কান্দে যাজ্ঞসেনী, তিতিল অবনী,
নয়নের নীর-ধারে।
চতুর্দ্দিকে যত, কৌরব উন্মত্ত,
নানা উপহাস করে।।
এহেন সময়, অন্ধের আলয়,
নানা অমঙ্গল দেখি।
মহাঘোর ধ্বনি, বায়স শকুনি,
ডাকয়ে পেচক পাখী।।
গৃহে অগ্নি হয়, শুনি শিবাচয়,
একত্র করিয়া ডাকে।
ভাঙ্গে রথধ্বজ, পড়ি মরে গজ,
হাহাকার রব লোকে।।
অকস্মাৎ ঘর, দহে বৈশ্বানর,
নগর পূরিল ধূমে।
বহে তপ্ত বাত, সঘনে নির্ঘাত,
প্রলয় যেনহ ভূমে।।
বিহনে বারিদ, বরিষে শোণিত,
সদা ক্ষিতি কম্পমান।
দেউল প্রাচীর, যতেক মন্দির,
ভাঙ্গি পড়ে স্থানে স্থান।।
দেখি বিপরীত, চিত্ত উচাটিত,
ধর্ম্মভীত বৃদ্ধজন।
ভীষ্ম দ্রোণ ক্ষত্তা, সুবল দুহিতা,
অন্ধে কৈল নিবেদন।।
শুন কুরুরায়, অন্তকাল প্রায়,
নিকট হইল দেখি।
অতি অকুশল, অলক্ষ্মী কেবল,
তোমার গৃহেতে দেখি।।
তোমার নন্দন, দুষ্ট আচরণ,
দুর্য্যোধন বহু কৈল।
দ্রুপদ-দুহিতা, সতী পতিব্রতা,
সভামাঝে আনাইল।।
যতেক করিল, দ্রৌপদী সহিল,
সবাকার উপরোধ।
শীঘ্র কর রায়, ইহার উপায়,
যাবত না হয় ক্রোধ।।
শুনি অন্ধ বীর, হইল অস্থির,
আনাইল যাজ্ঞসেনী।
মধুর সম্ভাষে, বহু প্রীতি ভাষে,
কহে অন্ধ নৃপমণি।।
বধূগণ-মধ্যে, তোমা গণি আদ্যে,
শ্রেষ্ঠা সুশীলা সুব্রতা।
তোমার চরিত্র, পরম পবিত্র,
ত্রিজগতে হৈল খ্যাতা।।
দেখ বধূ মোকে, কর্ম্মের বিপাকে,
দুষ্ট পুত্রগণ পাইল।
লোকে অপকীর্ত্তি, জগতে দুর্ব্বৃত্তি,
সব পুত্র হৈতে হৈল।।
দিল বহু দুঃখ, দেখি মম মুখ,
ক্ষমহ দ্রুপদ-সুতা।
তুমি না ক্ষমিলে, আমি দুঃখ পেলে,
পশ্চাতে পাইবে ব্যথা।।
দূর কর রোষ, হইয়া সন্তোষ,
মাগ বর মম স্থান।
মাগ মাগ বর, ক্ষম কটূত্তর,
হৈয়ে প্রসন্ন-বদন।।
শুনিয়া সুন্দরী, করযোড় করি,
বর মাগিল তখন।
পাণ্ডবের পতি, ধর্ম্ম-নরপতি,
দাসত্ব কর মোচন।।
ধর্ম্ম মহারাজ, খণ্ডে যেন লাজ,
দাস বলি ক্ষিতি-তলে।
আমার নন্দনে, যেন শিশুগণে,
দাসসুত নাহি বলে।।
তথাস্তু বলিয়া, সানন্দ হইয়া,
পুনঃ বলে মাগ বর।
নহে এক বর, তব যোগ্যতর,
তুমি মাগ অন্য বর।।
দ্রৌপদী বলিল, কৃপা যদি হৈল,
মাগি যে তোমার পায়।
সশস্ত্র-বাহন, আর চারি জন,
মুক্ত করহ সবায়।।
দিনু এই বর, মাগহ অপর,
যেই লয় মনে তব।
তুমি কুলাশ্রয়, মম ভাগ্যোদয়,
যে বর মাগিবে দিব।।
মাগহ তৃতীয়, যেই তব প্রিয়,
দিতে না করিব আন।
করি কৃতাঞ্জলি, বলেন পাঞ্চালী,
কর রাজা অবধান।।
দুই বর পাই, আর নাহি চাই,
লোভ না জন্মাও মোরে।
জ্ঞানী-জন-স্থান, শুনেছি বিধান,
তাহা করি যে তোমারে।।
বৈশ্য মাগিবেক, সবে বর এক,
ক্ষত্র লৈবে দুই বর।
দ্বিজের কুমার, লবে শতবার,
শাস্ত্রে কহে মুনিবর।।
যেই মম কাজ, দিলা মহারাজ,
আর কি লইব বর।
শুনি অন্ধরাজ, পেয়ে বড় লাজ,
প্রশংসিল বহুতর।।
করি যোড়পাণি, বলে যাজ্ঞসেনী,
শুন আমার বচন।
মুক্ত হই তবে, পুণ্য থাকে যবে,
পুনঃ অর্জ্জিবেক ধন।।
দ্রৌপদী-বচন, শুনিয়া রাজন,
প্রশংসি প্রমাণ কৈল।
পাণ্ডুর নন্দন, দাসত্ব মোচন,
শুনি সবে তুষ্ট হৈল।।
ভারত-কবিতা, মহাপুণ্য কথা,
প্রচার হৈল সংসারে।
কাশীদাস কয়, নাহিক সংশয়,
শ্রবণে বিপদ্ তরে।।