1 of 2

অধ্যায় ২৯ : অবুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ডিজাইন – চার্লস ডারউইন

অধ্যায় ২৯ : অবুদ্ধিমত্তাপূর্ণ ডিজাইন – চার্লস ডারউইন

‘আপনি কি আপনার দাদা, নাকি দাদির দিক থেকে বানরদের আত্মীয়?’ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ডের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে অনুষ্ঠিত টমাস হেনরি হাক্সলির সাথে বিখ্যাত বিতর্কে এটাই ছিল বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্সের দৃষ্টতাপূর্ণ প্রশ্ন। হাক্সলিসেই বিতর্কে চার্লস ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থনে তার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছিলেন। উইলবারফোর্সের প্রশ্নটির উদ্দেশ্য একই সাথে অপমান ও ঠাট্টার। কিন্তু এর ফলাফল উল্টো হয়েছিল। হাক্সলি মনে মনে বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ ঈশ্বর, এভাবে আমার হাতে পরিস্থিতি তুলে দেবার জন্য’ এবং তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি বরং নরবানরদেরই আত্মীয় হওয়া শ্রেয়তর . মনে করেন সেইসব মানুষদের আত্মীয় হবার চেয়ে, যারা কিনা বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো নিয়ে ঠাট্টা করে বিতর্ক এড়ানোর চেষ্টা করে। তিনি হয়তো এমনভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারতেন যে, তিনি দুইদিক থেকেই বানর-জাতীয় পূর্বসূরি থেকে বিবর্তিত হয়েছেন, তবে খুব সাম্প্রতিক কোনো সময়ে না, বরং বেশ দূর অতীতের কোনো একসময়। আর সেটাই ডারউইন দাবি করেছিলেন তার অসাধারণ ধারণাটিতে। আমাদের প্রত্যেকের পারিবারিক বৃক্ষে তারা আছে।

এই দৃষ্টিভঙ্গিটি বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে, যখন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর আসলেই কখনোই ভাবা সম্ভব ছিল না যে বাকি জীবজগৎ থেকে মানুষ পুরোপুরি আলাদা। মানুষ আর তার বিশেষ অবস্থান দাবি করতে পারেনি: তারাও প্রকৃতির অংশ আর যে-কোনো জীবের মতোই। আপনার কাছে হয়তো বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু ডারউইনের সেই সময়, ভিক্টোরীয় যুগে বেশিরভাগ মানুষের কাছে বিষয়টি ছিল আসলেই বিস্ময়কর।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এইপ বা নরবানরদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা বোঝার জন্য কোনো একটি শিম্পাঞ্জি বা গরিলার সাথে খানিকটা সময় কাটানো অথবা হয়তো আয়নায় মনোযোগ দিয়ে তাকানোই যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু ডারউইনের সেই দিনগুলোয় সবাই কমবেশি মনে করতেন যে অন্য যে- কোনো প্রাণী থেকে মানুষ খুবই ভিন্ন এবং আমরা যে অন্য কোনো প্রাণীর সাথে সাধারণ পূর্বসূরি ভাগ করতে পারি সেটি অকল্পনীয় ও রীতিমতো হাস্যকর একটি প্রস্তাবনা ছিল। বহু মানুষই ভেবেছিলেন যে ডারউইনের এই ধারণাটি পুরোপুরি পাগলামি, নিশ্চয়ই কোনো শয়তানের কাজ। বাইবেলের ‘বুক অব জেনেসিসে বর্ণিত ব্যস্ত ছয়দিনে ঈশ্বরের সব জীব সৃষ্টি করার কাহিনিটি একমাত্র সত্যি কাহিনি দাবি করে কিছু খ্রিস্টধর্মাবলম্বী এখনও তাদের বিশ্বাস অপরিবর্তিত রেখেছেন। ঈশ্বরই এই পৃথিবী ও এই পৃথিবীর মধ্যে সবকিছুকে পরিকল্পনা করেছেন, সৃষ্টি করেছেন তাদের যথাযথ জায়গায় চিরকালের জন্য। এই ধর্মবিশ্বাসীরা বিশ্বাস করতেন প্রতিটি প্রাণী আর উদ্ভিদ সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই অপরিবর্তিত আছে। এখনও কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন যে আমরা আমাদের এই বর্তমান অবস্থানে এসেছি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

ডারউইন ছিলেন জীববিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ববিদ, দার্শনিক ছিলেন না তিনি। সুতরাং আপনি হয়তো ভাবছেন কেন এই বইয়ে তাকে নিয়ে একটি অধ্যায় লেখা হলো। এর কারণ হচ্ছে তার প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের ধারণাটি ও এর সব আধুনিক সংস্করণগুলো গভীরভাবে দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছে, যেমন করেছে বিজ্ঞানীদের, বিশেষ করে যখন তারা মানবতার কথা ভেবেছেন। সর্বকালে সবচেয়ে প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক ধারণা এটি। আধুনিক দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট বলেছেন, ‘এককভাবে এটি শ্রেষ্ঠতম একটি ধারণা যা কেউ ভাবতে পারেন।’ এই ধারণাই ব্যাখ্যা করে কীভাবে মানুষ ও তাদের আশেপাশের সব জীবের উদ্ভব হয়েছে এবং কীভাবে তারা এখনও পরিবর্তনশীল। এই বৈজ্ঞানিক ধারণাটির একটি ফলাফল হচ্ছে, আগের চেয়ে অনেক বিশ্বাস করা সহজতর হয়েছে যে, কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। প্রাণিবিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স লিখেছিলেন, ‘১৮৫৯-র আগে কোনো সময় আমি নিরীশ্বরবাদী হবার কথা কল্পনা করতে পারিনা, যখন ডারউনের ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিস’ প্রকাশ হয়েছিল।’ ১৮৫৯-এর আগে অবশ্যই নিরীশ্বরবাদীরা ছিলেন, ডেভিড হিউম, সম্ভবত একজন। কিন্তু এর পরে আমরা অনেককেই দেখি। বিবর্তন সত্যি, এটা বিশ্বাস করার জন্য আপনাকে অবশ্যই নিরীশ্বরবাদী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বহু ধর্মবিশ্বাসী আছেন যারা ডারউইনবাদীও, কিন্তু তারা ডারউইনবাদী হতে পারবেন না এমন কিছু বিশ্বাস করে যে, ঈশ্বর ঠিক বর্তমানরূপে সব প্রজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।

তাঁর তারুণ্যে ডারউইন এইচ.এম.এস. বিগল জাহাজে চড়ে পাঁচ বছরের সমুদ্রযাত্রায় দক্ষিণ-আমেরিকা, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। তার জীবনের এটাই ছিল একমাত্র এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম অভিযান। এমন কোনো অভিযান যে-কারো জীবনেরই শ্রেষ্ঠতম অভিযান হবার কথা। তার আগের জীবন দেখলে আমরা দেখব, তিনি খুব বেশি প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র ছিলেন না, কারো পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না বা কেউ প্রত্যাশা করতে পারেনি যে এই মানুষটি মানবচিন্তায় এমন একটি অসাধারণ অবদান রেখে যাবেন। স্কুলেও তার প্রতিভার কোনো চিহ্ন লক্ষ্য করেনি কেউ। তার বাবাও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এই ছেলেটি কিছুই করতে পারেনা, ইঁদুর শিকার করার পিছনে যে এত সময় ব্যয় করে, সে পরিবারের কলঙ্ক। প্রথমে তিনি এডিনবরায় তার ভাইয়ের মতোই ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছিলেন, কিন্তু সেটি তার পোষায়নি, এরপর আমরা কেমব্রিজে তাকে ডিভিনিটি পড়তে দেখি, ভাইকার বা ধর্মযাজক হবার লক্ষ্যে। তাঁর অবসর সময়ে তিনি ছিলেন অতিউৎসাহী প্রকৃতিবিদ, নানাধরনের কীটপতঙ্গ আর উদ্ভিদ সংগ্রহ করতেন, কিন্তু তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত ছিল না এই মানুষটি ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন জীববিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিতি পাবেন। অনেকভাবেই তাকে মনে হতো তিনি আসলেই জানেন না কী করতে চাইছেন জীবনে। কিন্তু বিগল জাহাজে এই পৃথিবী ভ্রমণ তাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। এই অভিযানটি ছিল বৈজ্ঞানিক অভিযান, মূলত জাহাজটি যেসব দেশে যাবে সেখানকার উপকূল সীমারেখার মানচিত্র তৈরি করাই উদ্দেশ্য ছিল এর। উপযুক্ত যোগ্যতা না-থাকা সত্ত্বেও ডারউইন সেই অভিযানে যোগ দেন উদ্ভিদবিদ হিসাবে, কিন্তু তার নোটবুকে পাথর, জীবাশ্ম এবং নানা জীবের বিস্তারিত বিবরণ লিখেছিলেন, যেখানেই অভিযান তাকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানেই। ছোট বিগল জাহাজটি খুব দ্রুত তাঁর সংগ্রহ-করা নমুনা দিয়ে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি তার সব নমুনাগুলো ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠাতে পেরেছিলেন, যেগুলো পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য সেখানে সংরক্ষিত হয়েছিল।

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে তার যাত্রাবিরতি ডারউইনের সেই সমুদ্র-অভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে প্রমাণিত হয়ে হয়েছিল পরবর্তীতে। এই আগ্নেয় দ্বীপগুলোর অবস্থান দক্ষিণ-আমেরিকা উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ কিমি দূরে। বিগল গালাপাগোসে পৌছেছিল ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে। সেখানে বহু বিস্ময়কর প্রাণী ছিল পরীক্ষা করার জন্য, যেমন জায়ান্ট টরটয়েস, সামুদ্রিক ইগুয়ানা। যদিও তার কাছে বিষয়টি তখনও স্পষ্ট হয়নি, ডারউইনের বিবর্তনের ধারণার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাদামাটা দেখতে ফিঞ্চ পাখিগুলো। বেশকিছু পাখি তিনি সংগ্ৰহ করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন গবেষণা করার জন্য। নিবিড় পরীক্ষায় পরে প্রমাণিত হয় সেখানে আসলে ১৩টি স্বতন্ত্র প্রজাতি আছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য মূলত তাদের ঠোঁটে। ইংল্যান্ডে ফেরার পর, ডারউইন তার যাজক হবার ইচ্ছা চিরতরে পরিত্যাগ করেন, যখন তিনি সমুদ্রে ছিলেন, তার পাঠানো নানা নমুনা ইতিমধ্যে তাকে বিজ্ঞানীদের মহলে সুপরিচিত করে তুলেছিল, অপরিচিত সেই ছাত্রটি তখন বিজ্ঞানী-মহলে সুপরিচিত। তিনি সার্বক্ষণিক প্রকৃতিবিদে রূপান্তরিত হয়েছিলেন এবং বহুদিন ধরেই কাজ করেছিলেন তার বিবর্তনতত্ত্বটিকে নিয়ে। এছাড়াও তিনি বিশ্বসেরা গবেষক ছিলেন বার্নাকল বিষয়ে, বার্নাকলরা হচ্ছে ছোট লিম্পেট-এর মতো দেখতে ছোট প্রাণী, যারা পাথর কিংবা জাহাজের গায়ে আটকে থাকে। ইংল্যান্ডে ফেরার পর ডারউইন যতই ভাবছিলেন ততই তিনি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলেন যে, প্রজাতিরা বিবর্তিত হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়, এবং চিরকালের জন্যে অপরিবর্তনীয় নয় বরং সারাক্ষণই তারা পরিবর্তিত হচ্ছে। এবং অবশেষে তিনি প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য একটি প্রস্তাবনায় পৌছান, প্রাণী ও উদ্ভিদরা যারা তাদের পরিবেশের সাথে সুঅভিযোজিত, তাদের যথেষ্ট দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো পরের প্রজন্মে হস্তান্তর করার জন্যে। দীর্ঘ সময় পরে এই বিষয়টি এমন উদ্ভিদ ও প্রাণীদের তৈরি করবে যাদের দেখলে মনে হবে, যে পরিবেশে তাদের পাওয়া গেছে, তাদের ঠিক সেই পরিবেশে বসবাস করার মতো করেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিবর্তন কাজ করছে, তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ দিয়েছিল গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ। যেমন, ইতিহাসের কোনো একটি পর্যায়ে, তিনি ভেবেছিলেন, ফিঞ্চরা মূল মহাদেশ থেকে এই দ্বীপে এসেছিল, হয়তো শক্তিশালী কোনো বাতাসে ভেসে, এবং বহু হাজার প্রজন্মের ব্যবধানে, প্রতিটি দ্বীপে পাখিরা ধীরে ধীরে অভিযোজিত হয়েছে যেখানে তাদের বসবাস সেই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে।

একই প্রজাতির সব পাখি একই রকম নয়। সাধারণত অনেক বৈচিত্র্য বা প্রকরণ আছে, যেমন, কোনো একটি সদস্যের ঠোঁট হয়তো অন্যদের চেয়ে খানিকটা বেশি সুচাল। যদি এই ধরনের ঠোঁট থাকাটা পাখিটিকে দীর্ঘদিন বাঁচতে সাহায্য করে, তাহলে বেশ ভালো সম্ভাবনা থাকবে সে প্রজননও করবে। যেমন, কোনো একটি পাখি সদস্য যার কিনা শক্তিশালী ঠোঁট আছে বীজ খাবার জন্য, সে এমন কোনো দ্বীপে খুব ভালো করবে যেখানে অনেক বীজ আছে খাবার জন্য। কিন্তু সে সম্ভবত বেশি ভালো করত না যদি এমন কোনো দ্বীপে সে থাকত যেখানে খাদ্য মূলত বাদাম, যার শক্ত খোলস ভাঙতে হবে। সে পাখিটির সংগ্রাম করতে হবে খাদ্য-অনুসন্ধানের জন্য কারণ এর ঠোঁটের আকার খানিকটা ভিন্ন, তার জন্যে কঠিন হবে সেখানে প্রজনন ও সন্তান তৈরির জন্যে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা। এটাই এই ধরনের ঠোঁট পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার বিষয়টি কম সম্ভাব্য করে তুলবে। সুতরাং বীজসমৃদ্ধ দ্বীপে, বীজ খাওয়ার উপযুক্ত ঠোঁট ক্রমেই প্রাধান্য বিস্তার করবে। বহু সময় অতিক্রান্ত হবার এটি নতুন প্রজাতির বিবর্তিত হবার কারণ হবে, যা সেই দ্বীপে প্রথম আসা মূল প্রজাতি থেকে হবে ভিন্ন। ভুল ধরনের ঠোঁটসহ পাখি প্রজাতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। কোনো একটি দ্বীপের ভিন্ন পরিস্থিতিতে খানিকটা ভিন্ন ধরনের ফিঞ্চ পাখি বিবর্তিত হবে। অনেক দীর্ঘ সময় পর, পাখিদের ঠোঁট ক্রমশ সেই পরিবেশে খাপ খাওয়ার জন্য আরো বেশি উপযুক্ত হয়ে উঠতে থাকবে। ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপগুলোয় ভিন্ন পরিবেশ মানে, যে-পাখিরা সেখানে বাস করছে সেখানে তারা বসবাস করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।

ডারউইনের আগে, তাঁর পিতামহ ইরাসমাস ডারউইনসহ অনেকেই প্রস্তাব করেছিলেন প্রাণী আর উদ্ভিদরা বিবর্তিত হয়েছে। চার্লস ডারউইন এর সাথে যুক্ত করেছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অভিযোজনের তত্ত্বটি, যে-প্রক্রিয়াটি সুঅভিযোজিতদের সুযোগ করে দেয় তাদের বৈশিষ্ট্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে হাতবদল করার জন্যে প্রয়োজনীয় সময় অবধি বেঁচে থাকার জন্যে। এই টিকে থাকার সংগ্রাম সবকিছুই ব্যাখ্যা করে। এই সংগ্রাম শুধু ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সদস্যদের মধ্যেই নয়, একই প্রজাতির সদস্যরাও নিজেদের মধ্যে সংগ্রাম করে। পরবর্তী প্রজন্মে তাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্য হস্তান্তরে প্রচেষ্টায় তারা প্রত্যেকেই দ্বন্দ্ব্বরত। এ কারণেই জীবদের নানা বৈশিষ্ট্য আছে যা দেখলে যেন মনে হয় তাদের কোনো বুদ্ধিমান সত্তা পরিকল্পনা করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা কোনো সচেতন বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত হয়না। কোনো সচেতন সত্তা বা ঈশ্বর এটি পরিচালিত করে না। এটি নৈর্ব্যক্তিক। এটি যন্ত্রের মতো যা-কিনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। এটি অন্ধ সেই অর্থে এটি জানেনা কোথায় এটি যাচ্ছে, চিন্তা করেনা এটি কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদদের সৃষ্টি করছে। এটি তাদের জন্য কোনোকিছু বোধও করেনা। আমরা যখন এর তৈরি করা জীবদের দেখি, খুব কঠিন সেই ভাবনা থেকে বিরত থাকা, যে তাদের কেউ খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু সেটি ভুল হবে ভাবা। ডারউইনের তত্ত্ব অনেক সহজতর আর যৌক্তিক প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিয়েছে আমাদের। এটি ব্যাখ্যা করে কেন জীবরা এত বৈচিত্র্যময়, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি তারা যে-পরিবেশে বাস করে তারা এর কোনো অংশের সাথে সুঅভিযোজিত।

১৮৫৮ সালে ডারউইন তখনও তাঁর আবিষ্কার প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি মূলত তার বইটি নিয়ে কাজ করছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন যতটা সম্ভব ত্রুটিমুক্ত করে সঠিকভাবে তিনি তাঁর ধারণাটিকে প্রকাশ করবেন। কিন্তু আরেকজন প্রকৃতিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে তাকে চিঠি লিখেছিলেন বিবর্তনের একই ধরনের তত্ত্বের একটি রূপরেখাসহ। ঘটনাচক্রে এই চিঠিটি তার ধারণাগুলো নিয়ে ডারউইনকে প্রকাশ্যে আসার জন্যে প্ররোচিত করেছিল। প্রথমে লন্ডনের লিনিয়াল সোসাইটিতে একটি যৌথ উপস্থাপনা এবং পরের বছর ১৮৫৯ সালে তাঁর বই ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিস’ প্রকাশের মাধ্যমে। ডারউইন চাননি তার দীর্ঘদিনের গবেষণা প্রকাশের আগেই ওয়ালেস কিছু প্রকাশ করুক। বইটি তাকে সাথে সাথে বিখ্যাত করে তুলেছিল।

প্রকাশকের সম্পাদকরা মূল পাণ্ডুলিপি পরিবর্তন করতে বলেছিলেন ডারউইনকে। তিনি রাজি হননি। প্রকাশক জন মারেও ডারউইনের মূল পাণ্ডুলিপি অপরিবর্তিতরূপেই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races In the Struggle for Life শিরোনামে বইটি ১৮৫৯ সালে ২৪ নভেম্বর লন্ডন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে অবশ্য বইটি পরিচিতি পায় এর শিরোনামের সংক্ষিপ্ত রূপ On the Origin of Species নামে। সে বছর লন্ডনের খানিকটা অস্বাভাবিক শীত বিজ্ঞানীদের জন্য উষ্ণ করে তুলেছিল এই বইটি। ১৫ শিলিং দামের এই বইটি প্রকাশের প্রথম দুই দিনেই ১২৫০ কপির প্রত্যেকটি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। পরের মাসে দ্বিতীয় সংস্করণটির পুরো ৩০০০ কপিও বিক্রি হয়েছিল। পরবর্তীতে বইটির আরো অনেক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। বলাবাহুল্য বইটি মূল প্রস্তাবনা তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। অবশ্য ডারউইন নিজেকে এই বিতর্ক থেকে দূরে রেখেছিলেন এবং তাঁর গবেষণা আর লেখা চালিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী ছয়টি সংস্করণে ডারউইন তার বইটি পুনঃসম্পাদনা করেছিলেন। এরপর আরো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন ডারউউন, এর মধ্যে ১৮৭১ সালে The Descent of Man তার বিবর্তনের ধারণাকে আরো বিস্তৃত করে। কিছু মানুষ যারা এটি পড়েছিলেন তারা বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারেননি। বিগলের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিৎসরয়, যেমন, নিজেও বিজ্ঞানী, আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেবার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যিনি, তিনি বাইবেল-এর সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনীর একনিষ্ঠ বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হতাশ হয়েছিলেন যে ধর্মীয় বিশ্বাসের অবমূল্যায়নে তিনিও কিছু ভূমিকা রেখেছিলেন বলে, এবং প্রকাশ্যেই বলেছেন, এমনটি হবে জানলে তিনি কখনো ডারউইনকে তার জাহাজে জায়গা দিতেন না। অবশ্য ফিৎসরয় মারা গেলে ডারউইন তার পরিবারের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সাহায্য অব্যাহত রেখেছিলেন।

এমনকি আজো সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা যারা জেনেসিসের গল্প বিশ্বাস করেন এবং জীবনের উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি আক্ষরিক ব্যাখ্যা হিসাবে, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিবর্তনের মূল প্রক্রিয়াটি কীভাবে চালিত হচ্ছে ডারউইনের সেই ব্যাখ্যাটি নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেননা আর। আংশিকভাবে এর কারণ ডারউইনের সময় থেকে বহু প্রমাণই জড়ো হয়েছে তার তত্ত্বটি ও এর পরবর্তী সংস্করণগুলোর স্বপক্ষে। জিনতত্ত্ব, যেমন, বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে কীভাবে বংশগতি কাজ করে। আমরা এখন জিন ও ক্রোমোজোম সম্বন্ধে জানি, আমরা জানি তাদের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে, যারা কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরের জন্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আমাদের বিশ্বাস করানোর জন্যে জীবাশ্ম-প্রমাণ আজ আরো বেশি শক্তিশালী। ডারউইনের সেই সময় থেকে, এইসব কারণেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব শুধুমাত্র কোনো হাইপোথিসিসের চেয়েও বেশি, এটি একটি হাইপোথিসিস যার যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণ আছে স্বপক্ষে, এটি বাস্তব প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। ডারউইনবাদ কমবেশি ধ্বংস করেছে প্রচলিত ডিজাইন বা কোনো বুদ্ধিমান সত্তা দ্বারা জীবনসৃষ্টির যুক্তিটাকে, এবং যা বহু মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ডারউইন তার সময়সীমানায় নিজে অবশ্য ভেবেছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যপারে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কাজটি মানুষের বুদ্ধিমত্তার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। সহকর্মী একজন বিজ্ঞানীকে লেখা তার একটি চিঠিতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই বিষয়ে কোনো উপসংহারের কাছে আমরা এখনও পৌঁছাতে পারিনি: ‘পুরো বিষয়টি মানুষের বুদ্ধিমত্তার জন্যে অনেক বেশি জটিল’, তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘একটি কুকুর যেমন নিউটনের মন নিয়ে ভাবতে পারে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *