১০৩. কুন্তীর নিকটে রাম ও কৃষ্ণের আগমন

ধর্ম্ম চক্রশালে যবে করেন প্রবেশ।
হেনকালে আইলেন রাম হৃষীকেশ।।
প্রণাম করিয়া দোঁহে কুন্তীর চরণে।
আপনার পরিচয় দেন দুইজন।।
শুনি শূরসেন-সুতা দোঁহে করি কোলে।
দোঁহারে করান স্নান নয়নের জলে।।
কোথা ছিলি তাত মোর অনাথের নড়ি।
হাপুতির পুত তোরা দরিদ্রের কড়ি।।
দ্বাদশ বৎসর আমি মুখ নাহি দেখি।
অনুক্ষণ কান্দিয়া দুর্ব্বল হৈল আঁখি।।
আজিকার রাত্রি মোর হৈল সুপ্রভাত।
দ্বাদশ বর্ষের কষ্ট আজি গেল তাত।।
কহ তাত সবার কুশল সমাচার।
তোমার মায়ের আর আমার ভ্রাতার।।
দ্বাদশ বৎসর হৈল, নাহি দেখি শুনি।
কেবা মরে, কেবা জীয়ে, কিছুই না জানি।।
নাহি জানি তোমার এতেক নিষ্ঠুরতা।
না জানি যে এতেক নির্দ্দয় তোর পিতা।।
গহন কাননে ভ্রমি আর কত দেশ।
দ্বাদশ বৎসর কেহ না করে উদ্দেশ।।
কৃষ্ণ কহিলেন, দেবী ত্যজ মনস্তাপ।
না ভুঞ্জিলে না খণ্ডে পূর্ব্বের মহাপাপ।।
গৃহদাহে মরিলা, শুনিয়া এই কথা।
সাতদিন অন্ন জল না ছুঁলেন পিতা।।
আমারে পাঠাইলেন বুঝিতে কারণ।
বিদুরের স্থানে শুনিলাম বিবরণ।।
দ্বাদশ বৎসর কষ্ট অরণ্যে পাইলে।
তোমা স্মরি তাত ভাসিছেন অশ্রুজলে।।
কিন্তু কি করিব বল বিধির লিখন।
কেহ নাহি পারে যাহা করিতে লঙ্ঘন।।
শোক না করিহ দেবী, দুঃখ হৈল শেষ।
কালি কিম্বা পরশ্ব চলহ নিজ দেশ।।
কুন্তীরে প্রণাম করি যান ধর্ম্ম-পাশ।
করপুটে প্রণমিয়া করেন সম্ভাষ।।
শীঘ্র উঠি ধর্ম্মসুত করি অলিঙ্গন।
দোঁহাকার অশ্রুজলে ভাসেন দুজন।।
স্নেহভাবে দোঁহারে না ছাড়ে দুইজন।
বহুক্ষণে দোঁহা মুখে না সরে বচন।।
তবে পঞ্চ ভাই রাম কৃষ্ণে সম্বোধিয়া।
যতেক পূর্ব্বের কষ্ট কহেন বসিয়া।।
কহেন সকল কথা ধর্ম্মের নন্দন।
জতুগৃহ যে প্রকারে হইল দাহন।।
বিদুরের মন্ত্রণাতে যেমতে উদ্ধার।
রাক্ষসের মুখে রক্ষা হৈল যে প্রকার।।
বনে, বনে, দেশে দেশে, তপস্বীর বেশ।
দ্বাদশ বৎসর যত পাইলেন ক্লেশ।।
একে একে কহেন সকল বিবরণ।
শুনি আশ্বাসিয়া বলে দেবকী-নন্দন।।
দুষ্ট ধৃতরাষ্ট্র, নষ্ট তার পুত্রগণ।
সমুচিত ফল তারা পাইবে এখন।।
যদি প্রীতে বাঁটিয়া না দেয় রাজ্যভার।
সকলে মিলিয়া তারে করিব সংহার।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন , তবে দামোদরে।
কি মতে জানিলা মোরা কুম্ভকার ঘরে।।
কৃষ্ণ বলেন, যে যুদ্ধ কৈল তব ভাই।
মনুষ্য করিতে পারে ক্ষিতিমাঝে নাই।।
বিনা ভীমার্জ্জুন অন্যে করিতে না পারে।
সন্ধানে জানিনু তেঁই আছ এই ঘরে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, আজি সুপ্রভাত।
তাই আজি নয়নে দেখিনু জগন্নাথ।।
একমাত্র বড় ভয় হতেছে অন্তরে।
সবে জ্ঞাত হৈল, আজি কুম্ভকার ঘরে।।
বিশেষ তোমার হইয়াছ আগমন।
এ সকল বার্ত্তা পাছে শুনে দুর্য্যোধন।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা ভয় কর কারে।
শত দুর্য্যোধন তোমা কি করিতে পারে।।
তিন লোক সহায় করিয়া যদি আসে।
মুহূর্ত্তেকে বিনাশিব চক্ষুর নিমিষে।।
সপ্তবংশ সহ আমি যাজ্ঞসেন সখা।
সবারে করিবে জয় ভীমার্জ্জুন একা।।
যুধিষ্ঠির কহেন, যে তাহারে না গণি।
জ্যেষ্ঠভাত ধৃতরাষ্ট্রে বড় ভয় মানি।।
আজিকার রজনী বঞ্চিব এই দেশে।
যেই চিত্তে লয়, কালি করিব দিবসে।।
এত বলি মেলানি করিল দুই জনে।
বিদায় হইয়া যান রাম নারায়ণে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।