ঋগ্বেদ ১০।০৮৯
ঋগ্বেদ সংহিতা ।। ১০ম মণ্ডল সূক্ত ৮৯
ইন্দ্র দেবতা। রেণু ঋষি।
১। সকল অধ্যক্ষের প্রধান ইন্দ্রকে স্তব কর। তাহার মহিমা পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত সকলের তেজঃ হীন করিয়াছে। তিনি মনুষ্যদিগকে ধারণ করেন, তাহার মহিমা সমুদ্র অপেক্ষা অধিক, তাহার তেজঃ সমস্ত সংসার পরিপূর্ণ করে।
২। বীৰ্য্যবান্ ইন্দ্র আপনার তেজঃ সমস্ত তেমনিভাবে চতুর্দিকে ঘূর্ণিত করিতে থাকেন, যেমন রথী চক্র ঘূর্ণিত করে। কৃষ্ণবর্ণ অন্ধকার সমস্ত যেন একটী অস্থায়ী ও অদৃশ্য সৃষ্টিস্বরূপ, তাহাকে ইন্দ্র আপন জ্যোতিঃদ্বারা নষ্ট করেন।
৩। হে স্তবকারী! আমার সহিত মিলিত হইয়া সেই ইন্দ্রের উদ্দেশে এরূপ একটী নুতন স্তব উচ্চারণ কর, যাহা নিকৃষ্ট না হয়, যাহা পৃথিবী ও স্বর্গে উপমারহিত হয়। তিনি যজ্ঞে উচ্চারিত স্তবগুলি পাইবার জন্য যেরূপ ইচ্ছুক হয়েন; শত্রুদিগের দর্শন পাইবার জন্যও তদ্রূপ ব্যস্ত হয়েন। তিনি বন্ধুকে অনুসন্ধান করেন না, অর্থাৎ অনিষ্ট করিবার জন্য অনুসন্ধান করেন না।
৪। ইন্দ্রকে অকাতরে স্তব করা হইয়াছে, আকাশের মস্তক হইতে জল আনায়ন করিয়াছি, যেমন অক্ষবারা চক্র ধারিত হয়, তদ্রুপ সেই ইন্দ্র নিজ কাষ্ঠের দ্বারা দ্যুলোক ও ভূলোককে উত্তম্ভিত করিয়া রাখেন (১)।
৫। যাহাকে পান করিলে মনে তেজঃ উদয় হয়, যিনি শীঘ্র প্রহার করেন, যিনি বীরত্ব করিয়া শত্ৰুদিগকে কম্পান্বিত করেন, যিনি অস্ত্রশস্ত্রধারী ও সরল গতিশীল, সেই সোম অরণ্যসমূহকে বৃদ্ধিযুক্ত করেন। কিন্তু বর্ধিত হইয়াও সেই অরণ্যসমূহ ইন্দ্রের সহিত সমতুল হইতে পারে না, কিংবা তাহার ভাবের লাঘব করিতে পারে না।
৬। দ্যাবাপৃথিবী, বা মরুদেশ, বা আকাশ, বা পর্বতগণ যে ইন্দ্রের সমতুল্য হইতে পারে না, তাহার নিমিত্ত সোমরস ক্ষরিত হইতেছে। ইহার ক্রোধ যখন শত্ৰুদিগের উপর চালিত হয়, তখন ইনি বিলক্ষণ হিংসা করেন, দুর্ভেদ্যদিগকেও ভেদ করেন।
৭। যেরূপ পরশু অরণ ছেদন করে, তদ্রুপ ইন্দ্র বৃত্রকে বধ করিলেন, শত্রুর পুরী ধ্বংস করিলেন, পৃথিবী বিদীর্ণ করিয়া নদীর পথ পরিষ্কার করিয়া দিলেন, অপক্ক কলসের ন্যায় পৰ্বতকে ভঙ্গ করিলেন। আপন সহায়দিগের সঙ্গে গাভীসমূহ নিষ্কাশিত করিলেন।
৮। হে ইন্দ্র! তুমি ভক্তের ঋণ মোচন কর, তুমি অবিচলিত। খড়গ যেমন গ্রন্থি ছেদন করে, তদ্রূপ তুমি অকল্যাণ নষ্ট কর। যে সকল ব্যক্তি মিত্র ও বরুণের কাৰ্য্য নষ্ট করে, তারা জানে না যে, তাঁহাদের কাৰ্য তাহাদিগের পক্ষে হিতকর বন্ধুর কার্যের ন্যায়; ইন্দ্র তাহাদিগকেও হিংসা করেন।
৯। যে সকল দুষ্টাশয় ব্যক্তি মিত্র ও অর্য্যমা ও বরুণ ও মরুৎগণকে দ্বেষ করে, হে বৃষ্টিবর্ষণকারী ইন্দ্র! তাহাদিগকে বধ করিবার জন্য শব্দকারী ও বৃষ্টিবর্ষণকারী উজ্জ্বল বজ্র শাণিত কর।
১০। কি স্বর্গ, কি পৃথিবী, কি জল, কি পর্বত, সকলেরই উপর ইন্ত্রের আধিপত্য আছে। প্রবল ব্যক্তি ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিদিগের উপর ইন্দ্রেরই আধিপত্য। কি নূতন বস্তু লাভ করিবার সময়, কি লব্ধ বস্তু রক্ষা করিবার সময়, সকল অবসরেই ইন্দ্রকে প্রার্থনা করিতে হয়।
১১। কি রাত্রি, কি দিন, কি আকাশ, কি জলধারী সমুদ্র, কি সুবিস্তীর্ণ বায়ু, কি পৃথিবীর সীমা, কি নদী, কি মনুষ্য, সকল অপেক্ষাই ইন্দ্র প্রধান, সকলকেই ইন্দ্র অতিক্রম করিয়া আছেন।
১২। হে ইন্দ্র! তোমার অস্ত্র, ভঙ্গ হইবার নহে, দীপ্তিময়ী উষা পতাকার ন্যায় তোমার অস্ত্র জ্যোতির্ময় হউক। যেরূপ আকাশ হইতে প্রস্তর পতিত হইয়া বৃক্ষ ধ্বংস করে, তদ্রূপ তুমি অনিষ্টকারী শত্ৰুদিগকে অতি উত্তপ্ত ও গর্জনকারী অস্ত্র দ্বারা বিদ্ধ কর।
১৩। যখন ইন্দ্র জন্ম গ্রহণ করিলেন, তখন মাস সকল ও বনসমূহ ও উদ্ভিজ্জবৰ্গ ও পর্বতগণ এবং পরস্পর সংযুক্ত দ্যাবাপৃথিবী, ইহারা সকলে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিল।
১৪। হে ইন্দ্র! যে অস্ত্র ক্ষেপণ করিয়া পারাত্মা রাক্ষসকে বিদীর্ণ করিলে, তোমার সেই নিক্ষেপযোগ্য অস্ত্র কোথায় রহিল? যেরূপ গোহত্যাস্থানে গাভীগণ হত হয়(১), তদ্রুপ তোমার ঐ অস্ত্রদ্বারা নিহত হইয়াবন্ধুদ্বেষী রাক্ষসগণ পৃথিবীতে পতিত হইয়া শয়ন করে।
১৫। যে সকল রাক্ষস শত্রুতা করিতে করিতে এবং অত্যন্ত পীড়া দিতে দিতে আমাদিগকে বেষ্টন করিল, হে ইন্দ্র! তাহারা গাঢ় অন্ধকারে পতিত হউক, নিতান্ত জ্যোতির্ময় রজনীও তাহাদিগের পক্ষে অন্ধকারময় হউক।
১৬। লোক সকল তোমার উদ্দেশে অনেক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে, স্তবকারী ঋষিদিগের মন্ত্রগুলি তোমাকে আহ্লাদিত করে। তোমাকে এই যে সকলে মিলিয়া আহ্বান করা হইতেছে, তাহা তুমি ঘোষণা করিয়াদাও। তাবৎ পূজকের প্রতি অনুকূল হইয়া তাহাদিগের নিকট গমন কর।
১৭। হে ইন্দ্র! তোমার স্তবগুলি আমাদিগকে রক্ষা করিয়া থাকে। আমরা যেন নূতন নূতন উৎকৃষ্ট স্তব লাভ করি। আমরা বিশ্বামিত্র সন্তান, রক্ষার জন্য তোমার স্তব করিতেছি, আমরা যেন নানা বস্তু লাভ করি।
১৮। সেই স্থূলকায় ধনশালী ইন্দ্রকে আহ্বান করিতেছি। এই যুদ্ধের সময় যখন অন্ন ইত্যাদি দ্রব্য বণ্টন হইবেক, তখন তিনিই প্রধানরূপে অধ্যক্ষতা করিবেন। যুদ্ধে তিনি স্বপক্ষ রক্ষার জন্য উগ্রমূর্তি ধারণপুৰ্ব্বক শত্ৰুদিগকে হিংসা করেন, বৃত্রদিগকে বধ করেন, ধন সমস্ত জয় করেন।
————
(১) গোহত্যা প্রথা বিশেষরূপে প্রচলিত ছিল, নচেৎ গোহত্যার জন্য ভিন্ন স্থান নির্ধারিত থাকা সম্ভব নহে।