০৪৬. দময়ন্তীর পতি অন্বেষণ ও সুবাহু-নগরে সৈরিন্ধ্রী বেশে অবস্থিতি

গভীর অরণ্যে ভৈমী করিল প্রবেশ।
নানাজাতি পশু তথা দেখয়ে বিশেষ।।
সিংহ কোল ব্যাঘ্র দ্বিপ খড়্গী কৃষ্ণসার।
মৃগ মৃগী দেখে আর মহিষ মার্জ্জার।।
শল্লকী নকুল গোধা মূষিক বানর।
নানা জাতি নভোমার্গ স্পর্শে তরুবর।।
শাল তাল পিয়াল যে অর্জ্জুন চন্দন।
শিমুল খর্জ্জুর জাম কদম্ব কাঞ্চন।।
আম্রতক বিভীতক ফল আমলকী।
পলাশ ডম্বুর ভল্লাতক হরীতকী।।
খদির পাণ্ডবী পিচুমর্দ্দ কোবিদার।
শাখোট কপিথ বট অশ্বথ যে আর।।
নোয়াড়ি বদরী বিঞ্চি বহেড়া পর্কটী।
অশোক চম্পক কেন্দু তিন্তিড়ীক ঝাঁটি।।
বাপী সর তড়াগ সিন্ধুর সম নদী।
নানা ঋতু, রম্যস্থান বহু রত্ন নিধি।।
যত যত দেখে ভৈমী অন্যে নাহি মন।
স্বামী অন্বেষণে ভ্রমে গহন কানন।।
যারে দৃষ্টি করে ভৈমী জিজ্ঞাসে তাহারে।
দেখিয়াছ মম প্রভু গেল কোথাকারে।।
সিংহগ্রীব প্রভু মম বিশাল লোচন।
দীর্ঘতর যুগ্ম ভুজ অর্দ্ধেক বসন।।
ওহে সিংহ মহাতেজা বনের ঈশ্বর।
বনের বৃত্তান্ত যত তোমার গোচর।।
সত্য কহ প্রাণনাথ গেল কোন্ দিগে।
অনাথা তোমার স্থানে এই ভিক্ষা মাগে।।
অনন্তর এক মহা সরিৎ দেখিল।
প্রণাম করিয়া তারে ভৈমী জিজ্ঞাসিল।।
তরঙ্গিণী করিয়া স্বামীর সমাচার।
শীতল করহ তুমি হৃদয় আমার।।
ক্ষুধায় বিশেষ শ্রমে আকুল শরীর।
জলপান হেতু কি আসেন তব তীব্র।।
তথা হৈতে গেল ভৈমী না পেয়ে উত্তর।
অতি উচ্চতর এক দেখে গিরিবর।।
তাহাকে জিজ্ঞাসে ভৈমী করিয়া রোদন।
অতি উচ্চতর শৃঙ্ঘ পরশে গগন।।
বহুদূর তব দৃষ্টি যায় শৈলবর।
কহ মোর কোথায় আছেন প্রাণেশ্বর।।
পঙ্কজকেশর অঙ্গ, কর স্পর্শে জানু।
কর্ণান্তে নয়ন, মুখশোভা শীতভানু।।
বীরসেনসুত প্রভু নিষধ ঈশ্বর।
দেখেছ কি প্রাণনাথে কহ গিরিবর।।
এইমত গিরিপৃষ্ঠে ভ্রমে কত দিন।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লিষ্টা, বদন মলিন।।
যুগল নয়নে বহে জলধারা প্রায়।
অর্দ্ধবাসা মুক্তকেশা ধূলি সর্ব্ব গায়।।
তথা হৈতে চলি যায় উত্তর মুখেতে।
মুনির আশ্রমে যায় তৃতীয় দিনেতে।।
অনাহারী বাতাহারী দীর্ঘ গোঁপ দাড়ি।
কর পদ সর্পবৎ, নখ যেন বেড়ি।।
দেখি দময়ন্তী তাঁরে ভূমিষ্ঠ হইয়া।
প্রণতি করিয়া রহে অগ্রে দাঁড়াইয়া।।
ভৈমীরে জিজ্ঞাসে মুনি মধুর বচনে।
কে তুমি, কি হেতু কর ভ্রমণ কাননে।।
দময়ন্তী বলে, আমি পতি বিরহিণী।
এই বনে হারাইনু মম পতিমণি।।
অন্বেষণ করি তাঁরে, করি সেই ধ্যান।
হারাধন পাই যদি, তবে রহে প্রাণ।।
আজ্ঞা কর মুনিরাজ কোন দেশে যাব।
নিশ্চয় কি পুনরপি দরশন পাব।।
এত শুনি মুনিরাজ আশ্বাস করিল।
না কর রোদন, তব দুঃখ শেষ হৈল।।
পাইবে স্বামীরে পুনঃ পাবে রাজ্যভার।
পুত্র কন্যা সহ সুখে বঞ্চিবে অপার।।
এত বলি ঋষিবর অন্তর্ধান হৈল।
বিস্ময় মানিয়া তবে বৈদর্ভী চলিল।।
নদ নদী কন্টক পর্ব্বত ঘোর বনে।
রাত্রি দিন যায় নিরানন্দ মনে।।
যাইতে যাইতে দেখে এক নদীকূলে।
বহুদ্রব্য সঙ্গে লয়ে বহু লোক চলে।।
ভৈমীকে দেখিয়া লোক বিস্ময় মানিল।
বিপরীত দেখি কেহ ভয়ে পলাইল।।
কভু হাসে, কভু নাচে, চিত্রের পুত্তলী।
রাক্ষসী পিশাচী কিবা মানুষী বাতুলী।।
জিজ্ঞাসে দয়ার্দ্র হয়ে তবে কোন জন।
কে তুমি, একাকী ভ্রম নির্জ্জন কানন।।
বৈদর্ভী বলিল, নহি রাক্ষসী পিশাচী।
স্বামী অন্বেষিয়া ভ্রমি আমি ত মানুষী।।
অরণ্যের মধ্যে স্বামী ছাড়ি গেল মোরে।
সত্য কহ তোমরা কি দেখিয়াছ তাঁরে।।
এতেক শুনিয়া বলে বণিকের গণ।
তোমা ভ্নি এ বনে না দেখি অন্য জন।।
চেদিরাজ্যে যাই মোরা বাণিজ্য কারণ।
আইস মোদের সঙ্গে যদি লয় মন।।
আশ্বাস পাইয়া ভৈমী চলিল সংহতি।
সেই পথে অন্বেষিয়া যায় নিজপতি।।
হেনমতে কত পথে এক রম্যস্থলে।
একটি যে সরোবর শোভিত কমলে।।
কাতর হৈয়া শ্রমে যত বণিকগণ।
সেই নিশি তথায় বঞ্চিল সর্ব্বজন।।
নিশাকালে হস্তিগণ জলপানে এল।
নিদ্রিত আছিল পথে চরণে চাপিল।।
দশনে চিরিল কারে, শুণ্ডে জড়াইল।
বণিকগণের মধ্যে মহারোল হৈল।।
প্রানভয়ে পলাইয়া যায় কোন জন।
দময়ন্তী করিলেন বৃক্ষে আরোহণ।।
বৃক্ষোপরি আরোহিয়া করেন রোদন।
হায় বিধি মোর ভাগ্যে ছিল এ লিখন।।
জন্মকাল হৈতে আমি জানি নিজ মনে।
এমন দুষ্কৃতি আমি না করি কখনে।।
তবে কেন বিধি মোর কৈল হেন গতি।
অধিক সন্তাপ মোর উপজিল নিতি।।
মোর স্বয়ম্বরে এসেছিল দেবগণ।
নিরাশ হইয়া ক্রোধ কৈল সর্ব্বজন।।
সেই হেতু আমার না দেখি শ্রেয়ঃ আর।
এত কষ্টে পাপ আত্মা না যায় আমার।।
রজনী প্রভাত হৈলে যে যেখানে ছিল।
চারিদিক হতে আসি একত্র মিলিল।।
ভয় পেলে তথা হতে যায় শীঘ্রগতি।
কত দিনে চেদিরাজ্যে উত্তরিল সতী।।
বিবর্ণ বদনা কৃশা অঙ্গে অর্দ্ধ বাস।
ধূলিতে ধূসর কায়, ঘন বহে শ্বাস।।
বন হৈতে নগরেতে করিল প্রবেশ।
চতুর্দ্দিকে ধায় লোক দেখি তার বেশ।।
যুবা বৃদ্ধ নগরেতে যত শিশুগণ।
চতুর্দ্দিকে বেড়িয়া চলিল সর্ব্বজন।।
কেহ বা কর্দ্দম দেয়, কেহ দেয় ধূলা।
বৈদর্ভীরে বেড়িয়া হইল লোকমেলা।।
সুবা‍হু রাজার মাতা প্রাসাদে আছিল।
দময়ন্তী দেখিয়া ধাত্রীরে আজ্ঞা দিল।।
দেখ দেখ নারী এক নগরে আইসে।
মলিনা বিবর্ণরূপা বেষ্টিতা মানুষে।।
শীঘ্র গিয়া তাহারে আনহ মোর স্থানে।
আজ্ঞামাত্র ভৈমীকে আনিল সেইক্ষণে।।
ভৈমীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল রাজমাতা।
কহ নিজ পরিচয়, কাহার বনিতা।।
নিজরূপ আচ্ছাদন করেছ কি কারণ।
মেঘে ঢাকিয়াছে যেন রবির কিরণ।।
দময়ন্তী বলে, শুন কহি রাজমাই।
জাতিতে মানুষী আমি, সৈরিন্ধ্রী বলাই।।
দ্যূতে হারি স্বামী মোর পশিল কাননে।
অপ্রমিত শুণ তাঁর, না যায় কথনে।।
সঙ্গেতে ছিলাম আমি, ছাড়িলেন মোরে।
তাঁরে অন্বেষিয়া আমি আইনু নগরে।।
এত বলি দময়ন্তী করেন রোদন।
আশ্বাদিয়া রাজমাতা বলেন বচন।।
না কান্দহ কন্যে তুমি, চিত্ত কর স্থির।
তব দুঃখ দেখি মম বিদরে শরীর।।
পাইবে স্বামীর দেখা, থাক মোর বাসে।
লোক পাঠাইব তব পতির উদ্দেশে।।
ভৈমী বলে, এত যদি করুণা আমারে।
তবে সে থাকিতে পারি তোমার মন্দিরে।।
পুরুষ সহিত দেখা না হবে কখন।
পুরুষের স্থানে না পাঠাবে কদাচন।।
না ছুঁইব উচ্ছিষ্ট, না পদে দিব হাত।
পূর্ব্বাপর ব্রত মম, কহি রাজমাতঃ।।
বৃদ্ধ দ্বিজ পাঠাইবে স্বামী অন্বেষণে।
এতেক কহিলে রহি তোমার সদনে।।
সেইরূপ হইবে বলিয়া রাজমাতা।
ডাকিল সুনন্দা নামে আপন দুহিতা।।
রাজমাতা বলে তবে তনয়ার প্রতি।
সখ্য কর তুমি এই সৈনিন্ধ্রী সংহতি।।
অসম্মান যেন ‍না করিও কদাচন।
হীনকার্য্যে না করিও কভু নিয়োজন।।
মাতৃ আজ্ঞা মানি লৈল রাজার নন্দিনী।
ভৈমী রৈল তথা হৈয়া সুনন্দা সঙ্গিনী।।
বনপর্ব্বে পুণ্যশ্লোকে নলের চরিত্র।
পুণ্যকথা ভারতের শুনিলে পবিত্র।।