1 of 2

অধ্যায় ৮ : স্টয়িসিজম, কোনোকিছু গ্রাহ্য না করার শিক্ষা – এপিকটিটাস, সিসেরো, সেনেকা

অধ্যায় ৮ : স্টয়িসিজম, কোনোকিছু গ্রাহ্য না করার শিক্ষা – এপিকটিটাস, সিসেরো, সেনেকা

বাসা থেকে বের হবার পরই যদি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়, সেটি দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু আপনাকে যদি বাইরে যেতেই হয়, তাহলে রেইনকোট পরা কিংবা ছাতিটা নিয়ে আসা কিংবা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা ছাড়া আপনার খুব বেশী আর কিছু করার নেই। যতই চান না কেন আপনি বৃষ্টি থামাতে পারবেন না। আমাদের কি বিষয়টি নিয়ে মেজাজ খারাপ করা উচিত? নাকি বিষয়টি নিয়ে ফিলোসফিকাল হওয়া উচিত? ‘ফিলোসফিকাল’ হওয়া এখানে শুধুমাত্র বোঝাচ্ছে যে, আপনি যা পরিবর্তন করতে পারবেন না সেটাকেই মেনে নেওয়া। জীবনের হ্রস্বতা আর বৃদ্ধ হবার সেই অনিবার্য প্রক্রিয়া নিয়ে তাহলে কি ভাবনা হতে পারে? কীভাবে আপনি মানবজীবনের এইসব বাস্তবতাগুলোর মুখোমুখি হবেন? আবারো সেই একই প্রক্রিয়া, যাকে বলা যায়—ফিলোসফিকাল হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে। যখন কোনো মানুষ বলেন তাদের সাথে জীবনে যা ঘটছে সেগুলোর প্রতি তারা ‘ফিলোসফিকাল’ বা কোনো বিষয় নিয়ে দার্শনিকসুলভ ভাবনাকে প্রশ্রয় দেন, তারা সেই শব্দটাই ব্যবহার করছেন, যে শব্দটিকে ব্যবহার করতেন স্টয়িক বা বৈরাগ্যদর্শনের অনুসারীরা।

স্টয়িক বা Stoic শব্দটি এসেছে Stoa থেকে, এটি এথেন্সের একটি রঙিন ছাদে ঢাকা এলাকা যেখানে এই ঘরানার দার্শনিকরা একত্র হতেন আলোচনার জন্য। এই দর্শনের শুরুর দিকে অন্যতম দার্শনিক ছিলেন জেনো অব সিটিয়াম (Zeno of Citium, ৩৩৮-২৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। প্রাচীন গ্রিক বা প্রথমদিকের স্টয়িকরা বাস্তবতা, যুক্তি এবং নৈতিকতা-সংক্রান্ত নানাধরনের দার্শনিক সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মূলত পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তারা সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিলেন মানসিক নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত তাদের প্রস্তাবনাগুলোর জন্যে। তাদের মূল প্রস্তাবনাটি ছিল : আমরা যে-বিষয়গুলো পরিবর্তন করতে পারব, শুধুমাত্র সেই বিষয়গুলো নিয়েই আমাদের চিন্তা করা উচিত। এর বাইরে কোনোকিছু নিয়ে অস্থির হবার কোনো অর্থ নেই। প্রাচীন সংশয়বাদীদের মতোই, তাদের লক্ষ্য ছিল মানসিক প্রশান্তির সেই অবস্থাটি অর্জন করা। এমনকি ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখে, যেমন প্রিয়জনের মৃত্যুর মতো কোনো ট্র্যাজেডির মুখোমুখি, বৈরাগ্যদর্শনবাদী বা স্টয়িকদের অবিচল থাকা উচিত। যা ঘটেছে তার প্রতি আমাদের প্রদর্শিত প্রতিক্রিয়া এবং দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, এমনকি যদিও যা ঘটছে তার উপর প্রায়শই আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

বৈরাগ্য দর্শনের ঠিক কেন্দ্রে আছে সেই ধারণাটি, আমরা কী চিন্তা করব এবং অনুভব করব, সেই বিষয়গুলোর জন্য আমরাই দায়ী। ভালো কিংবা খারাপ ভাগ্যের প্রতি আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলো নির্বাচন করতে পারি। কিছু মানুষ তাদের আবেগগুলো মনে করেন আবহাওয়ার মতো। এর বিপরীত, স্টয়িকরা ভাবেন কোনো একটি পরিস্থিতি বা ঘটনা সম্বন্ধে আমরা যা অনুভব করব সেই বিষয়টি নির্ধারণ করি আমরা নিজেরাই। সেই পরিস্থিতিটি নিয়ে আসলে আমরা কী চাই তার উপর নির্ভর করে আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলো। কোনো আবেগই আমরা অনুভব করিনা শুধুমাত্র আবেগের খাতিরে। আমরা দুঃখ অনুভব করতে বাধ্য নই যখন আমরা যা চাই সেটি পেতে ব্যর্থ হই। আমাদের ক্রোধ অনুভব করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যখন কেউ আমাদের সাথে প্রতারণা কিংবা কৌশলের আশ্রয় নেয়। স্টয়িক দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে আবেগানুভূতি আমাদের যুক্তিগুলোকে অস্পষ্ট করে এবং আমাদের বিচারিক ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। সেকারণে আবেগানুভূতিকে শুধু নিয়ন্ত্রণই করা উচিত না, বরং যখন যেখানে সম্ভব পুরোপুরিভাবে সেগুলোকে বর্জন করতে হবে। পরবর্তী পর্যায়ের স্টয়িক দার্শনিকদের মধ্যে এপিকটিটাস (৫৫ থেকে ১৩৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সবচেয়ে সুপরিচিত। এপিকটিটাস তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন একজন ক্রীতদাস হিসাবে। শারীরিক পরিশ্রম ও সম্ভাব্য সবধরনের কষ্ট তিনি অনুভব করেছিলেন তাঁর জীবনে; ক্ষুধা,তৃষ্ণা এবং যন্ত্রণার বহু নির্যাতনও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন, তার কারণ ক্রীতদাস থাকাকালীন তাঁকে একবার তীব্রভাবে প্রহার করা হয়েছিল।

