1 of 2

অধ্যায় ১৭ : বাজির দান রাখুন – ব্লেইজ পাসকাল

অধ্যায় ১৭ : বাজির দান রাখুন – ব্লেইজ পাসকাল 

আপনি যদি উপরের দিকে কোনো পয়সা ছুড়ে মারেন বা টস করেন, এটি এর দুটি পাশের যে-কোনো একটি পাশে পড়বে, হেডস অথবা টেলস। ৫০/৫০ সম্ভাবনা আছে যে-কোনো একটি হবার, যদি-না অবশ্য পয়সাটি কোনো-না- কোনোভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে থাকে। সুতরাং আসলেই কোনো ব্যাপার না আপনি কোন্‌দিকে বাজি রাখবেন, কারণ আপনার সম্ভাবনা ৫০/৫০, আপনি যতবার টস করবেন হেড অথবা টেল পড়ার সমান সম্ভাবনা থাকবে। আপনি যদি নিশ্চিত না হন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিনা, তাহলে আপনার কী করা উচিত? বিষয়টি কি কয়েন টস করার মতো কিছু? নাকি আসলেই এমনভাবে আচরণ করা যৌক্তিক, যেন আসলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, এমনকি সেটি সত্য হবার সম্ভাবনা যখন খুবই কম? ব্লেইজ পাসকাল (১৬২৩-১৬৬২), যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, এই প্রশ্নটি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছিলেন। 

পাসকাল খুব আন্তরিকভাবে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগের অধিকাংশ খ্রিস্টানদের ব্যতিক্রম, মানবতা সম্বন্ধে তার খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। নৈরাশ্যবাদী ছিলেন তিনি। তিনি সবদিকেই বিপর্যয় দেখতে পেতেন। সবদিকেই তিনি ত্রুটি দেখতে পেতেন; আদম এবং হাওয়ার ঈশ্বরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার সেই আদিপাপকে এই অধঃপতনের কারণ হিসাবে মনে করতেন। অগাস্টিনের মতো, তিনিও বিশ্বাস করতেন মানুষকে পরিচালিত করে যৌনকামনা; মানুষ অনির্ভরযোগ্য এবং খুব সহজেই কোনোকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। প্রত্যকেই হতভাগ্য, প্রত্যেকেই চিন্তা আর হতাশার টানাপড়েনে ছিন্নভিন্ন। তিনি মনে করতেন, আমাদের সবারই অনুধাবন করা উচিত আমরা প্রত্যেকেই আসলে কত বেশি তুচ্ছ আর অপ্রয়োজনীয়। পৃথিবীতে যে সংক্ষিপ্ত সময় আমরা বাস করি, আমাদের জীবনের আগে-পরের অনন্ত সময়ের তুলনায়, তা প্রায় অর্থহীন। মহাবিশ্বের অসীম পরিসরের মধ্যে আমরা খুব সামান্যতম পরিসরে বাস করি। তারপরও, একই সাথে আবার পাসকাল বিশ্বাস করতেন মানবতার বহু কিছু করার সম্ভাবনা থাকত, যদি আমরা ঈশ্বরকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতাম। আমরা পশু আর দেবদূতদের মাঝামাঝি কোনো একটি অবস্থানে আছি, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এবং বেশিরভাগ সময়ে সম্ভবত আমরা পশুদের নিকটবর্তী। পাসকালের সবচেয়ে পরিচিত বই Pensées (Thoughts) সংকলিত করা হয়েছিল ৩৯ বছর বয়সে তার অকালমৃত্যুর পর বিভিন্ন লেখা থেকে নানা খণ্ডাংশ যুক্ত করে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে। খুব চমৎকারভাবে সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ আকারে এটি লেখা। কেউই আসলে জানেন না তিনি আসলে এইসব ভাবনা খণ্ডাংশগুলো কীভাবে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার বইয়ের মূল বিষয়টি নিয়ে কারো মনে সন্দেহ নেই, এটি খ্রিস্টধর্ম নিয়ে তার নিজস্ব একটি সংস্করণের সমর্থনে লেখা। পাসকাল তার বইটা শেষ করে যেতে পারেনি তার মৃত্যুর আগে। বইয়ের খণ্ডগুলো সাজানোর ভিত্তি ছিল যেভাবে পাসকাল কাগজগুলোর বান্ডিল আলাদা আলাদা করে সুতো দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। প্রতিটি বান্ডিল ছিল প্রকাশিত বইয়ের এক-একটি খণ্ড। 

পাসকালের জন্ম ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য-ফ্রান্সের অভরাইনে। শুরু থেকেই তিনি জীবনের গ্লাসকে অর্ধেক খালি হিসাবে দেখেছিলেন। তাঁর মা মারা গিয়েছিলেন যখন তাঁর বয়স মাত্র তিন। তাঁর অল্পকিছু বন্ধু ছিল। পাসকাল খানিকটা কুঁজো ছিলেন এবং শৈশব থেকেই প্রায়শই অসুস্থ থাকতেন, শারীরিকভাবে কখনোই তিনি পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর প্রতিকৃতিগুলোয়, তাকে দেখে কখনোই সুস্থ মনে হয়নি, তাঁর অশ্রুপূর্ণ চোখ বিষণ্ন হয়েই প্রতিকৃতির দর্শকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু খুব সংক্ষিপ্ত সময়েই তিনি অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে, তাঁর গর্বিত পরিবারের বাইরেও তাঁর প্রতিভাটি শনাক্ত হয়েছিল অল্পবয়স থেকে। বারো বছর বয়সেই তিনি ইউক্লিডের বত্রিশটি প্রস্তাবনা সমাধান করেছিলেন। তারুণ্যে, তাঁর বাবার অনুপ্রেরণায়, তিনি বিজ্ঞানকে বেছে নিয়েছিলেন; বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি বেশকিছু ধারণা নিয়ে কাজ করেছেন, বিশেষ করে শূন্যস্থান বা ভ্যাকিউম নিয়ে, চাপ মাপার যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন। ১৬৪২ সালে তিনি একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন যা যোগ-বিয়োগ করতে পারত। জটিল নানা গিয়ারসহ একটি স্টাইলাস বা কাঁটা সুনির্দিষ্ট একটি ডায়ালের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে এই হিসাব-নিকাশগুলো করা যেত, আর পাসকাল তাঁর বাবার ব্যবসার হিসাব-নিকাশে সহায়তা করার জন্যে সেটি বানিয়েছিলেন। জুতার বাক্সের সমান আকারের এই ক্যালকুলেটরটি পরিচিত ছিল Pascaline নামে, যদিও বেশ কষ্টকর এটি চালানো, তবে এটি কাজ করত। শুধুমাত্র সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল এটি বানানো বেশ ব্যয়বহুল ছিল। তিনি প্রথম ঘোড়ায় টানা যাত্রীবাহী বাস বা প্যারিস অমনিবাস পরিকল্পনা করেছিলেন গণপরিবহন হিসাবে। 

বিজ্ঞানী এবং আবিষ্কারক পাসকাল গণিতেও দক্ষ ছিলেন। গণিতে তার সবচেয়ে মৌলিক অবদান হচ্ছে probability বা সম্ভাবনা-সংক্রান্ত কিছু ধারণা। কিন্তু বর্তমানে তাঁকে মনে রাখা হয়েছে মূলত ধর্মীয় দার্শনিক এবং লেখক হিসাবে। অবশ্য তিনি খুব একটা পছন্দ করতেন না, সবাই তাকে দার্শনিক হিসাবে মনে রাখুক: কারণ তার নিজের লেখায় তিনি প্রায়শই দার্শনিকদের অজ্ঞতা ও তাদের চিন্তাভাবনার গুরুত্বহীনতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বরং নিজেকে তিনি একজন ধর্মতাত্ত্বিক হিসাবে ভাবতে ভালোবাসতেন। ছত্রিশ বছর বয়সে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে যাবার পর তিনি আর কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করেননি। এই সময়টায় তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর অসাধারণ, গভীরভাবে নৈরাশ্যবাদী ধারাবাহিক লেখা, মূলত অ্যাফোরিজম, যা তিনি লিখেছিলেন খ্রিস্টধর্মের সমর্থনে, যা পরে প্রকাশিত হয়েছিল Pensées নামে, যে বইটির জন্য তাকে আজ বিশেষভাবে সম্মান আর স্মরণ করা হয়। পাসকাল গণিত আর বিজ্ঞান বাদ দিয়ে তরুণ বয়সেই ধর্ম নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর এই পরিবর্তনের কারণ জানসনিজম (Jansenism) নামের বিতর্কিত একটি ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় ধর্মীয় আন্দোলনে তিনি যোগদান করেছিলেন। জানসনবাদীরা বিশ্বাস করতেন প্রি- ডেসটিনেশনের (predestination) ধারণায়। যে ধারণা দাবি করে সবকিছুই আমাদের নিয়তিতে পূর্বনির্ধারিত এবং আমাদের কোনো ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই। এবং শুধুমাত্র অল্পকিছু মানুষই ইতিমধ্যে ঈশ্বর-কর্তৃক পূর্বনির্বাচিত হয়েছেন স্বর্গে যাবার জন্য। এছাড়া জীবনাচরণে তারা কঠোর কিছু অনুশাসনও মেনে চলতেন। আমরা জানি একবার পাসকাল তার বোনকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিলেন তার নিজের শিশুকে আদর করার জন্যে, কারণ তার মতে এধরনের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। জীবনের শেষ বছরগুলোয় তিনি সন্ন্যাসীর মতোই কাটিয়েছিলেন। যদিও অসুখের কারণে তিনি যন্ত্রণাও ভোগ করছিলেন, কিন্তুতার মৃত্যু অবধি লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। 

রেনে দেকার্তও পাসকালের মতোই নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান ছিলেন, তাঁর মতো তিনিও বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ ছিলেন, বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব। পাসকাল এর বিপরীতটা ভাবতেন, বিশ্বাস করতেন যে আপনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবেন যুক্তি নয় বরং হৃদয় আর বিশ্বাস দিয়ে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রস্তাবিত দার্শনিকদের নানাধরনের যুক্তি তাকে কোনোভাবেই প্ররোচিত করাতে পারেনি এর ভিন্ন কিছু ভাবতে। যেমন বিস্ময়করভাবে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি যে, আপনি ঈশ্বরের সৃষ্টির ছাপ দেখতে পাবেন প্রকৃতিতে। তার জন্য মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় হলো সেই অঙ্গ যা আমাদের ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যাবে। তাসত্ত্বেও তিনি তার Pensées বইটিতে বুদ্ধিমান একটি যুক্তির অবতারণা করেন: যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে অনিশ্চিত, দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করবেন কিনা, তাদের প্ররোচিত করার জন্য। আর এ বিষয়ে পাসকালের একটি যুক্তি বর্তমানে পরিচিত Pascal’s Wager বা পাসকালের বাজি নামে। এর ভিত্তি প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনার ধারণাটির প্রতি তার আগ্রহ। আপনি যদি যৌক্তিক কোনো জুয়াড়ি হন, শুধুমাত্র জুয়ায় আসক্ত এমন কেউ না হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি চেষ্টা করবেন জেতার জন্য সেরা সুযোগটা নিতে, কিন্তু আপনি ক্ষতিটাও যতটা সম্ভব যেন কম হয় সেটাও চাইবেন। জুয়াড়িরা জেতার সম্ভাবনাটা আগে থেকে যাচাই করে দেখেন এবং সেভাবেই তারা বাজি রাখার চেষ্টা করেন। তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব-সংক্রান্ত সেই প্রশ্নে বাজি রাখার ব্যাপারটা আসলে কী? 

পাসকাল প্রস্তাব করেছিলেন, ধরুন আপনি নিশ্চিত না ঈশ্বরের আদৌ অস্তিত্ব আছে কিনা, সেক্ষেত্রে আপনার জন্যে কিছু বিকল্প উপায় আছে। আপনি আপনার জীবন এমনভাবে কাটাতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যেন ঈশ্বরের নিশ্চিত কোনো অস্তিত্ব নেই। যদি আপনি সঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে কোনো বিভ্রম ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারবেন, আপনার পাপের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি যে স্বর্গে যাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, এমন ভাবনা আর মনোকষ্ট আর বিনিদ্র চিন্তিত বহু রাতও এড়াতে পারবেন। এছাড়া কোনো উপাসনালয়ে গিয়ে অস্তিত্ব নেই এমন কোনো সত্তাকে উপাসনা করে আপনার সময় নষ্ট করতে হবে না। পাসকাল মনে করেন এই পথটির অবশ্যই সুস্পষ্ট কিছু সুবিধা আছে, কিন্তু এর সাথে যুক্ত আছে বড়মাপের একটা ঝুঁকি। যদি আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেন, এবং পরবর্তীতে ঈশ্বরের যদি আসলেই অস্তিত্ব থেকে থাকে, আপনি শুধু স্বর্গে অনন্ত সুখ পাবার সম্ভাবনাই হারাবেন না, আপনার জায়গা হতে পারে নরকে, যেখানে অনন্তকাল আপনাকে নির্যাতিত হতে হবে। পাসকালের মতানুযায়ী যে-কারো জন্যেই এটি অবশ্যই কল্পনা করা সম্ভব এমন সবচেয়ে খারাপ পরিণতি। 

বিকল্পভাবে, পাসকাল প্রস্তাব করেন, ঈশ্বর আছেন এমন ভেবেই আপনি আপনার জীবন কাটাতে পারেন। আপনি আপনার ধর্মের সব নিয়ম পালন আর প্রার্থনা বা উপাসনা করতে পারেন। অবশেষে যদি দেখা যায় সত্যিই ঈশ্বরের অস্তি ত্ব আছে, আপনি তাহলে সম্ভাব্য সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি পাবেন: অনন্তকালের জন্য সুখি হবার সত্যিকারের সম্ভাবনা। পাসকাল মনে করিয়ে দেন যে যদি আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করার পথটি নির্বাচন করেন, এবং পরে যদি আপনি ভুলও প্রমাণিত হন, আপনাকে খুব বেশি কিছু বিসর্জন দিতে হবে না (এবং ধরে নেয়া যায়, আপনার মৃত্যুর পর তো আপনি আর থাকছেন না, যে আপনি জানতে পারবেন যে আপনি ভুল করেছেন, কষ্ট আর সময় নষ্ট করার জন্য মন খারাপ করবেন); যেমন পাসকাল বলেছিলেন, ‘আপনি যদি জেতেন তাহলে সবই জিতবেন, আপনি যদি হারেন তাহলে কোনোকিছুই হারাবেন না।’ তিনি শনাক্ত করেছিলেন যে, আপনি হয়তো সেই ‘বিষাক্ত আনন্দগুলো’ উপভোগ করতে পারবেন না—তার মতে সেগুলো হচ্ছে বিলাসিতা আর আত্মাভিমান। কিন্তু এর পরিবর্তে আপনি হবেন বিশ্বাসী, সৎ, দয়াশীল, নম্র, কৃতজ্ঞ, একজন ভালো বন্ধু, যে সবসময় সত্যিকথা বলবে। অবশ্যই সবাই ঠিক এভাবে বিষয়টি দেখবেন না। পাসকাল সম্ভবত তার ধর্মীয় জীবন নিয়ে এতই মোহাচ্ছন্ন হয়েছিলেন যে, তিনি আদৌ অনুধাবন করেননিধর্মীয় অনুশাসন না-মানা বহু মানুষের জন্য তাদের পুরো জীবন ধর্মের অনুশাসন আর বিভ্রমের পেছনে বিনিয়োগ করা অর্থহীন আত্মত্যাগ হতে পারে। তবে যাই হোক, যেমন পাসকাল বলেছিলেন, একদিকে আপনার সম্ভাবনা আছে অনন্ত সুখের এবং তবে খানিকটা আপেক্ষিক সমস্যা হতে পারে এ জীবনে, এমনকি যদি আপনি ভুলও করেন। অন্যদিকে আপনি যদি অনন্তকাল নরকে যাবার সম্ভাবনা মেনে নেন, সেক্ষেত্রে পৃথিবীতে আপনার সময়ে সম্ভাব্য কোনো লাভই স্বর্গের অনন্তকালের আনন্দের লাভের সাথে তুলনা করা সম্ভব না। 

পাসকালের দৃষ্টিভঙ্গিতে আরো একটি প্রস্তাবনা ছিল, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই এই প্রস্তাবে আপনার যে-কোনো একটি দিকে সমর্থন থাকতে হবে, সিদ্ধান্তহীন হলে চলবে না। যদি আপনার কোনো মতামত না থাকে তাহলেও আপনার সম্ভাবনা যারা বিশ্বাস করেন না তাদের মতোই হবে, আপনার তাহলে নরকে যাবার সম্ভাবনা আছে অথবা অন্তত স্বর্গে আপনার জায়গা হবে না। আপনাকে কোনো-না-কোনো দিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যখন কিনা আপনি আসলেই জানেন না ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কিনা। আপনার কী করা উচিত সেই বিয়য়টি পাসকালের কাছে খুব সুস্পষ্ট ছিল। আপনি যদি যৌক্তিক কোনো জুয়াড়ি হন এবং জেতার সম্ভাবনাটা ভালোভাবে যাচাই করেন, তাহলে হয়তো আপনি লক্ষ করবেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষেই বাজি ধরা উচিত হবে। পয়সা দিয়ে টস করার মতোই, এমনকি শুধুমাত্র সামান্য সম্ভাবনা আছে বিষয়টি সত্য হবার। তবে এর সম্ভাব্য পুরস্কার অসীম এবং সম্ভাব্য হেরে যাবার ক্ষতিও বেশি না। তিনি ভাবতেন, কোনো যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে বাজি রাখা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব না, অবশ্যই ঝুঁকি আছে যে, আপনি ঈশ্বরের উপর বাজি রাখলেন এবং হেরে গেলেন: দেখা গেল ঈশ্বরের আসলেই অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সেটাই হলো ঝুঁকি, যা আপনার নেয়া উচিত। 

কিন্তু কী হবে, যদি আপনি এই প্রস্তাবনার যুক্তিটা বুঝতে পারলেন, কিন্তু আপনি অন্তর থেকে অনুভব করলেন না যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে? আসলেই খুব কঠিন (এবং হয়তো অসম্ভব) নিজেকে ভুল বুঝিয়ে কোনোকিছুতে বিশ্বাস করানো যখন আপনি নিজেই সেটি সত্যি নয় বলে সন্দেহ করছেন। আপনার কাপড়ের আলমারিতে লুকিয়ে থাকা পরিদের কথা ভাবুন। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন, কিন্তু পরিদের সত্যিকার অস্তিত্ব আছে এমন সত্যিকারের ভাবনা থেকে খুবই ভিন্ন সেটি। আমরা সেইসব জিনিস বিশ্বাস করি, যে জিনিসগুলো সত্য বলে আমরা চিন্তা করতে পারি। বিশ্বাসের এটাই মূল প্রকৃতি। সুতরাং কীভাবে একজন ঈশ্বর-অবিশ্বাসী ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারেবেন? পাসকালের কাছে এই সমস্যারও একটি উত্তর ছিল। একবার যখন আপনি সমাধান করতে পারবেন যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করাই আপনার স্বার্থের জন্য ভালো, তাহলে আপনার নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য একটা উপায় খুঁজে বের করা প্রয়োজন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এবং আপনি সেটি বিশ্বাস করেন। আপনাকে যা করতে হবে তাহলো ঈশ্বরে যারা বিশ্বাস করেন তাদের অনুকরণ করতে হবে, তাদের মতো উপসনালয়ে সময় কাটাতে হবে, যেখানে সবাই যা করছে তা করতে হবে। খুব শীঘ্রই আপনি শুধু একজন অনুকরণকারী থাকবেন না বরং আপনার মনে বিশ্বাস আর অনুভূতিরও জন্মও হবে তাদের মতো। পাসকাল তেমনটাই ভাবতেন। তার মতে এটাই আসলে অনন্ত জীবন জয় করা এবং অনন্তকালের নরকের নির্যাতন এড়াতে আপনার জন্যে সবচেয়ে সেরা সুযোগ। 

পাসকালের যুক্তিগুলো অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, ঈশ্বর, যদি তার অস্তিত্ব থাকে, তিনি হয়তো বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না সেইসব সুবিধাবাদীদের যারা তাকে শুধু বিশ্বাস করেছে, কারণ বাজির দানে সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ। মনে হতেই পারে যে এটি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করার জন্য একটি ভ্রান্ত ধরনের কারণ। খুবই স্বার্থপরতা, কারণ যে-কোনো মুল্যে নিজের আত্মাকে নরক থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে এটা আপনার স্বার্থপর কামনা। একটি ঝুঁকি অবশ্যই হতে পারে যে ঈশ্বর নিশ্চিত করবেন বাজির এই যুক্তি মেনে তারা তাকে বিশ্বাস করেছে তাদের কাউকেই কোনোদিন স্বর্গে ঢুকতে দেবেন না। পাসকালের বাজির যুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে, এটি লক্ষ্য করেনি সেই সম্ভাবনাটিকে, হয়তো এই বাজি অনুসারে বাজি রেখে আপনি কোনো ভুল ধর্ম, ভুল ঈশ্বর বা দেবতাকে উপাসনার জন্যে নির্বাচন করলেন। পাসকাল তার যুক্তিটি উপস্থাপন করেছেন একজন খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু আরো তো অনেক ধর্ম আছে, যে ধর্মের ঈশ্বররাও অনন্ত কালের সুখের প্রলোভন দেখান তার অনুসারীদের। সেইসব ধর্মগুলোর মধ্যে কোনোটা যদি সত্যি হয়, তাহলে পাসকালের বাজি মেনে যারা খ্রিস্টীয় ধর্মের ঈশ্বরের জন্য বাজি রেখেছেন, তারা নিজেদের স্বর্গের অনন্ত সুখ থেকেই বঞ্চিত করবেন, ঠিক যেমন করে এখনও ঈশ্বর-অবিশ্বাসীও করবেন। পাসকাল যদি এই সম্ভাবনাটি নিয়ে ভেবে দেখতেন, হয়তো তিনি যতটা ছিলেন তারচেয়ে আরো বেশি নৈরাশ্যবাদী হতেন মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে। এখনও দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাঝে মাঝে মনে করা হয় যে কারো মন ভালো করার সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে তাদের বলা যে সবকিছুই একদিন ঠিক হয়ে যাবে: জীবনকে মূলত আনন্দময় একটি প্রক্রিয়া হিসাবে ভাবা, যেখানে সুখ কোনো মরীচিকা নয় এবং মানব পূর্ণতার সত্যিকারের একটি সম্ভাবনা আছে। তবে, যদি আমরা পাসকালের বইটির কিছু পাতা পড়ি, অনুধাবন করতে পারি পুরোপুরিভাবে কীভাবে এই পথ বিভ্রান্তির, কারণ পাসকাল সেই বিশেষ যোগ্যতাটা অর্জন করতে পেরেছিলেন, একই সাথে পশ্চিমা দর্শনে তিনি ছিলেন সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী এবং সবচেয়ে উৎসাহদায়ক ব্যক্তি। এই সংমিশ্রণ মনে হতে পারে স্বাভাবিক, কারণ সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী চিন্তাবিদরা বিস্ময়করভাবে, প্রায় সবসময়ই সেইসব চিন্তাবিদরাই হন যারা আমাদের মন ভালো করে দিতে পারেন। 

পাসকালের উদ্দেশ্য ছিল পাঠকদের ঈশ্বরবিশ্বাসী করে তোলা, এবং পাসকালের মনে হয়েছিল এই কাজটি করার জন্য সেরা উপায় হচ্ছে জীবনের সব ভয়ংকর জিনিসগুলোর বর্ণনা দেয়া। তিনি মনে করেছিলেন মানবজীবনের সব দুর্দশা পুরোপুরিভাবে বিবেচনা করে পাঠকরা তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাথলিক চার্চের শরণাপন্ন হবেন। পাসকালের জন্য দুর্ভাগ্য যে, খুব কম আধুনিক পাঠকই তার বইটিকে এভাবে অনুসরণ করেছেন। বইটির প্রথমাংশে, জীবনের সমস্যাগুলোর একটি তালিকা দেয়া হয়েছে, যা অবশ্যই অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল তার দ্বিতীয় তালিকাটির চেয়ে, যে তালিকায় তিনি ঈশ্বরধারণার ভালো দিকগুলো উল্লেখ করেছিলেন। পাসকাল শুরু করেছিলেন পার্থিব সুখ হচ্ছে একটি বিভ্রম এমন দাবি করে, কিন্তু তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন আমাদের বোঝাতে যে একাকী আমাদের নিজেদের জীবন সম্বন্ধে ভাবতে আমরা কতটা ঘৃণা বোধ করি। তার খুব পরিচিত এই অ্যাফোরিজমটি মনে করিয়ে দেয় : ‘মানুষের সব দুঃখ আসে তার নিজের ঘরে শান্তিপূর্ণভাবে থাকার অক্ষমতা থেকে।’ হয়তো তার এই অ্যাফোরিজমটি পৃথিবীর সব বিমানবন্দরের বহির্গমন লাউঞ্জের উপর বড় হরফে লিখে রাখা উচিত। 

পাসকালের লেখার আকর্ষণ ছিল তার তিক্ততায় আর তীক্ষ্ণ নৈরাশ্যবাদে। নিজেদের ভয়ংকর আত্মাভিমানের মুখোমুখি না-হবার জন্য মানুষ সব করতে পারে, ‘মানুষ এতই অহংকারী যে, খুব সামান্যতম কিছু, বিলিয়ার্ড টেবিলে কিউ দিয়ে কোনো বলকে ঠেলার মতো, যথেষ্ট তাদের দিকভ্রান্ত করার জন্য।’ এবং একই সাথে তারা নিপীড়িত তাদের আবেগের জন্য, বিশেষ করে খ্যাতির জন্য তাদের আবেগ। পাসকালের মতে ‘আমরা এত বেশি দাম্ভিক যে আমরা সারা পৃথিবীতে সুপরিচিত হতে চাই, এমনকি সেই মানুষগুলোর কাছে যারা আসে শুধুমাত্র আমরা চলে যাবার পরেই।’ তিনি ভাবতেন, হয়তো সবচেয়ে বড় কষ্টের কারণ খুব সামান্য, বোরডোম বা বিরক্তি, ‘আমরা প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করি, কিন্তু যখনই আমরা তা জয় করি, বাকি সবকিছুই অসহ্য অনুভূত হয় কারণ এটি বিরক্তি উৎপাদন করে।’ পাসকালের সমাধান, ‘মানুষ আর কী? অসীমের তুলনায় সে কিছুই না।’ 

মানবজাতির অপরিবর্তনযোগ্য বিভ্রান্তিকর অশুভ আচরণ, করুণাযোগ্য এবং মূল্যহীন প্রকৃতির প্রমাণগুলো তার পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করার জন্যে পাসকাল কোনো সুযোগই ছাড়েননি। তিনি আমাদের জানান, সুখ হচ্ছে একটি মায়া (‘যে কিনা এই পৃথিবীর দম্ভকে দেখতে পায় না, তারা নিজেরাই দাম্ভিক’), দুঃখই চিরন্তন (যদি আমরা সত্যিকারভাবে সুখি হতাম, তাহলে সেটি নিয়ে চিন্তা করার জন্যে আমাদের কালক্ষেপণ করতে হতো না।’) এবং সত্যিকারের ভালোবাসা হচ্ছে অলীক কল্পনা (‘মানুষের হৃদয় কত ফাঁপা আর নোংরা’), এবং কত বেশি পাতলা আমাদের চামড়া, যতটাই আমরা দাম্ভিক (‘সামান্য কিছুই আমাদের সান্ত্বনা দেয়, কারণ সামান্য কিছুতেই আমরা আঘাত পাই’), এবং এমনকি আমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে শক্তিশালী সেও অসহায় অসংখ্য অসুখের হাতে, যে অসুখগুলোর কাছে আমরা সবাই আক্রম্য (‘মাছিরা অনেক শক্তিশালী কারণ তারা আমাদের মনকে পরজীবীর মতো ব্যবহার করতে পারে, আমাদের শরীরকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।’), পার্থিব সব প্রতিষ্ঠাগুলো দুর্নীতিপরায়ণ (‘মানুষ দুর্বল হয়ে পড়বে, এর চেয়ে নিশ্চিত কিছু নেই’) এবং আমাদের প্রবণতা আছে নিজেদের গুরুত্বকে বেশিমাত্রায় দেখার জন্যে (‘পৃথিবীর বহু রাজ্য আছে, যারা আমাদের সম্বন্ধে কিছুই জানেনা।’), এই পরিস্থিতিতে আমাদের যা করার আছে সেটি হলো আমাদের এই দুর্দশাময় পরিস্থিতিকে সরাসরি মোকাবেলা করা: ‘মানুষের মহত্ত্ব আসে সে যে শোচনীয়ভাবে হতভাগ্য সেই জ্ঞান থেকে।’ 

আর এমন ভাবনা নিয়ে লেখা কোনো একটি বই পড়ার পরও অনেকেই হয়তো অবাক হয়ে আবিষ্কার করবেন যে পাসকাল পড়া আসলেই পুরোপুরিভাবে হতাশাজনক কোনো অভিজ্ঞতা নয়, যা হয়তো প্রথমে ভাবা হয়েছিল। তার লেখা আমাদের প্রবোধ দেয়, আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে এবং কখনো এমনকি কৌতুকময়। যারা হতাশার শেষ প্রান্তে, তারা বিস্ময়করভাবেই এর চেয়ে আর কোনো ভালো বই খুঁজে পাবেন না, যার লক্ষ্য মানুষের প্রতিটি শেষ ইচ্ছাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। তার বইটি সে-কারণে কোনো মিথ্যা মিষ্টি প্রবোধপূর্ণ বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভেতরের সৌন্দর্য, ইতিবাচক ভাবনা, গোপন সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করার বিজ্ঞাপন করেছে, সে-কারণেই আত্মহননকারী কাউকে ছাদের সীমানা থেকে নিরাপদে সরে আসার প্ররোচনা দেবারও শক্তি রাখে। পাসকালের হতাশাবাদ আসলেই আমাদের সান্ত্বনা দিতে পারে, এর কারণ আমরা নেতিবাচকতায় যেমন, তেমনি আশাবাদিতা দ্বারাও বিষণ্ন হই। আমাদের পেশাগত জীবন, ভালোবাসা, সন্তান, রাজনীতি, আমাদের পৃথিবী নিয়ে আশা, সেটাই তো প্রধান কারণ যা আমাদের রাগায় আর তিক্ত করে। আমাদের আশার সুবিশালতা আর কঠোর বাস্তবতার অসঙ্গতি উৎপাদন করে হিংস্রতম হতাশা যা আমাদের দিনগুলো ধ্বংস করে এবং বৈরিতার চিরস্থায়ী চিহ্ন এঁকে দিয়ে যায় আমাদের মুখে। আমরা অবশেষে এমন কোনো লেখককে পাই যিনি যথেষ্ট দয়ালু আমাদের সবচেয়ে খারাপ অন্তর্দৃষ্টিগুলোকে সত্যায়িত করার জন্যে, যা আদৌ অস্বাভাবিক অনন্য এবং লজ্জাপূর্ণ নয়, যা খুব সাধারণের অংশ, মানবজাতির অনিবার্য বাস্তবতা। আমাদের ভয় যে শুধুমাত্র আমরাই চিন্তিত, বিরক্তিপূর্ণ, ঈর্ষায় আক্রান্ত, নিষ্ঠুর, বিকৃত আর আত্মপ্রেমী, তা আসলেই ভিত্তিহীন, যা উন্মুক্ত করে আমাদের অন্ধকার বাস্তবতাগুলোকে ঘিরে একটি ঐক্য সৃষ্টি করার উপায় 

পাসকালকে আমাদের সম্মান করা দরকার, খ্রিস্টীয় নৈরাশ্যবাদীদের সেই সুবিশাল ধারাটি, যে ধারায় তিনিও একজন, আমাদের করুণ দশাকে এত সুন্দর আর প্রকাশ্যে নিয়ে এসে আমাদের অবর্ণনীয় উপকার করার জন্যে। পাসকাল আমাদের মনে করিয়ে দেন যে আজ সেক্যুলাররাই ধার্মিকদের চেয়ে অনেক বেশি আশাবাদী, বিষয়টি নিয়তির পরিহাস, বিশেষ করে যখন কিনা সেক্যুলাররাই ধার্মিকদের অবুঝ বিশ্বাসপ্রবণতাকে প্রায়শই পরিহাস করেছে। সেক্যুলাররাই এখন আশাবাদী অর্থনৈতিক উন্নতি আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার দ্বারা পৃথিবীতে স্বৰ্গ সৃষ্টি করার প্রত্যাশায়। যারা অনায়াসে অলৌকিকতার বিশ্বাসকে উড়িয়ে দিতে পারে, তারাই আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, মেডিকেল গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সিলিকন ভ্যালি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সম্মিলিত ক্ষমতার উপর যে, তারা মানবজাতির সব সমস্যার সমাধান করবে। ধর্মীয় নৈরাশ্যবাদিতা মনে করিয়ে দেয় আমরা অন্তর্গতভাবে ত্রুটিপূর্ণ প্রাণী: যারা দীর্ঘস্থায়ী সুখের অযোগ্য, সমস্যাজনক যৌনতাড়নায় আক্রান্ত, সামাজিক মর্যাদা নিয়ে সদাচিন্তিত, ভয়ংকর সব দুর্ঘটনা যাদের যে-কোনো সময় আক্রমণ করে এবং সবসময়ই ধীরে ধীরে আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই সবকিছু কেন আমাদের মন ভালো করতে পারে? হয়তো নৈরাশ্যবাদী অতিরঞ্জন স্বস্তিদায়ক। আমাদের ব্যক্তিগত হতাশা যাই হোক না কেন, যখনই পাসকালের মনমেজাজের সাথে আমরা আমাদের মনমেজাজ তুলনা করব, আমরা নিজেদের বেশ ভাগ্যবান বলে অনুভব করতে শুরু করব। পাসকাল আমাদের ঈশ্বরের দিকে ফেরাতে চেয়েছিলেন জীবন কত ভয়াবহ সেটি বর্ণনা করে। কিন্তু তার সেই সমস্যাগুলো আমাদের সাথে ভাগ করে নেবার মাধ্যমে, তিনি আসলে আমাদের শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিলেন যেন আমরা আমাদের জীবনের সমস্যাগুলো আরো সাহস আর ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে পারি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *