১৩৬. অর্জ্জুনের সুভদ্রা হরণ

বলভদ্র আজ্ঞা পেয়ে যত নারীগণ।
পিঠালি হরিদ্রা লৈয়া কৈলা উদ্বর্ত্তন।।
তৈল আমলকী গন্ধ মাখিল কুন্তলে।
স্নান করিবারে গেল সরস্বতী-জলে।।
কৃষ্ণের ইঙ্গিত পেয়ে দেবী সত্যবতী।
ভদ্রা লৈয়া গেল সহ অনেক যুবতী।।
অর্জ্জুনে ডাকিয়া তবে বলে নারায়ণ।
শুনিলে কি অর্জ্জুন আইল দুর্য্যোধন।।
আজি অধিবাস হেতু রাম আজ্ঞা দিল।
স্নান হেতু তারে সরস্বতী পাঠাইল।।
মৃগয়ার ছলে চড়ি যাহ মম রথে।
সুভদ্রা লইয়া তুমি যাহ সেই পথে।।
দারুকে ডাকিয়া কৃষ্ণ কহেন ইঙ্গিতে।
অর্জ্জুনে লইয়া তুমি যাহ মম রথে।।
যে কিছু কহিবে পার্থ না কর অন্যথা।
যথায় বলিবে রথ লৈয়া যাবে তথা।।
পাইয়া কৃষ্ণের আজ্ঞা দারুক সত্বর।
সাজাইয়া আনে রথ অর্জ্জুন গোচর।।
সুসজ্জ হইয়া পার্থ লৈয়া ধনুঃশরে।
খড়্গ ছুরী গদা শূল চক্র লৈয়া করে।।
কৃষ্ণরথে আরোহণ করি মহাবীর।
চালাইয়া দেন রথ সরস্বতী-তীর।।
যথা ভদ্রা করে স্নান নারীগণ মাঝে।
ধীরে ধীরে পার্থ তথা গেল পদব্রজে।।
ধরিয়া ভদ্রারে তুলি চড়াইয়া রথে।
চালাইয়া দেন রথ ইন্দ্রপ্রস্থ-পথে।।
হাহাকারে ডাকিল যতেক কন্যাগণে।
সুভদ্রা হরিয়া লয় কুন্তীর নন্দন।।
শব্দ শুনি বেগে ধায় সভাপাল সব।
ধর ধর বলি ডাকে আরে রে পাণ্ডব।।
আরে পার্থ মতিচ্ছন্ন হইল তোমারি।
কেমন সাহস তোর হেন গৃহে চুরি।।
না পলাহ বলি তার পাছেতে ডাকিল।
শৃগালের শব্দে যেন সিংহ নেউটিল।।
ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া করি শরজাল।
নিমিষে কাটেন তিন লক্ষ সভাপাল।।
সভাপালে মারিয়া চালাইলেন রথ।
নিমিষে গেলেন পার্থ দশক্রোশ পথ।।
সুভদ্রা হরিল বার্ত্তা শুনিয়া শ্রবণে ।
চতুর্দ্দিকে ধাইয়া আইল সর্ব্বজনে।।
কেহ স্নানে কহে দানে ভোজনে শয়নে।
যে যথা আছিল ত্যজি ধায় সর্ব্বজনে।।
চড়িতে তুরগে রথে না পাইল কাল।
ক্রোধভরে বাহির হইল কামপাল।।
ক্রোধে বলভদ্রের কাঁপয়ে কর পদ।
যুগল নয়ন যেন স্ফুট কোকনদ।।
ধর ধর বিনা শব্দ নাহি কারো মুখে।
ধর গিয়া ধর, বলে যারে আগে দেখে।।
কামদেব যাইয়া চড়িল মীনধ্বজে।
সাত কোটি রথ সঙ্গে নব কোটি গজে।।
ধর গিয়া বলি আজ্ঞা দিল বলরাম।
সবার অগ্রেতে গিয়া উত্তরিল কাম।।
সারণ আইল সঙ্গে রথ কোটি সাত।
গজ অশ্ব পদাতিক নানা অস্ত্র হাত।।
কৃপ বৃন্দ উপগদ কৃতবর্ম্মা ধীর।
যে যাহার সৈন্য লৈয়া ধায় যদুবীর।।
গদ শাম্ব আইল লইয়া বহু সেনা।
পাইয়া রামের আজ্ঞা ধায় সর্ব্বজনা।।
ধর গিয়া বলি আজ্ঞা দেন হলধর।
সসৈন্যে সারণ বীর চলিল সত্বর।।
উগ্রসেন বসুদেব সাত্যকি উদ্ধব।
রামের নিকটে এল যতেক যাদব।।
ক্রোধে বলভদ্র-তনু কাঁপে থরথর।
ফুলিয়া হইল তনু যেমন মন্দর।।
প্রলয় মেঘের শব্দে ডাকে যেন গলা।
অঙ্গ হৈতে ছিঁড়িয়া পড়িল বনমালা।।
রাম বলে, পাণ্ডবের এত গর্ব্ব হৈল।
শ্বাপদ যজ্ঞের হবি খাইতে ইচ্ছিল।।
চণ্ডাল হইয়া ইচ্ছা হরিল ব্রাহ্মণী।
গারুড়ি অজ্ঞাতে যেন ধরে কাল ফণী।।
যে পুরে সূর্য্যেন্দু বায়ু তেজ মন্দ বয়।
যে পুরে আসিতে শক্তি শমনের নয়।।
দেখ হের মতিচ্ছন্ন হৈল দুরাচার।
চুরি করি লয়ে যায় ভগিনী আমার।।
এই দোষে তারে আজি মারিব সমূলে।
বাতি দিতে না রাখিব পাণ্ডবের কুলে।।
তাহাকে মারিব যে হেইবে তার বংশে।
পৃথিবী খুঁজিয়া আজি মারিব সবংশে।।
ইন্দ্রপ্রস্থ মাটি আজি তাড়িয়া লাঙ্গলে।
ফেলাইয়া দিব আজি সমুদ্রের জলে।।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ পঞ্চানন।
কার শক্তি মম শত্রু করিবে রক্ষণ।।
জানি আমি পাণ্ডবের অতি মন্দ রীতি।
না জানিয়া করে কৃষ্ণ তার সহ প্রীতি।।
অন্তঃপুরে দেয় তারে রহিবারে স্থান।
নহে কেন এতেক হইবে অপমান।।
যত স্নেহ করিনু শুধিল তার গুণ।
ভগিনী হরিয়া মুখে দিল কালি চুণ।।
প্রতিফল ইহার পাইবে দুষ্ট আজি।
এত বলি বাহির হইল রাম সাজি।।
বামেতে লাঙ্গল ধরি দক্ষিণে মুষল।
বজ্রহস্তে শোভা যেন পায় আখণ্ডল।।
কৃষ্ণে ডাক বলি দূতে দিল পাঠাইয়া।
সে প্রিয় সখার কর্ম্ম দেখুক আসিয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশী কহে, সাধুজন সদা করে পান।।