যদিও তাঁকে রোমের স্টয়িক দার্শনিক বলা হয়, এপিকটিটাসের জন্ম কিন্তু রোমে নয়। ক্রীতদাস হিসাবে তাঁর জন্ম হয়েছিল ফ্রিজিয়ায়, বর্তমানে যা তুরস্কের অংশ। যদিও ফ্রিজিয়া তখন রোমের অধীনে কিন্তু রোমসাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্তের ভাষা ছিল গ্রিক। এফাফ্রোডিটাস নামের এক রোমান-নাগরিকের দাস হিসাবে তিনি রোমে এসেছিলেন। রোমে তিনি সংস্পর্শে এসেছিলেন দার্শনিক মুসোনিয়াস রুফাসের, যিনি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর শিক্ষাদানের কৌশল ছিল সক্রেটিসের মতোই, কথোপকথন আর প্রাণবন্ত তর্কবিতর্ক, এবং সক্রেটিসের মতোই তিনি কিছু লিখে যাননি। দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর পশ্চিম গ্রিসে নিকোপলিসে এপিকটিটাস একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমরা তাঁর সম্বন্ধে যা-কিছু আজ জানি, মূলত তা এসেছে এই স্কুলে থাকাকালীন তাঁর সংলাপ আর বিতর্কের যে-অংশগুলো তাঁর শিক্ষার্থীরা লিপিবদ্ধ করেছিলেন সেখান থেকে। বিশেষ করে তাঁর ছাত্র আরিয়ান, তিনি সংকলন করেছিলেন Discourses, এপিকটিটাসের কথোপকথনের একটি বিস্তারিত সংকলনটি, এবং একটি ছোট বই, Enchiridion, বা হ্যান্ডবুক। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এই দুটি বই। যখন তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মন স্বাধীন থাকতে পারে, এমনকি যখন শরীর দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি, তিনি তখন আসলে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন। এবং এটি তাঁর কাছে কোনো বিমূর্ত তত্ত্ব ছিলনা শুধুমাত্র। তাঁর শিক্ষার সাথে অন্তর্ভুক্ত ছিল ব্যবহারিক বা প্রয়োগ করা সম্ভব এমন কিছু উপদেশ, যার মূল বিষয় ছিল কীভাবে আমরা যন্ত্রণা এবং দুঃখকষ্ট মোকাবেলা করব। যার সার বক্তব্যটা ছিল : Our thoughts are up to us অর্থাৎ আমরা কী ভাবব সেটা নির্ভর করবে আমাদের উপরেই। তাঁর এই দর্শনে অনুপ্রাণিত হিসাবে আধুনিক সময়ে নজর কেড়েছিলেন জেমস বি. স্টকডেল। আমেরিকার এই বৈমানিক ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনামে তাঁর বিমান ভূপাতিত হবার পর যুদ্ধবন্দি হিসাবে আটক ছিলেন। বন্দি থাকাকালীন সময়ে স্টকডেলকে বহু নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল, প্রায় চার বছর ধরে নানাধরনের শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন তিনি। স্টকডেল বলেছিলেন, তীব্র নির্যাতনের বন্দিজীবনটি তিনি জীবিত অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, কলেজে থাকাকালীন একটি কোর্সে পড়া এপিকটিটাসের দর্শন থেকে যা-কিছু তিনি মনে করতে পেরেছিলেন সেটি প্রয়োগ করার মাধ্যমে। যখন তার বিমান ভূপাতিত হয়, তিনি প্যারাসুটে যখন নিচে নামছিলেন, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার সাথে যে যাই করুক না কেন তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না, যত নিষ্ঠুর সেই আচরণ হোক না কেন। তিনি যদি তার পরিস্থিতি পরিবর্তন না করতে পারেন, তিনি কিছুতেই নিজেকে সেই পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবেন না। স্টয়িসিজম তাকে সেই শক্তি দিয়েছিল একাকী সেই বন্দিজীবনের নির্যাতন আর যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য, যা অধিকাংশ মানুষকে ধ্বংস করেছিল।

স্টয়িসিজম দর্শনে ইতিহাসে এপিকটিটাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে, ইচ্ছা বা উইল বা বাছাই করার ক্ষমতা বা চয়েসের ধারণাটি প্রস্তাব করার জন্যে। এর জন্যে তিনি একটি গ্রিক শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, prohairesis, যার মানে খুব সুপরিকল্পিতভাবে কোনোকিছু নির্বাচন বা কোনোকিছুকে বিকল্পগুলোর মধ্যে শ্রেয়তর মনে করা। এটাকেই তিনি তাঁর নৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে রেখেছিলেন। যদিও তাঁর তত্ত্বটি নতুন ছিল সেই সময়, কিন্তু এটির ভিত্তি ছিল প্রাচীন স্টয়িক দার্শনিকদের ধারণাগুলো। স্টয়িক দার্শনিকরা বলেছিলেন, অধিকাংশ জিনিস যা মানুষ মূল্যবান মনে করে, সেগুলো বাস্তবিকভাবে তাদের প্রতি প্রদর্শিত শ্রদ্ধার প্রতি নির্বিকার। আনন্দ, সুনাম, সম্পদ কিংবা স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলোর কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য নেই। শুধুমাত্র সদ্‌গুণ, যা কিনা এই বিষয়গুলোর সঠিক ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের পথ দেখাতে পারে, সেটাই আসলে সত্যিকারভাবে উত্তম ও অর্জনের যোগ্য। এপিকটিটাস তাঁর তত্ত্বটিকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন যুক্তি দিয়ে যে আমাদের সদ্‌গুণ মূলত এই prohairesis-এরই সঠিক ব্যবহার, অর্থাৎ সঠিকভাবে নির্বাচন করার ক্ষমতা। যেমন তিনি বলতেন, টাকার নিজের কোনো মূল্য নেই, কিন্তু এটি মূল্য অর্জন করে যখন আমরা এটি সঠিকভাবে ব্যবহার করার পথ বেছে নিই।

এই কঠিন দর্শনের সূচনা প্রাচীন গ্রিসে, তবে এটি সবচেয়ে বিকশিত হয়েছিল রোমসাম্রাজ্যে। দুজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক স্টয়িক দার্শনিকদের শিক্ষা সম্প্রচার করেছিলেন: মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং লুসিয়াস অ্যানেউস সেনেকা (১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। জীবনের হ্রস্বতা এবং জরা ও মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা ছিল তাদের বিশেষ আলোচনার বিষয়। তাঁরা শনাক্ত করেছিলেন বার্ধক্য একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, এবং যা পরিবর্তন করা সম্ভব নয় তারা সেটি পরিবর্তন করার চেষ্টা করেননি। এবং একই সাথে যদিও, তারা বিশ্বাস করতেন আমাদের সবারই এই সংক্ষিপ্ত সময়েরই সদ্ব্যবহার করা উচিত।

কোনো সন্দেহ নেই সিসেরো অসম্ভব কর্মঠ ছিলেন, তাঁর একটি দিনেই তিনি বহু কাজ সম্পাদন করতেন। তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ, এবং অবশ্যই একজন দার্শনিক। তাঁর On Old Age বইটিতে তিনি বৃদ্ধ হবার চারটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে চিহ্নিত করেছিলেন : কাজ করা ক্রমশ কঠিনতর হয়ে ওঠে, শরীর জরায় আক্রান্ত হয়ে আরো দুর্বলতর হয়ে ওঠা, শারীরিক সুখানুভূতিগুলো আর আগের মতো উপভোগ্য না থাকা, এবং মৃত্যুর খুব নিকটে অগ্রসর হওয়া। বৃদ্ধ হওয়া অনতিক্রম্য, কিন্তু সিসেরো প্রস্তাব করেছিলেন, আমরা নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারি কীভাবে আমরা এই বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়ার প্রতি প্ৰতিক্ৰিয়া দেখাব। আমাদের শনাক্ত করা উচিত যে বৃদ্ধাবস্থায় এই ক্রমানবতি আমাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলবেই এমন কোনো আবশ্যিকতা নেই। প্রথমত, বৃদ্ধমানুষ তাদের অভিজ্ঞতার কারণে অল্প কাজ করেই জীবন ধারণ করতে পারে, কারণ তারা যে-কাজই করবেন, সেটি তারা অনেক কার্যকরীভাবে করতে পারেন। তাদের শরীর এবং মনের আবশ্যিকভাবে নাটকীয় মাত্রায় অবনতি হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যদি তারা শরীর ও মনের নিয়মিত অনুশীলন করেন। এবং এমনকি যখন শারীরিক সুখ কম-উপভোগ্য হয়ে ওঠে, বৃদ্ধ মানুষরা আরো বেশি সময় অতিবাহিত করতে পারেন বন্ধুত্বে আর কথোপকথনে, যে কাজগুলো স্বতন্ত্রভাবেই সুখকর। পরিশেষে, সিসেরো বিশ্বাস করতেন যে, আত্মা চিরকাল বেঁচে থাকে, সুতরাং বৃদ্ধদের মৃত্যুভয় থাকা উচিত নয়। সিসেরোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আমাদের অবশ্যই উচিত হবে মেনে নেয়া যে, বৃদ্ধ হওয়া হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক হবার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।

সেনেকা, স্টয়িক দর্শনের আরেক জনপ্রিয় ব্যাখ্যাকারী একই রকম অবস্থান নিয়েছিলেন যখন তিনি তাঁর জীবনের হ্রস্বতার কথা ভেবেছিলেন। আপনি সচরাচর কাউকে জীবন অনেক দীর্ঘ বলে অভিযোগ করতে শুনবেন না, অধিকাংশেরই অভিযোগ, এটি বেশি সংক্ষিপ্ত। কত কিছু করার আছে, অথচ সেগুলো করার জন্য জীবন কত ছোট। প্রাচীন গ্রিক হিপোক্রাতিসের ভাষায়, জীবন ছোট কিন্তু শিল্প অমর। বৃদ্ধরা, যারা তাদের মৃত্যুকে নিকেটে আসতে দেখেন, তারা প্রায়ই আশা করেনযদি আরো অল্প কয়েকটি বছর বাঁচার জন্যে পাওয়া যেত, তাহলে জীবনে সত্যিকারভাবে যা তারা চান সেটা অর্জন করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু প্রায়শই অনেক বিলম্ব হয়ে যায়, শুধুমাত্র তাদের সেই অনুভূতিটা অবশিষ্ট থাকে, কী হতে পারত, সেই বিষয়ে তাদের দুঃখবোধ এবং অনুশোচনাগুলো। প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর এই বিশেষ ক্ষেত্রে। ঠিক যখনই আমরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার মতো একটি অবস্থায় আসি, তখনই আমাদের মরার সময়ও এসে যায়। সেনেকা অবশ্যই এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত ছিলেন না। সিসেরোর মতোই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সেনেকার হাতে সময় ছিল নাটক লেখা, রাজনীতি এবং সফলভাবে একটি ব্যবসা পরিচালনা, এবং সর্বোপরি দার্শনিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। তিনি সমস্যাটিকে দেখতেন এভাবে : আমাদের জীবন কত ছোট সেটা বিষয় নয়, বরং আমাদের জন্য বরাদ্দ সময়টাকে আমরা কত খারাপভাবে ব্যবহার করি সেটাই মূল সমস্যা। আরো একবার, মানব-পরিস্থিতির অনিবার্য বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সেনেকার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। জীবন সংক্ষিপ্ত বলে আসলেই আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত নয়, বরং আমাদের উচিত এর পূর্ণ ব্যবহার করা। তিনি যুক্তি দেন, কিছু মানুষকে যদি হাজার বছর দেয়া হয়, তারা খুব সহজে একইভাবে সময় নষ্ট করবে ঠিক যেমন করে এখন তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়টি তারা নষ্ট করে থাকে। এবং এমনকি তারপরও তারা অভিযোগ করবেন জীবন আসলেই খুব ছোট। বাস্তবিকভাবে, জীবন আসলেই সাধারণত যথেষ্ট বড় বেশকিছু কাজ করার জন্য যদি আমরা সঠিক কাজগুলো নির্বাচন করতে পারি এবং গুরুত্বহীন কাজে যদি সময় নষ্ট না করি। কেউ টাকার পেছনে দৌড়ান এমন প্রাণশক্তি নিয়ে যে তাদের অন্যকিছু করার কোনো সময়ই থাকে না আর। কেউ তাদের সব অবসর সময় ব্যয় করে শারীরিক সুখের অনুসন্ধানে, নেশাগ্রস্থ হয়ে। এই বিষয়টি আবিষ্কার করার জন্য যদি আপনি আপনার বৃদ্ধাবস্থা অবধি অপেক্ষা করেন, তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সেনেকা ভাবতেন, সাদা চুল আর কুচকানো চামড়া দেখে মনে করার কোনো কারণ নেই সেই বৃদ্ধমানুষটি কোনো কাজের মতো কাজ করে তার জীবন অতিবাহিত করেছেন, এমনকি অনেক মানুষ ভ্রান্তভাবে এমন কিছু ভেবে আচরণ করেন। জাহাজে পাল তুলে ঝোড়ো বাতাসে এদিক-সেদিক বয়ে চলার মানে কিন্তু কোনো অভিযানে যাওয়া নয়। হয়তো জাহাজের মধ্যে তাকে বেশকিছু ঝাঁকুনি সহ্য করতে হয়েছে। জীবনের ক্ষেত্রেও তাই, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভেসে যাওয়া আর মূল্যবান, অর্থবহ অভিজ্ঞতাগুলোর জন্যে সময় না-খুঁজে পাওয়া খুবই ভিন্ন সত্যিকারের বাঁচার থেকে। ভালোভাবে নিজের জীবন কাটানোর একটি সুবিধা হচ্ছে যখন আপনি বৃদ্ধ হবেন আপনার স্মৃতিগুলোকে ভয় করতে হবেনা। আপনি যদি আপনার সময় নষ্ট করেন, আপনি যখন পেছন ফিরে তাকাবেন, আপনি হয়তো চিন্তা করতে চাইবেন না আপনি কেমন করে আপনার জীবন কাটিয়েছিলেন, কারণ খুব সম্ভবত সেগুলো খুবই কষ্টকর হবে, কারণ বহু সুযোগ আপনি হারিয়েছেন। সে-কারণে বহু মানুষই তুচ্ছ কাজ নিয়ে প্রায়শই ব্যস্ত থাকে। সেনেকা ভাবতেন, আপনি যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন সেই সত্যটিকে এড়ানোরই এটি একটি কৌশল। তিনি তাঁর পাঠকদের তাগিদ দেন ভিড় থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্য, ব্যস্ততার ভান করে নিজেদের থেকে লুকানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করার জন্য।

তাহলে কীভাবে, সেনেকার মতানুযায়ী, আমাদের সময় কাটানো উচিত হবে? স্টয়িকদের আদর্শ হচ্ছে নিঃসঙ্গচারী হয়ে বসবাস করা, সব মানুষের সঙ্গ থেকে দূরে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায়, তিনি ঘোষণা করেন তাঁর উপলব্ধিজাত অর্থে দর্শন অধ্যয়ন করা। সত্যিকারের বেঁচে থাকার জন্য এটি একটি উপায়। সেনেকার নিজের জীবন তাঁকে প্রচুর সুযোগ দিয়েছিল, তিনি যা প্রচার করেছিলেন সেই দর্শনগুলো তাঁর নিজের জীবনে প্রয়োগ করার জন্যে। যেমন ৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় সম্রাট গাইয়াসের বোনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনের। বিষয়টি আদৌ স্পষ্ট নয় তিনি সেটি করেছিলেন কিনা, তবে এর ফলাফল ছিল তাঁকে আট বছরের জন্য কর্সিকা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এরপর তাঁর ভাগ্য আবার সুপ্রসন্ন হয় যখন তাঁকে রোমে তলব করা হয় ১২ বছর বয়সী ভবিষ্যৎ রোমসম্রাট নিরোর শিক্ষক হিসাবে কাজ করার জন্য। পরবর্তীতে সেনেকা নিরোর ভাষণ-লেখক এবং রাজনৈতিক পরামর্শক ছিলেন। তবে সম্রাট নিরোর সাথে তাঁর এই সম্পর্কের পরিণতি ছিল ভয়ানক, যদিও নিয়তির আরেকটি চক্রান্ত। নিরো পরে তাঁকে অভিযুক্ত করেছিলেন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রকারীদের একজন হিসাবে। এবার সেনেকার জন্য কোনো পরিত্রাণ ছিলনা। নিরো তাঁকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেন। নিরোর এই আদেশ অমান্য করার কোনো উপায়ই নেই, কারণ কাজটি না করলে তাকে এমনিতেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। আর এই অভিযোগের বিরোধিতা করাও অর্থহীন, বিশেষ করে সম্রাট যখন কুখ্যাত নিরো। তিনি আত্মহত্যা করেন, তাঁর বৈরাগ্যদর্শনের মতাদর্শের প্রতি সততাসহ, শান্তিপূর্ণ আর শেষমুহূর্ত অবধি কোনো ধরনের অস্থিরতা ছাড়াই।

স্টয়িকদের মূল শিক্ষাগুলোর দিকে তাকানোর একটি উপায় হচ্ছে এটিকে একধরনের সাইকোথেরাপি বা মনোচিকিৎসা হিসাবে ভাবা; ধারাবাহিক কিছু মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল যা আমাদের জীবনকে প্রশান্তিময় করে তুলতে পারে। আপনার চিন্তাগুলোকে জট বাঁধিয়ে রাখা সমস্যাপূর্ণ আবেগগুলোকে পরিত্যাগ করুন এবং দেখবেন সবকিছুই সরল মনে হবে। যদিও দুঃখজনকভাবে, এমনকি যদি আপনি আপনার আবেগকে শান্ত করতে সক্ষমও হন, আপনি হয়তো আবিষ্কার করবেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু এইসাথে হারিয়েও ফেলেছেন। নির্বিকার এই মানসিক অবস্থা যা স্টয়িকরা সবসময় আদর্শ হিসাবে প্রচার করেছেন, হয়তো দুঃখ কমাতে পারে এমন কোনো পরিস্থিতিতে যার উপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এর মূল্য হতে পারে যে আমরা শীতল, হৃদয়হীন এবং হয়তো মানুষ হিসাবে খানিকটা কমে যাব। প্রশান্তি অর্জনের মূল্য যদি এটি হয়ে থাকে, এটি খুব বেশি মনে হতেও পারে।

স্টয়িসিজম নামের এই দর্শনটির চার শতাব্দী ব্যাপী স্বর্ণযুগ ছিল প্রাচীন গ্রিস ও রোমে। সমাজের প্রতিটি শ্রেণিতে সেই সময় এটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। সন্দেহ নেই দর্শনটির বিস্মিত করার মতো, তবে খুবই বাস্তবমুখী ব্যবহারিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল: মানুষকে শেখানো কীভাবে প্রশান্তি অর্জন করা যায় এবং কীভাবে সাহসের সাথে যে-কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা আর দুঃখকষ্টকে মোকাবেলা করা সম্ভব। আমরা এখন সেই দর্শনের শাখাকে সম্মান করি যখনই আমরা কাউকে বলি ‘স্টয়িক’ বা শুধুমাত্র ‘ফিলোসফিকাল’, যখন নিয়তি তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়: যখন তারা চাবি হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে অপমাণিত হয়, ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয় অথবা সমাজে অপদস্থ হয়। সব দর্শনের মধ্যে স্টয়িসিজম বা বৈরাগ্যদর্শনই হয়তো আমাদের এই অস্থির আর শঙ্কার সময়ের জন্যে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ও উপযোগী। বহু শত দার্শনিক স্টয়িক দর্শনবাদের চর্চা করেছেন। সুপরিচিত স্টয়িক দর্শনের প্রচারক এবং পথপ্রদর্শক হিসাবে সেনেকা এবং সিসেরো ছাড়া আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই দয়ালু, উদার রোমসম্রাট (যিনি সাম্রাজ্যের প্রান্তে জার্মানিক গোত্রগুলোর সাথে যুদ্ধ করার অবসরে দর্শনচর্চা করতেন, মার্কাস অরেলিয়াস (১২১-১৮০ খ্রিস্টাব্দ)। তাদের লেখা এখনও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই পাঠযোগ্য এবং গভীরভাবে সান্ত্বনা- প্রদায়ক, নির্ঘুম রাতের জন্য বিশেষভাবে আদর্শ, যে রাতগুলো শঙ্কা আর সন্দেহের লাগামহীন বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে উর্বর। স্টয়িসিজম আমাদের বিশেষভাবে চারটি সমস্যা মোকাবেলা করতে সাহায্য করতে পারে :

এক. দুশ্চিন্তা : প্রায় সবসময়ই সম্ভাবনা আছে ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটার। আমরা যখন দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হই, এই পরিস্থিতিতে অন্যদের সান্ত্বনা দেবার স্বাভাবিক কৌশল হচ্ছে আমাদের আশ্বস্ত করা এমন কিছু বলে, যাই হোক না কেন, আমরা এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠব, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে : যেমন, ব্রিতকর ই-মেইলটা হয়তো কারো চোখে পড়বে না, ব্যবসার ঠিকই উন্নতি হবে কিংবা কোনো কলঙ্কজনক কিছু ঘটবে না ইত্যাদি। কিন্তু স্টয়িক দার্শনিকরা এমন কোনো কৌশলের ঘোরবিরোধী ছিলেন, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন দুশ্চিন্তা কী হতে পারে সেটি নিয়ে আমাদের সেই ভয় আর কী ঘটতে পারে সেটি নিয়ে আমাদের আশার মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সেই শূন্যস্থান যত বড় হবে, ততই প্রবল হবে আমাদের চিন্তা আর মানসিক অবস্থার অস্থিরতা আর দোদুল্যমানতা। মনের প্রশান্তি ফিরে পাবার জন্য আমাদের যা করা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে পদ্ধতিগতভাবে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে সকল আশার শেষ অবশিষ্টাংশকে ধ্বংস করা। আশা-জাগানো কাহিনি দিয়ে নিজেদের শান্ত করার প্রচেষ্টার বদলে, স্টয়িকবাদীরা মনে করেন আরো অনেক বেশি ভালো হবে সাহসের সাথে সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাগুলোর সাথে মোকাবেলা করা এবং তারপর পুরোপুরি চিন্তাগুলোকে বশে নিয়ে আসা। যখন আমরা আমাদের ভয়গুলোর মুখোমুখি হই সরাসরি এবং কল্পনা করি যদি সেই ভয়গুলো সত্যি হয় তাহলে জীবন কেমন হতে পারে, সেই মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবনে পৌঁছাবার সুযোগ থাকে আমাদের : আমরা কোনো-না-কোনোভাবে ব্যাপারটা সামলে নিতে পারব। আমরা সামলে নিতে পারব এমনকি যদি আমরা কারাগারেও যাই, এমনকি যদি আমাদের সব টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলি, এমনকি যখন জনসমক্ষে আমরা অপমানিত হই, এমনকি যখন আমাদের ভালোবাসার মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে যায়, এমনকি যদি আমাদের শরীরে টিউমারটি ভয়ংকর ক্যান্সার হিসাবে প্রমাণিত হয় (স্টয়িকরা আত্মহত্যায় দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন)। আমরা সাধারণত ভবিষ্যতের ভয়ংকর কোনো পরিণতি শক্ত করে বন্ধ করে থাকা চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া বেশিকিছু করার সাহস পাইনা। এবং সে-কারণেই আমাদের উপর এটি তার চিরন্তন ধর্ষকামী চাপটি অব্যাহত রাখতে পারে। এর পরিবর্তে, সেনেকা যেমন মন্তব্য করেছিলেন: ‘আপনার দুশ্চিন্তা কমাতে, আপনাকে অবশ্যই ধরে নিতে হবে আপনি ভয় পাচ্ছেন যা ঘটবে বলে, অবশ্যই সেটি ঘটতে যাচ্ছে।’ কোনো এক বন্ধু, সে হয়তো শঙ্কিত তাকে জেলে যেতে হতে পারে, তার মুখের উপর সেনেকার সুস্পষ্ট জবাব ছিল, ‘এমন কারো পক্ষে জেলখানাও সবসময় সহ্য করা সম্ভব হবে, যে কিনা আমাদের অস্তিত্বের বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে।’

স্টয়িক দার্শনিকরা প্রস্তাব করেছিলেন, আমাদের উচিত হবে কিছু সময় বরাদ্দ করা যখন সবচেয়ে খারাপ পরিণতিতে আমাদের কী করতে হবে সেটি যেন আমরা অনুশীলন করতে পারি। যেমন আমাদের উচিত, বছরে একটা সপ্তাহ চিহ্নিত করে রাখা, যখন আমরা কেবলমাত্র বাসি রুটি খাব এবং একটিমাত্র চাদর বিছিয়ে শক্ত মেঝেতে শোব, যাতে আমরা চাকরি থেকে বরখান্ত হওয়া কিংবা জেলখানায় বন্দি হওয়া নিয়ে অহেতুক অস্থির না হয়ে পড়ি। তাহলে আমরা বুঝতে পারব কেন মার্কাস অরেলিয়াস বলেছিলেন, ‘একটি সুখীজীবনের জন্যে আসলে খুব সামান্য জিনিসেরই প্রয়োজন।’ প্রতিদিন সকালে একজন ভালো স্টয়িক প্রিমেডিটেশন চর্চা করে তার দিন শুরু করবেন; প্রিমেডিটেশন হচ্ছে এই দিনে আগত ঘণ্টায় ঘটতে পারে এমন সব খারাপ পরিণতি নিয়ে ভাবা। মার্কাস অরিলিয়াসের কঠোর ভাষায় ‘মরণশীল হয়েই আপনার জন্ম হয়েছিল, আপনিও মরণশীলদের জন্ম দিয়েছেন, সুতরাং আপনাকে অবশ্যই সবকিছু বিবেচনা করতে হবে, সবকিছু প্রত্যাশা করতে হবে।’ সে-কারণেই বৈরাগ্যদর্শন যে-কোনো আকস্মিক বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য একটি অভিজাত, চমৎকার এবং বুদ্ধিদীপ্ত অনুশীলনীর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

দুই. ক্রোধ: আমরা প্রায়শই রেগে যাই, বিশেষ করে আমাদের সঙ্গী, আমাদের সন্তান এবং রাজনীতিবিদদের নানা কর্মকাণ্ডে। আমরা যথারীতি রাগের মাথায় নানা কথা বলি এবং জিনিসপত্র ভাঙচুর করি, প্রায়শই একে অপরের ক্ষতি করি, আহত করি শব্দে, আচরণে ও কর্মে। স্টয়িক দার্শনিকরা মনে করেন, আমাদের ক্রোধ হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর অসংযমী একটি আচরণ, কিন্তু তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রেগে যাওয়া স্পষ্টতই নির্বুদ্ধিতার একটি পরিচয়। কারণ তাঁদের বিশ্লেষণে হঠাৎ এই রেগে উন্মত্ত হবার বিষয়টির কারণ কেবল একটাই হওয়া সম্ভব : আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভ্রান্ত একটি ধারণা। এটি আসলেই আমাদের ছেলেমানুষিপনার তিক্ত একটি ফল। স্টয়িকবাদী বিশ্লেষণে ক্রোধের জন্ম হয় আশা আর বাস্তবতার হিংস্র সংঘর্ষে। আমাদের জীবনে ঘটা প্রতিটি দুঃখজনক ঘটনার প্রতি আমরা ক্রোধে চিৎকার করে উঠি না, শুধুমাত্র এই কাজটি আমরা করি যখন এটি একই সাথে দুঃখজনক এবং অপ্রত্যাশিত। ক্রোধ প্রশমনের জন্য, সেকারণে আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে জীবনের কাছ থেকে কীভাবে অনেক কম প্রত্যাশা করা যায়। অবশ্যই আমাদের প্রিয়জনরা আমাদের হতাশ করবে, খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের সহকর্মীরা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে না, অবশ্যম্ভাবীভাবেই আমাদের বন্ধুরা আমাদের মিথ্যা কথা বলবে, এইসব কোনোকিছুরই আমাদের অবাক করে দেয়া উচিত নয়। হ্যাঁ, আমাদের হয়তো দুঃখ অনুভূত হতে পারে। অবশ্যই এটি কখনোই, আমরা যদি স্টয়িক হই, আমাদের ক্রোধান্বিত করবে না। একজন বিজ্ঞমানুষের উচিত হবে এমন একটি পরিস্থিতি অর্জন করার জন্য তার লক্ষ্য স্থির করা, যেখানে কোনোকিছুই যেন হঠাৎ করে তাদের মানসিক প্রশান্তি নষ্ট করতে না পারে। প্রতিটি ট্র্যাজেডির মূল্যায়ন আগে থেকেই সম্পন্ন থাকা উচিত। সেনেকা নিরোর দেয়া মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি মাথায় পেতে নেবার আগে তার প্রিয়জনদের উদ্দেশে যেমন বলেছিলেন, ‘জীবনের খানিকটা অংশের জন্য কাঁদার কী দরকার, যখন এর পুরোটাই অশ্রু দাবি করে।’

তিন. সন্দেহপ্রবণতা : খুবই সহজ ভাবা যে, খারাপ কিছু ঘটার জন্য আমাদেরকেই বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা প্রায়ই ভাবি কেন এটা আমাদের সাথে ঘটল। আমরা আমাদেরকে ছিন্নভিন্ন করি নানা দোষারোপ আর অপবাদে অথবা ভিতরের বিষ উগরে দিই পৃথিবীর প্রতি। স্টয়িক দার্শনিকরা আমাদের এই কাজগুলো না-করার উপদেশ দিয়েছেন। এটি হয়তো আমাদের যেমন দোষ না, হয়তো কারোরই দোষ না। যদিও ধর্মবিশ্বাসী না, স্টয়িকবাদীরা রোমবাসীদের ভাগ্যদেবী ফরচুনার বিষয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। ফরচুনাকে তাঁরা মনে করতেন নিয়তিকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি উপযুক্ত রূপক। ফরচুনার অসংখ্য উপাসনালয় ছিল সারা সাম্রাজ্য জুড়ে, লোকপ্রিয় ধারণা ছিল ফরচুনাই মানুষের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করে। এবং তাকে মনে করা হতো উদার এবং একই সাথে স্বেচ্ছাচারী ও প্রতিশোধপরায়ণ। অবশ্যই সে মেরিটোক্রাট নয়, অর্থাৎ মানুষের মেধা ও যোগ্যতার উপর তার প্রাপ্য নির্ধারণ করা উচিত এমন ধারণার অনুগামী ছিল না সে। দেবীকে উপস্থাপন করা হতো দান করার জন্য এক হাতে নানা কাঙ্ক্ষিত দ্রব্য দ্বারা পূর্ণ একটি বিশাল কর্নকোপিয়া বা শিঙ্গাকৃতির পাত্র ও অন্য হাতে কারো জীবনের গতিপথ বদলে দেবার জন্য হাল বা কর্ণ। এবং তার মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী যে হয়তো আপনাকে একটা দারুণ কাজের সুযোগ করে দিতে পারেন অথবা সুন্দর কোনো সম্পর্ক এবং হয়তো এর পরের মুহূর্তে শুধুমাত্র তার ইচ্ছা হচ্ছে না এই কারণে আপনার গলায় মাছের কাঁটা আটকে মরা নিশ্চিত করতে পারে। কোনো একজন স্টয়িকদের সে-কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হচ্ছে সেই বিষয়টি শ্রদ্ধা করা যে, ফরচুনা বা নিয়তির মতো উন্মত্ত কোনো এক চরিত্রের মর্জির উপর কতটা নির্ভর করতে পারে আমাদের জীবন। সেনেকা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এমন কোনো কাজ নেই যা করার জন্যে ফরচুনা সাহস পাবে না। এই জিনিসটা আমরা আগে থেকে যদি মেনে নিতে পারি তাহলে আমরা আমাদের সাফল্য আর সুসময়ের স্থায়িত্ব নিয়ে যেমন সন্দিহান থাকব, তেমনি আমাদের ব্যর্থতাগুলোর প্রতি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিধারণ করতে পারব। সর্বতোভাবেই, আমরা যা-কিছু পাই, তার বেশিরভাগ পাবারই আমাদের যোগ্যতা নেই। কোনো বিজ্ঞব্যক্তির তাই দায়িত্ব হচ্ছে ভাগ্যের উপহারে কখনোই বিশ্বাস না-করা: খ্যাতি, বিত্ত, ক্ষমতা, ভালোবাসা, স্বাস্থ্য, এর কোনোটাই আমাদের নিজের নয়। এই সবকিছুর উপর আমাদের নির্ভরতার তাই হওয়া প্রয়োজন খুবই হালকা এবং গভীরভাবে সতর্ক।

চার. বিভ্রম: খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের নিজেদের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমরা বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করি। এই পৃথিবীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিশাল অংশকে প্রভাবিত করে আমাদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো। এবং সে- কারণে আমরা চাপ অনুভব করি, আতঙ্কিত হই, আমরা গালমন্দ করি, ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করি। আমাদের সেই পূর্বাবস্থা ফিরে পেতে আমাদের অবশ্যই নিয়মিতভাবে নিজের কাছে নিজেদের কিছুটা খাটো করতে হয়। আমরা যেরকম এবং আমরা যা করি সেগুলো সত্যিকারভাবে গুরুত্বপূর্ণ, খুবই ঝামেলাপূর্ণ ও খুবই স্বাভাবিক এই বিভ্রান্তিকে আমাদের অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। স্টয়িকরা খুবই আগ্রহী ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে এবং দর্শনের সব শিক্ষার্থীকে তাঁরা উপদেশ দিয়েছিলেন মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য: আপনি সন্ধ্যার আকাশ আলো করে রাখা শুক্র গ্রহ বা ভিনাস কিংবা জুপিটার দেখতে পাবেন। আঁধার আরো গভীর হলে আপনি হয়তো আরো কিছু নক্ষত্র দেখতে পাবেন, আলদেবরন, অ্যান্ড্রোমিডা এবং অ্যারিস.. আরো অনেক। আমাদের সৌরজগৎ ছাড়িয়েও মহাকাশের অকল্পনীয় বিস্তারের হাতছানি অনুভব করতে আপনার ভুল হবে না। অসংখ্য ছায়াপথ আর কসমসের এই দৃশ্যটাকে স্টয়িকবাদীরা শ্রদ্ধা করতেন, কারণ তারা মনে করতেন মনকে প্রশান্ত করার ক্ষেত্রে এর একটি বিশেষ প্রভাব আছে। আমরা সেই প্রেক্ষাপটে অনুভব করতে পারি, আমাদের কোনো সমস্যা, হতাশা কিংবা আশার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই এই মহাবিশ্বে। আমাদের সাথে ঘটা কোনোকিছুই বা আমরা যা-কিছু করি না কেন, তার কোনোটাই সৌভাগ্যক্রমে কসমিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

পরিশেষে, স্টয়িক দর্শনের প্রয়োজনীয়তা মনে হয় আগের চেয়েও এখন অনেক বেশি। প্রতিটি দিন আমরা মুখোমুখি হচ্ছি নানা পরিস্থিতির, যা স্টয়িকরাই পারেন বুঝতে এবং তারাই একমাত্র চান যেন আমরা প্রস্তুত থাকি। তাদের শিক্ষা মনে হতে পারে নৈরাশ্যবাদী এবং একই সাথে সমীহ জাগানো, যা আমাদের গভীরভাবে সান্ত্বনা দিতে পারে। অবশ্য কোনো-কোনো ক্ষেত্রে আমাদের মনে তাদের এই অবস্থান হাস্যরসেরও জন্ম দিতে পারে। তবে কোনো সন্দেহ নেই স্টয়িকবাদীরা আমাদের আমন্ত্রণ জানায়, সাহসী এবং স্পর্ধিত হয়ে আমাদের বহু সমস্যার মোকাবেলা করার জন্যে। সেনেকা যেমন আমাদের মনে করিয়ে দেন, ‘আপনার কব্জির দিকে তাকান, ওখানেই, যে-কোনো সময়ই আপনি খুঁজে পাবেন স্বাধীনতা।’ আমাদের এই সময়ের ক্রোধের উদ্রেক করার মতো তুষ্ট আর ছেলেমানুষি আশাবাদিতায় বিপরীতমুখী ভারসাম্য আনতে এইসব প্রাচীন দার্শনিকদের তিক্ত-মধুর প্রজ্ঞার চেয়ে উত্তম আর কিছুই নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *