৩১. কর্ণের জন্ম বিবরণ

জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল কহ তপোধন।
কুন্তীগর্ভে জন্মে কর্ণ বিখ্যাত ভুবন।।
কৌরবের পক্ষে কেন কুন্তীর নন্দন।
দেখিয়া ধরিল কুন্তী কিরূপে জীবন।।
মুনি বলে, শুন কুরুবংশ চূড়ামণি।
কৌরবের রণে গেল কর্ণ বীরমণি।।
বিদুরের মুখে শুনি এসব বচন।
চিত্তেতে চিন্তিয়া কুন্তী ভাবে মনে মন।।
আমার নন্দন কর্ণ কেহ না জানিল।
সূর্য্যের ঔরসে জন্ম কর্ণের হইল।।
দৈবের এ সব কথা বিধির ঘটন।
রাধা যে পাইয়া পুত্র করিল পালন।।
রাধার নন্দন বলি ঘোষে সর্ব্বজন।
কেহ জ্ঞাত নহে কর্ণ আমার নন্দন।।
এ সময়ে লোকে যদি হয় সে প্রচার।
উপহাস করিবেক কৌরব কুমার।।
ইহার কারণে আমি করিব গমন।
কর্ণেরে কহিব আমি এ সব বচন।।
আমার বচন কর্ণ খণ্ডিতে নারিবে।
অবশ্য সহায় পাণ্ডুপুত্রদেব হবে।।
কিরূপে নিভৃতে দেখা হবে কর্ণ সনে।
এতেক ভাবিয়া কুন্তী যুক্তি কৈল মনে।।
প্রাতঃস্নান নিত্য কর্ণ যমুনায় করে।
একেশ্বর যায় স্নানে, নাহি লয় কারে।।
তত্ত্ব জানি কুন্তী তথা করিল গমন।
যমুনায় নামি কর্ণ করয়ে তর্পণ।।
নিত্যকর্ম্ম সমাপিয়া সূর্য্যে করে স্তব।
উঠিয়া আইসে, কুন্তী মানিল উৎসব।।
কর্ণের সাক্ষাতে কহে গদ গদ বাণী।
অবধান কর বৎস পূর্ব্বের কাহিনী।।
আমার নন্দন তুমি সূর্য্যের ঔরসে।
যখন ছিলাম আমি জনকের বাসে।।
অতিথি সেবায় তাত রাখিল আমারে।
অনেক সেবন কৈনু দুর্ব্বাসা মুনিরে।।
চারিমাস সেবিলাম বিবিধ বিধানে।
আজ্ঞাবর্ত্তী হয়ে আমি রহি অনুক্ষণে।।
আমার সেবায় মুনি সন্তুষ্ট হইয়া।
মন্ত্রদান করিলেন আমারে ডাকিয়া।।
যে মন্ত্র দিতেছি দেবি তব বিদ্যমান।
মন্ত্র পড়ি যেই দেবে করিবে আহবান।।
সেইক্ষণে আসিবেন তোমার সাক্ষাতে।
যে বর মাগিবে, তাহা পাইবে নিশ্চিতে।।
এত বলি মহামুনি গেল যথাস্থানে।
তবে আমি মন্ত্র পরীক্ষিতে একদিনে।।
কলসে আনিতে যাই যমুনার বারি।
কৌতুকে জপিনু মন্ত্র সূর্য্যে ধ্যান করি।।
তখনি আসিল সূর্য্য মোর বিদ্যমানে।
সূর্য্যে দেখি ভীত আমি হইলাম মনে।।
অনেক বিনয় করি কহিনু বচন।
না বুঝি তোমারে আমি করি আবাহন।।
অজ্ঞান স্ত্রীজন দোষ ক্ষমিবে আমার।
শুনিয়া হাসিয়া সূর্য্য কহে আরবার।।
কভু মিথ্যা নাহি হয় মুনির বচন।
কভু মিথ্যা নহে কণ্যা মম আগমন।।
আমারে ভজহ তুমি, নাহিক সংশয়।
না ভজিলে মন্ত্র মিথ্যা হইবে নিশ্চয়।।
বিবাহিতা নহ, চিন্তা করিছ অন্তরে।
মম বরে মহারাজ বরিবে তোমারে।।
এত শুনি বশ আমি হইনু তাহার।
সূর্য্যের প্রসাদে হৈল জনম তোমার।।
প্রসব করিয়া তোমা সচিন্তিত মন।
কুমারী কালেতে জন্ম হইল নন্দন।।
লোকে খ্যাত হয় পাছে এ সব কাহিনী।
যমুনায় ভাসাইনু তাম্রকুণ্ড আনি।।
পাইয়া তোমারে রাধা করিল পালন।
কদাচিৎ নহ তুমি রাধার নন্দন।।
যে হইল সে হইল, অজ্ঞাত কারণ।
ভ্রাতৃগণ সহ তুমি করহ মিলন।।
ছয় ভাই মিলি বৎস নাশ মোর দুঃখ।
শত্রুগণে মারি ভুঞ্জ যত রাজ্য সুখ।।
এত শুনি কর্ণ কহে করিয়া মিনতি।
এ সকল গুপ্তকথা জানি যে ভারতী।।
জানিয়া করিলে ত্যাগ আমারে পূর্ব্বেতে।
রাধা যে পালিল মোরে বিখ্যাত জগতে।।
রাধার নন্দন বলি ঘোষে ত্রিভুবনে।
তব পুত্র আমি, এবে বলিব কেমনে।।
বলিলে কি লোকে ইহা করিবে প্রত্যয়।
জগতে কুযশ লজ্জা হবে অতিশয়।।
বলিবেক ক্ষত্রগণ করি উপহাস।
যুদ্ধকাল দেখি কর্ণ পাইল তরাস।।
ভাই বলি পাণ্ডবের লইল শরণ।
ব্যর্থ কর্ণ নাম বলি ঘোষে অকারণ।।
এ সব হইতে মৃত্যু ভাল শতগুণে।
এ কর্ম্ম করিতে নাহি পারিব কখনে।।
তাহে দুর্য্যোধন মোরে শিশুকাল হতে।
নানা ভোগে পুরস্কারে পালিল যত্নেতে।।
দেশ ভূমি গ্রাম রত্ন দিল বহুতর।
হরিহর আত্মা যেন, নহে ভিন্ন পর।।
তিলেক বিভিন্ন মনে নহে কদাচনে।
তাহার অপ্রীতি আমি করিব কেমনে।।
বিশেষে তাহারে আমি কৈনু অঙ্গীকার।
অর্জ্জুনের সঙ্গে পণ সমর আমার।।
মোর হাতে পরলোকে যাবে ধনঞ্জয়।
কিম্বা অর্জ্জুনের হাতে মোর মৃত্যু হয়।।
এই ত প্রতিজ্ঞা কৈনু সভা বিদ্যমানে।
সত্যভ্রষ্ট হৈতে নাহি পারিব কখনে।।
সে কারণে ক্ষমা কর জননি আমারে।
এত শুনি পুনঃ কুন্তী কহিল কর্ণেরে।।
ভাইগণ সঙ্গে যদি না কর মিলন।
মোর বাক্য যদি নাহি করিবে পালন।।
তবে এক সত্য কর মোর বিদ্যমানে।
আর চারি পুত্রে মোর না মারিবে প্রাণে।।
এত শুনি কর্ণ কৈল সত্য অঙ্গীকার।
আর চারি ভায়েরে ‍না করিব সংহার।।
পঞ্চ পুত্র রবে তব এই পৃথিবীতে।
অর্জ্জুন সহিত কিংবা আমার সহিতে।।
ব্যাসের বচন মাতা আছে পূর্ব্বাপর।
পৃথিবীতে তব পঞ্চ রহিবে কোঙর।।
সংসারের মধ্যে হবে রণে মহাতেজা।
একচ্ছত্র পৃথিবীতে হবে মহারাজা।।
ব্যাসের বচন মিথ্যা নহে কদাচন।
জগতে রহিবে পঞ্চ তোমার নন্দন।।
পাইবে তোমার পুত্রগণ রাজধানী।
নিশ্চয় আমার মৃত্যু হইবে জননি।।
না ভাবিহ দুঃখ মাতা, যাহ নিজ স্থানে।
এত বলি দণ্ডবৎ করিল চরণে।।
বিদায় হইয়া কর্ণ গেল নিজপুরে।
যথাস্থানে গেল কুন্তী দুঃখিত অন্তরে।।
বিদুরের প্রতি কুন্তী কহিল সকল।
শুনি বিদুরের হৃদে হৈল কুতূহল।।
কাশীরাম দাস কহে শুন জগজ্জন।
উদ্যোগপর্ব্বের কথা হৈল সমাপন।।

উদ্যোগপর্ব্ব সমাপ্ত।