মস্তক জ্বলনে দুঃখ অশ্বথামা পায়।
দেখি মুনি ব্যসদেব কহিলেন তায়।।
যাবৎ তোমার দেহে থাকিবে জীবন।
শিরোমণি তোমার না হবে কদাচন।।
পৃথিবীতে নর তৈল মাখিবার কালে।
তব নামে তিনবার আগে দিবে ফেলে।।
সেই তৈল পড়িবেক পৃথিবী উপরে।
তোমার মস্তকেতে পড়িবে মম বরে।।
তাহাতে নিবৃত্ত হবে তোমার জ্বলনি।
নিজস্থানে যাহ, ভয় না করিহ দ্রৌণি।।
তব নামে অগ্রে তৈল যে জন না দিবে।
ব্রক্ষ্মবধ পাতক তাহাকে পরশিবে।।
এইরূপে অশ্বথামা দিয়া মণিবর।
বিমনা হইয়া গেল আপনার ঘর।।
ব্যাস নারদেরে লয়ে পান্ডুপুত্রগণ।
বৃষ্ণ সহ করিলেন শিবিরে গমন।।
পুনর্জন্ম হৈল মনে করে ভীমবীর।
গোবিন্দের সাহায্যে সুস্থির যুধিষ্ঠির।।
জানিলেন কৃষ্ণ হৈতে তরিনু সঙ্কটে।
সতত রাখেন কৃষ্ণ বিঘ্ন যদি ঘটে।।
দ্রৌণির মস্তক মণি লইয়া সত্ত্বর।
দ্রৌপদীর নিকটে গেলেন কৃকোদর।।
অগ্রে শিরোমণি রাখি কহেন বৃত্তান্ত।
ভাগ্যে রক্ষা পাইলাম এবার নিতান্ত।।
দ্রৌপদী বলেন মম গেল পরিতাপ।
দুঃখের কারণ মম ছিল পূর্ব্ব পাপা।।
মণি আনি দিয়া তুষ্ট করিলে আমারে।
আমা প্রতি মন আছে কহিনু তোমারে।।
এই মণি মহারাজ করুক ধারণ।
তবে ভীম আরো মম তুষ্ট হয় মন।।
দ্রৌপদীর অভীষ্ট জানিয়া ধর্ম্মরায়।
করিলেন স্বমস্তক ভূষিত তাহায়।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করেন নারায়নে।
অন্তর্য্যামী ভগবান জানহ আপনে।।
না হইল না হইবে এমন মন্ত্রণা।
তোমার রক্ষিত আমি জানে সর্ব্বজনা।।
কার বরে দ্রোণপুত্র রাত্রিতে আসিয়া।
একাকী সকল সৈন্য গেল বিনাশিয়া।।
পূর্ব্বে যদি জনার্দ্দন হইত এমন।
সংহার করিত দ্রৌণি সব সৈন্যগণ।।
কহ শুনি জগন্নাথ ইহার কারণ।
কি কারণে অশ্বথামা করিল এমন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন রাজা জানিলে কি হয়।
কালে করে কারে হরে কাল সর্ব্বময়।।
পরাক্রমে দ্রোণপুত্র পারে কি তোমায়।
সাধিল দুষ্কর কার্য্য শিবের কৃপায়।।
ভক্তি হেতু মহাদেব অর্জ্জুনের বশ।
সব রক্ষা করিলেন দিন অষ্টাদশ।।
ক্ষয়কালে উপনীত দ্রোণের নন্দন।
পাইল শিবির দ্বারে শিব দরশন।।
ভক্তিভাবে স্তব করে দেব মহেশ্বরে।
বর পাইলেক দ্রোণি যা ছিল অন্তরে।।
দয়ার সাগর হর না ভাবি বিষাদ।
দ্রৌণিরে আপন খড়গ দিলেন প্রসাদ।।
বর দিয়া শঙ্কর গেলেন নিজালয়।
বধিল সকল সেনা দ্রোণের তনয়।।
পরম দয়ালু হর দেবের দেবতা।
সংহার কারণে রুদ্র প্রলয় বিধাতা।।
পূর্ব্বে দক্ষযজ্ঞ নষ্ট করেন মহেশ।
পুনঃ বর দেন তুষ্ট হয়ে ব্যোমকেশ।।
ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু অগ্নি আদি দেবগণ।
শিব সেবি সব কার্য্য করিল সাধন।।
যাহার আজ্ঞায় জয় হয় ত্রিভুবনে।
ভক্ষণ করিল বিষ সমুদ্র মন্থনে।।
শিব বরে দ্রৌণি সব করিল বিনাশ।
নহিলে কাহার শক্তি হেন করে আশ।।
সৃষ্টির সংহার কর্ত্তা সেই দেবরাজ।
তাঁর আজ্ঞা বিনা কেহ নাহি করে কাজ।
জন্মাইয়া ত্রিজগৎ করেন পালন।
কার পরিপূর্ণ হলে আপনি নিধন।।
আদ্যদেব মহাগুরু সব্বদেব গুরু।
ভক্তের অধীন সদা বাঞ্ছাকল্পতরু।।
এতেক মহত্ত্ব তব শিব প্রসাদাৎ।
অর্জ্জুনে তোষেন দেব হইয়া কিরাত।।
যত বীর মরিলেন ভারত সমরে।
কুরুক্ষেত্রে পড়িয়া চলিল স্বর্গপুরে।।
তুমি আমি যথাকালে যাব অনায়াসে।
পূর্ব্বাপর আছে হেন শাস্ত্রেতে বিশেষে।।
এত শুনি ধর্ম্মরাজ বলেন বচন।
বুঝিলে না বুঝে মন মায়ার কারণ।।
তোমা বিনা নাই গতি শুন পরমেশ।
সর্ব্ব শূন্য দেখি আমি না পাই উদ্দেশ।।
দৈব হেতু সব হয় কে খন্তিতে পারে।
কর্ম্মবশে গতায়ত প্রাণী সদা করে।।
তথাপি তোমারে কহি মনের মানসে।
জয় পরাজয় হয় স্ব স্ব কর্ম্মবেশে।
দেখহ গোবিন্দ মম অতি অমঙ্গল।
গেল বন্ধু বান্ধবাদি তনয় সকল।।
বংশে বাতি দিতে আর না রহিল কেহ।
কি সুখে রহিব বল, চাহি নাক গেহ।।
বিলাপ করুণা যত কি করি এখন।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি বিধির লিখন।।
তোমার চরণে মতি রহে অনিবার।
জীবন যৌবন ধন মিথ্যা পরিবার।।
গোবিন্দ বলেন রাজা ত্যজ শোক মন।
রাজধর্ম্ম সদাচার কর অনুক্ষণ।।
যুদ্ধে মৃত্যু ক্ষত্রকুলে প্রধান এ কার্য।
প্রজার পালন কর পৃথিবীর মাঝ।।
জয় পরাজয় হয় নাহিক এড়ান।
পূর্ব্বাপর সংসারেতে আছে এ বিধান।।
কৃষ্ণের বচনে রাজা স্থির কর মন।
দ্রৌপদী সুস্থিরা হয়ে চিন্তে নারায়াণ।।
গোবিন্দ কৃষ্ণ নাম জপিতে লাগিল।
সকল আপদ খন্ডে জন্মে দিবজ্ঞান।
ব্যাসের রচিত দিব্য ভারত পুরাণ।।
মহাভারতের কথা কাশী বিরচিল।
এইত ঐষিকপর্ব্ব সমাপ্ত হইল।।
ঐষিকপর্ব্ব সমাপ্ত।