1 of 2

অধ্যায় ২০ : ঘরের মধ্যে হাতি – জর্জ বার্কলি (এবং জন লক)

অধ্যায় ২০ : ঘরের মধ্যে হাতি – জর্জ বার্কলি (এবং জন লক) 

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যখন আপনি ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দেন, আর কেউ যদি না দেখে, তাহলে কি আসলেই ফ্রিজের ভিতর লাইটটা বন্ধ হয়ে যায়? আপনি কীভাবে সেটি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন? হয়তো আপনি একটা রিমোট ক্যামেরা ফ্রিজের ভিতর লাগিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু তারপর কী হবে, যদি আপনি ক্যামেরাটা বন্ধ করে দেন? যেমন ধরুন সেই বিখ্যাত প্রশ্নটি, বনের মধ্যে কোনো গাছ পড়ে গেলে কী হয়, সেই পড়ার শব্দ শোনার মতো কেউ যদি সেখানে না থাকে? আসলেই কি সেখানে শব্দ হয়? আপনি কীভাবে জানেন যে-ঘরটিতে আপনি থাকেন, আপনি সেখানে না-থাকলেও সেটি সবার অলক্ষ্যে তার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখে? হয়তো আপনি যখন সেখানে থাকেন না, আর কেউ যদি সেটি না দেখে, তাহলে সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আপনি হয়তো কাউকে আপনার হয়ে নজর রাখতে বলতে পারেন। কঠিন প্রশ্নটি হচ্ছে: এটি কি তার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখে যখন ‘কেউ’ সেটি লক্ষ করে না? খুব স্পষ্ট নয় কীভাবে আপনি এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারবেন। আমরা অধিকাংশই মনে করি কোনো বস্তুর অস্তিত্ব অব্যাহত থাকে এমনকি যখন কেউ সেটির উপর নজর না রাখে, কারণ এটাই সরলতম উত্তর। এছাড়া আমরা অধিকাংশই মনে করি যে, পৃথিবীটি আমরা লক্ষ করছি সেটির অস্তিত্ব শুধুমাত্র আমাদের মনেই নয়, বাইরেও সেটির অস্তিত্ব আছে। 

যদিও আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্কলির (১৬৮৫-১৭৫৩) মতে, যিনি ক্লয়েনের (আয়ারল্যান্ডের একটি শহর) বিশপ হয়েছিলেন, কোনোকিছু যা আর পর্যবেক্ষণ করা হয়না, তার আর অস্তিত্বও থাকেনা। যেমন, যদি কোনো মন প্রত্যক্ষভাবে সচেতন না থাকে যে বইটা আপনি পড়ছেন, এটির আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা। যখন আপনি বইটির দিকে তাকাচ্ছেন, আপনি বইটি দেখতে পাচ্ছেন এবং পৃষ্ঠাগুলো স্পর্শ করতে পারছেন, কিন্তু বার্কলির জন্য এর মানে হচ্ছে, আপনি কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করছেন। এর মানে এটা নয় যে পৃথিবীতে বাইরে এমন কিছু আছে যা এইসব অভিজ্ঞতার কারণ হচ্ছে। বইটি হচ্ছে শুধুমাত্র আপনার এবং অন্যদের মনে কিছু ধারণার সমষ্টি (এবং হয়তো ঈশ্বরের মনে), এমন কিছু না যা আপনার মনের বাইরে ৷ বার্কলির মতে আমাদের বাইরের কোনো পৃথিবীর ধারণা অর্থহীন I বার্কলির এইসব কথাগুলো কিন্তু আমাদের সহজাত ধারণার সাথে মেলেনা। নিশ্চয়ই চারপাশেই আমাদের ঘিরে আছে বহু জিনিস যাদের অস্তিত্বের কোনো হেরফের হয় না, কেউ তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকুক বা না থাকুক, তাইনা? বার্কলি তেমন ভাবতেন না। 

