১১১. পঞ্চ-পাণ্ডবের সহিত দ্রৌপদীর বিবাহ

মুনিগণ দেবগণ আইল সভায়।
বিবাহের আজ্ঞা দিল পাঞ্চালের রায়।।
পঞ্চ ভায়ে বসাইল পঞ্চ সিংহাসনে।
হরিদ্রা পিটালি গন্ধ দিল প্রতিজনে।।
পঞ্চ-তীর্থ জল আনি স্নান করাইল।
ইন্দ্রের ভূষণে বিভূষিতাঙ্গ হইল।।
বিবাহ মঙ্গল যত হইল সুবেশ।
রত্নবেদী-মধ্যস্থলে করিল প্রবেশ।।
সিংহাসনে বসাইল দ্রৌপদী সুন্দরী।
পঞ্চ ভাই সাতবার প্রদক্ষিণ করি।।
পঞ্চজন অগ্রে-বেদী-মধ্যে বসাইল।
পঞ্চ ভাই হস্তে হস্তে বন্ধন করিল।।
কৃষ্ণা-বাম-বৃদ্ধাঙ্গুলি যুধিষ্ঠির হস্ত।
তর্জ্জনীতে বৃকোদর মধ্যাঙ্গুষ্ঠে পার্থ।।
নকুল অনামাঙ্গুষ্ঠে কনিষ্ঠে কনিষ্ঠ।
ক্রমে পঞ্চজনে কৃষ্ণা করাইল দৃষ্ট।।
দুন্দুভি-নিনাদে নৃত্য করে বিদ্যাধরী।
হুলাহুলী মঙ্গল করয়ে নরনারী।।
পাঞ্চজন্য বাজান আপনি নারায়ণ।
লক্ষ লক্ষ শঙ্খ বাজে, বাদ্য অগণন।।
কল্যাণ করিল যত দেবি-ঋষিগণ।
দ্বিজেরে দক্ষিণা দিল না যায় লিখন।।
হেনমতে সম্পূর্ণ করিয়া বিভাকার্য্য।
প্রভাতে চলিয়া গেল যেবা যার রাজ্য।।
মুনিগণ দ্বিজগণ গেল নিজ স্থান।
দ্বারাবতী চলিলেন কৃষ্ণ বলরাম।।
যাইতে বিদুরে স্মরিলেন যদুমণি।
পাণ্ডবের বার্ত্তা দিতে গেলেন আপনি।।
কৃষ্ণে দেখি বিদুর আনন্দ-জলে ভাসে।
পাদ্য অর্ঘ্য সিংহাসনে পূজিল বিশেষে।।
দ্বাদশ বৎসর হেথা নাহি যাহায়াত।
বড় ভাগ্য হস্তিনা, কি হেতু জগন্নাথ।।
কহ কিছু জান যদি পাণ্ডবের বার্ত্তা।
কোন্ দেশে কোন্ রূপে আছে তার কোথা।।
মরিল বাচিঁল কিছু না জানি তদন্ত।
কেবল ভরসা এই সবে ধর্ম্মবন্ত।।
হা হা কুন্তী, হা হা ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির।
তোমা না দেখিয়া আছে এ পাপ শরীর।।
এত বলি বিদুর পড়িল মূর্চ্ছা হৈয়া।
দুই হাতে ধরি কৃষ্ণ বসান তুলিয়া।।
হাসিয়া বিদুরে তবে কহে জগন্নাথ।
ভাল বার্ত্তা লহ তুমি হৈয়া খুল্লতাত।।
পাণ্ডবের বিবাহ যে ত্রৈলোক্য জানিল।
এক লক্ষ্য রাজা সহ দলে আসিছিল।।
কালি রাত্রে বিবাহিতা হৈল যাজ্ঞসেনী।
পঞ্চ পাণ্ডবের ভার্য্যা তিনি একাকিনী।।
পতি ও ভাসুর দুই রাজা যুধিষ্ঠির।
পতি ও দেবের দুই সহদেব বীর।।
ভীম ও অর্জ্জুন আর নকুল প্রবীর।
ভাসুর, দেবর, পতি তিন দ্রৌপদীর।।
আমিও ছিলাম সব কুটুম্ব সংহতি।
শুভকর্ম্ম সমাপিয়া যাই দ্বারাবতী।।
গোবিন্দ-চরণ ধরে ভূমে লোটাইয়া।
এ কথা এথায় হরি না কহিও আর।
শুনি দুষ্টলোকে পাছে করে কুবিচার।।
হাসিয়া বলেন কৃষ্ণ, ডরহ কাহারে।
সবে পলাইয়া এল পাণ্ডবের ডরে।।
ভীমার্জ্জুন-পরাক্রম অতুল ভূতলে।
এক লক্ষ্য নৃপতি জিনিল অবহেলে।।
বিদুরে প্রবোধি চলি গেলা ভগবান্।
বিদুর ত্বরিতে গেল ধৃতরাষ্ট্র-স্থান।।
বিদুর বলেন, আজি, শুভরাত্রি হৈল।
দ্রুপদ-নন্দিনী কৃষ্ণা কুরুকুলে এল।।
এই মাত্র সংবাদ পাইয়া আমি আজ।
আপনারে জানাতে আসিনু মহারাজ।।
ধৃতরাস্ট্র শুনি কহে আনন্দে বিভোর।
আগুসরি আন গিয়া পুত্রবধূ মোর।।
নানারত্ন ফেল দুর্য্যোধনেরে নিছিয়া।
আগুসরি আন কৃষ্ণা রতনে ভূষিয়া।।
বিদুর বলিল, রাজা হেথা বধূ কোথা।
যুধিষ্ঠিরে বলিলেন, দ্রুপদ-দুহিতা।।
ধৃতরাষ্ট্র শুনি যেন শেল বাজে বুকে।
ততোধিক ভাগ্য বলি, বলে রাজা মুখে।।
দুর্য্যোধন হইতে অধিক যুধিষ্ঠির।
শুভবার্ত্তা শুনি হৃষ্ট হইল শরীর।।
কহ শুনি বিদুর, আছয়েতারা কোথা।
কার ঠাঁই পাইলা তুমি এ সব বারতা।।
বিদুর বলেন, কৃষ্ণা কৈল লক্ষ্য-পণ।
সেই লক্ষ্য বিন্ধিলেক ইন্দ্রের নন্দন।।
তব মুখে শুনি কথা আনন্দ অপার।
বিদুর কহিছে মন বুঝিয়া রাজার।।
কন্যা-হেতু বহু দ্বন্দ্ব কৈল রাজা সব।
ভীমার্জ্জুন সবারে করিল পরাভব।।
মুনিগণ দেবগণ একত্র হইয়া।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডবে কৃষ্ণারে দিল বিয়া।।
যদুবংশ সহ গিয়াছিলেন শ্রীপতি।
কহি বার্ত্তা আমারে গেলেন দ্বারাবতী।।
এত বলি বিদুর গেলেন নিজ স্থান।
অধোমুখে অন্ধ রাজা মনে করে ধ্যান।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।