[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১৪. আজ সকালে ছিলুম মিদনাপুরে

আজ সকালে ছিলুম মিদনাপুরে, কাল দুপুরে চলে গেলুম ম্যাড্রাসে। এমনিতে শুনলে এমন কিছু আশ্চর্য মনে হয় না, কিন্তু এই মিদনাপুরের সঙ্গে মেদিনীপুরের কোনও সম্পর্ক নেই, আর ওই ম্যাড্রাস আমাদের ম্যাড্রাস থেকে প্রায় চোদ্দো-পনেরো হাজার মাইল দূরে।

ক্যানাডার ক্যালঘেরি শহরের একটা অঞ্চলের নাম মিদনাপুর। কেন ওই নাম তা কেউ জানে। খুব সরল অনুমান এই যে বাংলার মেদিনীপুর জেলা থেকে কোনও সাহেব কোনও সময়ে কানাডায় চলে গিয়ে বসতি নিয়েছিলেন, এবং মেদিনীপুরের প্রিয় স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য সেই নামটিই রেখেছেন।

এরকম নাম অনেক আছে।

এই বিশাল দেশে এসে মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গরা নিশ্চয়ই প্রথমে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। প্রায় কুমারী, উর্বর ভূমি, ভেষজ ও খনিজ সম্পদেও প্রকৃতি অকৃপণ। একটার পর একটা অঞ্চল দখল করতে-করতে এগিয়ে নাম রাখার ব্যাপারে অভিযাত্রীরা খুব সমস্যায় পড়েছিল। প্রথম অভিযাত্রীদল যত বেশি যোদ্ধা ছিল, তত কল্পনাশক্তি তাদের ছিল না। তাই জায়গার নাম রাখার ব্যাপারে তারা অনেকসময় পূর্ব পরিচিত নামের সঙ্গেই একটা করে নিউ জুড়ে নতুন উপনিবেশ বানিয়েছে। যেমন নিউ ইয়র্ক, নিউ ইংল্যান্ড, নিউ অর্লিয়েন্স, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ইত্যাদি। তারপর যার যা পরিচিত নাম এলোপাতাড়ি বসিয়ে দিয়েছে। দিল্লি-বোম্বাই কলিকাতা-মাদ্রাজ এর নামেও শহর আছে উত্তর আমেরিকায়। কলকাতা নামে একাধিক জায়গা এখানে আছে শুনেছি। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখিনি বা যাইনি। মাদ্রাজ দেখেছি। এমনকী মস্কো নামের একটা শহরের পাশ দিয়েও আমরা গেছি। সেই শহরটি আইডাহো আর ওয়াশিংটন রাজ্যের সীমানায়।

এরকম নতুন নাম এখনও হচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন কাগজে পড়লুম, আচার্য রজনীশ ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁর দলবল সমেত আমেরিকার উত্তর অঞ্চলে একটা কলোনি করেছেন। তার নাম হয়েছে রজনীশনগর। স্থানীয় লোকেরা অবশ্য এই নতুন নাম পত্তনে আপত্তি জানিয়েছে, কাগজে চিঠি লেখালেখি হচ্ছে যে আচার্য রজনীশ এবং তাঁর চ্যালারা ব্যভিচারী এবং কমুনিস্ট, সুতরাং তাদের কলোনিকে যেন শহরের মর্যাদা না দেওয়া হয়!

এডমান্টন থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে এসে থেমেছিলুম ক্যালঘেরিতে। দুশো মাইলের কিছু বেশিদূরত্ব, সে রাস্তা দীপকদা মেরে দিলেন পৌনে তিন ঘন্টায়।

দীপকদার দুখানা গাড়ির মধ্যে একটি ছোট্ট ছিমছাম, অন্যটি ঢাউস। এই দ্বিতীয় গাড়িটিই নেওয়া হয়েছে। এ গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস আছে। সামনের সিট অর্থাৎ ফার্স্ট ক্লাসে তিনজন বসতে পারে। সেকেন্ড ক্লাসে চারজন। আর থার্ড ক্লাসে মুখোমুখি দুসারি সিট, প্রয়োজনে সেগুলো তুলে দিলে দু-তিনজন বিছানা পেতে শুয়েও যেতে পারে।

অত যাত্রী নেই অবশ্য আমাদের। দীপকদা, জয়তীদি আর ওঁদের দুই মেয়ে জিয়া আর প্রিয়া। এ ছাড়া জয়তীদির মেজদি, শিবাজি রায় নামে আর একজন যুবক আর আমি তো আছিই।

ক্যালঘেরিতে একদিন থামা হল। কারণ এখানে মেজদির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী থাকেন একজন। কলকাতায় যিনি এষা মুখার্জি নামে খ্যাতনাম্নী ছিলেন, তিনি এখানে এসে হয়েছেন এষা চৌধুরি। এষা দেবীর মুখ দিয়ে সর্বক্ষণ কথার ফুলঝুরি ছোটে আর সর্বক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তা শুনতে ইচ্ছে করে। মেয়েদের মধ্যে এরকম ‘কথাশিল্পী’ কদাচিৎ দেখা যায়। ওঁর স্বামী শ্যামলবাবু মৃদুভাষী কিন্তু সুরসিক। মাঝে-মাঝে টুকটুক করে এক আধটা মন্তব্য ছাড়েন। বান্ধবীকে পেয়ে এষা চৌধুরি দারুণ খুশি হয়ে হইচই এবং পার্টি লাগিয়ে দিলেন। সেই সুবাদে আমরাও বেশ খাতির যত্ন পেলুম।

ক্যালঘেরি শহরটি অতি মনোরম। পেট্রোলিয়ামের কল্যাণে দিন-দিন শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে, এবং অদূর ভবিষ্যতে এখানে অলিম্পিক সংঘটনের জন্য শহরটি তৈরি হচ্ছে।

ক্যালঘেরি টাওয়ার একটি বিশাল উঁচু ব্যাপার, যার ওপরে উঠলে পুরো শহরটি দেখা যায়। এ শহরেও সত্তর-আশিতলা বাড়ির অভাব নেই। টাওয়ারটি তার চেয়েও উঁচু, এবং চূড়ায় যে রেস্তোরাঁটি রয়েছে, সেটি আস্তে-আস্তে ঘোরে। অর্থাৎ এক জায়গায় টেবিল নিয়ে বসে খাবার খেতে-খেতেই আমরা পুরো শহরের দৃশ্যপটটি উপভোগ করতে পারলুম।

এষা দেবী এত হাসিখুশি মানুষ, তবু মাঝে-মাঝে তাঁর খুব মন খারাপ হয়। এখানে মন টিকছে না। দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। আমাদের দেখে যেন দেশের জন্য আরও উতলা হয়ে উঠলেন। কিন্তু দেশে ফেরার অনেক বাস্তব অসুবিধে আছে। শ্যামলবাবু যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, সে ব্যাপারের উপযুক্ত চাকরি আমাদের দেশে বেশি নেই।

এষাকে আমাদের কলকাতার এক বিখ্যাত মহিলা নাকি বলে দিয়েছিলেন, দ্যাখ, যখন খুব মন খারাপ হবে, তখন রেফ্রিজারেটারের দরজা খুলে ভেতরটাতে তাকিয়ে থাকবি। ওসব তো আর দেশে ফিরে গেলে পাবি না। খুব ন্যায্য কথা। ওরকম খাঁটি দুধ, পাঁচ রকমের মাংস, পনেরো রকমের কেক প্যাসট্রি ইত্যাদি যা সব সময় সবার বাড়িতে মজুত থাকে, তা কলকাতায় পাওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না।

কিন্তু আমি ভাবলুম, উপনিষদের মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্যকে জিগ্যেস করেছিলেন, যা নিয়ে আমি অমৃত হব না, তা নিয়ে আমি কী করব! আর কলকাতার মৈত্রেয়ী কি না বললেন, খাবারদাবারের কথা? কালের কী বিচিত্র গতি! অবশ্য, ইস্কুল-কলেজের ‘এসে’-তে ছেলেমেয়েরা অনেকেই মৈত্রেয়ীর ওই উক্তির কোটেশন দেয় বটে, কিন্তু মৈত্রেয়ীর ওই আদিখ্যেতার কথা শুনে যাজ্ঞবল্ক্য তার উত্তরে যে কী রকম কড়কে দিয়েছিলেন, তা অনেকেই জানে না। জানাবার দায়িত্বও আমার নয়। সুতরাং একালের মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবল্ক্য-এর মতন সঠিক জ্ঞানের কথাই বলেছেন বটে। রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন, ‘জেনো, বাসনার সেরা বাসারসনায়’!

ক্যালঘেরি থেকে বেরুবার পরই আমাদের সত্যিকারের যাত্রা শুরু হল। বলতে গেলে নিরুদ্দেশ যাত্রা।

আমাদের শেষ পর্যন্ত একটা লক্ষ্যস্থল আছে বটে, কিন্তু কোন পথে কিংবা কবে সেখানে পৌঁছব, তার ঠিক নেই। অনেকগুলো ম্যাপ সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। নেভিগেটারের দায়িত্ব প্রথমে শিবাজি রায় নিয়েছিলেন যদিও, কিন্তু একদিন পরেই আমরা সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে পদচ্যুত করলুম, সে দায়িত্ব নিলেন জয়তীদি। তাঁর যেমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তেমনি চোখ সজাগ। এসব রাস্তায় একবার ডানদিক বা বাঁদিক ঘুরতে ভুল করলেই পঞ্চাশ-একশো মাইল ঘোরপথের ধাক্কা। নেভিগেটার হওয়ার বদলে শিবাজি রায় মজার কথা বলে আমাদের আনন্দ দেওয়ার ভার নিলেন। আমার ওপর ভার রইল, যথা সময়ে কফি কিংবা আপেল খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া আর মেজদির চশমা খোঁজার। চলন্ত গাড়িতেও সেই মহিলা ঘন্টায় দু-বার করে চশমা হারাতে লাগলেন।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার নাম বাল্যকালে ভূগোলে পড়েছি শুধু। সেই রাজ্য ধরে এখন চলেছে আমাদের গাড়ি। পথের দু-পাশে জঙ্গলময় পাহাড়। এগুলোই বোধহয় রকি মাউন্টেনস। এদিকে জনবসতি খুবই কম। তবে আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা পরপরই এসে যাবে গ্যাস স্টেশন, খাবার জায়গা, রাত্রি বাসের জন্য মোটেল।

পথ দিয়ে যেতে-যেতেই রাস্তার দুধারে অনবরত নির্দেশ দেখা যাবে, আর কত মাইল দূরে গ্যাস স্টেশন। সেখানে কী কী সুযোগ-সুবিধে আছে। মোটেল আছে কি না। এদেশের রাস্তাটাই যেন একটা শিল্প। এই শিল্পকে নিখুঁত করার জন্য এদের যত্নের অন্ত নেই।

আরও একটা চমৎকার জিনিস আছে রাস্তার ধারে-ধারে। তার নাম রেস্ট এরিয়া। গাড়ি চালাতে-চালাতে যদি কখনও ক্লান্তি বা একঘেয়েমি আসে তার জন্য এই বিশ্রামের ব্যবস্থা রয়েছে। তরু ছায়াময় একটি চমৎকার নিরিবিলি জায়গা, সেখানে রয়েছে বসার জায়গা, পানীয় জল, বাথরুম, আর টেলিফোনের ব্যবস্থা। সবই বিনা পয়সায়। গাড়ি থামিয়ে সেখানে যতক্ষণ খুশি আলস্য করা যায়। সঙ্গের খাবারদাবার খেয়ে নেওয়া যায়। এই জায়গাগুলিকে দেখলে আমার ঠিক মরুদ্যানের কথা মনে হয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল অন্তর-অন্তর এরকম একটি করে মরুদ্যান। এখানকার গাছগুলো অধিকাংশ ইউক্যালিপটাস, তাই বাতাসে চমৎকার সুগন্ধ।

সঙ্গে খাবার থাক বা না-ই থাক, খিদে বা তেষ্টা পেলে পছন্দমতো খাবার জায়গা পেতে একটুও অসুবিধে নেই। পকেটের উত্তাপ অনুযায়ী নানা রকম পান-ভোজনালয়। যার পকেট গরম সে যদি ওয়াইন বা বিয়ার সহযোগে পাঁচ-সাত কোর্সের লাঞ্চ-ডিনার খেতে চায়, তারও ব্যবস্থা আছে। আবার সস্তায় চট করে কিছু একটা খেয়ে নেওয়ার জায়গাও অসংখ্য। সস্তায় সবচেয়ে ভালো খাবারের দোকানের রাজা হল ম্যাকডোনাল্ড। এদের দোকানের সংখ্যা যে কত লক্ষ তা বলা আমার পক্ষে অসাধ্য। যেকোনও ছোট শহরেই একটা করে ম্যাকডোনাল্ড। আর আশ্চর্য ব্যাপার, এদের সব দোকানেই এদের খাবার একই রকমের ভালো, আর দামও এক। সুরা বা মদিরা বিক্রি করে না এরা, এদের মতন চমৎকার আলুভাজা ও কফি পাঁচতারার হোটেলগুলোও দিতে পারে না, আর এদের হামবার্গারের স্বাদ তো জগৎ বিখ্যাত। এদের সব দোকানই দারুণ খোলামেলা, বাইরে ভেতরে প্রচুর বসবার জায়গা, সেই রকমই পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে, তকতকে। কাউন্টার থেকে নিজেদেরই খাবার আনতে হয়। এঁটো গেলাস-প্লেট খরিদ্দাররা নিজেরাই যথাস্থানে রেখে দিয়ে আসে। ম্যাকডোনাল্ডের তুল্য সস্তা, বিশুদ্ধ ও সুস্বাদু খাবারের দোকান আমাদের সারা দেশে একটাও নেই। এদেশে ম্যাকডোনাল্ড তো কয়েক লক্ষ বটেই, তা ছাড়াও ওদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ‘বার্গার কিং’ বা ওই জাতীয় নামের আরও অন্যান্য কোম্পানির দোকান আরও কয়েক লক্ষ।

ব্রিটিশ কলম্বিয়া ছেড়ে আমরা ওয়াশিংটন প্রদেশের সীমানা দিয়ে ঢুকে পড়লুম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

এখানকার চেক পোস্টে ইমগ্রেশন অফিসারটির বয়েস বাইশ-তেইশ বছরের বেশি নয়। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা হলেও মুখখানা একেবারে বালকের মতন। প্রথমে সে মন দিয়ে আমাদের ভিসা ইত্যাদি পরীক্ষা করল, তারপর সন্তুষ্ট হতেই সে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাদের সঙ্গে খুব আন্তরিক ব্যবহার করতে লাগল। কোন রাস্তা দিয়ে গেলে আমাদের পথ সংক্ষিপ্ত হবে, কোথায় রাত কাটানো বেশি আরামদায়ক, আর ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢোকবার সময় গাড়িতে কিন্তু আপেল-টাপেল জাতীয় কোনও ফল রেখো না, জানো তো মেড ফ্লাই (ভূমধ্যসাগরের মাছি) নিয়ে ওখানে কত ঝামেলা হচ্ছে। আমাদের গাড়ি ছাড়ার সময় সে হাতছানি দিয়ে আমাদের বিদায় জানাল পর্যন্ত। কোনও বিমানবন্দরে আমরা কক্ষনো এরকম ভালো ব্যবহার পাই না। বিমান বন্দরের অফিসাররা যেন মানুষ নয়, সবাই এক-একটি যন্ত্র।

আমেরিকা ও কানাডার প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রথম-প্রথম এক রকম হলেও আমেরিকার ধরন ধারণই যেন একটু আলাদা মনে হয়। রাস্তার নিয়মকানুনের বেশ কড়াকড়ি। এখানকার হাইওয়েতে গতি সীমা পঞ্চান্ন মাইল মাত্র, সেটা সত্যি দুঃখের ব্যাপার। এখানকার গাড়িগুলো অশ্বশক্তির বদলে যেন বাঘ-শক্তিতে চলে, ঘন্টায় একশো কুড়ি কী দেড়শো মাইল বেমালুম চলে যেতে পারে, সেই সব গাড়িকে পঞ্চান্ন মাইলের বল্লায় বেঁধে রাখার কোনও মানে হয়! এক দশক আগেও মার্কিন দেশের গাড়ি গড়ে সত্তর থেকে নব্বই মাইল গতিতে চলত। কিন্তু মাঝখানে একবার তেল সংকটের সময় নাকি হিসেব করে দেখা হয়েছে যে, পঞ্চান্ন মাইল গতিতে চললেই গাড়ির তেল সবচেয়ে কম খরচ হয়। তা ছাড়া দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কম।

গতিসীমা ভঙ্গ করলেই ফ্যাসাদ। জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল থেকে কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। মোড়ে-মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ থাকে না বটে কিন্তু হেলিকপ্টার, এরোপ্লেনে উড়ে-উড়ে পুলিশ রাস্তার গাড়ির গতি মাপে। তা ছাড়া আছে র‍্যাডার যন্ত্র। এবং ভ্রাম্যমাণ পুলিশের গাড়িতে আছেই। নির্জন রাস্তায় ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে মোটরবাইক চেপে লুকিয়ে থাকে পুলিশ, কোনও গাড়ি একটু নিরিবিলি দেখে নিয়মভঙ্গ করলেই এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরবে।

গাড়ি চালাবার সময় মদ্যপান নিষিদ্ধ। এমনকী গাড়িতে ছিপিখোলা কোনও মদের বোতল রাখাও অপরাধ। যখন তখন পুলিশ এসে গাড়ি থামিয়ে চেক করতে পারে। আগে থেকে মদ খাওয়া থাকলেও তিন পেগের বেশি হলেই ব্রিদালাইজার পরীক্ষায় ধরা পড়ে যাবে।

দীপকদা এই প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প শোনালেন।

একবার তিনি এক পার্টি থেকে তাঁর এক বন্ধুর গাড়িতে ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন বন্ধুর স্ত্রী। মধ্যরাত্রি পেরিয়ে গেছে। বন্ধুটি বেশ খানিকটা হুইস্কি পান করলেও বেপরোয়াভাবে ধরেছিলেন গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল, ভেবেছিলেন ঠিক বাড়ি পৌঁছে যাবেন। গাড়িটা মাঝে-মাঝে দু-একবার লগবগ করতেই হঠাৎ কোথা থেকে একটা পুলিশের গাড়ি প্যাঁ-পোঁ করতে-করতে এসে ধরে পড়ল। একেবারে শেষ মুহূর্তে গাড়ি থামিয়ে বন্ধুটি বুদ্ধি খাঁটিয়ে চট করে নিজে স্টিয়ারিং থেকে সরে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে বসিয়ে দিলেন সেই জায়গায়। যেন উনিই চালাচ্ছিলেন গাড়ি। ভদ্রমহিলার পায়ে তখন জুতো নেই, উনি গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছিলেন একটু আগে। সেই অবস্থাতেই কোনওক্রমে সামনে সপ্রতিভ হয়ে বসলেন।

পুলিশ ভদ্রমহিলাকে বললেন, নেমে এসো! তুমি বদ্ধ মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছ!

ভদ্রমহিলা বললেন, বাজে কথা! আমি এক ফোঁটা খাইনি।

পুলিশ বলল, বটে! এই রাস্তার মাঝখানের লাইন দিয়ে একশো গজ সোজা হেঁটে দেখাও তো!

ভদ্রমহিলা দিব্যি একশো গজ সোজা হেঁটে দেখিয়ে দিলেন।

তখন সেই পুলিশ অফিসার তার টুপি ছুঁয়ে বললেন, লেডি, তুমি একটু আগে যেরকম গাড়ি চালাচ্ছিলে, তাতে আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি তুমি অন্তত দশ পেগ খেয়েছ। কিন্তু তোমার সহ্য করার ক্ষমতা আছে বটে। বাপস! তোমার ক্ষুরে-ক্ষুরে দণ্ডবৎ!

তারপর পুলিশটি ভদ্রমহিলার মটকা-মারা স্বামীকে ডেকে বলল, এই, তোমার লাইসেন্স আছে? দয়া করে তুমি তোমার এই ভয়ংকরী স্ত্রীটির বদলে নিজে গাড়ি চালাও!

গল্পটা শুনে আমরা হেসে উঠলুম। তারপর আমি জিগ্যেস করলুম, দীপকদা, গল্পটা তো খুব আপনার এক বন্ধুর নামে চালালেন। আসলে নিশ্চয়ই আপনার আর জয়তীদির অভিজ্ঞতা?

জয়তীদি হাসতে-হাসতে বললেন, না, তখন আমি ছিলুম না, তার মানে তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। সেই আমলে ও-ও মাঝে-মাঝে হুইস্কিতে টইটম্বুর হত নিশ্চয়ই। নইলে বন্ধুর বদলে ও নিজে সেদিন গাড়ি চালায়নি কেন?

সত্যি এখানকার পুলিশের গাড়ি দেখলেই গা ছমছম করে। গাড়ির মাথায় লাল-নীল আলো সব সময় ঘোরে, আর পুলিশের গাড়ি যখন কারুকে তাড়া করে তখন এক সঙ্গে অনেকগুলো শিয়ালের ডাকের মতন শব্দ হয়। আর কী স্মার্ট চেহারা ও পোশাক এখানকার পুলিশদের, যেন আইন ভঙ্গকারীদের ধরাই ওদের ধ্যান জ্ঞান।

আমেরিকার রাজপথের প্যাট্রোল পুলিশকে কেউ কোনওদিন ঘুষ দিতে পেরেছে এমন কথা শুনিনি।

হয়তো আমরা কখনও অপূর্বসুন্দর এক হ্রদের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, অন্য পাশে নানা রঙের গাছের সারি, হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি যেতেই আমরা শিউরে উঠি। দৃশ্য উপভোগ করার বাসনা মাথায় উঠে যায়। যেন আমরা অপরাধী। এখানকার পুলিশদের অসীম ক্ষমতা, যেকোনও ছোট জায়গার শেরিফ ইচ্ছে করলেই আমাদের বিনা বিচারে জেলে ভরে দিতে পারে।

দীপকদা একটু হাত খুললেই আমাদের গাড়িটা একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন বটে কিন্তু অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পঞ্চান্ন মাইলেই চালাচ্ছেন।

কিছু একটা হিসেবের ভুলে আমরা চলে গেলুম আইডাহো প্রদেশে। এখানে তো আমাদের যাওয়ার কথা নয়। আমাদের পথ তো অরিগন রাজ্য দিয়ে, সেখানে স্পোকেন নামে মোটামুটি একটা বড় জায়গায় আমরা রাত কাটাব ঠিক করেছি।

আইডাহো একটা পাণ্ডব বর্জিত দেশ বললেই হয়। শহর যেন নেই, শত-শত মাইল ফাঁকা জায়গা। সন্ধের পর গা ছমছম করে। সবাই ঝুঁকে পড়ে ম্যাপ দেখতে লাগলুম, এ জায়গা ছেড়ে আমাদের অরিগনে ঢুকতেই হবে।

অন্যমনস্কভাবে দীপকদা বুঝি অ্যাকসিলারেটারে একটু জোরে চাপ দিয়ে ফেলেছিলেন, হঠাৎ দেখি মোড়ের মাথায় আলো জ্বেলে পুলিশের গাড়ি অপেক্ষা করছে আর আমাদের থামতে ইঙ্গিত করছে।

থামতে আমরা বাধ্য। বুক দুপদুপ করছে। সবাইকে জেলে পাঠাবে? দীপকদার লাইসেন্স কেড়ে নেবে?

পুলিশ অফিসারটি বলল, তোমরা বাষট্টি মাইল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলে।

দীপকদা কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, হয়তো!

পুলিশটি বলল, হয় তো নয়, সত্যি।

তারপর গাড়ির মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল আমাদের। খুব সম্ভবত ভারতীয় নারীদের দেখেই মন গলে গেল তার। সে বলল, ঠিক আছে এই তোমাদের ফার্স্ট ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিলুম, আর এরকম কোরো না!