০৪৩. নল ও পুষ্করের দ্যূতক্রীড়া

স্বয়ম্বর নিবর্ত্তিয়া যায় দেবগণ।
পথেতে দ্বাপর কলি ভেটে দুই জন।।
পুছিল দুজনে ইন্দ্র যাহ কোথাকারে।
কলি বলে, যাই বৈদর্ভীর স্বয়ম্বরে।।
সে কন্যার রূপ গুণ শুনিয়া শ্রবণে।
প্রাপ্তি ইচ্ছা করি তথা যাই দুই জনে।।
হাসি ইন্দ্র বলে, সাঙ্গ হৈল স্বয়ম্বর।
নলেরে বরিল ভৈমী সভার ভিতর।।
এত শুনি বলে কলি মহাক্রোধভরে।
দেব স্বামী ত্যজি দুষ্টা বরিল নরেরে।।
এই হেতু দণ্ড আমি করিব তাহারে।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি করিব তাহারে।।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি করিব তাহারে।
প্রতিজ্ঞা করিনু আমি তোমার গোচরে।।
দেবগণ বলে, তার দোষ নাহি তিলে।
আমা সবাকার বাক্যে বরিলেক নলে।।
নলের চরিত্র কিছু কহনে না যায়।
দেবতার যত গুণ নল নৃপে হয়।।
সমুদ্র গভীর ছিল, স্থির ছিল মেরু।
পৃথিবীতে ক্ষমা ছিল, চন্দ্র ছিল চারু।।
সবারে ছাড়িয়া নলে করিল আশ্রয়।
যজ্ঞ সভা তৃপ্ত দেব যাহার আলয়।।
সত্যব্রত দৃঢ়ব্রতী তপঃশৌচ দানী।
আমা সবাকার মাঝে নলেরে বাখানি।।
হেন নলে দুঃখদাতা হবে যেই জন।
বিপুল দুঃখেতে মজিবেক সেই জন।।
এত বলি দেবগণ করিল গমন।
দ্বাপর কলিতে দোঁহে চিন্তে মনে মন।।
নলের যতেক গুণ বলে সুরপতি।
হেন যনে দিবে দণ্ড কাহার শকতি।।
কলি বলে, তুমি মোর হইবে সহায়।
যেমনে দণ্ডিব মনে করিব উপায়।।
রাজ্যভ্রষ্ট করাব, বিচ্ছেদ দুই জনে।
পাশায় করিয়া মত্ত নৈষধ রাজনে।।
অক্ষপাটি হবে তুমি সহায় আমার।
কলি বাক্যে দ্বাপর করিল অঙ্গীকার।।
এতেক বিচারি দোঁহে করিল গমন।
নলের সহিত কলি থাকে অনুক্ষণ।।
নৃপতির পাপছিদ্র খুঁজে নিরন্তর।
হেনমতে গেল দিন দ্বাদশ বৎসর।।
একদিন নরপতি সন্ধ্যার কারণে।
অল্প শৌচ কৈল পদে, ভ্রম হৈল মনে।।
ছিদ্র পেয়ে কলি প্রবেশিল তাঁর দেহে।
নিজ বুদ্ধি হীন হৈল রাজার হৃদয়।।
পুষ্কর নামেতে ছিল রাজার সোদর।
তাহার সদনে কলি চলিল সত্বর।।
কলি বলে, অবধান করহ পুষ্কর।
বৈভব বাঞ্ছব যদি মম বাক্য ধর।।
নলের সহিত পাশা খেল গিয়া তুমি।
সহায় হইয়া তোরে জিতাইব আমি।।
কলির আশ্বাস পেয়ে পুষ্কর চলিল।
খেলিব দেবন, বলি নলে আহবানিল।।
এতেক শুনিয়া নল পুষ্করের দম্ভ।
অহঙ্খারে ক্ষণেক না করিল বিলম্ব।।
পণ করি খেলিতে লাগিল দুই জন।
হিরণ্য বিবিধ আর রজত কাঞ্চন।।
পুষ্করের বশ অক্ষ দ্বাপর প্রভাবে।
নাহি হয় অন্যথা সে, যাহা মাগে যবে।।
পুনঃ ক্রোধে পণ করিলেন রাজা নল।
মতিচ্ছন্ন হইল, না বুঝে মায়াবল।।
সুহৃদ বান্ধব মন্ত্রী যত পৌরজন।
কার শক্তি না হৈল করিতে নিবারণ।।
তবে যত বন্ধুগণ একত্র হইয়া।
দময়ন্তী স্থানে সবে জানাইল গিয়া।।
মহাদুঃখ উৎপাত আনেন নৃপতি।
কর গিয়া আপনি নিবৃত তুমি সতী।।
এত শুনি দময়ন্তী বিষণ্ণ বদন।
অতিশীঘ্র নৃপস্থানে করিল গমন।।
রাজারে বলেন ভৈমী বিনয় বচন।
মন্ত্রীসহ দ্বারে আছে অমাত্যের গণ।।
আজ্ঞা কর, সবে আসি করুক দর্শন।
ত্যজহ দেবন প্রভু, রাজ্যে দেহ মন।।
কলিতে আচ্ছন্ন রাজা, নাহি শুনে বাণী।
মাথা তুলি ভৈমীরে না চাহে নৃপমণি।।
পুনঃ পুনঃ কহি ভৈমী বারিতে নারিল।
জ্ঞানহত হৈল রাজা, নিশ্চয় জানিল।।
নিজ নিজ গৃহে তবে গেল পুরজন।
অন্তঃপুরে গেল ভৈমী করিয়া রোদন।।
হেনমতে নলরাজা খেলে বহু দিন।
ক্রমে ক্রমে বৈভবাদি সব হৈল হীন।।
অক্ষ বিনা নৃপতির নাহি অন্য মন।
সকল ত্যজিয়া রাজা খেলে অনুক্ষণ।।
দেখিয়া বৈদর্ভী মনে আতঙ্ক পাইল।
বৃহৎসেনা নামে ধাত্রী প্রতি সে বলিল।।
শীঘ্র আন বার্ষ্ণেয় সারথিকে ডাকিয়া।
আজ্ঞামাত্র গেল ধাত্রী আরতি বুঝিয়া।।
সেইক্ষণে আইল সারথি বিচক্ষণ।
সারথি দেখিয়া ভৈমী বলেন বচন।।
সর্ব্বনাশ হেতু পথ করিল রাজন।
এ মহাবিপদে তুমি করহ তারণ।।
ইন্দ্রসেন পুত্র আর কন্যা ইন্দ্রসেনা।
মম জ্ঞাতিগৃহে রাখি এস দুই জনা।।
বিলম্ব না কর রথ আন শীঘ্রগতি।
আজ্ঞামাত্র রথ সাজি আনিল সারথি।।
রথে চড়াইল দুই কুমার কুমারী।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল কুণ্ডিন নগরী।।
রথ অশ্ব সহিত থুইল রাজপুরে।
পুনঃ গেল বার্ষ্ণেয় সে নিষধ নগরে।।
পুণ্যকথা ভারতের শুনে পুণ্যবান।
কাশীদাস বিরচিল নলের আখ্যান।।