০২৮. যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদী সংবাদ

দ্রৌপদীর বাক্য শুনি ধর্ম্ম নরপতি।
করেন উত্তর তার ধর্ম্মশাস্ত্র নীতি।।
ক্রোধ সম ‍পাপ দেবী নাহিক সংসারে।
প্রত্যক্ষে শুনহ, ক্রোধ যত পাপ ধরে।।
গুরু লঘু জ্ঞান নাহি থাকে ক্রোধকালে।
অকথ্য কথন দেবী ক্রোধ হৈলে বলে।।
আছুক অন্যের কার্য্য আত্মা হয় বৈরী।
বিষ ‍খায়, ডুবে মরে, অঙ্গে অস্ত্র মারি।।
সে কারণে বুধগণ সদা ক্রোধ ত্যজে।
অক্রোধ যে লোক, তাকে সর্ব্বলোকে পূজে।।
ক্রোধে পাপ, ক্রোধে তাপ, ক্রোধে কুলক্ষয়।
ক্রোধে সর্ব্বনাশ হয়, ক্রোধে অপচয়।।
জপ তপ সন্ন্যাস ক্রোধীর অকারণ।
রজোগুণে ক্রোধী বিধি করিল সৃজন।।
হেন ক্রোধ যেই জন জিনিবারে পারে।
ইহলোক পরলোক অবহেলে তরে।।
সময়েতে তেজ দেখাইবে সমুচিত।
ক্রোধে মহাপাপ না করিবে কদাচিত।।
ক্ষমা সম ধর্ম্ম দেবী অন্য ধর্ম্ম নয়।
পূর্ব্বেতে কশ্যপ মুনি করিল নির্ণয়।।
অষ্টাঙ্গ বেদাঙ্গ যজ্ঞ মহাদান ধ্যান।
ক্ষমাশীল জনে সর্ব্বদা দীপ্যমান।।
পৃথিবীকে ধরিয়াছে ক্ষমাবন্ত জনে।
আমা সম জন ক্ষমা ত্যজিবে কেমনে।।
সেই হেতু দ্রৌপদী ত্যজহ ক্রোধ মন।
শত অশ্বমেধ ফর অক্রোধী যে জন।।
দুর্য্যোধন না ক্ষমিল, আমি না ক্ষমিব।
এইক্ষণে কুরুবংশ সকল মজাব।।
কুরুবংশ দেখ দেবী মম পুণ্যভার।
মোর ক্রোধ হৈলে বংশ হইবে সংহার।।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি বুঝাইবে সবে।
সবাকারে দুর্য্যোধন তিরস্কৃবে যবে।।
আপনার দোষে তারা হইবে সংহার।
পূর্ব্বে করিয়াছি আমি এমন বিচার।।
কৃষ্ণা বলে, সেই বিধাতারে নমস্কার।
যেই জন হেনরূপ করিল সংসার।।
সেইজন যাহা করে, সেইমত হয়।
মনুষ্যের শক্তিবলে কিছু সাধ্য নয়।।
যজ্ঞ দান তপ ব্রহ বহু আচরিলে।
দ্বিজসেবা দেবপূজা কতই করিলে।।
ধিক্ ধিক্ বিধি তার কৈল হেন গতি।
ধর্ম্ম হেতু পঞ্চ ভাই পাইলে দুর্গতি।।
ধর্ম্ম হেতু সব ত্যজি আইলে বনেতে।
চারি ভাই আমাকেও পারহ ত্যজিতে।।
তথাপিহ ধর্ম্ম নাহি ত্যজিলে রাজন।
কায়ার সহিত যেন ছায়ার গমন।।
যেই জন ধর্ম্ম রাখে , তারে ধর্ম্ম রাখে।
নাহিক সন্দেহ, শুনিয়াছি ব্যাস মুখে।।
তোমারে না রাখে ধর্ম্ম কিসের কারণে।
এই ত বিস্ময় ব হয় মম মনে।।
তোমার যতেক ধর্ম্ম বিখ্যাত সংসার।
সর্ব্ব ক্ষিতীশ্বর হয়ে নাহি অহঙ্কার।।
শ্রেষ্ঠ জন, হীন জন, দেখহ সমান।
সহাস্যবদনে সদা কর নানা দান।।
লক্ষ লক্ষ বিপ্রগণ স্বর্ণপাত্রে ভুঞ্জে।
আমি করি পরিচর্য্যা সেবা হেতু দ্বিজে।।
দিতাম সুবর্ণপাত্র দ্বিজে আজ্ঞামাত্রে।
এখন বনের ফল ভুঞ্জ বনপত্রে।।
রাজসূত্র অশ্বমেধ সুবর্ণ গো সব।
আর সব বহু যজ্ঞ দান মহোৎসব।।
সে সব করিতে বুদ্ধি হইল তোমায়।
সর্ব্বস্ব হারিলে রাজা কপট পাশায়।।
যে বনের মধ্যে রাজা চোর নাহি থাকে।
তথায় নিযুক্ত বিধি করিল তোমাকে।।
এখন সে ধর্ম্ম তুমি করিবে কেমনে।
রাজ্যহীন ধনহীন বসতি কাননে।।
ধিক্ বিধাতারে এই, করে হেন কর্ম্ম।
দুষ্টাচার দুর্য্যোধন করিল অধর্ম্ম।।
তাহারে নিযুক্ত কেন পৃথিবীর ভোগ।
তোমারে করিল বিধি এমন সংযোগ।।
যুধিষ্ঠির কহে, কৃষ্ণা উত্তম কহিলে।
কেবল করিলে দোষ, ধর্ম্মেরে নিন্দিলে।।
আমি যত কর্ম্ম করি, ফলাকাঙ্ক্ষা নাই।
যাহা করি সমর্পি যে ঈশ্বরের ঠাঁই।।
কর্ম্ম করি যেই জন ফলাকাঙ্ক্ষা নাই।
বণিকের মত সেই বাণিজ্য করয়।।
ফললোভে ধর্ম্ম করে লুব্ধ বলি তারে।
লোভে পুনঃ পুনঃ পড়ে নরক দুস্তরে।।
এই ত সংসার সিন্ধু উর্ম্মি কত তায়।
হেলে তরে সাধুজন ধর্ম্মের নৌকায়।।
ধর্ম্মকর্ম্ম করি ফলাকাঙ্ক্ষা নাহি করে।
ঈশ্বরেতে সমর্পিলে অবহেলে তরে।।
ধর্ম্মফল বাঞ্ছা করি ধর্ম্মগর্ব্ব করে।
ধর্ম্মেরে করিয়া নিন্দা অধর্ম্ম আচরে।।
এই সব জনগণে পশুমধ্যে গণি।
বৃথা জন্ম যায় তার পেয়ে নরযোনি।।
ধর্ম্মশাস্ত্র বেদনিন্দা করে যেই জন।
তির্য্যগের মধ্যে তারে করয়ে গণন।।
পুনঃ পুনঃ তির্য্যক্ যোনিতে জন্ম হয়।
নরক হইতে তার কভু পার নয়।।
শিশু হয়ে ধর্ম্মচর্য্যা করে যেইজন।
বৃদ্ধের ভিতর তারে করয়ে গণন।।
প্রত্যক্ষে দেখহ কৃষ্ণা, ধর্ম্ম যাহা কৈল।
সপ্ত বৎসরের আয়ু মার্কণ্ডের ছিল।।
ধর্ম্মবলে সপ্ত কল্প জীয়ে মুনিরাজ।
আর যত দেখ মুনি ঋষির সমাজ।।
মুখে যাহা কহে, তাহা হয় সেইক্ষণে।
ধর্ম্মবলে ভ্রমিবারে পারে ত্রিভুবনে।।
ইন্দ্র চন্দ্র নক্ষত্রাদি যত স্বর্গবাসী।
ধর্ম্ম আচরিয়া সবে স্বর্গমধ্যে বসি।।
তপ জপ যজ্ঞ দান ব্রত শ্রেষ্ঠাচার।
বাঞ্ছা না করিলে নাহি ফল পায় তার।।
আমারে বলিলে তুমি সদা কর ধর্ম্ম।
আজন্ম আমার দেবি সহজ এ কর্ম্ম।।
পূর্ব্বে সাধুগণ সব গেল যেই পথে।
মম চিত্ত বিচলিত না হয় তাহাতে।।
তুমি বল, বনে ধর্ম্ম করিবে কেমনে।
যথাশক্তি তত আমি করিব কাননে।।
অন্য পাপ কৈলে প্রায়শ্চিত্ত আছে তার।
ধর্ম্মনিন্দা কৈলে প্রায়শ্চিত্ত নাহি আর।।
হর্ত্তা কর্ত্তা ধাতা যেই সবার ঈশ্বর।
যাঁহার সৃজন এই যত চরাচর।।
আমি ‍কোন্ জন তারে অমান্য করিতে।
ভ্রম নাহি আমার ইহাতে কোন মতে।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীদাস কহে, সদা শুনে সাধুর নর।।