১৩৪. সুভদ্রার বিবাহ-কারণ সত্যভামার মহাচিন্তা ও হস্তিনায় দূত প্রেরণ

মুনি বলে, অবধান করহ নৃপতি।
রাম-বাক্য শুনি দোঁহে হৈল দুঃখমতি।।
অধোমুখে বসিলেন দৈবকী রোহিণী।
সতী বলে সর্ব্বনাশ হৈল ঠাকুরাণী।।
না দিলে মারিবে পার্থ যুঝিবেক ক্রোধে।
আর যত মরিবেক তা সহ বিরোধে।।
মরিবে অনেক লোক সুভদ্রা-কারণ।
এক্ষণে না হয় কেন সুভদ্রা মরণ।।
গরল খাউক কিংবা প্রবেশুক জলে।
সকল অরিষ্ট খণ্ডে সুভদ্রা মরিলে।।
আমি তার সহ করি জলেতে প্রবেশ।
সংসারেতে লোকলজ্জা স্ত্রীবধ বিশেষ।।
এতেক ভাবিয়া দেবী ব্যাকুল-পরাণ।
পুনঃ উঠি যান সতী গোবিন্দের স্থান।।
দৈবকী রোহিণী দেবী কহিলেন যত।
গোবিন্দে করান সতী তাহা অবগত।।
গোবিন্দ বলেন, প্রিয়ে কি ভয় তোমার।
উপায় করিব, ইথে সে ভার আমার।।
দূত পাঠাইয়া তুমি আন ধনঞ্জয়।
সতী বলে, আমি যাই, দূত-কর্ম্ম নয়।।
একাকিনী যান সতী পার্থের সদন।
দেখিলা সুভদ্রা সহ আছেন অর্জ্জুন।।
সত্যভামা বলেন, কি নিশ্চিন্ত আছহ।
এতেক প্রমাদ পার্থ কিছু না জানহ।।
পার্থ বলিলেন, দেবি কিসের প্রমাদ।
যাহার সহায় দেবি তব যুগ্মপাদ।।
পার্থেরে লইয়া সতী যান কৃষ্ণস্থান।
হস্তে ধরি পালঙ্কে বসান ভগবান।।
গোবিন্দ বলেন, সখা কর অবধান।
পিতৃ-আজ্ঞা তোমারে সুভদ্রা দিতে দান।।
লাঙ্গলী বলেন, সখা কর অবধান।
পিতৃ-আজ্ঞা তোমারে সুভদ্রা দিতে দান।।
লাঙ্গলী বলেন, আমি দিব দুর্য্যোধনে।
এত বলি দূত পাঠাইলেন সেখানে।।
কি হইবে কহ সখা উপায় ইহার।
শুনি হাসি বলিলেন কুন্তীর কুমার।।
এই কথা হেতু সখা চিন্তা কেন মনে।
তোমার প্রসাদে আমি জিনি ত্রিভুবনে।।
মৃত্যুপতি মৃত্যুঞ্জয় ইন্দ্রে নাহি ডরি।
কামপাল যত শক্তি ধরেন শ্রীহরি।।
দাণ্ডাইয়া আপনি দেখুন হলধর।
সুভদ্রা লইয়া যাব সবার গোচর।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, দ্বন্দ্বে নাহি প্রয়োজন।
লুকাইয়া ভদ্রা লয়ে করহ গমন।।
মম রথে চড়ি যাহ মৃগয়ার ছলে।
সুভদ্রা পাঠাব আমি স্নানহেতু জলে।।
সেইকালে লয়ে তুমি করিবে গমন।
পশ্চাতে করিব শান্ত রেবতীরমণ।।
এতেক বলিল যদি দৈবকীকুমার।
অর্জ্জুন বলেন, দেব যে আজ্ঞা তোমার।।
হেনমতে বিচার করিয়া দুইজন।
নিজগৃহে চলিলেন করিতে শয়ন।।
প্রভাতে উঠিয়া পার্থ করি স্নান দান।
কি করিব বসিয়া করেন অনুমান।।
এতেক অনর্থ হৈবে রাম সহ রণ।
কিছু না জানেন রাজা ধর্ম্মের নন্দন।।
এত চিন্তি ইন্দ্রপ্রস্থে দূত পাঠাইয়া।
লিখিলেন সমস্ত বৃত্তান্ত বিবরিয়া।।
আমাকে সুভদ্রা দিতে কৃষ্ণের মানস।
কামপাল হইলেন তাহাতে বিরস।।
তাহে কৃষ্ণ বলিলেন লহ লুকাইয়া।
উহার বিহিত আজ্ঞা দেহ পাঠাইয়া।।
শুনিয়া বলেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।
পাণ্ডবের সখা বল বুদ্ধির নারায়ণ।।
তিনি কহিবেন যাহা করিবে সে কাজ।
শুনি পার্থ সানন্দ হৈলেন হৃদিমাঝ।।
হেনমতে সপ্ত নিশি গত হয় তথা।
হেথা দুর্য্যোধন রাজা শুনিল বারতা।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী হরিষ সর্ব্বজন।
কৃষ্ণের ভগিনীপতি হৈবে দুর্য্যোধন।।
দেশান্তর হইতে আনায় বন্ধুগণ।
বিবাহ-সামগ্রী হেতু করে নিয়োজন।।
স্থানে স্থানে বসি সবে করেন বিচার।
দুর্য্যোধনে পাণ্ডবের ভয় নাহি আর।।
এই কথা অহনির্শি চিন্তে মনে মন।
আজি হৈতে নির্ভয় হইল দুর্য্যোধন।।
পাণ্ডবের সহায় কেবল নারায়ণ।
দুর্য্যোধনের আত্মবন্ধু হইল এক্ষণ।।
দ্রোণ বলে, কৃষ্ণের কুটুম্বে নাহি প্রীত।
তাঁর নাহি পরাপর ভক্তজন হিত।।
বিদুর কহেন, কথা আশ্চর্য্য লাগয়।
কৃপাচার্য্য বলে, ইহা কদাচিত নয়।।
দুর্য্যোধনে অপ্রীত গোবিন্দ মহাশয়।
এমত হইবে কর্ম্ম মনে নাহি লয়।।
দূতস্থানে জিজ্ঞাসিল সব বিবরণ।
সকল বৃত্তান্ত দূত কহিল তখন।।
দ্বারকাতে আছেন অর্জ্জুন কুন্তী-সুত।
তাহাকে সুভদ্রা দিব বলেন অচ্যুত।।
পাণ্ডবে অপ্রীত রাম না করে স্বীকার।
দুর্য্যোধনে দিব বলে রোহিণী-কুমার।।
গোবিন্দের চিত্ত নহে দুর্য্যোধনে দিতে।
না হয় নির্ণয় কিছু কি হয় পশ্চাতে।।
ভীষ্ম বলে দুর্য্যোধন পাবে লজ্জা মাত্র।
যে কেহ করুক বিভা মোরা বরযাত্র।।
মহাভারতের কথা ‍অমৃত-সমান।
কাশী কহে, পাপী শুনে হয় পুণ্যবান।।