১০১. ভীমের যুদ্ধে রাজ-পরিবারদিগের ত্রাস

ভীমের ভৈরব নাদ, ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি।
হাতে বৃক্ষ যেন যুগ-অন্ত সমর্ব্ত্তী।।
ভঙ্গ দিয়া রাজগণ ধায় চতুর্ভিত।
মহারোল নগরে হইল অপ্রমিত।।
হেনকালে আইল পুরের এক জন।
দ্রৌপদীর আগে কহে করিয়া ক্রন্দন।।
দেখ সৈন্যভঙ্গ, যেন সিন্ধু উথলিল।
নগরের ঘরদ্বার-সকলি ভাঙ্গিল।।
প্রাণ লয়ে দেশান্তরে গেল প্রজাগণ।
অন্তুঃপুরে কি হৈল না জানি এখন।।
ধনে-প্রানে রাজ্য-দেশ সবার সহিত।
তোমার কারণে রাজা মজিল নিশ্চিত।।
শুনিয়া কাতার হৈয়া দ্রুপদ-নন্দিনী।
জনকের ঠাঁই শীঘ্র পাঠায় কেশিনী।।
যাহ শীঘ্র কেশিনী জনকে গিয়া কহ।
ত্যজ যুদ্ধ আপনার কুটুম্ব রাখহ।।
আপনার প্রাণ রাখ আর আত্মগণ।
দারা বধূ রাখ গিয়া, আর পরিজন।।
আপনা রাখিলে তাত সকলি পাইবা।
আমার লাগিয়া কেন সবংশে মজিবা।।
যে পণ করিয়াছিলা হইল পূর্ণিত।
ব্রাহ্মণ বিন্ধিল লক্ষ্য সবার বিদিত।।
মম ভাল মদ এবে তোমারে না লাগে।
ব্রাহ্মণের হইলাম, আছি তাঁর আগে।।
যাহ শীঘ্র না রহিও, আমার শপথ।
শুনিয়া দ্রৌপদী-বার্ত্তা ব্যথিত দ্রুপদ।।
পুত্রগণে আনি কহে সকরুণ-বাণী।
যতেক কহিয়া পাঠাইয়া যাজ্ঞসেনী।।
চলি যাহ পুত্রগণ, সম্বরহ রণ।
এ সৈন্য সাগর কে করিবে নিবারণ।।
সমান সহিতে যে সংগ্রাম সুশোভন।
না শোভে পতঙ্গপ্রায় অগ্নিতে মরণ।।
বিশেষ না জানি অন্তঃপুর ভদ্রাভদ্র।
সৈন্যগণ কোলাহল প্রলয়-সমুদ্র।।
আপনার প্রাণ রাখ, রাখ পুরজন।
আমি রহিলাম দ্বিজ-সাহায্য-কারণ।।
যুদ্ধ করি প্রাণ আমি ত্যজি আপনার।
কৃষ্ণার যে গতি আজি, সে গতি আমার।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলে, পিতা মুখে নাহি লাজ।
ভগিনীকে ছাড়ি যাব সংগ্রামের মাঝ।।
হেন প্রাণ রাখি আর কোন্ প্রয়োজন।
কোন্ লাজে লোকে দেখাইব এ বদন।।
মারিব, মারিব আজি করিব সমর।
তুমি যাহ, রাখ গিয়া আপনার ঘর।।
পুত্রের বচন শুনি বলয়ে দ্রুপদ।
কৃষ্ণা পাঠাইয়া বলি আপন বিপদে।।
যত দিন কৃষ্ণা জন্মিয়াছে মম গৃহে।
কভু নাহি লঙ্ঘি আমি, কৃষ্ণা যাহা কহে।।
বৃহস্পত্যধিক বুদ্ধি কৃষ্ণা শশিমুখী।
যাহার মন্ত্রণাবলে রাজ্যে আমি সুখী।।
কৃষ্ণা যে কহিলা যুদ্ধ করিতে বারণ।
তোমা সবা যেতে কহি তাহার কারণ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলিল, তোমরা যাহ ঘর।
কৃষ্ণার রক্ষণে আমি আছি একেশ্বর।।
এত বলি প্রবোধি পাঠায় সবাকারে।
পুনঃ ধৃষ্টদ্যুন্ন গিয়া প্রবেশে সমরে।।
করিল অনেক যুদ্ধ কীচক সংহতি।
গদাঘাতে ধৃষ্টদ্যুন্ন করিল বিরথী।।
গদার প্রহারে তাঁর হত হৈল জ্ঞান।
হাত হৈতে খসিয়া পড়িল ধনুর্ব্বাণ।।
নিরস্ত্র বিরথ হৈল দ্রুপদ-নন্দন।
দ্বিজগণ মধ্যে পশি রাখিল জীবন।।
কান্দয়ে দ্রৌপদী তবে করিয়া বিলাপ।
না জানি যে কিবা হৈল, বৃদ্ধ মম বাপ।।
না জানি যে কিবা হৈল মাতৃ-ভাতৃগণ।
বহু বিলাপিয়া দেবী করেন ক্রন্দন।।
কৃষ্ণার রোদন দেখি কন ধনঞ্জয়।
কি হেতু কান্দহ দেবী, কারে তব ভয়।।
কৃষ্ণা বলে, আপনাকে নাহি করি তাপ।
মম হেতু সবংশে মজিল মম বাপ।।
পার্থ বলে, কি হইবে করিলে বিষাদ।
অভয়-পঙ্কজ হয় গোবিন্দের পাদ।।
এ মহা-বিপদ-সিন্দু-তরিতে তরণী।
গোবিন্দকে স্মরণ করহ যাজ্ঞসেনী।।
অর্জ্জুনের বাক্যে কৃষ্ণা স্মরে জগন্নাথ।
হে কৃষ্ণ আপদহর্ত্তা সবাকার তাত।।
তোমা বিনা রাখে মোর, নাহি অন্য জন।
আমারে বিপদে রক্ষা কর নারায়ণ।।
পিতা মাতা রাখ মোর, রাখ ভ্রাতৃগণ।
রাজ্য দেশ রক্ষ মোর যত প্রজাগণ।।
তুমি মম সত্য পাল, আমি যদি সতী।
সবা জিনি মোরে লক দ্বিজ মম পতি।।
দ্রৌপদীর আপন জানিয়া জগন্নাথ।
নাহি ভয় বলিয়া তুলিলা বাম হাত।।
দ্রৌপদীরে আশ্বাসি বাজান পাঞ্চজন্য।
শব্দেতে নিঃশব্দ হৈল যত রিপুসৈন্য।।
সর্ব্ব যদুগণে ডাকি বলেন গোবিন্দ।
এই দেখ অর্জ্জুনে বেড়িল রাজবৃন্দ।।
সৈন্যগণ গতাযাতে ভাঙ্গিল নগর।
যত্নপূর্ব রাখ সবে পাঞ্চালের ঘর।।
শুনিয়া সাত্যকি গদ প্রদ্যুন্ন সারণ।
গোবিন্দে চাহিয়া বলে করিয়া গর্জ্জন।।
এই যদি ধনঞ্জয় কুন্তীর কুমার।
তুমি তার প্রিয়বন্ধু, বলয়ে সংসার।।
এ মহা সঙ্কট মধ্যে পড়িয়াছে একা।
আর কোন্ কালে তার তুমি হবে সখা।।
তুমি ক্ষমা কৈলে না ক্ষমিব মোরা সবে।
মারিয়া ক্ষত্রিয়গণে রাখিব পাণ্ডবে।।
এত বলি চলে সবে যুদ্ধ করিবারে।
প্রবোধিয়া বাসুদেব রাখেন সবারে।।
এতক্ষণ আমি মারিতাম রাজগণ।
যুদ্ধ করিবারে রাম করেন বারণ।।
রামের বচন কেবা লঙ্ঘিবারে ক্ষম।
বিশেষ বুঝিব অজ্জুনের পরাক্রম।।
পৃথিবীর লোক যদি হয় একত্রিত।
অজ্জুনে জিনিতে নারে কহিনু নিশ্চিত।।
চিন্তিত না হও কিছু অজ্জুর্ন-কারণ।
পাঞ্চাল নগর গিয়া করহ রক্ষণ।।
কৃষ্ণের বচনে যত যাদব ভূপাল।
রক্ষা হেতু গেল সবে নগর পাঞ্চাল।।
অস্ত্রশস্ত্র হাতে প্রতি ঘরে প্রতিজন।
প্রজাগণ রক্ষিল নিবারি সৈন্যগণ।।
কুন্তীর বসতি কুম্ভকার-কর্ম্মশাল।
তথা রক্ষা হেতু যান শ্রীরাম গোপাল।।
মহাভারতের কথা সুধার সমান।
ভক্তিতে শুনিলে লভে নর দিব্যজ্ঞানে।।