর নয়। যদি সামান্যতম পরিমাণ সন্দেহ থাকে, বর্জন করুন। দেকার্ত নিজে যা বিশ্বাস করতেন তার বেশ কিছু বিষয় নিয়ে যাচাই করেছিলেন এবং প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কি চূড়ান্তভাবে জানেন সেই বিষয়গুলো সম্বন্ধে, তাদের আপাতদৃষ্টিতে যা মনে তারা কি আসলেই সেটাই? তিনি কি নিশ্চিত যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন না? 

দেকার্ত আসলে খুঁজে বের করতে চাইছিলেন একটি জিনিস যে বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত হতে পারবেন। সেটাই তাকে বাস্তবতায় নোঙ্গর করতে সাহায্য করবে। কিন্তু ঝুঁকি ছিল যে তিনি সন্দেহের ঘূর্ণিতে ডুবে যেতে পারেন এবং অবশেষে হয়তো অনুভব করতে পারেন যে কোনোকিছুই আসলে নিশ্চিত নয়। এখানে খানিকটা সন্দেহবাদী অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি, তবে সেটি পিরো ও তার অনুসারীদের সংশয়বাদিতা থেকে ভিন্ন। প্রাচীন সংশয়বাদীদের উদ্দেশ্য ছিল দেখানো যে- কোনো কিছু সম্বন্ধেই নিশ্চিত হওয়া যায়না। অন্যদিকে দেকার্ত দেখাতে চেয়েছিলেন যে কিছু বিশ্বাস, এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী সন্দেহবাদিতার নিরীক্ষা থেকেও সুরক্ষিত হতে পারে। 

দেকার্ত তাঁর সেই নিশ্চয়তা খোঁজার অভিযানে যাত্রা শুরু করেছিলেন আমাদের ইন্দ্রিয় থেকে আসা প্রমাণগুলো যাচাই করার মাধ্যমে: দেখা, স্পর্শ করা, গন্ধ নেয়া, স্বাদ নেয়া এবং শোনা। আমরা কি আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর ভরসা রাখতে পারি? তিনি বলেছিলেন, সম্ভবত না। এই অনুভূতিগুলো মাঝে মাঝে আমাদের ধোঁকা দেয়। আমরা ভুল করি। আপনি কী দেখতে পাচ্ছেন সেটা ভেবে দেখুন। সবকিছু দেখার ক্ষেত্রে আপনার দৃষ্টি কি নির্ভরযোগ্য? আপনার কি সবসময় আপনার দেখার উপর বিশ্বাস রাখা উচিত? 

পানিতে একটা সোজা লাঠি ডুবালে আপনার চোখে পানির নিচে সেটাকে বেঁকে গেছে বলে মনে হবে। বহু দূরের চারকোনা কোনো মিনার দেখলে মনে হতে পারে যে সেটি গোলাকৃতির। মাঝে মাঝে আমরা সবাই ভুল করি, আমরা যা দেখছি সেই বিষয়ে। এবং দেকার্ত উল্লেখ করেছিলেন যে এমন কোনোকিছু বিশ্বাস করা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না যা অতীতে আমাদের ঠকিয়েছে। সুতরাং নিশ্চয়তার স্বপক্ষে ইন্দ্রিয়নির্ভর কোনো প্রমাণকে তিনি পরিত্যাগ করেন। তিনি কখনোই নিশ্চিত হতে পারবেন না যে তার ইন্দ্রিয়ানুভূতি তাকে ঠকাচ্ছে না। সেগুলো সম্ভবত বেশিরভাগ সময়ই সেটা করে না। কিন্তু একটি অস্পষ্ট সম্ভাবনা আছে যে তারা সেটি করতে পারে, এর অর্থ তার কাছে, তিনি পুরোপুরিভাগে তাদের কখনোই বিশ্বাস করতে পারবেন না। তাহলে তার অবস্থানটি কোথায়? 