বোধগম্যভাবেই, যখন বার্কলি তাঁর তত্ত্বগুলো নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, বহু মানুষই মনে করেছিলেন তিনি হয়তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। বাস্তবিকভাবেই, কেবল তার মৃত্যুর পরে তার ধারণাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছিলেন দার্শনিকরা এবং তারা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি আসলে কী করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক বিখ্যাত স্যামুয়েল জনসন যখন বার্কলির তত্ত্ব সম্বন্ধে শুনেছিলেন, তিনি রাস্তায় একটা পাথরকে জোরে লাথি মেরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি এভাবেই এটি ভুল প্রমাণ করলাম’। জনসনের মূল কথাটি ছিল অবশ্যই নানা জিনিসের অস্তিত্ব আছে এবং শুধুমাত্র ধারণা বা আইডিয়া দিয়ে তারা তৈরি না, সুতরাং বার্কলি অবশ্যই ভুল। কিন্তু বার্কলির বুদ্ধিমত্তার পরিমাণ নিয়ে জনসন যতটা ধারণা করেছিলেন, তিনি তার চেয়েও বুদ্ধিমান ছিলেন। আপনার পায়ে পাথরের শক্ত ঘনত্ব অনুভব করলেই সেটি জড় উপাদানগুলোর অস্তিত্ব প্রমাণ করেনা, শুধুমাত্র শক্ত পাথরের ‘ধারণার’ অস্তিত্ব ছাড়া। শুধুমাত্র বার্কলির জন্যে আমরা যাকে পাথর বলছি সেটি অনুভূতির জন্ম দেয়া, তা ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যিকারের ‘বাস্তব’ কোনো পাথর নেই যা আমাদের পায়ের ব্যথার অনুভূতির কারণ হচ্ছে। আসলেই আমাদের যা ধারণাগুলো আছে তার বাইরে কোনো বাস্তবতা নেই। 

বার্কলিকে মাঝে মাঝে বর্ণনা দেয়া হয় একজন ‘আইডিয়ালিস্ট’ হিসাবে এবং কখনো “ইমম্যাটেরিয়ালিস্ট’ হিসাবে। তিনি আইডিয়ালিস্ট কারণ তিনি বিশ্বাস করেন শুধুমাত্র আইডিয়া বা ধারণার অস্তিত্ব আছে। আর তিনি ইমম্যাটেরিয়ালিস্ট, কারণ তিনি বাস্তব জড় পদার্থের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে এমন বহু দার্শনিকের মতোই তিনি আমরা যা দেখি আর বাস্তবতার মধ্যে সম্পর্ক দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। অধিকাংশ দার্শনিকরা, তিনি বিশ্বাস করতেন, এই সম্পর্কের ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বিশেষ করে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন এই পৃথিবীর সাথে আমাদের চিন্তাগুলো কীভাবে সম্পর্কযুক্ত সে-ব্যপারে জন লক ভুল বলেছেন। লকের ধারণাগুলোর সাথে বার্কলির ধারণাগুলোর তুলনা করলে আমরা বার্কলির দৃষ্টিভঙ্গি সহজে বুঝতে পারব 

জন লক ভাবতেন, আপনি যদি কোনো হাতির দিকে তাকান, আপনি হাতিটিকে দেখতে পারছেন না। যাকে আপনি হাতি হিসাবে ভাবছেন এটি আসলে একটা রিপ্রেজেন্টেশন বা প্রতিনিধি, লক যা দাবি করেছিলেন আপনার মনের একটি ধারণার প্রতিফলন হিসাবে, অনেকটা একটা হাতির ছবি বা ইমেজের মতো। লক ‘আইডিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সেই সবকিছু বোঝাতে যা আমাদের পক্ষে ভাবা কিংবা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব হতে পারে। আপনি যদি কোনো ধূসর হাতি দেখেন, তার ধূসরত্ব শুধুমাত্র এমন কিছু না যা হাতিটির মধ্যে আছে, কারণ ভিন্ন আলোতে এটিকে দেখতে ভিন্নরকম মনে হয়। এই ধূসরত্বকে লক বলেছিলেন secondary quality, এটি তৈরি হয় হাতির কিছু বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সংমিশ্রণে, এই ক্ষেত্রে আমাদের চোখ, হাতির চামড়ার রঙ, এর চামড়ার বৈশিষ্ট্য, এর মলের গন্ধ সবকিছুই এর আনুষঙ্গিক গুণাবলি বা সেকেন্ডারি কোয়ালিটি। 

প্রাথমিক গুণাবলি, যেমন কোনোকিছুর আকার আকৃতি, লকের মতে পৃথিবীর সবকিছুর সত্যিকার বৈশিষ্ট্য। প্রাথমিক গুণাবলিগুলোর ধারণাগুলো সেইসব জিনিসগুলোরই সদৃশ। আপনি যদি বর্গাকার কোনোকিছু দেখেন, তাহলে সত্যিকারের যে জিনিসটি আপনার মনে ধারণার জন্ম দেবে সেটিও বর্গাকার হবে। কিন্তু আপনি যদি একটি লাল বর্গাকার কিছু দেখেন, বাস্তব পৃথিবীর সেই সত্যিকারের জিনিসটি যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন সেটি লাল নয়, সত্যিকারের জিনিসটি রঙহীন; রঙের অনুভূতি, লক বিশ্বাস করতেন সৃষ্টি করে আসলে বস্তুটির আণুবীক্ষণিক গঠন এবং আমাদের দৃষ্টি ক্ষমতার সম্মিলন ৷ 

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে, যদিও। লক বিশ্বাস করতেন যে, আসলেই আমাদের বাইরে একটি জগৎ আছে, যে জগৎটিকে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেন ব্যাখ্যা করতে, কিন্তু লক দাবি করতেন আমরা শুধুমাত্র সেটি করতে পারি পরোক্ষভাবে। তিনি ছিলেন রিয়েলিস্ট বা বাস্তববাদী, তিনি সত্যিকারের একটি পৃথিবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন এবং এই বাস্তব পৃথিবীটি তার অস্তিত্ব অব্যাহত রাখে এমনকি যখন কেউই সেটির সম্বন্ধে সচেতন নাও থাকে। লকের কাছে সমস্যা হচ্ছে সেই পৃথিবীটা কেমন সেটি জানা। তিনি মনে করতেন যে প্ৰাথমিক গুণাবলি সংক্রান্ত আমাদের ধারণাগুলোর, যেমন কোনোকিছুর আকার-আকৃতি বাস্তব কোনোকিছু সম্বন্ধে একটি ভালো চিত্র দেয়। কিন্তু কীভাবে সেটি তার পক্ষে বলা সম্ভব হতে পারে? একজন এমপিরিসিস্ট হিসাবে, যিনি বিশ্বাস করেন আমাদের সব জ্ঞানের উৎস হচ্ছে আমাদের অভিজ্ঞতা, তার কাছে ভালো প্ৰমাণ থাকা উচিত তার দাবির পক্ষে যে, প্রাথমিক গুণাবলিগুলো আসলেই বাস্তব পৃথিবীর সদৃশ। কিন্তু তার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেনি সত্যিকারের পৃথিবী কেমন সেটি তিনি কীভাবে জানতে পারেন, কারণ আমরা সেখানে গিয়ে সেটি যাচাই করতে পারিনা। তিনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন, প্রাথমিক গুণাবলির ধারণাগুলো, যেমন আকার আকৃতি, বাইরের সত্যিকার পৃথিবীর গুণাবলির সদৃশ? বার্কলির দাবিটি বরং সঙ্গতিপূর্ণ বেশি, লকের ব্যতিক্রম তিনি ভাবতেন যে, আমরা সরাসরি পৃথিবীটাকে অনুভব করি। এর কারণ পৃথিবী আর কিছুই না ধারণা ছাড়া। সমস্ত অভিজ্ঞতায় যা আছে এটা ততটুকুই। অন্যভাবে বললে পৃথিবী এবং এর মধ্যে বিদ্যমান সবকিছুরই অস্তিত্ব আছে শুধু মানুষের মনে। 

যা-কিছু আপনি অভিজ্ঞতালব্ধ হন, এবং ভাবেন, একটি চেয়ার অথবা একটি টেবিল, ৩ সংখ্যাটি ইত্যাদি, সবকিছুই বার্কলি মনে করেন, অস্তিত্বশীল শুধু আমাদের মনে। কোনো একটি বস্তু হচ্ছে ধারণার সমষ্টি যা আপনি এবং অন্য মানুষরা সেটি সম্বন্ধে ভাবেন। এর বাইরে আর কোনো অস্তিত্ব নেই। যদি কেউ না থাকে সেটি দেখা অথবা শোনার জন্য, তার কোনো অস্তিত্বও আর থাকে না কারণ কোনোকিছুই মানুষ (এবং ঈশ্বর) সেটি সম্বন্ধে যা ভাবেন তার বেশি কিছু না। বার্কলি তার সেই অদ্ভুত প্রস্তাবনাটি সংক্ষিপ্ত রূপ দেন ল্যাটিন ভাষায় একটি বাক্যে, Esse est percipi – to be (or exist ) is to be perceived. কোনোকিছুর অস্তি ত্বের জন্য প্রয়োজন সেটি অনুভূত (পর্যবেক্ষিত) হওয়া। 

সুতরাং ফ্রিজের লাইট অবশ্যই জ্বলতে থাকবে না, এবং জঙ্গলে কোনো গাছ পড়ে গেলেও কোনো শব্দ করবে না, যদি সেখানে কোনো সচেতন মন না থাকে বিষয়টির অভিজ্ঞতা লাভ করার জন্য। বিষয়টি এমনই একটা সুস্পষ্ট উপসংহার মনে হতে পারে আমরা বার্কলির immaterialism থেকে পেতে পারি, কিন্তু তিনি নিজে কিন্তু ভাবেননি যে, কোনোকিছু ক্রমাগত অস্তিত্ব লাভ করে আবার অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। এমনকি তিনি শনাক্ত করেছিলেন সেটি খুব অদ্ভুত ব্যাপার হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঈশ্বর আমাদের ধারণাগুলোর অব্যাহত অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ঈশ্বর নিরন্তরভাবে এই পৃথিবীতে নানা জিনিস অনুভব করে যাচ্ছেন, আর সেজন্যই তাদের অব্যাহত অস্তিত্ব আছে। বিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বে এটি চমৎকারভাবে প্রকাশ করা হয়েছে একজোড়া লিমেরিকের মাধ্যমে, প্রথমটি, যেখানে মূলত বোঝানো হয়েছে সেই ধারণাটির অসারতা, কোনো একটি গাছের অস্তিত্ব থাকে না যদি সেটি কেউ না পর্যবেক্ষণ করে। 

There once was a man who said ‘God 
Must think it exceedingly odd 
If he finds that this tree 
Continues to be 
When there’s no one about in the Quad.’

(একবার এক মানুষ যিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরের কাছে
অবশ্যই খুব বেশি অদ্ভুত মনে হয় 
যদি তিনি দেখেন এই গাছটি 
ঠিকই তার জায়গায় আছে 
যখন চত্বরে কেউ নেই।) 

অক্সফোর্ড কলেজে ঘাসের চত্বর (quad বলা হয়) বেশ ভালোভাবেই বার্কলির ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করেছে। তার তত্ত্বের কঠিনতম বিষয় যা মানতে কষ্ট হয়, সেটি হচ্ছে কোনো একটি গাছের অস্তিত্ব সেখানে থাকবে না যদি কেউ সেটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ না করে (কেউ যদি না দেখে) এবং পরের লিমেরিকে সমাধান দিচ্ছে ঈশ্বর থেকে আসার একটি বার্তা: 

Dear Sir, Your astonishment’s odd : 
I am always about in the Quad. 
And that’s why the tree 
Will continue to be, 
Since observed by Yours faithfully, God. 
(প্রিয় মহোদয়, আপনার বিস্ময়টি অদ্ভুত 
আমি সবসময়ে চত্বরে উপস্থিত 
আর সেকারণে গাছটি 
তার জায়গায় স্থির থাকবে, 
কারণ সেটি পর্যবেক্ষণ করছে আপনার একান্ত বিনীত, ঈশ্বর।) 

যদিও বার্কলির জন্য একটি সুস্পষ্ট সমস্যা হচ্ছে ব্যাখ্যা করা কীভাবে আমরা কখনোই কোনো বিষয়ে ভ্রান্ত হতে পারি। যদি আমাদের শুধু ধারণাই থাকে, এবং তার বাইরে কোনো জগৎ না থাকে, আমরা কীভাবে সত্যিকারের কোনো বস্তুর সাথে চোখের বিভ্রমকে আলাদা করতে পারি? তার উত্তর ছিল, অভিজ্ঞতার পার্থক্য দিয়ে, যাকে আমরা বাস্তব বলছি আর যাকে বিভ্রম বলছি, এই দুই অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যখন আমরা ‘বাস্তব’ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করি, আমাদের ধারণাগুলো পরস্পরবিরোধী হয়না। যেমন, যদি আপনি কোনো পানির উপর একটি দাঁড়কে (নৌকার) বের হয়ে আসতে দেখেন, এটি দেখতে হয়তো বাঁকা মনে হবে যেখানে এটি পানির উপরে ভেসে উঠেছে। লকের মতো রিয়েলিস্টদের মতে সত্যিটা হচ্ছে দাঁড়টি সোজাই তবে এটি শুধুমাত্র দেখতে বাঁকা লাগছে। বার্কলির মতে, আমাদের বাঁকা দাঁড়-সংক্রান্ত একটি ধারণা আছে, কিন্তু আমরা যদি পানিতে হাত ডুবিয়ে এটিকে স্পর্শ করি, সেই ধারণার সাথে এটি বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমরা তখন এটি সোজাই অনুভব করি। 

বার্কলি অবশ্য তাঁর সবসময় কাটাননি শুধুমাত্র immaterialism সমর্থন করে। তার জীবনে অবশ্যই এর বাইরেও বেশকিছু ছিল, খুব সামাজিক এবং আলাপী মানুষ ছিলেন তিনি, তার কাছের বন্ধু ছিলেন ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’-এর লেখক জোনাথন সুইফট। তার জীবনের শেষদিকে তিনি একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিলেন, বারমুদা দ্বীপে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা, সেটি সফল হয়নি, তবে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর নামে আমেরিকার পশ্চিম-উপকূলে ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলি)। আমেরিকাকে নিয়ে তার লেখা একটি কবিতা যার একটি পংক্তি, Westward the course of empire takes its way অনুপ্রাণিত করেছিল এর এক প্রতিষ্ঠাতাকে। হয়তো বার্কলির ইমম্যাটেরিয়ালিজমের আরো অদ্ভুত ছিল তাঁর শেষজীবনের অন্য বিচিত্র আগ্রহগুলো, যেমন টার ওয়াটারের স্বাস্থ্যগুণ নিয়ে তার প্রচারণা। টার ওয়াটার (পাইন কাঠ পোড়ানোর পর বের হয়ে আসা তেল, পাইন টার ও পানির মিশ্রণ), আমেরিকার লোক-চিকিৎসায় ব্যবহৃত হওয়া ঔষধটিকে মনে করা হতো সর্বরোগের নিরাময়কারী। তিনি এমনকি এর গুণগান করে দীর্ঘ কবিতাও লিখেছিলেন। যদিও সেই সময় টার ওয়াটার জনপ্রিয় ছিল, এমনকি বেশকিছু অসুখের নিরাময় করতেও সক্ষম হয়েছিল এর মৃদু রোগজীবাণুনাশক বৈশিষ্ট্যের জন্যে, কিন্তু বর্তমানে আর এটি জনপ্রিয় নয়। বার্কলির আইডিয়ালিজমও তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে বার্কলি হচ্ছেন সেইসব দার্শনিকদের একজন, যারা কোনো একটি যুক্তিকে অনুসরণ করেছেন সেটি তাদের যেদিকেই নিয়ে যাক না কেন, এমনকি যখন সেটি এমন কোনো উপসংহারের দিকে নিয়ে যায়, আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান যা সমর্থন করতে দ্বিধাবোধ করে। যাই হোক খুব কম দার্শনিকই বার্কলির ধারণা সহ্য করেছেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *