১১৫. সুন্দ উপসুন্দের বিবরণ ও দ্রৌপদী সম্বন্ধে পাণ্ডবগণের নিয়ম নির্দ্ধারণ

জন্মেজয় বলে, মুনি কর অবধান।
শুনিবারে ইচ্ছা বড় ইহার বিধান।।
পঞ্চ ভাই এক স্ত্রী কিমতে আচরিল।
বিভেদ নহিল, দিন কহিতে বঞ্চিল।।
মুনি বলে, নরপতি শুন সাবধানে।
ইন্দ্র প্রস্থে গেল যবে ভাই পঞ্চজনে।।
কতদিনে হৈল নারদের আগমন।
কৃষ্ণা সহ পাণ্ডব পূজিল শ্রীচরণ।।
করযোড়ে করি দাঁড়াইল ছয় জন।
বসিবারে আজ্ঞা মুনি দিলেন তখন।।
নারদ বলেন, শুন পাণ্ডুর নন্দন।
একপত্নী পতি যে তোমরা পঞ্চজন।।
ভাই ভাই বিভেদ করিয়া থাক পাছে।
স্ত্রী হেতু বিরোধ হয় পূর্ব্বে হেন আছে।।
সুন্দ উপসুন্দ বলি দুই ভাই ছিল।
নারী হেতু দুই ভাই যুদ্ধ করি মৈল।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, কহ মুনিবর।
কি হেতু করিল যুদ্ধ দুই সহোদর।।
নারদ বলেন, পূর্ব্বে কশ্যপ-নন্দন।
হিরণ্যকশিপু হিরণ্যাক্ষ দুই জন।।
নিকুম্ভ অসুর হিরণ্যাক্ষ দৈত্যবংশে।
সুন্দ উপসুন্দ দুই তাহার ঔরসে।।
মহাবল দুই ভাই মহাকলেবর।
অসুরকুলেতে শ্রেষ্ঠ মহা ভয়ঙ্কর।।
দুই ভাই এক বাক্য একই জীবন।
তিলেক বিচ্ছেদ নাহি হয়ত কখন।।
দুই জন মিলি তবে যুক্তি কৈল সার।
তপোবলে ত্রৈলোক্য করিব অধিকার।।
বিন্ধ্য-মহীধরে গিয়া তপ আরম্ভিল।
অনেক বৎসর বায়ু-আহারে রহিল।।
অনাহারে বহু তপ কৈল দুই জনা।
যতেক কঠোর কৈল না যায় গণনা।।
দোঁহার কঠোর তপ দেখি পিতামহ।
ডাকিয়া বলেন, মনোমত বর লহ।।
দুই ভাই বলে, বিধি করহ অমর।
বিরিঞ্চি বলেন, দোঁহে মাগ অন্যবর।।
দুই ভাই বলে, মোরে অন্য নাহি চাই।
তবে পত ত্যজি যবে এই বর পাই।।
বিধাতা বলেন, জন্ম হইলে মরণ।
মরণ-বিধান কিছু কর দুই জন।।
দৈত্য বলে, পরহস্তে নহিবে মরণ।
পরস্পর ভেদ হৈলে হইবে নিধন।।
স্বস্তি বলি বর দিয়া গেলেন বিধাতা।
সুন্দ উপসুন্দ গেল নিজ গৃহ যথা।।
ত্রৈলোক্য জিনিতে সৈন্য সাজাল অসুর।
নানাবর্ণে অস্ত্র লৈয়া গেল সুরপুর।।
অমর জানিল, ব্রহ্মা দিয়াছেন বর।
ছাড়িয়া অমরাবতী হইল অন্তর।।
বিনা যুদ্ধে পলাইয়া গেল দেবগণ।
ইন্দ্রপুরে ইন্দ্রত্ব করিল দুই জন।।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব জিনিল নাগালয়।
সবে পলাইয়া গেল দুই দৈত্যভয়।।
যজ্ঞ হোম ব্রত যথা দ্বিজ মুনিগণ।
একে একে উচ্ছিন্ন করিল দুইজন।।
দেবকন্যা নাগকন্যা অপ্সরী কিন্নরী।
ত্রৈলোক্যেপাইল যত অপূর্ব্ব সুন্দরী।।
সে সবারে হরিয়া আনিল নিজ ঘরে।
যখন যাহারে ইচ্ছা তখনি বিহরে।।
যে দেবের যে বাহন ভূষা অলঙ্কার।
সর্ব্বরন্তে পূর্ণ কৈল আপন ভাণ্ডার।।
স্থানভ্রষ্ট হৈয়া যত দেব ঋষিগণ।
ব্রহ্মারে সকলে গিয়া কৈল নিবেদন।।
শুনিয়া ক্ষণেক ব্রহ্মা হৃদয়ে চিন্তিয়া।
বিশ্বকর্ম্মা প্রতি কহিলেন বিবরিয়া।।
মনোহরা নারী এক করহ রচন।
তুলনা না হয় যেন এ তিন ভুবন।।
সেইক্ষণে বিশ্বকর্ম্মা মহা-বিচক্ষণ।
বিধাতার আজ্ঞা পেয়ে করিল সৃজন।।
ত্রৈলোক্য ভিতরে যত রূপবন্ত ছিল।
সর্ব্বরূপ হৈতে তিল তিল নিল।।
অপূর্ব্ব সুন্দরী নারী করিয়া রচন।
ব্রহ্মার অগ্রেতে লৈয়া দিল ততক্ষণ।।
যে সব দেবতা সেই কন্যা পানে চাহে।
যেই অঙ্গে পড়ে দৃষ্টি সেই অঙ্গে রহে।।
ব্রহ্মা বলিলেন, নাহি এ রূপের সীমা।
তিল তিল আনি কৈল নাম তিলোত্তমা।।
তবে করযোড়ে কন্যা ধাতা অগ্রে কয়।
কি করিব, আজ্ঞা মোরে কহ মহাশয়।।
বিরিঞ্চি বলেন, সুন্দ উপসুন্দ শূর।
তপোবলে দুই দৈত্য নিল তিনপুর।।
ভেদ হৈলে দুই ভাই হইবে সংহার।
উপায় করিয়া ভেদ করাহ দোঁহার।।
পাইয়া ব্রহ্মার আজ্ঞা চলিল সুন্দরী।
দেবতা-মণ্ডলী কন্যা প্রদক্ষিণ করি।।
কন্যা দেখি মোহিত হইল ত্রিলোচন।
চারি ভিতে চারি গোটা হইল বদন।।
যেই দিকে চায়, মুখ সেই দিকে রয়।
পূর্ব্ব সহ পঞ্চমুখ হৈল মৃত্যুঞ্জয়।।
মদনে পীড়িত হৈয়ে চাহে পুরন্দর।
দশ-শত চক্ষু তাঁর হৈল কলেবর।।
আর যত দেবগণ এক দৃষ্টে চায়।
অধৈর্য্য হইল সবে দেখিয়া কন্যায়।।
দেবগণ বলে, প্রভু কার্য্য সিদ্ধ হৈবে।
ইহারে দেখিয়া কোন জন না ভুলিবে।।
তবে তিলোত্তমা গেল যথা দুই জন।
ক্রীড়া করে দুই ভাই লইয়া স্ত্রীগণ।।
কোটি কোটি দৈত্যগণ সহ পরিবার।
অশ্ব গজ রথ সৈন্য পূর্ণিত ভাণ্ডার।।
লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরী লয়ে দুইজনে।
বিন্ধ্যাগিরি মধ্যে ক্রীড়া করে হৃষ্টমনে।।
রক্তবস্ত্র পরি তিলোত্তমা বিদ্যাধরী।
নানাপুষ্প তোলে সেই পর্ব্বত-উপরি।।
ধীরে ধীরে তথা দৈত্য করিল গমন।
দূরে থাকি কন্যারে দেখিল দুইজন।।
দেববরে, মত্ত, সদা মত্ত মধুপানে।
শীঘ্রগতি কন্যা দেখি উঠে দুইজনে।।
জ্যেষ্ঠ সুন্দ ধরিল কন্যার সব্যকর।
বামহস্তে ধরিল কনিষ্ঠ সহোদর।।
পরম আনন্দ সুন্দ কন্যারে দেখিয়া।
হাত ছাড়, ভাই প্রতি বলিল ডাকিয়া।।
মোর ভার্য্যা তোমার গুরুর মধ্যে গণি।
উহারে ধরহ তুমি কেমন কাহিনী।।
উপসুন্দ বলে, এরে বরিয়াছি আমি।
ভ্রাতৃবধূ হয় তব, ছাড়ি দেহ পাণি।।
সুন্দ বলে, আমি দেখিলাম এ কন্যারে।
উপসুন্দ বলে, কন্যা বরেছে আমারে।।
ছাড় ছাড় বলি দোঁহে করে গালাগালি।
ক্রুদ্ধ হয়ে দুই ভাই দোঁহারে নেহালি।।
মধুপানে কামবাণে হইল অজ্ঞান।
ক্রোধে দুই জনে হৈল অগ্নির সমান।।
ভয়ঙ্কর দুই গদা ধরি ততক্ষণ।
দোঁহাকারে প্রহার করিল দুইজন।।
যুগল পর্ব্বত প্রায় পড়ে দুই বীর।
খসিয়া পড়িল যেন যুগল মিহির।।
আর যত দৈত্যগণ এ সব দেখিয়া।
কালরূপা কন্যা জানি গেল পলাইয়া।।
দেবগণ সহ ব্রহ্মা আসিয়া তখন।
কন্যারে দিলেন বর করিয়া বর্ণন।।
সূর্য্যের কিরণে তুমি থাক নিরন্তর।
কারো দৃষ্ট নহে যেন তব কলেবর।।
তপ যজ্ঞ ভঙ্গ হৈবে তোমার কারণে।
ধর্ম্ম নষ্ট হৈবে লোক তোমা দরশনে।।
সেই হেতু সূর্য্য-অংশু মধ্যে তুমি রহ।
এত বলি অন্তর্দ্ধান কৈলা পিতামহ।।
নারদ বলেন, শুন ধর্ম্ম নৃপবর।
তুমি জান, অতি প্রীত পঞ্চ সহোদর।।
এইমত প্রীত তারা ছিল দুইজন।
হেন গতি হৈল দোঁহে নারীর কারণ।।
মহাবংশে জন্মিলা তোমরা পঞ্চজন।
বিভেদ না হয় যেন ভার্য্যার কারণ।।
এত শুনি পঞ্চ ভাই নারদ গোচরে।
সমান নির্ব্বন্ধ হয়ে বলে যোড়করে।।
বৎসরেক কৃষ্ণা থাকিবেক এক গৃহে।
অন্যজন সেইকালে অধিকারী নহে।।
কৃষ্ণা সহ দেখে যদি ভাই অন্য জনে।
দ্বাদশ বৎসর সেই যাইবে কাননে।।
এ নির্ব্বন্ধ করিলেন ব্রহ্মার নন্দন।
হেনমতে কৃষ্ণা সহ বঞ্চে পঞ্চজন।।