এখন আমি জেগে আছি আর এই বাক্যটি পড়ছি, বিশ্বাসটি সম্ভবত আপনার কাছে বেশ নিশ্চিত একটি অনুভূতি। আপনি জেগে আছেন, আমি আশা করছি, এবং আপনি পড়ছেন। আপনি কীভাবে পারবেন বিষয়টি নিয়ে কোনো সন্দেহ পোষণ করতে? কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি যে আপনি যখন স্বপ্নের মধ্যে জেগে থাকেন তখনও কিন্তু চিন্তা করতে পারেন। আপনি তাহলে কীভাবে জানেন আপনি এখনও স্বপ্ন দেখছেন না? হয়তো আপনি ভাবছেন ঠিক এই মুহূর্তে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আসা অনুভূতিগুলো খুবই বাস্তবসম্মত, অনেক বেশি খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে পরিপূর্ণ, স্বপ্ন এমন হয় না। কিন্তু বহু মানুষই খুব বেশি বাস্তবসম্মত স্বপ্নও দেখে থাকেন। আপনি নিশ্চিত যে আপনি এখন একটা স্বপ্ন দেখছেন না? কীভাবেই বা আপনি সেটি জানবেন? হয়তো আপনি কেবলই আপনাকে একটা চিমটি কেটে দেখলেন বিষয়টি সত্যি কিনা। যদি আপনি এখনও সেটা করে না- থাকেন, সেটা করে দেখার চেষ্টা করুন একবার। কী প্রমাণ করছে সেটা? কিছুই না। এমনকি স্বপ্নে দেখতে পারেন যে আপনি আপনাকে চিমটি কাটছেন। সুতরাং আপনি হয়তোবা স্বপ্নই দেখছিলেন। যদি সেটা তেমন মনে হচ্ছে না ঠিক, এমনটা হবার সম্ভাবনাও কম, কিন্তু তারপরও কিছু সামান্য সন্দেহ করার অবকাশ থাকবে আপনি জেগে আছেন কিংবা নেই, এমন প্রস্তাবে। সুতরাং দেকার্তের Method of Doubt বা সন্দেহ-পদ্ধতি ব্যবহার করে আপনি সেই বক্তব্যটাকে বর্জন করছেন, আমি জেগে আছি এবং এটা এখন পড়ছি এই বাক্যটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয় ৷ 

এটি আমাদের দেখাচ্ছে যে আমরা আসলে পুরোপুরিভাবে আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর নির্ভর করতে পারিনা। আমরা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হতে পারিনা যে আমরা স্বপ্ন দেখছি না। কিন্তু নিশ্চয়ই, দেকার্ত বলেছিলেন, এমনকি স্বপ্নেও ২+৩ =৫, এখানেই দেকার্ত একটি চিন্তার পরীক্ষা ব্যবহার করেন, একটি কাল্পনিক গল্প ব্যবহার করেন তার বক্তব্যটিকে বোঝানোর জন্যে। তিনি এরপর তার সন্দেহটাকে যতদূর সম্ভব নিয়ে যান, এবং ‘আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?”, এই পরীক্ষার চেয়ে আরো একটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেন যে-কোনো বিশ্বাসের জন্য। তিনি বলেন, কল্পনা করুন একটি দৈত্যের কথা, যে-কিনা অবিশ্বাস্য রকম শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান, কিন্তু খুব নিষ্ঠুরও তার আচরণে। এই দৈত্যটি, যদি তার অস্তিত্ব থাকে, এমন কিছু সে আপনাকে মনে করাতে পারে যে যতবারই আপনি অঙ্কটা করুন না কেন ২ + ৩=৫ হবে, যদিও আসলে এটি ৬-এর সমান। আপনি কিন্তু জানছেন না যে দৈত্যটা আপনাকে দিয়ে এটা করাচ্ছে। আপনি কিছু না- জেনেই নিষ্পাপভাবেই সংখ্যাগুলো যোগ করে ফলাফলে পৌঁছাচ্ছেন। সবকিছু মনে হবে স্বাভাবিক।

কিন্তু কোনো সহজ উপায় নেই প্রমাণ করা যে এটি এখন ঘটছে না। হয়তো এই নিষ্ঠুরভাবে চালাক দানবটি আমাকে সেই বিভ্রম সৃষ্টি করে দেখাচ্ছে যে, আমি ঘরে বসে আমার ল্যাপটপে এই শব্দগুলো টাইপ করছি, কিন্তু যখন বাস্তবিকভাবে আমি ফ্রান্সের দক্ষিণে কোনো সাগরের বেলাভূমিতে শুয়ে আছি। অথবা হয়তো আমি কোনো কাচের পাত্রে তরলে ভাসা মগজ, অশুভ সেই দানবটা ল্যাবরেটরির তাকে সাজানো। সে হয়তো আমার মগজের মধ্যে বৈদ্যুতিক তার যুক্ত করে নানা ইলেক্ট্রনিক বার্তা প্রেরণ করছে আর আমাকে সেই ধারণা দিচ্ছে যে আমি একটা কাজ করছি, যখন আসলেই আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো কাজ করছি। হয়তো এই দানবটাই আমাকে চিন্তা করাচ্ছে যে আমি শব্দ টাইপ করছি যার অর্থ আছে, যখন আসলে আমি কেবলই একটা অক্ষরই বারবার টাইপ করে যাচ্ছি। কোনো উপায় নেই সেটা জানার। আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না এটা আসলে ঘটছে না, শুনতে যতই উন্মাদের মতো মনে হোক না কেন। 

এই অশুভ দৈত্যের চিন্তার পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে সংশয়কে তার সর্বোচ্চ সীমানায় নিয়ে যাবার একটি দেকার্তীয় কৌশল। যদি এমন কোনো একটা জিনিস আমরা পাই যার দ্বারা নিশ্চিত হতে পারি, কোনো অশুভ দানব আমাদের সাথে কোনো কৌশল করছে না, সেটা আসলেই বিস্ময়কর হবে। এটি আমাদের একটি উপায় দেবে সেইসব মানুষদের উত্তর দেবার জন্য, যারা দাবি করে আমরা কোনো কিছুই নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না। 

দেকার্ত-এর পরে যে পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন সেটি দর্শনের সবচেয়ে পরিচিত পক্তি হিসাবে পরিচিত, যদিও বহু মানুষ এই উদ্ধৃতিটির সাথে পরিচিত, তবে এই উদ্ধৃতিটি যারা বোঝেন তাদের সংখ্যা উদ্ধৃতিটি যারা জানেন তাদের চেয়ে বেশ কম। দেকার্ত দেখেছিলেন এমনকি যদিও দানবটির অস্তিত্ব থাকে এবং তার সাথে সে ছলনাও করে থাকে, অবশ্যই কিছু আছে যাকে দানবটি কৌশলে ছলনা করছে। যতক্ষণ তিনি চিন্তাটি করছেন তিনি, দেকার্ত অবশ্যই অস্তিত্বশীল। দানবটি তাকে বিশ্বাস করাতে পারবেনা যে তার অস্তিত্ব আছে যদি তার অস্তিত্ব না থাকে। তার কারণ এমন কিছু যার কিনা অস্তিত্ব নেই সে কোনো চিন্তাও করতে পারবেনা, ‘আমি চিন্তা করি’ অর্থাৎ আমার অস্তিত্ব আছে (ল্যাটিন ভাষায় cogito ergo sum), এটাই ছিল দেকার্তের উপসংহার। আমি চিন্তা করছি, সুতরাং অবশ্যই আমার অস্তিত্ব আছে। আপনি নিজে চেষ্টা করে দেখুন, যতক্ষণ আপনি কোনো চিন্তা করতে পারবেন বা অনুভূতিটি টের পাবেন, প্রায় অসম্ভব হবে আপনার নিজের অস্তিত্বটি অস্বীকার করা। আপনি কী, সেটি অন্য আরেকটি প্রশ্ন, আপনি সন্দেহ করতে পারেন, আপনার কোনো শরীর আছে কিনা সেই ব্যাপারে, অথবা এমন কোনো শরীর, যা আপনি দেখতে ও স্পর্শ করতে পারেন। কিন্তু আপনি সন্দেহ করতে পারবেন না যে আপনার অস্তিত্ব আছে, কোনো একধরনের চিন্তাশীল সত্তা হিসাবে। সেই চিন্তাটি নিজেই নিজের যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারবে। যখনই আপনি আপনার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করা শুরু করবেন, সন্দেহ করার কাজটি প্রমাণ করে আপনার অস্তিত্ব আছে চিন্তাশীল সত্তা হিসাবে। 

শুনতে বেশ বড় কিছু মনে নাও হতে পারে, কিন্তু তার নিজের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দেকার্তের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি তাকে দেখিয়েছিল, যারা সবকিছু সন্দেহ করে, যেমন পিরোর অনুসারী সংশয়বাদীরা, কোথায় ভুল করেছেন। এটি একই সাথে সেই বিখ্যাত ধারণাটিরও সূচনা করেছিল, যাকে আমরা চিনি কার্টেসিয়ান ডুয়ালিজম বা কার্তেসীয় দ্বৈততাবাদ নামে। এটাই হচ্ছে সেই ধারণা যা দাবি করে আপনার মন আপনার শরীর থেকে পৃথক এবং এর সাথে সে ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া করে। এটাই দ্বৈততাবাদ, কারণ মন আর শরীর দুটি বিষয়।বিংশ শতাব্দীর একজন দার্শনিক, গিলবার্ট রাইল, এই ধারণাটিকে উপহাস করেছিলেন ghost in the machine বা মেশিনের মধ্যে ভূতের পুরাণকাহিনি হিসাবে : শরীর হচ্ছে মেশিন বা যন্ত্র, আত্মা হচ্ছে সেই যন্ত্রের মধ্যে বাস করা ভূত। দেকার্ত বিশ্বাস করতেন যে মনের ক্ষমতা আছে শরীরে উপর প্রভাব ফেলার এবং একইভাবে শরীরেরও ক্ষমতা আছে মনের উপর প্রভাব ফেলার, কারণ এই দুটোই মগজে কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে, পিনিয়াল গ্রন্থি। কিন্তু তার এই দ্বৈততাবাদের কিছু সত্যিকারের সমস্যা ছিল, বিশেষ করে কীভাবে তিনি ব্যাখ্যা করবেন যে অভৌত কোনো কিছু, আত্মা বা মন, এমন কিছু যা ভৌত, শরীরে পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। 

দেকার্ত তার শরীরের চেয়ে বরং নিজের মনের অস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। তিনি কল্পনা করতে পারতেন যে তার কোনো শরীর নেই, কিন্তু তার কোনো মন নেই সেটা তিনি কল্পনা করতে পারেননি। যদি তিনি কল্পনা করেন তার কোনো মন নেই, তিনি তখনও চিন্তা করছেন, সুতরাং সেটি প্রমাণ করবে যে তার একটি মন আছে; কারণ যদি মন না থাকত, তিনি কোনোকিছু চিন্তাও করতে পারতেন না। মন আর শরীরকে যে আলাদা করা যাবে, এই ধারণাটি এবং মন অথবা আত্মা হচ্ছে অভৌত একটি বিষয় যার শারীরিক কোনো অস্তিত্ব নেই, যা রক্ত মাংস বা অস্থি দ্বারা নির্মিত নয়, খুবই সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের মনে। বহু বিশ্বাসী আশা করেন যে মন অথবা আত্মা টিকে থাকে শরীরের মৃত্যু হবার পরেও। 

যতক্ষণ তিনি চিন্তা করছেন ততক্ষণ তাঁর নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যদিও অবশ্যই যথেষ্ট নয় সংশয়বাদের যুক্তি খণ্ডনে, সংশয়ের ঘূর্ণি থেকে পালানোর জন্য দেকার্তের প্রয়োজন ছিল আরো কিছু নিশ্চয়তা, যে ঘূর্ণি তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তার দার্শনিক ধ্যানে। তিনি যুক্তি দেন যে একজন ভালো ঈশ্বরের অবশ্যই অস্তিত্ব আছে। সেইন্ট আনসেল্ম-এর অনটোলজিকাল বা সত্তাতত্ত্বীয় যুক্তির একটি সংস্করণ ব্যবহার করে তিনি নিজেকে বিশ্বাস করাতে সফল হন যে ঈশ্বরের ধারণাই প্রমাণ করছে ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বর অবশ্য নিখুঁত আর ত্রুটিহীন হবেন না যদি-না তিনি শ্রেষ্ঠ আর অস্তিত্বশীল না হয়ে থাকেন, ঠিক যেমন করে কোনো ত্রিভুজ ত্রিভুজ হবে না যদি-না তাদের অন্তঃস্থ সব কোণগুলোর সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রির সমান হয়। তাঁর আরেকটি যুক্তি, Trademark Argument, প্রস্তাব করেছিল যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে সেটা আমরা জানি, কারণ তিনি আমাদের মনে সেই ধারণাটি গেঁথে দিয়েছেন। আমাদের ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো ধারণাই থাকত না যদি ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব না থাকত। একবার যখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, দেকার্তের চিন্তার গঠনমূলক পর্বটিও আরো সহজতর হয়ে ওঠে। একজন ভালো ঈশ্বর মানবতার সাথে এইসব মৌলিক বিষয় নিয়ে কখনোই প্রতারণা করবেন না। সুতরাং দেকার্ত উপসংহারে পৌঁছান এই পৃথিবী আমরা যেভাবে অভিজ্ঞতা লব্ধ হই কমবেশি সেরকমই। যখন আমরা একটা স্পষ্ট আর পরিষ্কারভাবে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অবধারণ বা উপলব্ধি করতে পারি, তখন তারা নির্ভরযোগ্য। তার উপসংহার: পৃথিবীর অস্তিত্ব আছে, কমবেশি যেভাবে এটি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি, এমনকি যদিও মাঝে মাঝে আমরা ভুল করি যা আমরা উপলব্ধি করছি সেই বিষয়ে। কিছু দার্শনিক, যদিও মনে করেন এটা খামখেয়ালি একটা ভাবনা এবং তার অশুভ দানবও খুব সহজে তাকে ছলনা করতে পারে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভুল ধারণা সরবরাহ করে, ঠিক যেমন ২+৩=৫ সম্বন্ধে করে। ভালো ঈশ্বরের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা ছাড়া, দেকার্তের পক্ষে তাঁর জানার পরিধি অতিক্রম করা সম্ভব হতো না যে তিনি একটি চিন্তাশীল সত্তা। দেকার্ত বিশ্বাস করতেন সম্পূর্ণ সংশয়বাদ থেকে তিনি একটি পথ দেখিয়েছেন বের হয়ে আসার, কিন্তু তার সমালোচকরা অবশ্য সেই বিষয়টি নিয়ে সংশয়মুক্ত নন। 

রেনে দেকার্ত যদিও সুপরিচিত আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমার অস্তিত্ব আছে বা I think therefore I am বাক্যটি উচ্চারণ করার জন্য। কিন্তু এই বাক্যটি ছাড়াও তিনি বহু কারণেই অত্যন্ত বিখ্যাত একজন দার্শনিক ছিলেন। তাকে বিশেষভাবে স্বতন্ত্র করেছিল যে-বিষয়টি, সেটি হচ্ছে তিনি খুব কঠোরভাবে যুক্তিবাদী ছিলেন, বিশেষ করে সেই যুগে যখন বহু দার্শনিকই তাদের যুক্তির সমর্থনে ঈশ্বরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। দেকার্ত মানুষের যুক্তি ব্যবহার ক্ষমতার চেয়ে বেশি আর কোনোকিছুই বিশ্বাস করতেন না। তাঁর Rules for the direction of the mind বইটি তিনি শুরু করেছিলেন এভাবে : ‘আমি আমাদের আত্মার সেই সত্যিকারের সম্পদের বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করব, আমাদের প্রত্যেকের জন্যেই যা উন্মুক্ত করেছে সেই উপায়গুলো, যার মাধ্যমে কারো সাহায্য ছাড়াই আমরা আমাদের মধ্যেই খুঁজে পাব জীবন পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন হতে পারে এমন সব জ্ঞান।’ সঠিক যুক্তি আর চিন্তার সুস্পষ্ট ব্যবহারের দ্বারা পরিচালিত আত্মবীক্ষণ প্রক্রিয়া যে অনেক কিছু অর্জন করতে পারে তার উপর দেকার্তের গভীর আস্থা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর অধিকাংশ সমস্যার কারণ হচ্ছে আমাদের মানসিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার, যার কারণ সংশয়, ভ্রান্ত ধারণা আর অবচেতন স্তরের অযৌক্তিকতা। দেকার্তকে নিয়ে আরেকভাবে ভাবা যায় এবং এটাই ব্যাখ্যা করে কেন তিনি ফরাসি বিপ্লবের নেতাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন, সেটি হচ্ছে তিনি বিশ্বাস করতেন সব ধারণার ভিত্তি হবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর যুক্তি, কর্তৃত্ব আর ঐতিহ্য নয় ৷ 

তাঁর সবচেয়ে সেরা বই discourse on the method প্রকাশিত হয়েছিল ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে, যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে তিনি সেটি লেখার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন: ‘অনেকদিন আগে আমি পুরোপুরিভাবে আমার জ্ঞানচর্চা পরিত্যাগ করেছিলাম, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার নিজের মধ্যে যা পাওয়া যেতে পারে তার বাইরে অথবা পৃথিবীর সেরা বইগুলোতে আর কোনো জ্ঞানের অনুসন্ধান করব না। আমি আমার তারুণ্য কাটিয়েছি নানা রাজসভা ও বিচিত্ৰ মেজাজ ও মর্যাদার বহু মানুষের সাথে মিশে, নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, নিজেকে নানা পরিস্থিতিতে পরীক্ষা করার সুযোগ দিয়ে, যা আমার ভাগ্য সুযোগ করে দিয়েছিল, এবং সবসময় আমি ব্যক্তিগতভাবে ভেবেছি যা-কিছু আমার পথে এসেছে যেন আমি সেখান থেকে কিছু অর্জন করতে পারি।’ 

প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি তার জন্মভূমি ফ্রান্সের বাইরে কাটিয়েছিলেন। মূলত ডাচ প্রজাতন্ত্রে, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, আর পুরোপুরি ভুলও ছিল না সেই ভাবনাটি, যে, ব্যবসায়ী ডাচরা অর্থ আয় করার জন্য এতই ব্যস্ত যে তার মতো মুক্তচিন্তার কোনো মানুষকে তারা জ্বালাতন করবে না। তবে দেখা যায় ওলন্দাজ মানুষরা তিনি যতটা মনে করেছিলেন খানিকটা কম বস্তুবাদী, সুতরাং গুপ্তচর আর গোপন পুলিশকে এড়াতে তাকে প্রায় ২৪ বার ঠিকানা পরিবর্তন করতে হয়েছিল। দর্শনের প্রতি আত্মগত ধারণার এই দৃষ্টিভঙ্গির চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল তার বিখ্যাত বাক্য, কগিতো আরগো সম (cogito ergo sum, I think therefore I am)। এই বাক্যটি প্রথম আমরা পাই ফরাসি ভাষায় je pense donc je suis হিসাবে তাঁর Discourse onthe method বইটিতে, পরে ১৬৪৪ সালে principles of philosophy বইটিতে বাক্যটি উপস্থিত হয় ল্যাটিন ভাষায়। বাক্যটি মূলত দেকার্তের একটি প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর, যে-প্রশ্নটির ব্যাপারে দার্শনিকরা মাঝে মাঝে হয়তো অযৌক্তিকভাবেই বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েন: সেই প্রশ্নটি হচ্ছে কীভাবে কেউ কোনোকিছু জানতে পারে, এমনকি কারো আসলেই অস্তিত্ব আছে কিনা, নাকি সে কোনো একধরনের স্বপ্ন অথবা অশরীরী কিছু। এই প্রশ্নটির একটি নিশ্চিত উত্তর খোঁজার তার অনুসন্ধানে (এই সবকিছুই কোনো স্বপ্ন না তো!) দেকার্ত শুরু করেছিলেন তাঁর সেই অনুধাবন থেকে যে মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো খুবই অনির্ভরযোগ্য, যেমন তিনি বলতে পারবেন না যে তিনি আসলে ফায়ারপ্লেসের পাশে এখন ড্রেসিং গাউন পরে বসে আছেন না, এমনকি কিছু তিনি স্বপ্নে দেখছেন। কিন্তু একটি ব্যাপারে তিনি সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে পারেন সেটি হচ্ছে তিনি আসলেই চিন্তা করছেন। এভাবে স্বচ্ছ একটি টটোলজিকাল কৌশল ব্যবহার করে তার অস্তিত্বের সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব, যেমন তিনি চিন্তা করতে পারতেন না যদি তার অস্তিত্ব না থাকত; সেকারণে তার চিন্তা হচ্ছে তাঁর অস্তিত্বের খুবই মৌলিক প্রমাণ, তার সেই বচনে যদি ফিরে আসি, আমি চিন্তা করি অর্থাৎ আমার অস্তিত্ব আছে। হয়তো খুব বড় কোনো অন্তর্দৃষ্টি মনে নাও হতে পারে, কিন্তু দেকার্ত জ্ঞানতাত্ত্বিক সংশয় আর অস্থিতিশীল পৃথিবীতে এটি ব্যবহার করেছিলেন প্রমাণ করতে যে তার মতো এমনকি একই ধরনের নানা সুনিশ্চিত সত্য আবিষ্কার করে যাবে। 

দেকার্তের শুষ্ক লেখায় প্রায়শই তার ব্যক্তিগত নানা ঘটনার বর্ণনা থাকত; যেমন একবার তিনি খুব শীতে স্টোভের মধ্যে বসে ধ্যান করে কাটিয়েছিলেন। দেকার্ত দর্শনের সেই নিঃসঙ্গ ধারাটির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যা দাবি করে আমরা বেশিরভাগ গভীর সমস্যারই সমাধান করতে পারি আমাদের নিজেদের গভীরে অনুসন্ধান করে, দলবদ্ধভাবে বা প্রজন্মান্তরে হাতবদল করা ধারণা যা সাধারণত দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল দেকার্তের, তিনি মনে করতেন দর্শনের জন্য একদল বিজ্ঞানীর দরকার নেই, কিংবা দামি যন্ত্রপাতি বা কোনোদিন শোনা হয়নি এমন কোনো শব্দাবলি, বা উপাত্তর দরকার নেই। তাদের দরকার শুধু কোলাহলমুক্ত একটি ঘর এবং একটি যৌক্তিক মন। একবার সকাল এগারোটায় তার বাসায় দেখা করতে এসেছিলেন তার কিছু বন্ধু, কিন্তু তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন তিনি তখনও বিছানায় শুয়ে। ‘কী করছ তুমি’ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বলেছিলেন ‘চিন্তা করছি’। বিস্মিত বন্ধুদের তিনি সমালোচনা করে বলেন, অর্থহীন কোনো কাজ করার চেয়ে বিশুদ্ধভাবে নীরবে ভাবার সৌন্দর্য অনেক বেশি। 

১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আরো একটি বই প্রকাশ করেন, সেটি মূলত বোহেমিয়ার রাজকুমারী ও শখের দার্শনিক এলিজাবেথের সাথে তার ছয়বছরের পত্রালাপের ফসল; তিনি দেকার্তকে প্যাশন বা আবেগ নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছিলেন, দেকার্ত প্রাচীন দার্শনিকদের এই বিষয় নিয়ে সঠিক কাজ করেননি এমন ভেবে বিষয়টি নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন, অনেকটা মানুষ কীভাবে তাদের আবেগকে চিনবে আর কীভাবে সেগুলোর প্রকৃত ব্যবহার করবে এমন বিষয় নিয়ে। তিনি ছয়টি মৌলিক প্যাশন বা আবেগ চিহ্নিত করেছিলেন : বিস্ময়,ভালোবাসা, ঘৃণা, কামনা, আনন্দ আর দুঃখ, এবং তিনি দাবি করেন সব আবেগই এই ছয়টি মূল আবেগের মিশ্রণ। দেকার্ত স্টয়িকদের আবেগকে জয় করার বিষয়টির উপর ভরসা করতে পারেননি, তিনি শুধু প্রস্তাব করেছিলেন কীভাবে কেউ তাদের মনে সেই আবেগগুলোকে চিহ্নিত করতে পারে, এবং বুঝতে পারেন তাদের আচরণের উপর এই আবেগের প্রভাব আসলে কতটুকু। স্পষ্টতই তিনি এই সময়ের সাইকোথেরাপি বেশ পছন্দ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দার্শনিক হিসাবে একটি কাজ হচ্ছে অন্য মানুষকে বোঝাতে সাহায্য করা যেন তারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন যে আমরা মানসিকভাবে অনেক অগ্রসর হতে পারব কঠোর পরিশ্রম আর সঠিক উপদেশের মাধ্যমে। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে সুইডেনের রানি ক্রিস্টিনার আমন্ত্রণে তিনি সুইডেন যান, কিন্তু খুব শীতে ভোরে উঠে রানীকে সময় দেবার পরিণতিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে ৫৩ বছর বয়সে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। খুব ভালো করে ভাবলে তাঁর I think, therefore I am খুব হালকা কিছু মনে হবে না, কারণ এই বাক্যটাই সত্যিকারভাবে তার সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা দেয়, শুধু দেকার্ত নয় পুরো দর্শন সম্বন্ধেও। এটি ইঙ্গিত দেয় আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে আবেগীয় সংশয়, সংস্কার আর অসহায়ক প্রথাগত ধারণা থেকে নিজেদের যৌক্তিক ক্ষমতা ব্যবহার করে বের হয়ে আসতে হবে, একটি স্বাধীন যুক্তিনির্ভর অস্তিত্বের অনুসন্ধানে। 

দেকার্ত যেমনটা আমরা দেখেছি অনটোলজিকাল আর ট্রেডমার্ক যুক্তি ব্যবহার করে নিজেকে সন্তুষ্ট করেছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে। তাঁর আরেক স্বদেশি ব্লেইজ পাসকাল আমাদের কী বিশ্বাস করা উচিত এই প্রশ্নটিকে দেখেছিলেন খুব ভিন্নভাবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *