1 of 2

অধ্যায় ৩৮ : সিসিফাসের সুখ – আলবেয়ার্ট কামু

অধ্যায় ৩৮ : সিসিফাসের সুখ – আলবেয়ার্ট কামু

আলবেয়ার্ট কামু ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন মধ্য-বিংশ শতাব্দীর ফরাসি-আলজেরীয় একজন দার্শনিক এবং লেখক। আমাদের মনোযোগ পাবার উপর তাঁর দাবির ভিত্তি মূলত তার লেখা তিনটি কালজয়ী উপন্যাস : The Outsider (১৯৪২), The Plague(১৯৪৭), TheFall(১৯৫৬) এবং দুটি দার্শনিক প্রবন্ধ :The Myth of Sisyphus (১৯৪২), The Rebel (১৯৫১)। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে, তাঁর প্রকাশক মিশেল গালিমর্দ ঘটনাচক্রে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন, যখন তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে একটি দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। মৃত্যুর সময় কামুর পকেটে একটি ট্রেনের টিকিট ছিল, যেটা তিনি ব্যবহার না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একেবারে শেষমুহূর্তে, গালিমর্দের গাড়িতে একসাথে গন্তব্যে ফিরবেন বলে।

কামুর খ্যাতির সূচনা এবং এখনও মূলত তার উপরই ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দি আউটসাইডার। উপন্যাসটির পটভূমি তাঁর জন্মস্থান আলজিয়ার্স। এটি মূলত মারসোল্ট নামের স্বল্পভাষী, বিচ্ছিন্ন, শ্লেষপটু আর নৈরাশ্যবাদী একটি চরিত্রের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত, যিনি ভালোবাসা, কাজ অথবা বন্ধুত্ব, সবকিছুই অর্থহীন বলে মনে করতেন, এবং ঘটনাচক্রে একদিন তিনি, খানিকটা ভুলবশত, একজন আরব ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন। তিনি জানতেন না, তার এরকম একটি কাজের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল এবং পরিণতিতে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হয়, আংশিকভাবে এর কারণ বিচারের সময় তিনি কোনো ধরনের অনুশোচনা প্রকাশ করেননি, এমনকি নিজের নিয়তি নিয়েও কোনো ধরনের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেননি। উপন্যাসটি সেই মানসিক অবস্থাটির একটি চিরন্তন রূপ দিয়েছিল, যা সংজ্ঞায়িত করেছিলেন সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্কহাইম, anomie নামে, হতদ্যোম, অবসাদগ্রস্ত, আবেগহীন, উদাসীন, বিচ্ছিন্নতার সেই পরিস্থিতি, যখন কেউ নিজেকে অন্য সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে এবং তারা কোনো উপায় খুঁজে পায় না তাদের সহমর্মিতা কিংবা মূল্যবোধগুলো ভাগ করে নেবার জন্যে।

দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর ‘দি আউটসাইডার’ বইটি পড়া ফরাসি এবং অন্য বহু দেশের তরুণদের বয়ঃসন্ধিকাল থেকে উত্তরণের একটি আচার হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে, এবং অবশ্যই ব্যাপারটা সহজ নয়, কারণ এই বইটি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা সতেরো বছর বয়সে প্রথমবারের মতো আত্মস্থ করা বেশ জটিল একটি কাজ। দি আউটসাইডার-এর নায়ক মারসোল্ট সবকিছু যেভাবে বিদ্যমান সেই সংক্রান্ত সব প্রচলিত উত্তরগুলোকে কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তিনি সবকিছুকেই ভণ্ডামি আর ভাবপ্রবণতায় আক্রান্ত হিসাবে দেখতেন, এবং তিনি বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যেতেও অক্ষম ছিলেন। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি কোনোকিছুকে ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রদত্ত বা উপস্থাপিত সর্বজনস্বীকৃত ব্যাখ্যাগুলোকে গ্রহণ করতে পারতেন না, যেমন শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্র, সম্পর্ক, সরকারপদ্ধতি। তিনি সাধারণ বুর্জোয়া জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তীব্রভাবে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছেন সেই সমাজের নিঃশেষিত নৈতিকতা আর পরিবার আর অর্থ-উপার্জনের প্রতি সংকীর্ণ উৎকণ্ঠাগুলোকে।

