০৪১. দময়ন্তীর স্বয়ম্বর

দময়ন্তী স্বয়ম্বর লোকমুকে শুনি।
সুরোলোকে আসেন নারদ মহামুনি।।
যথাবিধি তাঁরে পূজে দেব সুরেশ্বর।
জিজ্ঞাসিল কোথা ছিলে ওহে মুনিবর।।
ঋষি বলে গিয়াছিনু পৃথিবী মণ্ডল।
আশ্চর্য্য দেখিনু তথা, শুন আখণ্ডল।।
বিদর্ভ রাজার কন্যা দময়ন্তী নামা।
দেব যক্ষ নাগ নরে দিতে নারে সীমা।।
তার ‍রূপে সুশোভিত হল ভূমণ্ডল।
চন্দ্র ম্লান হৈল দেখি বদন কমল।।
ভীমরাজা করিল কন্যার স্বয়ম্বর।
নিমন্ত্রিয়া আনিলেন যত নৃপবর।।
দময়ন্তী রূপগুণ শুনিয়া শ্রবণে।
দেখিতে আইল কত বিনা নিমন্ত্রণ।।
নারদের এই বাক্যে শুনি দেবগণ।
দময়ন্তী রূপে মুগ্ধ হৈল সেইক্ষণ।।
দময়ন্তী প্রাপ্তি বাঞ্ছা করি দেবগণ।
স্বয়ম্বর স্থানে সবে করিল গমন।।
পৃথিবীতে বসে যত রাজরাজেশ্বর।
অহির্নিশি আসিতেছে বিদর্ভ নগর।।
সসৈন্যে চলিল নল পেয়ে নিমন্ত্রণ।
পথে নল সহ ভেট হৈল দৈবগণ।।
দেখিয়া নলের রূপ বিস্ময় অন্তর।
দময়ন্তী বাঞ্ছা ত্যাগ কিরল অমর।।
নলে দেখি অন্যে না বরিবে কদাচন।
এত চিন্তি নল প্রতি বলে দেবগণ।।
সাধু সর্ব্বগুণাশ্রয় তুমি মহারাজ।
সহায় হইয়া তুমি কর এক কাজ।।
কৃতাঞ্জলি করি বলে নিষধ নন্দন।
কে তোমরা আমা হৈতে কিবা প্রয়োজন।।
ইন্দ্র বলে, আমি ইন্দ্র, ইনি বৈশ্বানর।
শমন বরুণ এই জলের ঈশ্বর।।
সবে আসিয়াছি দময়ন্তী লভিবারে।
সবাকার দূত হয়ে যাহ তথাকারে।।
কি বলে বৈদর্ভী, জানি আইস সত্বর।
নলেরে এতেক বাক্য কহে পুরন্দর।।
রাজা বলে, দ্রুতগতি যাইতেছি আমি।
কেমনে ভেটিব কন্যা, অগম্য সে ভূমি।।
রক্ষকেরা পুররক্ষা করিছে যতনে।
এ বেশে পুরুষ আমি যাইব কেমনে।।
দেবগণ বলে, আমা সবার প্রভাবে।
না হবে বারণ, তুমি অলক্ষেতে যাবে।।
দেবগণ বাক্য নল করিয়া স্বীকার।
চলিয়া গেলেন দময়ন্তীর আগার।।
সখীগণমধ্যে দময়ন্তীরে দেখিল।
দেখিয়া তাঁহার রূপ মোহিত হইল।।
অতি সুকুমাররূপা অনঙ্গ মোহিনী।
কৃশোদরা মনোহরা বিশাল লোচনী।।
পূর্ব্বে হংসমুকে রাজা যতেক শুনিল।
সত্য সত্য বলি রাজা সকল মানিল।।
নলে দেখি দময়ন্তী হল চমকিত।
কেবা এ পুরুষবর হেথা উপনীত।।
ইন্দ্র কিম্বা কামদেব অশ্বিনীকুমার।
ধন্য ধাতা, হেন রূপ সৃজিল ইহার।।
বসিতে আসন দিতে হৃদয়ে বিচারে।
সাহস করিয়া কিছু কহিতে না পারে।।
কতক্ষণে মৃদু হাসি কহে মৃদুভাষে।
কে তুমি আসিলে হেথা বল কিবা আশে।।
কেমনে আসিলে হেথা, কেহ না দেখিল।
লক্ষ লক্ষ রক্ষকেতে যে পুরী রাখিল।।
পবনাদি দেবে মোর পিতা দণ্ড করে।
এত দূর্গ পার হয়ে এলে কি প্রকারে।।
রাজা বলে আমি নল জান বরাননে।
হেথা আইলাম দেবতার দূতপণে।।
ইন্দ্রাগ্নি বরুণ যম পাঠান আমারে।
সবাকার ইচ্ছা বড় তোমা লভিবারে।।
এ চারি জনের মধ্যে যারে হয় মন।
আজ্ঞা কর, তারে গিয়া করি নিবেদন।।
এই হেতু তব পুরে করি আগমন।
দেবের প্রভাবে না দেখিল কোন জন।।
কন্যা বলে, দেবগণ বন্দিত সবার।
সে কারণে তা সবায় মম নমস্কার।।
নিস্ফলে হেথায় আসিছেন দেবগণ।
পূর্ব্বে নল নৃপতিরে করেছি বরণ।।
হংসমুখে পূর্ব্বে আমি বরেছি তোমায়।
কেমনে আমারে ত্যাগ কর নররায়।।
কায়মনোবাক্যে রাজা তুমি মম পতি।
তোমা ভিন্ন বিষ অগ্নি জলে মোর গতি।।
নল বলে, যেই দেবে পূজে সর্ব্বজন।
তপস্যা করিয়া বাঞ্ছে যাঁর দরশন।।
মুহূর্ত্তেকে ভূমণ্ডল বিনাশিতে পারে।
হেন জন বাঞ্ছে তোমা, ত্যজ কোন তাঁরে।।
ইন্দ্র দেবরাজ দৈত্য দানব মর্দ্দন।
ত্রৈলোক্যের উপরে যাঁহার প্রভুপণ।।
শচীর সমান হবে যাঁহারে বরিলে।
হেন দেব ত্যজি কেন মনুষ্য ইচ্ছিলে।।
দিকপাল বৈশ্বানর সবাকার গতি।
যাঁর ক্রোধে মুহুর্ত্তেকে ভস্ম হয় ক্ষিতি।।
বরুণ জলেশ, যম নর অন্তকারী।
কেমনে বরিবে অন্যে তাঁকে পরিহরি।।
কন্যা বলে, অন্যে মোর ‍নাহি প্রয়োজন।
তুমি ভর্ত্তা তুমি কর্ত্তা করিনু বরণ।।
শুভকার্য্যে বিলম্ব না কর মহামতি।
গলে মাল্য দিতে রাজা দেহ অনুমতি।।
নল বলে, ইহা সম নাহিক অধর্ম্ম।
দূত হয়ে কেমনে করিব হেন কর্ম্ম।।
এত শুনি বৈদর্ভীর বিষণ্ণ বদন।
দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ, করেন রোদন।।
পুনঃ বলে দময়ন্তী চিন্তিয়া উপায়।
বরিব তোমায় দোষ না হবে তাহায়।।
দেবগণ সহ তুমি এস স্বয়ন্বরে।
তাঁ সবার মধ্যে আমি বরিব তোমারে।।
এত শুনি নল রাজা করেন গমন।
দেবগণ পাশে গিয়া করে নিবেদন।।
কেহ না দেখিল মোরে তব অনুগ্রহে।
দেখিলাম সে কন্যারে অন্তঃপুর গৃহে।।
কহিলাম সবাকারে যে সব সন্দেশ।
প্রবন্ধেতে রূপ গুণ বিভব বিশেষ।।
কারেও না চাহি কন্যা আমারে ইচ্ছিল।
আসিবার কালে পুনঃ এমত বলিল।।
দেবগণ সঙ্গে এস স্বয়ন্বর স্থানে।
তোমারে বরিব তাঁ সবার বিদ্যমানে।।
বৈদর্ভীর চিত্ত বুঝি সব দেবগণ।
নলের সমান রূপ ধরেন তখন।।
এইরূপে দেবগণ নলের সংহতি।
স্বয়ম্বর স্থানে চলি গেল শীঘ্রগতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
শ্রবণে অধর্ম্ম নাশে শাস্ত্রের বিধান।।