অধ্যায় ১ : যে মানুষটি প্রশ্ন করেছিলেন – সক্রেটিস এবং প্লেটো
প্রায় ২৪০০ বছর আগে এথেন্সে অতিরিক্ত বেশি প্রশ্ন করার জন্য এক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তাঁর আগেও বহু দার্শনিক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সক্রেটিসের হাত ধরেই এই দর্শন বিষয়টি সত্যিকারভাবে তার যাত্রা শুরু করেছিল। দর্শনের যদি কোনো পৃষ্ঠপোষক সেইন্ট বা সাধু থেকে থাকেন, তিনি হলেন সক্রেটিস।
চ্যাপটা নাক, মোটা, বেঁটে, অগোছালো, নোংরা এবং বেশ অদ্ভুত প্রকৃতির সক্রেটিস সেই সমাজে ঠিক মানানসই ছিলেন না। যদিও শারীরিকভাবে তিনি কুৎসিত ছিলেন, প্রায়ই গোছল করতেন না, তবে তাঁর ব্যক্তিত্বে অবশ্যই অদ্ভুত একধরনের আকর্ষণীয়তা ছিল, আর সেই সাথে প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর মেধারও অধিকারী ছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে অন্তত একটা বিষয়ে এথেন্সের সবাই একমত ছিলেন: এর আগে তাঁর মতো এমন কাউকে আর কখনোই দেখা যায়নি এবং সম্ভবত কখনোই আর দেখা পাওয়াও যাবে না। খুবই অনন্য এবং অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু একই সাথে তিনি খুবই বিরক্তিকর একজন মানুষও ছিলেন। নিজেকে তিনি ঘোড়া বা গবাদিপশুর গায়ে কামড়ানো বিরক্তিকর সেই মাছির মতো দেখতেন, যাদের বলা হয় গ্যাডফ্লাই (বা গোমাছি)। বিরক্তিকর অবশ্যই, তবে বড় কোনো ধরনের ক্ষতি তারা সাধারণত করেনা। তবে এথেন্সের সবাই অবশ্য তা মনে করতেন না। কিছু মানুষ তাকে ভালোবাসতেন ঠিকই তবে বেশিরভাগ মানুষই তাকে বিপজ্জনক একজন ব্যক্তি হিসাবেই ভাবতেন, যিনি অনেককেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।
তারুণ্যে তিনি ছিলেন সাহসী একজন সৈন্য, স্পার্টা এবং তাদের জোটের বিরুদ্ধে পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে এথেন্সের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। মধ্যবয়সে তাকে এথেন্সের বাজারে এলোমেলোভাবে হাঁটতে দেখা যেত, মাঝে মাঝে যিনি অন্যদের থামিয়ে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করতেন। কমবেশি মোটামুটিভাবে তিনি শুধু এই কাজটিই করতেন। কিন্তু যে-প্রশ্নগুলো তিনি করতেন সেগুলো ছিল ছুরির মতো ধারালো। প্রশ্নগুলো খুব সহজ মনে হতো ঠিকই, কিন্তু সেগুলো আদৌ সহজ কোনো প্ৰশ্ন ছিল না।
যেমন এর একটি উদাহরণ হতে পারে ইউথাইডেমুসের সাথে তাঁর একটি কথোপকথনে বা সংলাপে। সক্রেটিস তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছলনাপূর্ণ হয়ে করা কোনো কাজকে অনৈতিক মনে করা যেতে পারে কিনা? অবশ্যই অনৈতিক, ইউথাইডেমুস জবাব দিয়েছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর তো খুব স্পষ্ট। সক্রেটিস তখন তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বেশ তাহলে ধরুন, যদি আপনার কোনো এক বন্ধু যে কিনা খুবই হতাশাগ্রস্ত ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত এবং তিনি আত্মহত্যাও করতে পারেন, আপনি সেই শঙ্কায় তার ছুরিটা চুরি করলেন। সেটা কি একটি ছলনাপূর্ণ কাজ হবে না’? ‘অবশ্যই হবে’, ‘কিন্তু এমন কোনো কাজ করা অনৈতিক না হয়ে বরং নৈতিক হবার কথা কি নয়? যদিও এটি ছলনাপূর্ণ একটি কাজ, কিন্তু তারপরও তো এটি ভালো একটি কাজ, যার উদ্দেশ্য বন্ধুর জীবন বাঁচানো, খারাপ কোনো কাজ নয়’। ‘হ্যাঁ’, ইউথাইডেমুস উত্তর দিয়েছিলেন, ততক্ষণে অবশ্য তিনি সক্রেটিসের প্রশ্নের জালে জড়িয়ে গেছেন। সক্রেটিস ঠিক এভাবে বুদ্ধিমানের মতো বিপরীত একটি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে, ইউথাইডেমুসের সাধারণ মন্তব্যটি, ‘ছলনাপূর্ণ কোনো কিছু মানেই অনৈতিক’, এই প্রস্তাবটি আসলে সব পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য নয়। ইউথাইডেমুস বিষয়টি এর আগে কোনোদিনও বুঝতে পারেননি।
বারবার সক্রেটিস দেখিয়েছিলেন বাজারে যেসব মানুষগুলোর সাথে তাঁর দেখা হচ্ছে প্রতিদিন, তারা যা-কিছু জানেন বলে ভাবেন, আসলেই তারা সেটি জানেন না। কোনো একজন সামরিক সেনানায়ক হয়তো আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে শুরু করলেন যে তিনি আসলেই জানেন ‘সাহস’ বলতে কী বোঝায়, কিন্তু সক্রেটিসের সাথে বিশ মিনিট কথোপকথনের পরে তিনি পুরোপুরিভাবে সংশয়গ্রস্থ হয়ে পড়তেন। আর বহু মানুষের জন্যেই এই অভিজ্ঞতাটি নিশ্চয়ই খুব অস্বস্তিকর ছিল। মানুষ আসলেই সত্যিকারভাবে কতটুকু বুঝতে পারে তার সীমাটি দেখিয়ে দিতে সক্রেটিস ভালোবাসতেন এবং তিনি সেইসব ধারণাগুলোকে প্রশ্ন করতেন, যার উপর ভিত্তি করে তারা তাদের জীবন গড়ে তুলেছে। কথোপকথন যদি শেষ হয় এমন কোনোভাবে, যেখানে সবাই অনুধাবন করতে পারেন, আসলেই তারা কত অল্প জানেন, সক্রেটিসের জন্য সেটাই ছিল একটি সফলতা। আর সক্রেটিসের মতে কোনো কিছু কেউ পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারছেন এমন ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস বহন করে যাওয়ার চেয়ে বরং অনেক বেশি উত্তম অনুধাবন করা যে তিনি আসলেই সেটি ঠিকমতো বুঝতেই পারেননি।
সেই সময় এথেন্সের ধনী ব্যক্তিরা তাদের ছেলেদের সোফিস্টদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে পাঠাতেন। সোফিস্টরা ছিলেন বুদ্ধিমান, প্রাজ্ঞ শিক্ষক, যারা তাদের ছাত্রদের যুক্তি ব্যবহার করে বক্তৃতা দেবার কলা শেখাতেন। আর এই কাজটি করার জন্যে তারা মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকও নিতেন। কিন্তু তাদের ব্যতিক্রম, সক্রেটিস কিছু শেখানোর জন্য কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। বাস্তবিকভাবেই, তিনি দাবি করতেন যে, তিনি আসলে কিছুই জানেন না, সুতরাং কীভাবে আদৌ কাউকে কোনোকিছু শেখাতে পারেন?
