১০৪. দ্রুপদ রাজার খেদ এবং ধৃষ্টদ্যুন্নের প্রবোধ বাক্য

ধৃষ্টদ্যুন্ন মহাবীর দ্রুপদ নন্দন।
গুপ্তবেশে দেখিল সকল বিবরণ।।
যবে কৃষ্ণা লইয়া আইলা কুন্তীর তনয়।
গুপ্তবেশে ভগ্নী-মোহে ধৃষ্টদ্যুম্ন রয়।।
সকল বৃত্তান্ত বীর দেখিল নয়নে।
পিতারে জানাতে গেল ত্বরিত গমনে।।
হেথা যাজ্ঞসেন রাজা যাজ্ঞসেনী-শোকে।
ভূমে গড়াগড়ি দিয়া কান্দে অধোমুখে।।
রাজারে বেড়িয়া কান্দে যত মন্ত্রিগণ।
পুত্রগণ কান্দে আর অন্তঃপুর জন।।
হেনকালে ধৃষ্টদ্যুন্ন উত্তরিল তথা।
রাজা বলে, একা দেখি কৃষ্ণা মম কোথা।।
হরি হরি বিধি মোর কৈল হেন গতি।
অবহেলে হারাইনু কৃষ্ণা গুণবতী।।
কহ পুত্র কৃষ্ণার কুশল সমাচার।
কি হইল লক্ষ্যবেদ্ধা ব্রাহ্মণ-কুমার।।
একা দ্বিজে বেড়েছিল যত রাজগণ।
কহ পুত্র সংগ্রামে জিনিল কোন্ জন।।
সর্ব্বনাশ করিলেন ব্যাস মুনিবর।
তাঁর বাক্যে কৃষ্ণার করিনু স্বয়ম্বর।।
ধনুর্ব্বাণ দিল লক্ষ্য করিয়া নির্ম্মাণ।
বলিলেন, পার্থ বিনা না পারিবে আন্।।
মম কর্ম্মদোষে মুনি-বাক্য মিথ্যা হৈল।
কালে বিপরীত ফল আমাতে ফলিল।।
কহ বাপু, কৃষ্ণা রাখি আইলা কোথায়।
কৃষ্ণা ছাড়ি কোন্ মুখে আইলা হেথায়।।
হা কৃষ্ণা হা কৃষ্ণা মম প্রাণের তনয়া।
এত বলি পড়ে রাজা মূর্চ্ছাগত হৈয়া।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলে, আর না কান্দ রাজন।
সকল মঙ্গল রাজা ত্যজ দুঃখমন।।
ব্যাসের বচন রাজা কভু মিথ্যা নয়।
তোমার মানস পূর্ণ হইল নিশ্চয়।।
শুনি কহ কহ, বলি উঠিল রাজন।
কিমতে হইল সত্য ব্যাসের বচন।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলে, অবধানে শুন পিতা।
কহনে না যায় সেই ব্রাহ্মণের কথা।।
শতপুর করিয়া বেড়িল রাজগণ।
সবারে জিনিল সেই একক ব্রাহ্মণ।।
সহায় হইল তার এক দ্বিজ আর।
সুরাসুর মানুষে সদৃশ নাই তার।।
হাতে বৃক্ষ হানে যেন বজ্র-হস্তে ইন্দ্র।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যতেক নরেন্দ্র।।
এইমত যুদ্ধে তাত, হইল রজনী।
দুইজন সঙ্গে চলি গেল যাজ্ঞসেনী।।
এ দোঁহার সহ তাত আর তিনজন।
পথেতে যাইতে হৈল সবার মিলন।।
ভার্গবের কর্ম্মশালে আশ্রয়ে আছিল।
পঞ্চজন মিলিয়া তথায় চলি গেল।।
নারী এক ছিল তাহে পরমা সুন্দরী।
তাঁর রূপে বিনা দীপে ঘর আলো করি।।
জননী হইবে তার বুঝিনু কথায়।
তিন ভাই কৃষ্ণা সহ রাখিয়া তথায়।।
তত রাত্রে গেল দোঁহে ভিক্ষার কারণ।
ভিক্ষা করি আনি দিল করিতে রন্ধন।।
রন্ধন করিল কৃষ্ণা চক্ষুর নিমিষে।
মাতা তার সাদরে বলিল প্রিয়ভাষে।।
আশে পাশে ডাকিয়া আইস পুত্রগণ।
উপবাসী অতিথি থাকয়ে কোন্ জন।।
অতিথিরে দিয়া যেই অবশেষ থাকে।
দুই ভাগ করি কৃষ্ণা বাঁটহ তাহাকে।।
এক ভাগ করি কৃষ্ণা বাঁটহ তাহাকে।।
এক ভাগ দাও বাপু ইহার গোচর।
আর এত ভাগ কৃষ্ণা পঞ্চ ভাগ কর।।
চারি ভাগ দেহ এই চারি বিদ্যমানে।
এক ভাগ দ্রৌপদী করহ দুই স্থানে।।
তুমি অর্দ্ধ লহ মোরে দেহ অর্দ্ধ আনি।
সেই মত বাঁটিয়া দিলেক যাজ্ঞসেনী।।
এত যদি পুনঃ পুনঃ কহিল জননী।
ক্রোধ করি দুষ্ট দ্বিজ কহে কটুবাণী।।
এত রাত্রে অতিথিরে পাইব কোথায়।
ভুঞ্জিয়া থাকিবে কিম্বা থাকিবে নিদ্রায়।।
আজিকার ভিক্ষা মাতা সমধিক নহে।
বিশেষ যুদ্ধের শ্রমে পেটে অগ্নি দহে।।
আজিকার দিনে মাতা অতিথি রহুক।
ভয়েতে জননী বলে, তাহাই হউক।।
পুনঃ বলে, অতিথির ভাগ দেহ মোরে।
কালি প্রাতে যত ইচ্ছা, দিও অতিথিরে।।
দেহ দেহ বলি পুনঃ ডাকিল জননী।
সেইরূপ বাঁটিল দিলেন যাজ্ঞসেনী।।
গ্রাস দুই তিনে সেই সকলি খাইল।
মণ্ড আন মণ্ড আন, বলি ডাক দিল।।
না পাইয়া মণ্ড ক্রোধে কটাক্ষেতে চায়।
মোর মনে দ্রৌপদীরে মারিলেক প্রায়।।
মণ্ড না পাইয়া মনে জন্মে মহাক্রোধ।
ক্ষুধানলে তনু জ্বলে না মানে প্রবোধ।।
মাতা বলে, তাত আজিকার দোষ খণ্ড।
নূতন রন্ধনী, আজি না রাখিল মণ্ড।।
মায়ের বচনে বহুমতে শান্ত হৈল।
ভোজন শেষেতে তবে আচমন কৈল।।
ভোজন করিয়া চাহে শয়ন করিতে।
সবার কনিষ্ঠে বলে শয্যা পাতি দিতে।।
সাবার উপরে শয্যা করিল মাতার।
পঞ্চ ভাইয়ের শয্যা পদনীচে তাঁর।।
সবার চরণতলে কৃষ্ণা শয্যা পাতি।
হৃষ্ট হৈয়া শুইল দ্রৌপদি গুণবতী।।
শুইয়া সে সব তারা করিল তখন।
তাহে জানিলাম ছদ্ম না হয় ব্রাহ্মণ।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে সাধু নর।।