[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

২১. ওখরিড নামে সুবৃহৎ হ্রদ

ওখরিড নামে যে একটি সুবৃহৎ হ্রদ আছে কোথাও তা আমার জানা ছিল না। আমার বাড়িতে যে অ্যাটলাস আছে, তাতে স্টুগা নামে কোনও শহরের নাম তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাওয়া গেল না। ম্যাসিডোনিয়ার কথা আমি পড়েছি ইতিহাসে, ভূগোলে নয়। ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপের ছেলে দুঃসাহসী আলেকজান্ডার দিকবিজয় করতে-করতে ভারতের সিন্ধু নদীর পারে এসে থেমেছিলেন। সেই ম্যাসিডোনিয়া যে এখন আধুনিক যুগোশ্লাভিয়ার একটি রিপাবলিক, সরলভবে সত্যি কথাটা স্বীকার করছি, তা আমি জানতুম না আগে।

সেই ম্যাসিডোনিয়ার ওখরিড হ্রদের তীরে স্টুগা নামে অতি ছোট্ট একটি শহরের কবি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম হঠাৎ। সেখানকার বাৎসরিক কবি সম্মেলনের পঁচিশ বছর পূর্তি হচ্ছে, সেই উপলক্ষে পৃথিবীর বহু দেশের কবিদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সম্মেলনের উদ্যোক্তারা দেবেন আতিথেয়তা, ভারত সরকারের সংস্কৃতি সম্বন্ধ পরিষদ (আই সি সি আর) স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রস্তাব পাঠালেন আমার বিমান ভাড়া দেওয়ার।

এই সময় আমার খুব কাজের চাপ। কয়েকদিন আগেই বিদেশ থেকে ফিরেছি, কয়েক মাস পরেই আবার বিশ্ব বইমেলায় যোগদানের কথা আছে, এর মাঝখানে শারদীয় সংখ্যার লেখাটেখা শেষ করতে হবে। কিন্তু ভ্রমণের কথা উঠলেই আমার পায়ের তলা সুড়সুড় করে, তা ছাড়া ম্যাসিডোনিয়া নামটির রোমাঞ্চ অনুভব করি শরীরে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও যে যুগোশ্লাভিয়া জোট-নিরপেক্ষ হয়ে আছে, সেই দেশটি চাক্ষুষ দেখার আগ্রহও ছিল অনেকদিন ধরে। সুতরাং সাগরদা-নীরেনদা-রমাপদ চোধুরী-সেবাব্রত গুপ্ত প্রমুখ বাঘা বাঘা সম্পাদকদের উষ্ম ও রক্তচক্ষুর সম্ভাবনা সত্বেও রাজি হয়ে গেলুম এককথায়।

সুতরাং অগাস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আবার আকাশযাত্রা। যেতে হবে বেশ কয়েকবার বিমান বদল করে। বারবার নামা-ওঠা, এক একটা বিমানবন্দরে কয়েক ঘণ্টা করে অপেক্ষা বেশ বিরক্তিকর, কিন্তু নতুন দেশ দেখার আনন্দে তা সহ্য করা যায়। কলকাতা থেকে বোম্বাই তারপর বিরাট এক লাফে জুরিখ, সেখান থেকে বেলগ্রেড। আপাতত বেলগ্রেডে রাত্রিযাপন। বিমান কোম্পানিই সেখান হোটেল ঠিক করে রেখেছে।

বেলগ্রেডের আসল নাম বেওগ্রাড। খুবই প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর। এই শহরটিকে বলা যায় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মাঝখানের দরজা। কত যে যুদ্ধ, ধ্বংস ও রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটেছে এখানে তার ইয়ত্তা নেই। বিকেলবেলা পৌঁছে পরেরদিন সকালের মধ্যে, একা একা, এই শহর ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে না, কিন্তু একটা জিনিস দেখবই, তা আগে থেকেই ঠিক করে এসেছি। কোনও নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার নদী না দেখলে আমার মন আনচান করে। বেলগ্রেডের পাশ দিয়ে গেছে একটা নয়, দু-দুটো নদী। একটির নাম সাভা, আমাদের কাছে তেমন পরিচিত নয়। কিন্তু অন্যটি হল ইউরোপের প্রধান নদী দ্যানিয়ুব। এই শহরেরই এক প্রান্তে ওই দুই নদীর সঙ্গমস্থল।

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সমাজতান্ত্রিক দেশে রাত্তিরবেলাও একলা একলা নির্ভয়ে চলাফেরা করা যায়। রাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু কেউ অন্ধকারে ছুরি দেখাবে না। পকেটে পয়সা-কড়ি কম, ট্যাক্সি চড়ার বিলাসিতা মনেও আসে না। তবে এই শহরে ট্রাম চলে। ট্রামে চেপে, লোকজনকে জিগ্যেস করতে-করতে পৌঁছে গেলুম আমার অভীষ্ট স্থলে। দ্যানিয়ুবের তীরে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলুম বুদ্যানিয়ুবের স্বর্গীয় মূৰ্ছনা।

যুগোশ্লাভিয়ার ম্যাপে, এমনকী ম্যাসিডোনিয়ার ম্যাপেও স্টুগা শহরের নাম নেই। যেমন ভারতবর্ষের, এমনকী পশ্চিমবাংলার মানচিত্রেও চম্পাহাটি বা কৈখালির নাম পাওয়া যাবে না। এত ছোট শহরে এরকম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকা প্রথমে বিস্ময়কর মনে হলেও পরে বুঝতে পারলুম, এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমাদের সব কিছুই রাজধানীতে হয়, তার ফলে ছোট ছোট শহরগুলির মানুষরা আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে বিপুল বিশ্বের স্বাদ পায় না কখনও। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে তাদেরও কি সমান অধিকার নেই? রাজধানীর মানুষদের তুলনায় তারা অনেক কিছু থেকে কেন বঞ্চিত থাকবে?

ইংরিজি বানানে OHRID, উচ্চারণে ওখরিড নামে বিশাল হ্রদটির গায়ে এই স্টুগা শহর। জায়গাটি বড় সুন্দর। যেদিকেই তাকাও, বড় বড় পাহাড়ের গা। হ্রদের জল স্বচ্ছ নীল। বাড়িগুলির সামনে আপেল-ন্যাশপাতির বাগান। স্বাস্থ্যকর জায়গা হিসেবে খ্যাতি আছে বলে ইউরোপের অনেক ভ্রমণকারী আসে এখানে, তাই কয়েকটি বেশ বড় বড় হোটেল আছে। সুতরাং এতগুলি অতিথির স্থান সঙ্কুলানের অসুবিধে নেই।

হোটেলে ঘর পাওয়ার পর অনুষ্ঠানসূচিতে চোখ বোলালুম। বাইরের চল্লিশটি দেশ থেকে আশিজন কবিকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে, এ ছাড়া রয়েছে যুগোশ্লাভিয়ার কবিরা। ভারতীয় হিসেবে নাম রয়েছে তিনজন, অন্য দুজন হলেন সচ্চিদানন্দ বাৎসায়ন–অজ্ঞেয় এবং এল এল মেহোত্রা। অজ্ঞেয় হিন্দি ভাষায় প্রবীণ কবি, তাঁর কথা জানি, কিন্তু মেহোত্রার নাম আমি আগে কখনও শুনিনি। পরে জানলুম, এই মেহোত্রা যুগোশ্লাভিয়ায় আমাদের রাষ্ট্রদূত। বিকেলবেলা দেখা হল তাঁর সঙ্গে। অজ্ঞেয়জি তখনও এসে পৌঁছোননি, পরদিন আসবার কথা।

অন্যান্য দেশের কবিদের তালিকায় বেশ কয়েকটি নাম আমার পূর্ব পরিচিত, অন্যান্য সম্মেলনে দেখা হয়েছে, বিশেষত বেলজিয়ামের কাব্য-উৎসবে। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন আলাউদ্দিন আল-আজাদ, এঁর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না, আসবার পথে বিমানেই আলাপ হয়েছে। আমেরিকা থেকে এসেছেন পাঁচ জন, রাশিয়া থেকে দুজন। এই দুদেশের তালিকায় রয়েছে দুজন বিশ্ববিখ্যাত কবির নাম, অ্যালেন গিনসবার্গ এবং আন্দ্রেজ ভজনেসেনস্কি। এই দুজনকে ঘিরেই বেশি লোকের কৌতূহল।

গোটা ম্যাসিডোনিয়ার জনসংখ্যাই সাড়ে উনিশ লাখ, কলকাতার অর্ধেকও নয়। স্টুগা শহরের জনসংখ্যা দশ-পনেরো হাজার হবে। তবু এই পুঁচকে শহরে আছে একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক কবিতা-ভবন ও সংগ্রহশালা। সেখানে রক্ষিত আছে পৃথিবীর বহু ভাষার কবিতার বই, কবিদের ছবি ও পাণ্ডুলিপি। এ ছাড়া রয়েছে আর একটি কবিতা-কেন্দ্র। যেটি স্থানীয় কবিদের জন্য। যুগোশ্লাভিয়ার প্রধান ভাষা সার্বোক্রোয়াশিয়ান। কিন্তু তার চাপে ম্যাসিডোনিয়ান ভাষা যাতে হারিয়ে না যায়, সেইজন্য ম্যাসিডোনিয়ান ভাষার উন্নতির খুব চেষ্টা হচ্ছে। গোটা কবি সম্মেলনের সমস্ত কাজকর্ম চলল ওই ভাষায়। আমার ধারণা হল, এখানে এই আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনের উদ্যোগের অন্যতম কারণ, বিশ্বের লোকেরা জানুক, ম্যাসিডোনিয়ার একটি নিজস্ব ভাষা আছে।

কবিতা-ভবনের চূড়ায় একটি বিশাল আলো জ্বালিয়ে হল সম্মেলনের উদ্বোধন। সামনেই একটি ছোট নদী। কবিতা শুনতে সারা শহরের লোকই চলে এসেছে, সম্ভবত এটাই এই শহরের প্রধান বার্ষিক উৎসব। প্রত্যেক বছর এই উৎসবে একজন কবিকে প্রধান কবির সম্মান-পুরস্কার দেওয়া হয়। সোভিয়েত দেশের জনপ্রিয় কবি আন্দ্রেজ ভজনেসনস্কি এই পুরস্কার পেয়েছেন কয়েক বছর আগে, আমাদের অজ্ঞেয়জিও পেয়েছেন গত বছর, এ বছর পাচ্ছেন অ্যালেন গিনসবার্গ।

প্রতিদিন কবিতা পাঠের আসর দুবার। সন্ধ্যায় ও মধ্যরাত্রে। এ দেশের সন্ধ্যা শুরু হয় আটটার পর, শ্রোতারা খাওয়াদাওয়া করে আসে। যেহেতু কবিদের সংখ্যা অনেক, তাই প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের কবিদের ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সবাই একটি করে কবিতা পড়বেন। আর একটি অনুষ্ঠান মধ্যরাত্রি থেকে শুরু, তাতে যার যত খুশি কবিতা পড়তে পারেন, সারা রাত চললেও ক্ষতি নেই। দর্শক-শ্রোতারা অধৈর্য না হলেই হল। শ্রোতাদের রাত দুটো তিনটেয় বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িঘোড়া পাওয়ার চিন্তা নেই। যে-যার হেঁটেই বাড়ি ফিরতে পারে। এ ছাড়া অনেকেরই নিজস্ব গাড়ি আছে। এই গ্রাম-প্রতিম ছোট শহরেও ইচ্ছে করলে সারা রাত ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

খুব সম্ভবত স্বাস্থ্যের কারণেই অজ্ঞেয়জি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলেন না। স্থানীয় উদ্যোক্তারা অনেকেই তাঁর খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। রাষ্ট্রদূত মেহোত্রা একদিন থেকেই ফিরে গেলেন। সুতরাং ভারতীয় বলতে একা আমি। এত বড় রাষ্ট্রের ভার কি একা আমার ঘাড়ে সামলাতে পারি? তার জন্য অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। তৃতীয়দিন সকালে আমি সবেমাত্র ঘুম চোখে নিজের ঘর থেকে নেমে এসে হোটেলের ডাইনিং রুমে চা খেতে এসেছি। অর্ডার দেওয়া হয়েছে, তখনও চা আসেনি। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আর যত গুণই থাক, হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবারদাবার পেতে বড্ড দেরি হয়। যেহেতু সমস্ত হোটেলই সরকারি, তাই পরিচালকদের ব্যবহার অবিকল সরকারি কর্মচারিদের মতনই তাঁরা আস্তে হাঁটেন, অনেক কথা কানে শুনতে পান না। এখানে আবার ইংরিজিও বোঝেন না।

চায়ের প্রত্যাশায় বসে আছি, এমন সময় উদ্যোক্তাদের একজন প্রতিনিধি ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে বললেন, সেদিন প্রভাতী অনুষ্ঠানে কয়েকটি দেশের নামে গাছ পোঁতা হবে। ভারতবর্ষের নামের গাছটির গোড়ায় মাটি ঢালতে হবে আমাকে।

আমি বললুম, ঠিক আছে, চা-টা খেয়ে নিই?

প্রতিনিধি বললেন, কিন্তু সবাই তৈরি হয়ে আছে। আপনার জন্য শুরু করা যাচ্ছে না, অনুগ্রহ করে এক্ষুনি চলুন।

ভদ্রলোকের চোখমুখ দেখে মনে হল, ওঁর ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটা ঠিকঠাক পালিত না হলে উনি ওপরওয়ালার কাছ থেকে বকুনি খাবেন।

আমি বললুম, তা বলে, এক কাপ চা খাওয়ারও সময় হবে না?

উনি বললেন, তাহলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে।

অর্থাৎ উনিও জানেন যে আশু চা পাওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আমাকে উঠে পড়তেই হল।

আমাদের হোটেল থেকে মাইলদেড়েক দূরে একটি উদ্যানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কবিতার উদ্যান’। সেখানে প্রতি বছরই কিছু কিছু কবিকে নিয়ে গাছ পোঁতানো হয়। অজ্ঞেয়জি এলে প্রবীণ ও খ্যাতিমান হিসেবে এ কাজটি নিশ্চয়ই তাঁকেই করতে হত। সকালবেলা প্রথম কাপ চা পানের আগে আমার মেজাজ খোলে না। তা ছাড়া আগেরদিন একটা ভারী সুটকেস তুলতে গিয়ে আমার ডান হাতে হঠাৎ ব্যথা লেগেছে।

চারা গাছ নয়, মাঝারি আকারের একটি পাইন গাছ অন্য জায়গা থেকে এনে লাগানো হচ্ছে, সুতরাং অনেকখানি মাটি দিতে হবে। আমি মনে-মনে ভাবছি, গাছ পোঁতার জন্য এত আদিখ্যেতার কী দরকার। আমি এক চামচে মাটি ফেলার পর বাকি কাজটা তো বাগানের মালিরা করে দিলেই পারে। তা নয় পুরোটাই করতে হবে আমাকে, ভারী কোদালটা তুলতে হাত টনটন করছে আমার। কিন্তু মুখ বিকৃত করা উপায় নেই, হাসি হাসি মুখ করে থাকতে হবে। কারণ টি.ভি-র জন্য ছবি তোলা হচ্ছে। অজ্ঞেয়জি না এসে কী বিপদেই ফেললেন আমাকে!

এই অনুষ্ঠান শেষে অ্যালেন গিনসবার্গ আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, সুনীল, কী আশ্চর্য আবার এত তাড়াতাড়ি তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

আমি বললুম, তুমি পুরস্কার পেয়েছ, সেজন্য তোমাকে অভিনন্দন, অ্যালেন! আজকাল বড় বড় প্রতিষ্ঠান তোমাকে পুরস্কার দিচ্ছে।

অ্যালেন হেসে বলল, মায়া! সবই মায়া!

আমি বললুম, কাল সন্ধেবেলা থেকে তোমাকে দূর থেকে দেখছি। কত লোকের সঙ্গে তুমি অনবরত কথা বলে যাচ্ছ। খুব ব্যস্ত। সব লোকের সঙ্গে তুমি ঠান্ডা মাথায় সবরকম প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও কী করে, অ্যালেন?

অ্যালেন সেই রকমই হেসে বলল, বড় কঠিন কর্ম। কঠিন কর্ম!

অ্যালেন মায়াকে বলে মাইয়া কর্মকে বলে কার্মা। তবে এর দু-একদিন বাদে সে ‘জয় জয় দেবী, চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে’…এই শ্লোকটি নির্ভুল উচ্চারণে মুখস্ত বলেছিল, যদিও সে সংস্কৃত জানে না।

ম্যাসিডোনিয়ায় এখানকার উচ্চারণে ম্যাকেডোনিয়া) প্রত্যেক ছোট ছোট শহরেই আছে আলাদা বেতারকেন্দ্র। এ ছাড়া রাজধানী স্কেপিয়ায় টি.ভি . সেন্টার, খবরের কাগজ বেরোয় বেশ কয়েকটি, এরা সবাই মিলে বহিরাগত কবিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ব্যস্ত। কান একেবারে ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। অ্যালেনের মতন এই সব ‘কঠিন কর্ম’ আমি ঠিক পারি না। একই কথা বারবার বলতে একঘেয়ে লাগে। আমি ওদের কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই, তার চেয়ে প্রকৃতি দেখা অনেক আনন্দের।

স্কুগা শহরের মাঝামাঝি বয়ে যাচ্ছে একটি ছোট নদী, বেশ স্রোত। দুপাড় বাঁধানো, মাঝে মাঝে গাছের নীচে বেঞ্চ পাতা। কেউ-কেউ ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা দাপাদাপি করছে জলে। কিছুদূর অন্তর অন্তর একটা করে ব্রিজ। একটি ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আমি উঁকি মেরে চমকে উঠলুম। সেই নদীতে অসংখ্য মাছ, ছোট-ছোট চেলা জাতীয় ওই মাছ ধরা ও বাচ্চাদের দাপাদাপি দেখে আমার পূর্ববঙ্গের বাল্যস্মৃতি মনে পড়ে যায়।

নদীটি গিয়ে পড়েছে লেক ওখরিডে, সেই মোহনায় দলে-দলে নারী-পুরুষ এসেছে রোদ পোহাতে। পশ্চিমি দেশগুলির সমুদ্রতীরে এই রকম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এই হ্রদও প্রায় সমুদ্রের মতন। তবে পশ্চিমি দেশগুলিতে এই সব জায়গায় একটা জমজমাট ভাব থাকে, তার কারণ কাছাকাছি অনেক দোকানপাট ও গানবাজনা। সেই তুলনায় সেই জায়গাটা বেশ শান্ত।

কবির দলকে ছেড়ে, একলা একলা হাঁটতে-হাঁটতে আমি অনেক দূরে একটি গ্রাম্য বাজারে চলে যাই। পাশেই অভ্রভেদী পাহাড়। মানুষগুলি একবিন্দু ইংরেজি বোঝে না। কিন্তু মুখের ভাবে যে সারল্য তা বিশ্বজনীন। কিছু কিছু মানুষের চেহারা ও পোশাক এবং কোনও-কোনও বাড়ির গড়ন দেখলে বেশ চেনা-চেনা লাগে, মনে হয় আমাদের দেশের মতন। এর কারণ, তুর্কিরা এখানে বেশ কয়েক শতাব্দী রাজত্ব করে গেছে, সেই প্রভাব এখনও রয়েছে কিছু কিছু। এদেশে কিছু তুর্কি এবং মুসলমান আছে, মাঝে-মাঝে মসজিদও চোখে পড়ে।

এদেশের মুদ্রার নাম দিনার। আরব-পারস্য কাহিনিতে দিনারের উল্লেখ পেয়েছি অনেক। দশ দিনারে এক ক্রীতদাসী পাওয়া যেত, রাস্তায় কেউ এক-এক দিনার কুড়িয়ে পেলে আনন্দে লাফাত। সেই দিনারের এখন কী দুর্দশা! দু-মাইল ট্যাক্সি চাপলে এক হাজার দিনার লাগে। আমাদের এক টাকায় ওদের প্রায় তিরিশ দিনার। তবে কম মূল্যের দিক থেকে দিনার এখনও ইটালির লিয়াকে হারাতে পারেনি।

এখানকার খাদ্যদ্রব্যের খুব একটা গুণগান করা যায় না। পেট ভরাবার উপযোগী খাদ্য আছে ঠিকই, কিন্তু সুস্বাদু নয়। রান্না বৈচিত্র্যহীন। হোটেলে আমাদের খাদ্যদ্রব্য বিনামূল্যে, বাঁধাধরা মেনু, অতিরিক্ত কিছু নিতে গেলে দাম দিতে হয়। একদিন এক পরিচারক আমার পাশ দিয়ে এক প্লেট মাছ ভাজা নিয়ে যাচ্ছে দেখে বললুম, আমাকে ওই মাছ ভাজা দাও তো এক প্লেট। মাংস খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেছে, তা ছাড়া বাঙালির বাচ্চা মাছ দেখলে তো ইচ্ছে জাগবেই। একটি প্লেটে বড় সরপুঁটি জাতীয় মাছের দুটি টুকরো এনে দিয়ে সেই পরিচারক প্রায় আমার গালে থাপ্পর মেরে তিন হাজার দিনার নিয়ে নিল! অত দামের জন্যই বোধ হয় সেই মাছের স্বাদ আমার কাছে গাছের বাকল ভাঙার মতন মনে হল! সম্মেলন কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রত্যেককে আট হাজার দিনার করে দিয়েছিলেন হাতখরচ হিসেবে। তার মধ্যে তিন হাজার চলে গেল এক প্লেট মাছ ভাজায়! লোভ থেকে যে পাপ, এটা সেই পাপের বেতন!

একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পিকনিকে। মাইলপঞ্চাশেক দূরে পাহাড়ের ওপরে। সেন্ট লাউম নামে এক প্রাচীন মনাস্টারির চত্বরে। বড় মনোহর সেই স্থান। মনাস্টারিটি বেশ প্রাচীন, জানলাগুলিতে ছবি আঁকা রঙিন কাচ। এদিককার অধিকাংশ মানুষই গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের অন্তর্গত। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ধর্মচর্চা লোপ পায়নি।

এই পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে ওখরিড হ্রদটি অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। কাছেই দেখি এক জায়গায় জলের ওপর সরল রেখার অনেকগুলো সাদা সাদা বল ভাসছে। একজন জানাল যে প্রাচীন ম্যাসিডোনিয়া রাজ্যের মতন এই হ্রদটিও অনেক ভাগ হয়ে গেছে। কিছু অংশ গেছে গ্রিসে, কিছু অংশ আলবেনিয়ায়। আমরা যে বলগুলি দেখছি, সেটা হল আলবেনিয়ার সীমারেখা। এই সেই আলবেনিয়া, যেখানে পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের মানুষের প্রবেশ নিষেধ।

আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল আমার পূর্বপরিচিত মার্ক নেসডর নামে এক মার্কিন তরুণ কবি। সে বলল, সুনীল, তুমি যদি মনের ভুলে ওই সীমান্ত পেরিয়ে যাও, তা হলেই গুলি খেয়ে মরবে!

আমি বললুম, তোমার সে ভয় থাকতে পারে, আমার নেই। আমি মাদার টেরিজার কলকাতা থেকে এসেছি।

স্ট্রগায় কবিতা উৎসব হল চারদিন। এর মধ্যে দুটি সন্ধ্যা খুবই অভিনব। একটি সন্ধ্যা পুরোপুরি এবারের পুরস্কার বিজয়ী অ্যালেন গিনসবার্গকে কেন্দ্র করে। সেই আসর বসল ওখরিড শহরের সেন্ট সোফিয়া গির্জার অভ্যন্তরে, রাত দশটায়। এখানে অ্যালেনের কবিতা পড়া হল বিভিন্ন ভাষায়, তারপর অ্যালেন ছোট্ট বক্তৃতা দিল। নিজের কবিতা পড়ল, অনেকগুলি এবং গান তো সে গাইবেই। সঙ্গে আছে খুদে হারমোনিয়ামটি। তার প্রথম গানটিই হল, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।

স্টুগার শেষ সন্ধ্যাটি যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনই বর্ণাঢ্য। অনুষ্ঠানের নাম দা ব্রিজেস। অর্থাৎ পৃথিবীর নানা দেশের কবিদের মধ্যে সেতুবন্ধন। মঞ্চ সাজানো হল নদীর ওপরে সত্যিকারের একটি সেতুর ওপরে। দর্শক শ্রোতারা বসেছে নদীর দুধারে। প্রত্যেক দেশের একজন মাত্র কবি একটি করে কবিতা পড়বেন। এমনকী আমেরিকা বা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেও একজন করে। সুসজ্জিত মঞ্চটি নদীর ধার থেকে এমন অপরূপ দেখাচ্ছিল যে আমার ইচ্ছে করছিল দর্শকদের মধ্যেই বসতে। অজ্ঞেয়জি এলে আমি নিস্তার পেয়ে যেতুম, কিন্তু অগত্যা আমাকেও উঠতে হল মঞ্চে।

এ এক এমনই বিচিত্র কবি সম্মেলন, যেখানে মঞ্চোপরি উপবিষ্ট কবিরা কেউ কারুর কবিতা প্রায় এক অক্ষও বুঝতে পারছেন না। প্রত্যেক কবি কবিতা পাঠ করেছেন তাঁদের মাতৃভাষায়, তারপর স্থানীয় কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রী এসে আবৃত্তি করছে সেই কবিতার ম্যাসিডোনিয়ান ভাষায় অনুবাদ। ইংরেজির মধ্যস্থতা নেই। অর্থাৎ আমরা ফরাসি-জার্মান-ইজিপশিয়ান-গ্রিক ইতালিয়ান-স্প্যানিশ-পোলিশ-নরওয়েইনিয়ান-টার্কিশ ইত্যাদি ভাষার মূল কবিতাও বুঝছি না, ম্যাসিডোনিয়ান অনুবাদ আমাদের কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। কবিরা পড়ছেন নদীর দিকে তাকিয়ে। আমি মনে মনে বললুম, আর কেউ না বুঝুক, নদী বুঝবে।

অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটি এই যে, এই আসরে গ্রিক-জার্মান-ইতালিয়ান ইত্যাদি ভাষা মাত্র একবার করে শোনা গেলেও বাংলা ভাষা শোনা গেছে দুবার। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে।

মঞ্চে শাড়ি পরা মহিলাও ছিলেন একজন, তিনি এসেছেন শ্রীলঙ্কা থেকে, তিনি কবিতা পড়লেন ইংরিজিতে। সব শেষে পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হল অ্যালেন গিনসবার্গের হাতে। সেটি একটি গোল্ডেন রিথ বা স্বর্ণ-শিরোমাল্য। সত্যি সত্যি সোনার। সেটি গ্রহণ করে অ্যালেন মাইকে তিনবার শুধু বলল, ওম ওম ওম। এই ধ্বনির মর্ম বোধ হয় অন্য কেউই বোঝেনি, অ্যালেন চোখ টিপল আমার দিকে, দর্শকদের মধ্যে থেকেও অনেকে ওম ওম বলে চেঁচিয়ে উঠল।

এর পরদিন কবিতার আসর ছড়িয়ে গেল বিভিন্ন শহরে; কবিরা ভাগ হয়ে গেল কয়েকটি দলে। উদ্দেশ্য এই যে ম্যাসিডোনিয়ার সব অঞ্চলের মানুষই যেন এই আন্তর্জাতিক সমাবেশের কিছুটা অংশ নিতে পারে।

আমি আগে থেকেই বলে রেখেছিলুম, আমি খুব ছোট শহরে যেতে চাই। ছোট জায়গা আমার অন্তরঙ্গ লাগে, রাস্তাঘাটও ভালো করে দেখা যায়। আলাউদ্দিন আল-আজাদ ও আমি একই দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এলুম স্টিপ নামে একটি ছোট্ট শৈলশহরে। পথে প্রিলেপ নামে এক জায়গার এক দোকানে প্রকৃত টার্কিশ খাবার খাওয়া হল, বেশ ঝাল ঝাল খাদ্য, বেশ আমাদের রুচিমতন। এখানকার ওখানকার ওয়াইন বিখ্যাত। কিন্তু যুগোশ্লাভিয়ায় এসে দেখছি, এঁরা ওয়াইনের সঙ্গে সোডা কিংবা মিনারাল ওয়াটার মিশিয়ে দেয়। ইওরোপের অনেক দেশে ওয়াইনের সঙ্গে জল মেশালে বাঙাল বলবে!

স্টিপ শহরটি ক্ষুদ্র হলেও এখানেও একটি সংস্কৃতি ভবন আছে। কবিতা পাঠ হল তার চত্বরে, আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করলেন কিছু কিছু স্থানীয় কবি। সেই সব কবিদের সঙ্গে আড্ডা জমাল রাত্রে ভোজসভায়। সেই আড্ডা চলল রাত পৌনে তিনটে পর্যন্ত। কবিতা পাঠের আসরের চেয়েও আমার এই সব আড্ডা বেশি ভালো লাগে। আমরা কেউ কারুর কবিতা বুঝতে পারিনি, কিন্তু আড্ডায় চলে এলুম অনেক কাছাকাছি। এর মধ্যেই এক সময় প্রস্তাব উঠল, প্রত্যেককে নিজের দেশের দু-একখানা করে গান শোনাতে হবে। প্রথমে শুরু করল কিউবার মেয়ে মারলিন বোবেস, তারপর চেকোশ্লোভাকিয়ার লিডিয়া ভাদকের গ্যাভেরনিকোভা, তারপর হাঙ্গেরির পেটার কানট্রর…একে একে প্রত্যেকে। আলাউদ্দিন আল-আজাদ শোনালেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। যুগোশ্লাভিয়ার কবিরা দলে ভারী, তাঁরা শোনালেন অনেকগুলি পল্লিগীতি থেকে আধুনিক। আমাকেও বেসুরো হেঁড়ে গলায় গাইতেই হল দু-একখানা।

সারা ম্যাসিডোনিয়া ঘুরে সমস্ত কবির দল আবার জমায়েত হল এখানকার রাজধানী স্কোপিয়া-য়। বানান Skopje) এখানেও কবিতা পাঠ করতে হল একটি কারখানায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরও কবিতা শোনাবার প্রথা আছে।

তবে, কারখানায় কবিতা শোনাবার কথা মানে এই নয় যে, শ্রমিকরা ওভারঅল পরে যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে বড়-বড় মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমরা সেখানে কবিতা পড়ে যাচ্ছি। সে রকম ব্যাপারই নয়। মস্ত বড় কারখানা, প্রায় দশ হাজার লোক কাজ করে, তাদের রয়েছে নিজস্ব সুদৃশ্য রঙ্গমঞ্চ। সেখানে এসেছেন বিশেষ নিমন্ত্রিতরা। তবে এঁদের নিজস্ব বেতার ব্যবস্থা আছে। এখানকার কবিতা পাঠ সরাসরি শ্রমিকদের কাছে রিলে করা হবে, শ্রমিকরা ইচ্ছে করলে শুনতে পারেন, বন্ধ করে দিতে পারেন।

এই আসরে আমার পাশেই বসেছেন ভজনেসেনস্কি। এর আগে দু-তিনবার দেখা হলেও আমি ওঁর সঙ্গে আলাপ করিনি। কারণ, প্রথমত, আমি নিজে থেকে কারুর সঙ্গে আলাপ করতে পারি না। দ্বিতীয়ত ভজনেসেনস্কির ভাবভঙ্গি দেখে তাঁকে আমার অহঙ্কারী মনে হচ্ছিল। অহঙ্কারের কারণ আছে, তিনি সোভিয়েত দেশের জনপ্রিয় কবি। যুগোশ্লাভিয়ানরা অনেকেই রুশ ভাষা মোটামুটি বোঝে সুতরাং এঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিত, তিনি এখান থেকে পুরস্কারও পেয়ে গেছেন।

আমার লাজুকতাও বোধ হয় এক ধরনের অহংকার, তাই আমি বিখ্যাত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যেচে কথা বলতে পারি না। সুতরাং পাশাপাশি বসেও আমাদের দুজনের কোনও কথা হল না।

ভজনেসেনস্কির কবিতা পাঠের ভঙ্গিটি নাটকীয়। মঞ্চে মাইক্রোফোনটি ছিল একটি ডেস্কের ওপর, তিনি সেটি সরিয়ে আনলেন ফাঁকা জায়গায়, যাতে তাঁর সম্পূর্ণ শরীরটি দেখা যায়। তাঁর পরনে সাদা প্যান্ট ও সাদা শার্ট, মধ্যবয়েসি সুগঠিত দেহ, মাথার চুল ঈষৎ পাতলা হয়ে এসেছে। একটা পা সামনে এগিয়ে, এক হাত তুলে কখনও চেঁচিয়ে কখনও নীচু গলায় পড়লেন দুটি কবিতা। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারলুম না, তবে স্টুগা শব্দটি গেল কয়েকবার, এই উল্লেখ থাকলে স্থানী লোকেরা খুশি হয়।

এই সব আসরে অনেককেই খুব চেঁচিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে কবিতা পড়তে দেখি। ম্যাক্স মোয়ার্টস নামে একজন আমেরিকান কবি, অতি দীর্ঘকায় কাউবয়ের মতন চেহারা, সে প্রায় নাচতে নাচতে লম্বা একটা কবিতা মুখস্ত বলে। মালয়েশিয়ার কবি আবদুল গফফার ইব্রাহিম এমন হুঙ্কার দিয়ে, ডেস্ক চাপড়াতে-চাপড়াতে কবিতা পড়লে যেন সে মেঠো রাজনৈতিক বক্তৃতা দিচ্ছে। আবার অনেক লাজুক, মৃদু গলার কবিও আছেন।

অ্যালেন গিনসবার্গ এই আসরে ছিল না, তাকে পাঠানো হয়েছিল অন্য কারখানায়। তার সঙ্গে দেখা হল সন্ধেবেলা হোটেলের লবিতে। সে বলল, সুনীল, তোমার সঙ্গে তো এবার ভালো করে গল্পই করা গেল না। আমি বললুম, তুমি এখানে বড় ব্যস্ত। অনেকে তোমাকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে।

অ্যালেন আমার কাঁধ ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, সত্যি, ক্লান্ত হয়ে গেছি। শোনো, আর কারুকে বোলোনা, তুমি ঠিক পৌনে সাতটায় হোটেলের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো।

নির্দিষ্ট সময়ে অনেটা নামে এক পথপ্রদর্শিকা (অনেকেই তাকে ডাকছিল অনীতা বলে) অ্যালেন, ভজনেসেনস্কি ও আমি হোটেল থেকে কেটে পড়লুম আড্ডা দিতে। অ্যালেনের সঙ্গে ভজনেসেনস্কির খুব বন্ধুত্ব, পৃথিবীর অনেক দেশের কবি সম্মেলনে দেখা হয়েছে। ভজনেসেনস্কি আমেরিকাতেও গেছেন কয়েকবার, অ্যালেনও সোভিয়েত দেশে গেছে, যুগোশ্লাভিয়াতেও এসেছে দুবার।

পরিচয় হওয়ার পর দেখা গেল ভজনেসেনস্কি যথেষ্ট নম্র ও ভদ্র, তাঁর মঞ্চের নাটকীয়তার সঙ্গে বাইরের ব্যবহারে কোনও মিল নেই।

হাঁটতে-হাঁটতে আমরা চলে এলুম টার্কিস বাজার নামে একটি বিচিত্র এলাকায়। বেশ পুরোনো জায়গা, খোয়া পাথরের পথ, আঁকাবাঁকা, দুপাশে অসংখ্য দোকান, বেশিরভাগই খাবারের, কোনও কোনও দোকান উপচে এসেছে রাস্তায়। সেখানেই চেয়ার টেবিল পাতা। এটা যেন একটা আলাদা নগরী, এখানে শুধু তরুণ-তরুণীর ভিড়। অনেকেই কোনও দোকানে বসার জায়গা পায়নি। তারা আড্ডা দিচ্ছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এই তারুণ্যের জগৎ দেখে নিমেষে মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।

অনেটা-র চেনা, রাস্তার ওপর একটা খোলামেলা দোকানে একটা টেবিল নিয়ে বসলুম আমরা। সামান্য কিছু খাবার নেওয়া হল, আর চা। আড্ডা জমতে লাগল আস্তে আস্তে। অ্যালেন ভজনেসেনস্কিকে জিগ্যেস করল, তুমি ইন্ডিয়ায় যাওনি কখনও?

ভজনেসেনস্কি মাথা নেড়ে ক্ষুণ্ণভাবে বলল, না। ইন্দিরা গান্ধির আমলে একবার নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম। সব ঠিকঠাক, কিন্তু সেই সময়েই কিয়েভ শহরে দু-জায়গায় আমার কবিতা পাঠের ব্যবস্থা হয়েছিল, লোকজন টিকিট কেটে ফেলেছিল তাই ইন্ডিয়ায় যাওয়া হল না। আবার কোনও কারণে কিয়েভের অনুষ্ঠানও শেষ মুহূর্তে বাতিল হয়ে গেল!

আমি বললুম, এরপর আসুন একবার!

অ্যালেন বলল, হ্যাঁ, ইন্ডিয়ায় গিয়ে অবশ্য কলকাতায় যাব। গঙ্গার ধারে, নিমতলা শ্মশানে, দক্ষিণেশ্বরে। কী চমত্যার সময় কেটেছে আমার।

তারপর অ্যালেন মহা উৎসাহে শক্তি ও জ্যোতির্ময় দত্তের গল্প শোনাতে লাগল ওকে।

সর্বক্ষণই যে আমরা কলকাতা নিয়ে পড়ে রইলুম তা নয়। আড্ডার নিয়ম অনুসারে কথা গড়িয়ে যেতে লাগল প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে। রাত্রি গাঢ় হল কিন্তু যুবক-যুবতীদের ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। চতুর্দিকে হাসিখুশি হল্লা। অনেটা নামের মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী। ইংরেজি সাহিত্যের যথেষ্ট খবর রাখে, সে খুব সাবলীলভাবে মিশে গেল আড্ডায়। টেবিল যাতে ছাড়তে না হয় সেজন্য আমরা কাপের পর কাপ চা খেয়ে যাচ্ছি। এখানে মদটদও পাওয়া যায়। কিন্তু সেদিকে কারুর ঝোঁক নেই। অনেটা যথেষ্ট তরুণী, আমি ও ভজনেসেনস্কি প্রায় সমবয়েসি। অ্যালেনই বয়ঃজ্যেষ্ঠ। সে সদ্য ষাট পূর্ণ করেছে। সে খাবারদাবারের ব্যাপারে কিছুটা সাবধানি হয়েছে এখন, কিন্তু বার্ধক্যের ছোঁয়া লাগেনি শরীরে।

কথায় কথায় প্রসঙ্গ এল পৃথিবীর ধ্বংস-সম্ভাবনায়। পরমাণু যুদ্ধে পৃথিবীর থেকে কি একদিন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? ভজনেসেনস্কি কোনও উত্তর না দিয়ে কাতর, উদাসীনভাবে তাকিয়ে রইলেন। অ্যালেন আমার দিকে চাইতেই আমি বললুম, আমার নৈরাশ্যবাদী হতে ইচ্ছে করে না। অনেটা জোর দিয়ে বলল, না, না, পৃথিবী বাঁচবে। মানুষ বাঁচবে, মানুষের সমাজ আরও সুন্দর হবে।

অ্যালেন হেসে বলল, এই যৌবনের তেজই হয়তো একমাত্র বাঁচাতে পারে পৃথিবীকে।