তবে এই দাবি অবশ্য তাঁর কাছে ছাত্রদের শিখতে আসা বন্ধ করতে পারেনি, তাঁর কথোপকথন শোনার জন্যই তারা জড়ো হতো দল বেঁধে। আর বিষয়টি সোফিস্টদের কাছে তাকে মোটেও জনপ্রিয় করেনি।
একদিন তাঁর একজন বন্ধু, কেরোফোন, ডেলফিতে অ্যাপোলোর ওরাকল-এর কাছে গিয়েছিলেন। ওরাকল ছিলেন একজন জ্ঞানী বৃদ্ধ মহিলা, একজন সিবিল (সিবিলরা ছিলেন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন এমন কোনো মহিলা), মন্দিরে আসা দর্শনার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতেন তিনি। তার উত্তরগুলো সাধারণত হতো ধাঁধার মতো কোনো রূপে। কেরোফোন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “সক্রেটিসের চেয়েও জ্ঞানী কি কোনো ব্যক্তি আছেন?’ উত্তর এসেছিল, ‘না, সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী আর কেউ নেই। ‘
যখন কেরোফোন সক্রেটিসকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন, তিনি প্রথমে এটি বিশ্বাস করেননি। আসলেই তাকে বিষয়টি অবাক করেছিল, তিনি ভেবেছিলেন, ‘আমি কীভাবে এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হই যখন কিনা আমি এত কম জানি।’ তাঁর চেয়ে কেউ বেশি জ্ঞানী আছেন কিনা সেটি জানার জন্যে নানা মানুষদের প্রশ্ন করে জীবনের বহু বছর তিনি ব্যয় করেছিলেন। অবশেষে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, ওরাকল আসলে কী বলতে চেয়েছেন আর তার কথাটিও ঠিক। বহু মানুষ সেই বিষয়টি ভালো জানেন তারা সাধারণত যেটি করেন, কাঠমিস্ত্রি কাঠের কাজে ভালো, সৈন্যরা জানে যুদ্ধ করতে, কিন্তু তাদের কেউই আসলে সত্যিকারভাবে জ্ঞানী নন। তারা আসলেই জানেন না কী বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছেন।
‘দার্শনিক’-এর ইংরেজি শব্দ ‘ফিলোসফার’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা’। পশ্চিমা দর্শনের প্রচলিত ধারাটি, যা এই বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বিস্তার লাভ করেছিল প্রাচীন গ্রিস থেকে বিশ্বের বহু জায়গায়, কখনো প্রাচ্য দর্শনের সংমিশ্রণে ও মিথস্ক্রিয়ায় এটি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। যে-ধরনের জ্ঞানকে দর্শন মূল্য দেয়, তার ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি, তর্ক এবং প্রশ্ন করা; গুরুত্বপূর্ণ কেউ আপনাকে বলেছে সেটি সত্যি, শুধুমাত্র সেই কারণে সেটিকে সত্য বলে বিশ্বাস না-করা।
সক্রেটিসের কাছে জ্ঞান মানে অনেক বাস্তব তথ্য বা কোনোকিছু কীভাবে করতে হয় সেটি জানা নয়। এর মানে হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের সত্যিকারের প্রকৃতিটিকে অনুধাবন করা, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আমরা কতটুকু জানতে পারি তার সীমানাও। আজকের যুগে দার্শনিকরা কমবেশি সেই কাজটি করছেন, যা সক্রেটিস করেছিলেন : কঠিন সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা, যুক্তি এবং প্রমাণ পর্যালোচনা করা, গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য সংগ্রাম করা, বাস্তবতার প্রকৃতি সম্বন্ধে এবং কেমনভাবে আমাদের বাঁচা উচিত ইত্যাদি বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে- প্রশ্নগুলো আমরা নিজেদের করতে পারি, তাদের উত্তর অনুসন্ধান করা। যদিও সক্রেটিসের ব্যতিক্রম, আধুনিক দার্শনিকদের প্রায় আড়াই হাজার বছরের দর্শনের ধ্যানধারণার সুবিধাগুলো আছে, যার উপরে তারা নতুন কিছু নির্মাণ করতে পারেন। এই বইটি পশ্চিমা চিন্তাধারার গুরুত্বপূর্ণ কিছু দার্শনিকদের ধারণাগুলো পর্যালোচনা করেছে, যে-ধারাটি সূচনা করেছিলেন সক্রেটিস।
সক্রেটিসকে এত জ্ঞানী বানিয়েছিল যে-বিষয়টি সেটি হচ্ছে, তিনি প্রশ্ন-করা কখনোই থামাননি এবং নিজের যে-কোনো ধারণা নিয়ে তিনি সবসময় প্রস্তুত থাকতেন বিতর্ক করার জন্যে। তিনি বলতেন, এই জীবন ধারণ করার তখনই মূল্য আছে, যদি আপনি কী করছেন সেই বিষয়ে চিন্তা করেন। অপরীক্ষিত কোনো অস্তি ত্ব গবাদি পশুদের জন্য ঠিক আছে, মানুষের জন্যে নয়।
দার্শনিকদের ক্ষেত্রে যে-কাজটা খুবই অস্বাভাবিক, সক্রেটিস কোনোকিছু লিখে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার কাছে লেখার চেয়ে বরং কথা বলা অনেক বেশি উত্তম মনে হতো। কারণ তিনি মনে করতেন, লিখিত শব্দগুলো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। সেগুলো আপনাকে কোনোকিছু বোঝাতে পারেনা, যখন আপনি পড়ে সেটি বুঝতে পারবেন না। মুখোমুখি কথোপকথন অনেক বেশি উত্তম, তিনি মনে করতেন, কারণ কথা বলার সময় কোন্ ধরনের মানুষের সাথে আমরা কথা বলছি সেটা বিবেচনায় আনা যায়, এবং আমরা ঠিক সেইভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারি, আমরা যা বলছি সেটি যেন অপরপক্ষের কাছে বোধগম্য হয়।
যেহেতু কোনোকিছু লিখে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিলেন, সক্রেটিসের বিখ্যাত তারকা ছাত্র প্লেটোর মাধ্যমেই প্রধানত আমরা তার সম্বন্ধে বেশিরভাগ ধারণাগুলো পেয়েছি: এই মহান মানুষটি কী বিশ্বাস করতেন, কী নিয়ে তর্ক করতেন। প্লেটো, সক্রেটিস এবং যেসব মানুষদের তিনি প্রশ্ন করতেন, তাদের মধ্যে কথোপকথনগুলো নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশকিছু বই হিসাবে লিখে গিয়েছিলেন, যা পরিচিত প্লেটোনিক ডায়ালগস বা প্লেটোর সংলাপ নামে। দৰ্শন তো বটেই, সেগুলো সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনন্য সৃষ্টি। কোনো একভাবে ভাবা যেতে পারে যে, প্লেটো ছিলেন সেই যুগের শেক্সপিয়ার। তাঁর এইসব ডায়ালগস বা সংলাপগুলো পড়ে আমরা একটা ধারণা পাই, সক্রেটিস কেমন ছিলেন, তিনি কত বুদ্ধিমান ছিলেন, কীভাবে তিনি বেশকিছু মানুষের ক্রোধের কারণ হয়েছিলেন। কিন্তু আসলেই ব্যাপারটা এত সরল ছিল না, যেমন আমরা কিন্তু সবসময় নিশ্চিত হয়ে বলতে পারিনা, প্লেটো কি সত্যি সক্রেটিস যা বলে গেছেন সেটি লিখেছেন, নাকি নিজের সৃষ্ট ‘সক্রেটিস’ নামের একটি চরিত্রের মুখে প্লেটো তাঁর নিজের ধারণাগুলো তুলে দিয়েছিলেন।
তবে বেশিরভাগ মানুষই সেই ধারণাগুলোর মধ্যে একটি ধারণা : সক্রেটিস নয় বরং প্লেটোর নিজের ধারণা বলেই মনে করেন, সেটি হচ্ছে, পৃথিবীটাকে আমরা যেমন দেখছি বলে মনে করি, সেটি আসলে সেরকম নয়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের সামনে আমরা যা দেখি তা আসলে বাস্তবতা থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে ভিন্ন। আমরা অধিকাংশ মানুষই এই বাহ্যত রূপগুলোকে বাস্তবতা হিসাবে মনে করি। আমরা মনে করি আমরা বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা আসলে পারছি না। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে, এই পৃথিবীটা সত্যিকারভাবে কেমন, সেটি শুধুমাত্র দার্শনিকরাই বুঝতে পারেন। তারা বাস্তবতার প্রকৃতি আবিষ্কার করেন তাদের কোনো ইন্দ্রিয়ের উপর ভরসা করে নয় বরং চিন্তার দ্বারা।
তাঁর এই ভাবনাটি বোঝাতে তিনি একটি গুহার বর্ণনা দেন। আর সেই কাল্পনিক গুহায় মানুষ একটি দেয়ালের দিকে মুখ করে শৃঙ্খলিত হয়ে আছে। সামনে তারা শুধু দেখতে পাচ্ছে কম্পমান ছায়াগুলো, সত্যিকারের কোনোকিছু হিসাবে যা তারা বিশ্বাস করছে, কিন্তু সেগুলো বাস্তব নয়। তারা যা দেখতে পারছে সেটি হলো তাদের পিছনে আগুনের সামনে ধরে রাখা কোনোকিছুর ছায়া যা তাদের চোখের সামনের দেয়ালের উপর পড়ছে। এই মানুষগুলো তাদের সারাটা জীবন অতিবাহিত করে দেয়ালের উপর প্রক্ষেপিত ছায়াগুলোকে বাস্তব পৃথিবী হিসাবে ভেবে। তারপর, তাদের মধ্যে কোনো একজন তার শৃঙ্খল ভেঙে পেছন ফিরে আগুনের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে সবকিছু প্রথমে ঝাপসা মনে হয়, তারপর সে দেখতে পারে আসলে সে কোথায় অবস্থান করছে।
সে হোঁচট খেতে-খেতে গুহা থেকে বেরিয়ে আসে এবং সূর্যের দিকে তাকাতে সক্ষম হয়। এরপর যখন সে গুহায় আবার ফিরে আসে, বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে সে যা-কিছু অন্যদের বলে, কেউই সেগুলো বিশ্বাস করতে পারে না। যে-মানুষটি তার শৃঙ্খলিত জীবন থেকে মুক্ত হয়ে বের হয়ে আসতে পারে, সে দার্শনিকের মতো। কোনোকিছুর বাহ্যিক রূপের চেয়ে সে আরো গভীরে দেখতে পারে। বাস্তবতা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের খুব সামান্যই ধারণা আছে, কারণ গভীরভাবে কোনোকিছু নিয়ে ভাবার বদলে, তাদের সামনে যা আছে, তা দেখেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু এই চোখে যা দেখি সেটি ছলনাময়, তারা যা দেখে সেটি হচ্ছে ছায়া, বাস্তবতা নয়।
এই গুহার গল্প সংশ্লিষ্ট প্লেটোর সেই প্রস্তাবের সাথে, যা আমাদের কাছে পরিচিত, ‘থিওরি অব ফর্মস’ নামে। তাঁর এই দার্শনিক প্রস্তাবনাটি বোঝার সবচেয়ে সহজতম উপায় হতে পারে একটি উদাহরণের মাধ্যমে : আপনি আপনার জীবনে যতগুলো বৃত্ত দেখেছেন সেগুলোর কথা ভাবুন। তাদের কোনোটা কি একেবারে নিখুঁত বৃত্ত? না, তাদের কোনোটাই একেবারে ত্রুটিহীন নিখুঁততম বৃত্ত নয়। কোনো একটি নিখুঁত বৃত্তে এর পরিধির উপর যে-কোনো বিন্দু এর কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে অবস্থান করবে। বাস্তব বৃত্তগুলো কখনোই এটি পুরোপুরিভাবে অর্জন করতে পারেনা। কিন্তু আপনি বুঝতে পেরেছেন, আমি যখন ‘নিখুঁত বৃত্তের’ কথা বলছি আমি আসলে কী বোঝাতে চাইছি। বেশ, তাহলে এই ‘নিখুঁত বৃত্ত’ আসলে কী? প্লেটো বলবেন যে-কোনো একটি নিখুঁত বৃত্তের ধারণাটাই কোনো একটি বৃত্তের ফর্ম। আপনি যদি বুঝতে চান একটি বৃত্ত আসলে কী, আপনাকে বৃত্তের ফর্মের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে, সত্যিকারের বৃত্তের উপর নয়, যে বৃত্ত কিনা আপনি আঁকতে পারেন এবং আপনার দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে সেটি অভিজ্ঞতায় অনুভব করতে পারেন, যাদের প্রতিটি কোনো-না-কোনোভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এভাবে প্লেটো ভাবতেন, আপনি যদি গুডনেস বা ভালোত্ব কী সেটি বুঝতে চান, তাহলে আপনাকে মনোযোগ দিতে হবে ভালোত্বের ফর্মের উপর, বিশেষ কোনো ভালোত্ব পরিচায়ক ঘটনার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নয় যার সাক্ষী হয়তো আপনি ছিলেন। তিনি মনে করতেন দার্শনিকরা হচ্ছে সেই মানুষগুলো, যারা সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত আর যোগ্য ফর্মগুলো নিয়ে এভাবে নৈর্ব্যক্তিক উপায়ে ভাবার জন্য। ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভূত আর অভিজ্ঞ পৃথিবীর দ্বারা সাধারণ মানুষের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে সহজেই দিকভ্রান্ত হয়।
যেহেতু দার্শনিকরাই বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে সুদক্ষ, প্লেটো বিশ্বাস করতেন সব রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর কর্তৃত্ব শুধুমাত্র দার্শনিকদের দায়িত্বে থাকা উচিত। দ্য রিপাবলিক, তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত এই বইটিতে তিনি একটি কাল্পনিক নিখুঁত সমাজের কথা বর্ণনা করেছিলেন, যেখানে সমাজের উচ্চতম স্তরে থাকবেন দার্শনিকরা এবং তারা বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। কিন্তু যে নাগরিকদের তারা শাসন করছেন তাদের কল্যাণে তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দেবেন। তাদের নিচের স্তরে থাকবে সৈন্যরা, যারা দেশকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করার জন্য প্রশিক্ষিত হবেন, এবং তাদের নিচে থাকবে শ্রমিকরা। এই তিন স্তরের মানুষ নিখুঁত একটি ভারসাম্যে অবস্থান করবেন, প্লেটো ভাবতেন, এমন একটি ভারসাম্য, যা কিনা সু-ভারসাম্যময় কোনো মনের মতো, যেখানে যৌক্তিক অংশটি আবেগ আর কামনার উপর তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর প্রস্তাবিত সমাজের মডেলটি গভীরভাবে অগণতান্ত্রিক এবং যা মিথ্যাচার এবং বল প্রয়োগের মিশ্রণে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
শিল্পকলা বাস্তবতার মিথ্যা প্রতিনিধিত্ব করে, এমন অভিযোগ আরোপ করে তিনি সেই সমাজে বেশিরভাগ ধরনের শিল্পকলাকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। চিত্রকর নানা দৃশ্য ও রূপ আঁকেন, যা তারা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেন, কিন্তু প্রকৃত
ফর্ম সম্বন্ধে সঠিক তথ্য দেয়না এমন সব ইন্দ্রিয়গোচর রূপগুলো। প্লেটোর আদর্শ সেই ‘রিপাবলিকে’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র উপর থেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। এমন রাষ্ট্রকে এখন আমরা বলি ‘টোটালিটারিয়ান’ বা কর্তৃত্ববাদী কোনো রাষ্ট্র। প্লেটো ভাবতেন সব মানুষকে ভোট দেবার অধিকার দেয়া মানে দক্ষ কোনো ক্যাপ্টেনের পরিবর্তে অপ্রশিক্ষিত যাত্রীদেরকেই জাহাজ চালানোর সুযোগ দেয়া, আর সে-কারণে তাঁর মতে, আরো অনেক উত্তম পরিস্থিতি হচ্ছে, যারা ভালোভাবে জানেন কী করতে হবে কেবলমাত্র তাদেরকেই দায়িত্বে থাকতে দেয়া, যেমন জাহাজ চালাবেন প্রশিক্ষিত কোনো ক্যাপ্টেন।
প্লেটো তার দ্য রিপাবলিক বইটিতে যে-ধরনের রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করেছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্স তার থেকে খুবই ভিন্ন ছিল। সেখানে এক ধরনের গণতন্ত্র ছিল, যদিও জনসংখ্যার শুধুমাত্র দশ শতাংশ মানুষ সেখানে ভোট দেবার অধিকার রাখতেন। যেমন নারী এবং ক্রীতদাসরা এই অধিকার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু সব নাগরিকই রাষ্ট্রের আইনের চোখে ছিলেন সমান। এবং সেখানে জটিল সুপরিকল্পিত লটারি-পদ্ধতি ছিল যা নিশ্চিত করত যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত করার জন্যে প্রত্যেকেই যেন একটি ন্যায্য সুযোগ পায়।
প্লেটো তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসকে যেভাবে উচ্চ মূল্যায়ন করতেন, সামগ্রিকভাবে এথেন্স সেভাবে তাকে মূল্যায়ন করেনি। মূল্যায়ন তো দূরের কথা, বহু এথেন্সবাসী মনে করতেন সক্রেটিস হচ্ছেন বিপজ্জনক এক ব্যক্তি এবং তিনি পরিকল্পিতভাবে তাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অবমূল্যায়ন করছেন। ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন সক্রেটিসের বয়স সত্তর, এথেন্সবাসীদের একজন, মেলেতুস, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে তাঁকে আদালতে নিয়ে যান। তিনি দাবি করেছিলেন, সক্রেটিস এথেন্সবাসীদের উপাস্য দেবতাদের অবহেলা করছেন, এবং নিজের দেবতাদের দিয়ে তা প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি আরো অভিযোগ করেন যে, সক্রেটিস এথেন্সের তরুণদের খারাপ আচরণ ও ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করছেন।
দুটোই খব ভয়ংকর অভিযোগ ছিল সেই সময়ের এথেন্সে। এই অভিযোগের আদৌ কোনো সত্যতা ছিল কিনা সেটি জানা আমাদের পক্ষে খুবই কঠিন। হয়তো সক্রেটিস সত্যিই তাঁর ছাত্রদের রাষ্ট্রীয় ধর্ম অনুসরণ করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন, এছাড়াও কিছু প্রমাণ আছে যে এথেন্সের গণতন্ত্রকে উপহাস করতেও তিনি উপভোগ করতেন। সেটি তাঁর চরিত্রের সাথে মানানসই হতে পারে। তবে যে-বিষয়টা অবশ্যই সত্য ছিল সেটি হচ্ছে বহু এথেন্সবাসী আসলেই তাঁর বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগগুলো বিশ্বাস করেছিলেন।
যুক্তিতর্ক পরিশেষে সক্রেটিস দোষী না নির্দোষ এমন একটি প্রস্তাবনার পক্ষে বিপক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। ৫০১ জন নাগরিক, যারা এই বিচারপ্রক্রিয়ায় সুবিশাল আকারের জুরির দায়িত্বে ছিলেন, তাদের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি এথেন্সবাসী সক্রেটিসকে দোষী হিসাবে চিহ্নিত করে হ্যাঁ-ভোট দিয়েছিলেন এবং তারা তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। সক্রেটিস যদি চাইতেন তাহলে সম্ভবত তাঁর মৃত্যুদণ্ডটি এড়াতে পারতেন তাঁর যুক্তি ও কথার মাধ্যমে। কিন্তু এর পরিবর্তে, গোমাছির মতো তাঁর পরিচিতির সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন। তিনি উল্টো এথেন্সবাসীদের আরো খেপিয়ে তোলেন যুক্তি দিয়ে যে, তিনি ভুল কোনোকিছুই করেননি, এবং তাদের উচিত হবে, ৰাস্তবিকভাবে, শাস্তি দেবার বদলে তাকে আজীবন বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা। তাঁর এই প্রস্তাব অবশ্যই জুরিদের সহানুভূতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল বিষপানে বাধ্য করে। হেমলক নামের একটি গুল্ম থেকে বানানো এই বিষটি ধীরে ধীরে সারা শরীরকে অবশ করে দেয়। সক্রেটিস তাঁর স্ত্রী ও তিন ছেলেকে বিদায় জানান এবং তারপর চারপাশে তাঁর ছাত্রদের জড়ো করেন এবং বলেন, যদি তাকে সুযোগ দেয়া হতো আর কোনো কঠিন প্রশ্ন না করে, নীরবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার জন্য, তিনি সেটি গ্রহণ করতেন না, কারণ এরচেয়ে তাঁর কাছে মৃত্যুই শ্রেয়তর। নিজের ভিতরে তিনি একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেতেন, যা তাকে প্রতিটি বিষয় সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে নির্দেশ দিত, এবং তিনি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেননি। এরপর তিনি একটি পাত্র থেকে বিষপান করেন এবং খুব শীঘ্রই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
প্লেটোর সংলাপে, যদিও, সক্রেটিস এখনও জীবিত। এই কঠিন মানুষটি, যিনি সারাক্ষণই প্রশ্ন করতেন, এবং কোনোকিছু আসলেই কী সেই বিষয়ে চিন্তা করা থামানোর বদলে মৃত্যুকেই শ্রেয়তর মনে করতেন, সেই সময় থেকেই সব দার্শনিকদের জন্য তিনি অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। সক্রেটিসের তাৎক্ষণিক প্রভাব আমরা দেখতে পাই সেইসব ছাত্রদের মধ্যে, যারা তাঁর কাছে ছিলেন। শিক্ষকের মৃত্যু হলে প্লেটোই সক্রেটিসের চিন্তা, চেতনা আর প্রাণশক্তিটিকে বহন করে নিয়ে যান বহুদূর। তবে প্লেটোর সবচেয়ে সমীহ জাগানো ছাত্রটি ছিলেন, অ্যারিস্টোটল, যিনি সক্রেটিস এবং প্লেটো দুজন থেকে খুব ভিন্নধরনের দার্শনিক ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে আমরা পরের একটি অধ্যায়ে জানব।