1 of 2

অধ্যায় ১৫ : প্রবচনে দর্শন – ফ্রাঁসোয়া দ্য লা রোশফুকো

অধ্যায় ১৫ : প্রবচনে দর্শন – ফ্রাঁসোয়া দ্য লা রোশফুকো 

প্রচলিত একটি ধারণা আছে, যদি সঠিকভাব দর্শনচর্চা করা হয়, সেটি শুনলে মনে হবে গম্ভীর, সমীহ জাগানো, কিছুটা বিভ্রান্তিকর, যেন অনেকটা জার্মান ভাষা থেকে অদ্ভুতভাবে করা কোনো অনুবাদ। কিন্তু আধুনিক যুগের প্রায় সূচনালগ্নে এক ফরাসি দার্শনিকের জন্ম হয়েছিল যিনি তাঁর চিন্তাগুলোকে উপস্থাপন করার জন্যে খুব ভিন্ন একটি উপায়ের উপর আস্থা রেখেছিলেন। তিনি খুব ছোট আকারের, মাত্র ৬০ পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি বই লিখেছিলেন, যে বইটি দর্শনের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি মাস্টারপিস হিসাবে তার অবস্থান দাবি করতে পারে অনায়াসে। বইটি মূলত মানবজীবন ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে তার সূতীক্ষ্ণ, কখনো বিমর্ষ কিছু পর্যবেক্ষণের সংকলন, যাদের প্রত্যেকটি শুধুমাত্র এক কিংবা দুটি বাক্য পরিমাণ দীর্ঘ। নৈতিকভাবে বিভ্রান্ত আর অমনোযোগী অস্থির এই যুগে তাঁর সেই বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণগুলোর অনেকগুলোই এখনও সময়োপযোগী, প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং খানিকটা অদ্ভুতভাবে এখনও আমাদের সান্ত্বনা প্রদান করতে সক্ষম। 

ড্যুক ফ্রাঁসোয়া দ্য লা রোশফুকোর-এর জন্ম প্যারিসে, ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে। তার জীবনের শুরুতে তিনি বেশ সুবিধাপ্রাপ্ত ছিলেন (সম্পদে, যোগাযোগে, তার চেহারায়, এছাড়াও খুব সুন্দর আর প্রাচীন সম্ভ্রান্ত একটি নামে) তবে তার জীবনের বাকি সময়টা ছিল বেশ কঠিন। কয়েকজন ডাচেসের প্রেমেও পড়েছিলেন তিনি, যারা তাঁর সাথে কোনোদিনও ভালো আচরণ করেননি, রাজনৈতিক আদর্শবাদী তবে ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে কিছুদিন কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং তাঁর প্রিয় প্যারিস থেকে মোট চারবার তাকে নির্বাসিত করা হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি, এক বিদ্রোহের সময় চোখে গুলির আঘাত পান, যা তাকে প্রায় অন্ধ করে দিয়েছিল আক্রান্ত চোখে। নিজের টাকাপয়সা সব হারিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত শত্রুরা তার নাম ব্যবহার করে লেখা স্মৃতিকথায় তার পরিচিতদের নিয়ে নানা অপমান আর কুৎসাপূর্ণ মন্তব্য প্ৰকাশ করেছিলেন, বলাবাহুল্য লা রোশফুকো যে নির্দোষ তার প্রভাবশালী পরিচিতরা বিশ্বাস করেননি। 

বিশ্বাসঘাতকতা, কারাগার, দারিদ্র্য, শারীরিক পঙ্গুত্ব, মানহানির অভিযোগ, সবকিছুর পর লা রোশফুকো স্বেচ্ছায় সরে এসেছিলেন সবধরনের সক্রিয় জীবন থেকে। তাঁকে বেশিরভাগ সময় দেখা যেত সেই সময়ের দুজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী মহিলা মার্কি তো সাবলে এবং কমতে দো লাফ্যায়েট-এর আয়োজিত জমায়েতে। এই জমায়েতে জড়ো হতেন আমন্ত্রিত লেখক এবং শিল্পীরা, এবং জ্ঞানের নানা ক্ষেত্র নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি তর্ক ও আলোচনা করতেন। এই জমায়েতগুলো পরিচিত ছিল প্যারিসিয়ান সালোন হিসাবে। এইসব সালোনে বুদ্ধিমত্তা আর উপস্থিত বুদ্ধির বিশেষ কদর ছিল। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সেমিনার রুম না, এখানে কারোরই গালভরা পাণ্ডিত্য আর গাম্ভীর্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল না। এখানে শ্রোতাদের আকর্ষণ করার জন্য দরকার ছিল বিশেষ কিছু দক্ষতা, আর সেটাই ক্রমে রূপ দিয়েছিল লা রোশফুকোর মন ও তার কর্মকে। 

এই সালোনেই লা রোশফুকো সাহিত্যের একটি নতুন জনরা বা ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন, যার জন্যে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে ম্যাক্সিম বা প্রবাদ প্রবচন বা অ্যাফোরিজম: খুবই সংক্ষিপ্ত এবং দৃঢ়তার সাথে প্রকাশিত বক্তব্য যা খুব দক্ষতার সাথে মানবমন ও আত্মার অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশ করে যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় কোনো একটি জ্ঞানপূর্ণ কিন্তু প্রায়শই অস্বস্তিকর কোনো সত্যি কথাকে। দক্ষ কারো নিয়ন্ত্রণে একটি অ্যাফোরিজম তার আঘাত হানে তিন সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে। 

লা রোশফুকো সালোনেই তার ৫০৪টি অ্যাফোরিজমকে পরিশীলিত করেছিলেন, যা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি লক্ষ করেছিলেন কীভাবে শ্রোতারা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে এবং সেই অনুযায়ী তার বচনগুলোকে আরো শাণিত করেছিলেন। তার অ্যাফোরিজমের বিষয়ক্ষেত্র ছিল মনোবৈজ্ঞানিক নানা বিষয়। ঈর্ষা, দাম্ভিকতা,ভালোবাসা আর উচ্চাকঙ্ক্ষা ছিল তার পরিচিত পুনরাবৃত্তি হওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। কোনো একটি বৈশিষ্ট্যসূচক লা রোশফুকো অ্যাফোরিজম শুরু হতো পাঠকের প্রতি সম্ভাষণ করে, ‘আমরা’ অথবা ‘একজন’ শব্দ ব্যবহার করে, মৃদু চাপের মাধ্যমে সম্মতি আদায় করে, এরপর অ্যাফোরিজমটি মানবচরিত্রের কোনো একটি প্রচলিত সদ্‌গুণকে পরাভূত করে নৈরাশ্যবাদী কিংবা সংশয়বাদীর দিকে এটিকে পরিচালিত করে। তৃতীয় পঙ্ক্তিতে সাধারণত হুলটি ফোটানো হয় এবং প্রায়শই বিষয়টি আমাদের হাসায়, যেমন সেটি হতে পারে যখন আমরা বাধ্য হই স্বীকার করতে ইতিপূর্বে আমাদের কোনো আবেগপ্রবণ অথবা ভণ্ডামিপূর্ণ অবস্থানটিকে মিথ্যা ও ভুল ছিল। 

লা রোশফুকোর হয়তো সবচেয়ে সেরা ও নিখুঁত অ্যাফোরিজমটি হচ্ছে: 

We all have strength enough to bear the misfortunes of others. ‘আমাদের সবারই অন্যদের দুর্দশা সহ্য করার মতো যথেষ্ট শক্তি আছে।’ এর কাছাকাছি এবং সমানভাবে কার্যকরী: 

There are some people who would never have fallen in love, if 

they had not heard there was such a thing. 

‘কিছু মানুষ আছেন যারা কখনোই হয়তো প্রেমে পড়ত না, যদি তারা না শুনত এমন কোনো জিনিস আছে।’ 

এছাড়া কোনো অংশেই কম না: 

He that refuses praise the first time it is offered does it because he 

would like to hear it a second. 

‘প্রথমবার নিবেদন করা প্রশংসা যিনি নিতে অস্বীকার করেন, তিনি কাজটি করেন কারণ সেটি তিনি দ্বিতীয়বার শুনতে চান।’ 

ভলতেয়ার বলেছিলেন লা রোশফুকোর ম্যাক্সিম(Maxims) বইটি হচ্ছে সেই বই যা সবচেয়ে শক্তিশালীভাবে ফরাসিদের চরিত্রের আকার দিয়েছিল; তাদের মনোবীক্ষণ, সুস্পষ্টতা আর নৈরাশ্যবাদিতার স্বাদ দিয়েছিল। প্রতিটি বচনের পেছনেই আছে আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে সাধারণ আত্মচাটুকারিতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ। ইগোইজম বা অহংবাদের প্রতি দয়াশীলতা যে ঋণী সেই বিষয়টি উন্মোচনের আস্বাদ নিয়েছিলেন লা রোশফুকো এবং তিনি দাবি করেন, নিষ্ফল দাম্ভিক, উদ্ধত, স্বার্থপর এবং সংকীর্ণমনা হওয়া থেকে আমরা কখনোই খুব দূরে অবস্থান করিনা, এবং কখনোই, যখন আমরা আমাদের ভালো গুণাবলির উপর বিশ্বাস করি, তার কাছাকাছিও অবস্থান করিনা। ভালোবাসার নামে যন্ত্রণা ভোগ করার পর, তিনি বিশেষভাবে সন্দেহ পোষণ করতেন রোমান্টিক ভালোবাসার প্ৰতি: 

‘প্রেমিক প্রেমিকারা কখনোই পরস্পরের ক্লান্ত হয়না, কারণ তারা নিজেদের ছাড়া আর কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলে না।’ 

‘কেউ যখন বলেন তিনি কখনো মিথ্যা প্রেমের ভান করেন না, সেটি আসলেই প্রেমের ভান করার একটি রূপ।’ 

দেখতে খুব সহজ মনে হয় তার ভাবনাগুলো। দার্শনিক নিচাহ, লা রোশফুকোর দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যাফোরিজম লিখেছিলেন (যা সংগৃহীত আছে তারই Human, All Too Humanবইয়ে), যেখানে অবশ্যই ফরাসি এই ভদ্রলাকের নৈরাশ্যবাদিতা আর সুবুদ্ধির চমৎকার মিশ্রণ ছিল না: 

‘প্রেয়সীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে খুব অল্প মানুষই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন,তবে অধিকাংশই কাজটি করেছেন তাদের কেউ অপহরণ করার ইচ্ছা পোষণ করেননি বলে।’ 

লা রোশফুকো এমনভাবে লিখেছিলেন তার প্রবচনগুলো, কারণ তিনি সেইসব মানুষদের প্ররোচিত করতে চেয়েছিলেন তার ধারণা দিয়ে; তিনি জানতেন যে, যে মানুষগুেলোর খুব সামান্যই সময় আছে মনোযোগ দেবার আর আবশ্যিকভাবে যারা তার মতাদর্শানুসারীও নয়। এরপর থেকে যদি বেশিরভাগ দার্শনিকই (কিছু অদ্ভুত ব্যতিক্রম ছাড়া) তার মতো বুদ্ধিমত্তা আর সুনির্দিষ্টতাসহ লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করে থাকেন, তার কারণ তারা বিশ্বাস করেছিলেন (দুর্ভাগ্যজনকভাবে), যতক্ষণ অবধি ধারণাগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যে শৈলীতেই সেগুলো উপস্থাপন করা হোক না কেন, সেটি কারো সমস্যা করার কথা না। 

লা রোশফুকোর ভাবনা ছিল ভিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা এতবেশি অমনোযোগী, কেউ যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের জানাতে চান, তাদের অবশ্যই শিল্পকলার সব কৌশলের সদ্ব্যবহার করা উচিত যা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে, প্রয়োজনীয় সময়ের জন্যে আমাদের একঘেয়েমি ক্লান্তিকে নিঃসাড় করে দেয়ার মাধ্যমে। দর্শনের ইতিহাস খুব বেশি ভিন্ন হতো যদি এর অনুশীলনকারীরা কল্পনা করতেন যে তারা লিখছেন অধৈর্য আর অপেশাজীবী পাঠকদের জন্য যাদের মন বিক্ষিপ্ত, ঠিক যেমন প্যারিসের কোলাহলপূর্ণ সালোনের মধ্যে। তবে ইদানীং ১৪০ শব্দে সীমাবদ্ধ ডিজিটাল সালোন দ্বিতীয়বার আমাদের সুযোগ দিয়েছে লা রোশফুকোর অনুপ্রাণিত করা মূলনীতিগুলো আরো একবার কাজে লাগানোর জন্য। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *