১০৬. যুধিষ্ঠিরকে দ্রুপদের পরিচয় জিজ্ঞাসা

বসিল দ্রুপদ রাজা পুত্রের সহিত।
পাত্রমিত্রগণ আর দ্বিজ পুরোহিত।।
পঞ্চজন-মুখচন্দ্র করি নিরীক্ষণ।
হরষিত হৈয়া রাজা বলেন বচন।।
কে তোমরা, কোথা বাস, কহ সত্যবাণী।
কেবা জনক, কেবা হয় তব জননী।।
মনুষ্য লোকের প্রায় নাহি লয় মনে।
আকৃতি প্রকৃতি দেবতুল্য পঞ্চজনে।।
রূপে পঞ্চজনের না দেখি শ্রেষ্ঠাশ্রেষ্ঠ।
সবার সমান রূপ, জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ।।
কিবা ইন্দু ইন্দ্র কাম অশ্বিনীকুমার।
ইহা মধ্যে হবে, চিত্তে লয়েছে আমার।।
আর যত ধর্ম্মকর্ম্ম সত্য সম নহে।
মিথ্যা সম পাপ নাহি সর্ব্বশাস্ত্রে কহে।।
সর্ব্ব ধর্ম্মাধর্ম্ম তোমা সবার গোচর।
কহ সত্য খণ্ডুক মনের মতান্তর।।
এত শুনি বলেন, ধার্ম্মিক যুধিষ্ঠির।
সজল জলদ যেন বচন গম্ভীর।।
আমরা যে পঞ্চ ভাই পাণ্ডুর নন্দন।
আমি যুধিষ্ঠির, এই দোঁহে ভীমার্জ্জুন।।
এ নকুল সহদেব, জানহ নৃপতি।
অন্তঃপুরে মাতা কুন্তী সহিত পার্ষতী।।
এত শুনি নরপতি হইল উল্লাস।
আপনা পাসরে, মুখে নাহি সরে ভাষ।।
কদম্বকুসুম সম কলেবর ফুলে।
বসন ভূষণ তিতে নয়নের জলে।।
শীঘ্রগতি উঠি রাজা করি আলিঙ্গন।
একে একে সম্ভাষিল ভাই পঞ্চজন।।
রাজা বলে, পূর্ব্বভাগ্য আমার যে ছিল।
সেই ফলে মনের কামনা পূর্ণ হৈল।।
কহ শুনি তাত সেই সব বিবরণ।
গৃহদাহে মৈল বলি কহে সর্ব্বজন।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে গৃহদাহ নয়।
জৌগৃহ করিল পুরোচন পাপাশয়।।
বিদুরের মন্ত্রণায় তরিনু তাহাতে।
শুনিয়া দ্রুপদ রাজা বলে ক্রোধচিতে।।
এত বড় নির্দ্দয় সে অন্ধ-মহারাজ।
নাহি ধর্ম্মভয়, নাহি লোকভয়-লাজ।।
ধর্ম্মেতে রাখিল তোমা সে সব সঙ্কটে।
মজিবেক পাপিগণ আপন কপটে।।
গৃহদাহে মৈল বলি, কহে সর্ব্বজন।
জৌগৃহ করিল বলি শুনি যে এখন।।
এ সকল কষ্ট চিত্তে না ভাবিহ আর।
মম ধন রাজ্য বাপু সকলি তোমার।।
তবে কতক্ষণান্তরে বলয়ে বচন।
বিবাহ করহ পার্থ করি শুভক্ষণ।।
শুনিয়া করয়ে মানা ধর্ম্মের কুমার।
রাজা বলে, যাহা ইচ্ছা বিচার তোমার।।
তুমি কিম্বা বৃকোদর কিম্বা ধনঞ্জয়।
কিম্বা দুই জন এই মাদ্রীর তনয়।।
যুধিষ্ঠির বাক্য শুনি বিস্মিত নৃপতি।
অধোমুখ হৈয়া তবে নিরীক্ষয়ে ক্ষিতি।।
কুন্তীপুত্র শ্রেষ্ঠ তুমি ধর্ম্ম-অবতার।
তুমি হেন বল, আমি কি বলিব আর।।
বহু পতি ধরে সতী কভু নাহি শুনি।
হেন শাস্ত্র বেদে শাস্ত্রে নাহি আছে জানি।।
পূর্ব্বে সাধুগণ সব যাহা নাহি করে।
ধার্ম্মিক সাধুজন যাহা নাহি আচরে।।
এমত অপূর্ব্ব কথা কভু নাহি শুনি।
ইতরের প্রায় কেন কহ হেন বাণী।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, এ কথা প্রমাণ।
পূর্ব্ব সাধুগণ পথ কে করিবে আন।।
লোকে বেদে যাহা কহে জানিহ রাজন।
গুরুজন বাক্য কভু না করি লঙ্ঘন।।
লোকমত কর্ম্ম রাজা করিব সর্ব্বথা।
কিন্তু গুরুজন-বাক্যে না করি অন্যথা।।
লোকমধ্যে গুরুশ্রেষ্ঠ গুরুতে জননী।
মাতৃবাক্য কেমনে লঙ্ঘিব নৃপমণি।।
মাতা মম গরুদেব ইষ্টদেব জানি।
মাতার বচন আমি দেবতুল্য মানি।।
মাতার বচন লঙ্ঘে যেই দুরাচার।
যতেক সুকৃতি কর্ম্ম নিষ্ফল তাহার।।
যুধিষ্ঠির-বাক্য শুনি বিস্মিত দ্রুপদ।
অধোমুখ হয়ে বৈসে গণিয়া বিপদ।।
কতক্ষণে উত্তর করিল নরপতি।
নারিনু এ বিধি দিতে কি আছে শকতি।।
তুমি আর ধৃষ্টদ্যুম্ন পুরোহিত সহ।
এ কথা বিচার করি আমারে সে কহ।।
মহাভারতের কথা সুধা-সিন্ধুসম।
কাশীদাস রচিল ছন্দেতে অনুপম।।