বইটির যুক্তরাষ্ট্রের সংস্করণের পরিশেষে কামু লিখেছিলেন, ‘মারসোল্ট সবার মতো একই খেলায় অংশগ্রহণ করেনি। সে মিথ্যা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, সে নিজে আসলে কী, সেটাই সে বলেছিল, সে তার অনুভূতি গোপন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, আর সেকারণে সমাজও তাৎক্ষণিকভাবে হুমকি অনুভব করেছিল।’ বইটির অস্বাভাবিক মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতার বেশিরভাগ এসেছে শীতল আর বিচ্ছিন্নতার যে কণ্ঠস্বর নিয়ে মারসোল্ট আমাদের সাথে, তার পাঠকরা, কথা বলেন। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে যত কিংবদন্তির সূচনাবাক্য আছে, কামুর দি আউটসাইডার-এর সূচনাবাক্যটি তাদের মধ্যে অন্যতম। একটি বাক্যই পুরো উপন্যাসটির সুর নির্ধারণ করে দিয়েছে : Today mother died. Or maybe yesterday, I don’t know.’আজ মা মারা গেলেন। অথবা, গতকাল, আমি জানি না’। উপন্যাসটির শেষও তীব্রভাবে উদ্ধত। মারসোল্ট, বন্দুকের ঘোড়ায় চাপ দেবার অনুভূতি কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে, শুধুমাত্র সেকারণে কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া আর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘটানো হত্যাকাণ্ডটির জন্যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত, সে সবধরনের সান্ত্বনা পরিত্যাগ করেন, এবং সাহসের সাথে মেনে নেন মানবজাতির প্রতি মহাবিশ্বের চূড়ান্ত নির্বিকার নিস্পৃহতাকে : ‘আমার শেষ ইচ্ছা হচ্ছে, আমার রায় কার্যকর হবার দিন দর্শকদের একটি জমায়েত হবে, আর তারা আমাকে শুভকামনা জানাবে ঘৃণা আর বিদ্বেষপূর্ণ চিৎকারে।’ এমনকি যখন আমরা নিজেরা হত্যাকারী নই এবং আমরা আসলেই বিষণ্ন হতে পারি যখন আমাদের মায়ের মৃত্যু হয়, তারপরও দি আউটসাইডার-এর মেজাজে কিছু আছে যার কিছু- না-কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কমবেশি আছে, যখন আমরা ভাবি আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ স্বাধীনতা আছে অনুধাবন করার যে আমরা একটি খাঁচায় বাস করি, কিন্তু আমাদের সেই খাঁচা থেকে বের হবার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা নেই, কিংবা কেউই যখন আমাদের বুঝতে পারে না, সবকিছু অনেক বেশি হতাশাপূর্ণ মনে হয়, মনে পড়ছে এমন কোনো অভিজ্ঞতা?

এই উপন্যাসটি ছাড়াও কামুর দার্শনিক খ্যাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি একটি বড় প্রবন্ধ The Myth of Sisyphus, এই বইটির সূচনাবাক্যটিও যুগান্তকারী There is but one truly serious philosophical problem and that is suicide. Judging whether life is or is not worth living, that is the fundamental question of philosophy বাসত্যিকারভাবে একটিমাত্র দার্শনিক সমস্যা আছে এবং সেটি হচ্ছে আত্মহত্যা, বেঁচে থাকার আদৌকি কোনো মূল্য আছে কিংবা নেই, এই বিষয়টি বিচার করা, আর এটাই দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন।’ এই ধরনের একটি প্রস্তাবনার কারণ, কামুর মতে, যখনই আমরা গভীরভাবে ভাবতে শুরু করি, যেমন দার্শনিকরা করে থাকেন, দেখতে পাই জীবনের আসলে কোনো অর্থ নেই এবং সেকারণেই আমরা বাধ্য হই ভাবতে আমরা এটি শেষ করে ফেলব কিনা, বা এর সাথে সব হিসাবনিকাশ চুকিয়ে ফেলব কিনা।

বরং এই চরম দাবি বা প্রস্তাবনাটির অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে আমাদের উচিত হবে কামুকে দর্শনের ইতিহাসের তার অবস্থানে বসাতে। তাঁর নাটকীয় ঘোষণা যে, আমাদের আত্মহত্যার কথা বিবেচনা করতে হবে, কারণ জীবন অর্থহীন মনে হতে পারে, এমন প্রস্তাবনাটি নির্ভর করে আছে সেই ধারণায় যে- জীবন আসলেই সমৃদ্ধ হতে পারে ঈশ্বরপ্রদত্ত অর্থময়তায়, যে ধারণাটি আজ আমাদের অনেকের কাছেই মনে হতে পারে বহুদূরবর্তী কোনো ধারণা। তারপরও যদি খুব ভালো করে লক্ষ্য করা যায় দেখা যাবে অন্তত পশ্চিমে গত দুই হাজার বছর ধরে, জীবনের অর্থময়তার ধারণাটির উৎস অন্য সবকিছুর চেয়ে একটি প্রতিষ্ঠান, খ্রিস্টীয় চার্চ। কামু বহু দার্শনিকদের সেই ধারাবাহিকতায় অবস্থান করছেন, কিয়ের্কেগার্ড থেকে নিচাহ থেকে হাইডেগার এবং সার্ত্রে, যারা প্রত্যেকেই মল্লযুদ্ধ করেছেন সেই অস্বস্তিকর উপলব্ধির সাথে যে, বাস্তবিকভাবেই জীবনের কোনো পূর্বনির্ধারিত অর্থ নেই। আমরা শুধুমাত্র জৈববৈজ্ঞানিক অণুসমষ্টি যারা অচেতনভাবেই ঘূর্ণায়মান নির্বিকার কোনো একটি মহাবিশ্বে ছোট একটি পাথরের টুকরোর উপর। আমাদের এখানে কোনো কল্যাণময় স্বর্গীয় সত্তা প্ৰতিস্থাপন করেননি এবং এমন কোনো নির্দেশও দেননি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে আমাদের মুক্তির জন্যে, যেমন, টেন কমান্ডমেন্ট, গসপেল কিংবা কোনো ধর্মগ্রন্থ। কোনো পথনির্দেশনা নেই এবং কোনো সুবিশাল উদ্দেশ্য নেই। আর এই উপলব্ধিটাই সেইসব দার্শনিকের বহুপ্রস্তাবিত সংকটের কেন্দ্রে অবস্থিত, যাদের আমরা এখন জানি অস্তিত্ববাদী বা Existentialists হিসাবে। নৈরাশ্যবাদী আধুনিকতার শিশু, কামু মেনে নিয়ে নিয়েছিলেন, এই সুবিশাল মহাবিশ্বের বৃহত্তর কাঠামোয় আমাদের সবার জীবনই অর্থহীন, তবে অন্য দার্শনিকদের ব্যতিক্রম, তিনি চূড়ান্ত আশাহীনতা অথবা নৈরাশ্যবাদকে সরাসরি প্রতিরোধ করেছিলেন তার লেখায়। তিনি যুক্তি দেন যে আমাদের সেই জ্ঞান নিয়েই বাঁচতে হবে যে আমাদের সব প্রচেষ্টাই নিষ্ফল, আমাদের জীবন খুব দ্রুত সবাই ভুলে যাবে এবং আমাদের প্রজাতি অংশোধনীয়ভাবে নীতিভ্রষ্ট, সহিংস এবং তাসত্ত্বেও তাদের সব সহ্য করে টিকে থাকতে হবে। কামু লিখেছিলেন, আমরা সিসিফাসের মতো, যে গ্রিক পুরাণের চরিত্রটিকে দেবতারা শাস্তি দিয়েছিলেন বড় একটি পাথরের টুকরো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রতিদিন ঠেলে উপরে তোলার জন্য, কিন্তু পাথরটি উপরের তোলার পর সেটি আবার গড়িয়ে নিচে পড়ত, সিসিফাসকে আবার সেটা ঠেলে উপরে ওঠাতে হতো, এভাবেই অনন্তকাল ধরে সে এই অর্থহীন পরিশ্রমের শাস্তি তে বন্দী। কিন্তু পরিশেষে, কামু প্রস্তাব করেন, আমরা যাই করি না কেন, আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে যতটুকু আমরা পারি। আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে অস্তিত্বের এই অর্থহীনতার প্রেক্ষাপটটিকে, এবং তারপর এই চিরন্তন আশাহীনতার সম্ভাবনাকে জয় করতে হবে। তাঁর সেই বিখ্যাত প্রস্তাবনা One must imagine Sisyphus happy বা আমাদের অবশ্যই কল্পনা করতে হবে যে সিসিফাস সুখী।

এখানেই আমরা কামুর মুগ্ধ করার ও প্ররোচনা দেবার অসাধারণ দিকটি অনুভব করতে পারি: কামু তাঁর নিজেকে এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চান সেইসব কারণগুলো, কেন জীবনকে সহ্য করা অর্থহীনতা নয়। এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি অসাধারণ তীব্রতা আর পাণ্ডিত্যের সাথে নানা বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন, সম্পর্ক, প্রকৃতি, খাদ্য এবং বন্ধুত্ব। জীবনে বেঁচে থাকার কারণ দেখানো পথপ্ৰদৰ্শক হিসাবে কামু চমৎকার। বহু দার্শনিক থেকেই কামু ভিন্ন ছিলেন এক্ষেত্রে। কামু ছিলেন সুদর্শন, খুব সফল ছিলেন নারীদের সাথে, তার জীবনের ১০ বছরে, বহু সম্পর্ক তার প্রমাণ। চমৎকার ফ্যাশনজ্ঞান ছিল তার, জেমস ডিন আর হামফ্রে বোগার্টের স্টাইলের একটি চমৎকার মিশ্রণ ছিলেন তিনি, সন্দেহ নেই কেন’ভোগ’ ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদে তাঁকে চেয়েছিল। কিন্তু কামুর জন্যে এইসব শুধুমাত্র খামখেয়ালিশখ ছিল না, কারণ তিনি সত্যিকারভাবে জীবনের অদ্ভুত দিকটি অনুধাবন করেছিলেন, হয়তো সেটি যে-কাউকে আশাহীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়, কিন্তু একই সাথে জীবনকে আরো বেশি তীব্রভাবে বাঁচতে বাধ্য করে। সেভাবে কামু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন নিজের কাছে, এবং গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন সাধারণ জীবনের আনন্দগুলোর কথা। তিনি বলেছিলেন তিনি তার দর্শনকে দেখেন a lucid invitation to live and to create, in the very midst of the desert বা এই মরুভূমির মধ্যে বেঁচে থাকা আর সৃষ্টি করার জন্য একটি সুস্পষ্ট আহ্বান হিসাবে।

তিনি সাধারণত্বের পক্ষে কথা বলেছিলেন, দর্শনে সাধারণত্বের সমর্থক সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার গভীর দর্শনের পাতার-পর-পাতা পড়ার পর, পাঠকরা সেইসব মুহূর্তে স্বস্তির শ্বাস ফেলেন যখন কামু সূর্যালোক, চুমু কিংবা নাচের প্রশংসা করেছেন। নাটক কিংবা থিয়েটারের সাথে জড়িত থাকা কামুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তার পছন্দ আসলে কী, ফুটবল নাকি থিয়েটার, কামু উত্তর দিয়েছিলেন, কোনো ইতস্ততা ছাড়া, ফুটবল। কামু স্থানীয় আলজিয়ার্স টিমে গোলকিপার হয়ে খেলেছেন, এছাড়া ইউনিভার্সিটির অ্যাথেলেটিক্স টিমেও ছিলেন। টিম স্পিরিট, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একটি সাধারণ উদ্দেশ্য, সবকিছু কামুকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল, ১৯৫০ এর দশকে যখন একটি ক্রীড়া ম্যাগাজিন সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ইউনিভার্সিটি ফুটবল টিমে তাঁর কাটানোর সময় নিয়ে, তিনি বলেছিলেন, ‘বহু বছর পর, যখন আমার অনেক কিছুই দেখা হয়ে গেছে, আর মানুষের নৈতিকতা ও কর্তব্য সম্বন্ধে আমি যা নিশ্চিতভাবে জানি, সেই সবকিছুর জন্য আমি ক্রীড়ার কাছে ঋণী।’ কামু সেইসব নৈতিকতার কথা বলেছিলেন যা তিনি তার প্রবন্ধগুলোয় সমর্থন করেছেন: বন্ধুর পাশে থাকা, খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব আর সাহসিকতাকে মূল্য দেয়া। কামু সূর্য ভালোবাসতেন, তার চমৎকার Summer in Algiers প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন পানি উষ্ণতা আর রমণীদের বাদামি শরীরের দৃশ্য তিনি উপভোগ করতেন, লিখেছিলেন, ‘২০০০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো, বেলাভূমিতে নগ্নশরীরের আবির্ভাব হয়েছে, ২০ শতাব্দী ধরে মানুষ ঔদ্ধত্য আর অকপটতাকে ভদ্রতা দেবার চেষ্টা করেছে, চামড়া আর মাংসর পরিমাণ কমিয়ে, পরিচ্ছদকে জটিল করে। আজ তরুণরা ভূমধ্যসাগরীয় বেলাভূমিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে পুনরাবৃত্তি করছে ডেলোসে সেই ক্রীড়াবিদদের ভঙ্গিমাগুলো।’ একধরনের নতুন পাগানিজমের সপক্ষেও তিনি কথা বলেছিলেন, তার ভিত্তি ছিল শরীরের তাৎক্ষণিক সুখ খোঁজা: ‘আমি চমৎকার দীর্ঘদেহী এক তরুণীর কথা মনে করতে পারি, যে সারা বিকেল জুড়েই নেচেছিল। তার আঁটোসাঁটো নীল জামার উপর পরা ছিল জেসমিনের মালা, সারা শরীর যার ঘামে সিক্ত। নাচের সময় মাথা পেছনে হেলিয়ে প্রাণখুলে সে হাসছিল, যখনই টেবিলের পাশ দিয়ে সে অতিক্রম করছিল, ফুল আর শরীরের একটি মিশ্র গন্ধ সে রেখে যাচ্ছিল।’ কামু প্ৰতিবাদ করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে যারা এইসব তুচ্ছ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন না বরং তাদের কামনা আরো মহতী কিছু, আরো বিশুদ্ধ: ‘যদি জীবনের বিরুদ্ধে কোনো পাপ থেকে থাকে, এটি হয়তো জীবনের হতাশার বিষয়টি নয়, বরং অন্য কোনো জীবনের আশা করা আর এই জীবনের মাহাত্ম্য থেকে পালিয়ে বেড়ানো।’ একটি চিঠিতে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘মানুষ আমাকে আকৃষ্ট করে যতক্ষণ অবধি তারা জীবনের ব্যাপারে আগ্রহী, সুখের জন্য উদগ্রীব। বহু কারণ আছে যার জন্যে মৃত্যুবরণ করা যুক্তিযুক্ত কিন্তু কোনোকিছু যুক্তিযুক্ত নয় যার জন্যে হত্যা করা যেতে পারে।’

তার জীবদ্দশায় কামু প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, কিন্তু প্যারিসে বুদ্ধিজীবী সমাজ তাকে গভীরভাবে সন্দেহ করতেন। কারণ তিনি কখনোই প্যারিসের সেই অভিজাতদের দলে ছিলেন না। তিনি ছিলেন কর্মজীবী pied-noir (শব্দটি বোঝায় এমন কেউ যার জন্ম আলজেরিয়ায়, তবে ইউরোপীয় তার বংশঐতিহ্যে), যিনি শৈশবেই যুদ্ধাহত বাবাকে হারিয়েছিলেন, মা জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন উচ্চবিত্তদের বাড়ি পরিষ্কার করে। সুতরাং ব্যাপারটা কাকতলীয় নয় যে, কামুর প্রিয় দার্শনিক ছিলেন মনতাইন, আরেকজন মাটির কাছাকাছি বাস করা নিরহংকার ফরাসি এবং এমন একজন যাকে আমরা ভালোবাসতে পারি তিনি যা লিখেছেন এবং তিনি যেমন ছিলেন উভয় কারণেই

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *