১১৬. অর্জ্জুনের নিয়মভঙ্গ, বনগমন, নাগকন্যা উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সহিত মিলন

তবে কতদিনে সেই রাজ্যের ভিতরে।
ব্রাহ্মণের গবী হরি লৈয়া যায় চোরে।।
কাতরে ব্রাহ্মণ কহে অর্জ্জুনের পাশ।
থাকিয়া তোমার রাজ্যে হৈল সর্ব্বনাশ।।
গালি দেয় ব্রাহ্মণ যতেক আসে মনে।
জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুন সঙ্কোচে সে ব্রাহ্মণে।।
কি হেতু কান্দহ দ্বিজ, কহ বিবরণ।
দ্বিজ বলে অস্ত্র লৈয়া চল এইক্ষণ।।
হরিয়া আমার গবী যায় দুষ্টগণ।
শীঘ্রগতি চল, তারা গেল এতক্ষণ।।
দ্বিজের বচন শুনি ধনঞ্জয় বীর।
আস্তে ব্যস্তে চলিলেন আয়ুধ-মন্দির।।
দৈবযোগে অস্ত্র-গৃহে কৃষ্ণা যুধিষ্ঠির।
দূরে থাকি জানি পার্থ হলেন বাহির।।
দ্বিজ বলে, অস্ত্র লয়ে শীঘ্রগতি চল।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দ্বিজ, চক্ষে পড়ে জল।।
দ্বিজের রোদন দেখি পার্থে হৈল ভয়।
কি করিব, চিত্তেতে চিন্তেন ধনঞ্জয়।।
গৃহে প্রবেশিলে দুঃখ হৈবে বহুতর।
দ্বাদশ বৎসর যাব অরণ্য-ভিতর।।
ব্রাহ্মণের চক্ষুজল যত ভূমে পড়ে।
ততবার মহাপাপ মম শিরে চড়ে।।
দ্বিজ-দুঃখ নাশিলে হইবে বড় কর্ম্ম।
বিনাক্লেশে উপার্জ্জন কভু নহে ধর্ম্ম।।
এত ভাবি অর্জ্জুন গেলেন অস্ত্রঘরে।
হস্তে ধনু লৈয়া বীর চলেন সত্বরে।।
দ্বিজ সহ গেলেন যথায় চোরগণ।
চোর মারি আনি দেন বিপ্রের গোধন।।
দ্বিজে প্রবোধিয়া আসি কহেন ফাল্গুনি।
শুন নিবেদন মম ধর্ম্ম নৃপমণি।।
অতিক্রম করিলাম লঙ্ঘিয়া সময়।
বনবাসে যাব, আজ্ঞা কর মহাশয়।।
রাজা কন, কেন হেন কহ ধনঞ্জয়।
পূর্ব্বেতে নারদ ঋষি কৈলা যে সময়।।
কনিষ্ঠ ভায়ের সঙ্গে কৃষ্ণা যদি থাকে।
জ্যেষ্ঠ ভাই বনে যাবে, তাহা যদি দেখে।।
তুমি মম কনিষ্ঠ ইহাতে দোষ নাই।
কেন হেন অপ্রিয় বচন বল ভাই।।
পার্থ বলিলেন, স্নেহে বল মহাশয়।
এ কপট কর্ম্মে প্রভু মম মত নয়।।
সত্যে বিচলিত হই, নাহি চাহে মন।
আজ্ঞা কর মহারাজ, যাব আমি বন।।
এই বলি পার্থ করিলেন নমস্কার।
মাতৃ ভ্রাতৃ সখা ছিল যত যত আর।।
সবারে বিদায় মাগি গেলেন কানন।
সব বন্ধুগণ হৈল বিরস বদন।।
অর্জ্জুনের সহিত চলিল দ্বিজগণ।
পৌরাণিক কথকাটি গায়ক চারণ।।
মহাবনে প্রবেশ করিয়া মতিমান।
বহুপুণ্যতীর্থে করিলেন স্নান দান।।
কত দিনে হরিদ্বারে করিয়া গমন।
দেখিয়া হলেন হৃষ্ট পাণ্ডুর নন্দন।।
স্নান করি অগ্নিহোত্র করে দ্বিজগণ।
গঙ্গায় প্রবেশি পার্থ করেন তর্পণ।।
তর্পণ করিতে দেখি অগ্নিহোত্র-স্থানে।
জল হৈতে নাগকন্যা ধরিল অর্জ্জুনে।।
বলে ধরি লয়ে গেল আপন মন্দির।
উত্তম আলয় তথা দেখে পার্থবীর।।
অগ্নিহোত্র জ্বলে তথা দেখি ধনঞ্জয়।
সেই অগ্নি পূজিলেন কুন্তীর তনয়।।
নিঃশঙ্ক হৃদয় পার্থ, নাহি ভ্রম ভয়।
কন্যারে বলেন এই কাহার আলয়।।
কি নাম ধরহ তুমি, কাহার কুমারী।
কি কারণে আমারে আনিলা এই পুরী।।
কন্যা বলে, ঐরাবত-নাগরাজ বংশে।
কৌরব্য নামেতে নাগ এই পুরে বৈসে।।
তার কন্যা আমি যে উলুপী মোর নাম।
তোমারে দেখিয়া মোরে, পীড়িলেক কাম।।
আনিলাম তোমারে যে এই সে কারণ।
তোমারে ভজিব, মোর তৃপ্ত কর মন।।
পার্থ বলিলেন, কন্যা না জান কারণ।
ব্রহ্মচারী আমি, ভ্রমি সতত কানন।।
দ্বাদশ বৎসর করিয়াছি এ নিয়ম।
কিমতে লঙ্ঘিব তাহা নহে কোন ক্রম।।
কন্যা বলে, সব তত্ত্ব আমি ভাল জানি।
কৃষ্ণা হেতু নিয়ম যে করিলা আপনি।।
অন্য স্ত্রীতে নাহি দোষ শুন মহাশয়।
তাহে আর্ত্ত জনে রক্ষা উচিত নিশ্চয়।।
আর্ত্ত হয়ে আমি বাঞ্ছা করি যে তোমারে।
ধর্ম্ম আছে, পাপ ইথে নাহিক সংসারে।।
অনুগত জন আমি কহিনু নিশ্চয়।
এক পুত্র দান মোরে দেহ মহাশয়।।
তোমার ঔরসে এক পুত্র আমি চাই।
তাহার অধিক কাম্য কিছু মোর নাই।।
হৃদয়ে বিচারি পার্থ কন্যার বচন।
ধর্ম্ম-সাক্ষী করি করেন পত্নীত্বে গ্রহণ।।
এক নিশি বঞ্ছি তথা পার্থ মহাবীর।
প্রাতঃকালে গঙ্গা হৈতে হলেন বাহির।।
বিস্ময় হইয়া দ্বিজগণ জিজ্ঞাসিল।
প্রত্যক্ষ বৃত্তান্ত পার্থ কহেন সকল।।
তবে দ্বিজগণ সহ কুন্তীর নন্দন।
হিমালয় পর্ব্বতে করেন আরোহণ।।
অগস্ত্য নামেতে বট বশিষ্ঠ-আশ্রমে।
বহুতীর্থে পার্থ স্নান করিলেন ক্রমে।।
পৃথিবী দক্ষিণাবর্ত্তা করি হেন গণি।
পূর্ব্ব-সিন্ধু-তীরে বীরে গেলেন আপনি।।
গয়া গঙ্গা প্রয়াগ, নৈমিষারণ্য আদি।
পৃথিবীতে যত তীর্থ, যত নদ নদী।।
অঙ্গ বঙ্গ মধ্যেতে যতেক তীর্থ বৈসে।
স্নান করি চলিলেন কলিঙ্গ-প্রদেশে।।
কলিঙ্গে না পশি বাহুড়িল দ্বিজগণ।
কলিঙ্গে পশিলে ভ্রষ্ট হয়ত ব্রাহ্মণ।।
কলিঙ্গ নগরে পশিলেন ধনঞ্জয়।
ক্রমে ক্রমে দেখিলেন যত তীর্থচয়।।
সমুদ্রের তীরেতে মহেন্দ্র গিরিবর।
মণিপুর নামে এক আছয়ে নগর।।
চিত্রভানু নামে রাজা রাজ্য অধিকারী।
চিত্রাঙ্গদা নাম ধরে তাহার কুমারী।।
দেবের বাঞ্ছিত কন্যা, পূর্ণা রূপে গুণে।
নগরে বিহরে কন্যা, দেখিল অর্জ্জুনে।।
কন্যা দেখি মোহিত হইয়া ধনঞ্জয়।
শীঘ্রগতি গেলেন সে রাজার আলয়।।
পার্থ বলিলেন, রাজা কর অবধান।
তোমার কুমারী এই মোরে দেহ দান।।
রাজা বলে, কে তুমি, কোথায় তব ঘর।
কোন বংশে জন্ম তব, কাহার কোঙর।।
তীর্থবাসী জন হৈয়া বাঞ্ছ রাজসুতা।
কেমনে সাহসে তুমি কহ এই কথা।।
অর্জ্জুন বলেন, আমি পাণ্ডুর তনয়।
কুন্তী-গর্ভে জন্ম মম, নাম ধনঞ্জয়।।
এত শুনি শীঘ্রগতি উঠিয়া রাজন।
আলিঙ্গন করি দিল বসিতে আসন।।
রাজা বলে, এতদূরে আসা কি কারণ।
বিশেষিয়া কহিলেন পৃথার নন্দন।।
রাজা বলে, মোর ভাগ্যে আইলা হেথায়।
মম বিবরণ শুন, কহিব তোমায়।।
প্রভঞ্জন নামে রাজা মম পূর্ব্ববংশে।
পুত্র-বাঞ্ছা করি রাজা সেবিল মহেশে।।
প্রসন্ন হইয়া বর দিলেন ঈশ্বর।
তব বংশে হৈবে রাজা একই কোঙর।।
কুলক্রমে এক ভিন্ন দ্বিতীয় নহিবে।
যে পুত্র হইবে, সেই রাজে রাজা হবে।।
পূর্ব্বেতে এমত বর দিলেন ধূর্জ্জটী।
পুত্র না হইল মম, হইল কন্যাটী।।
পুত্রবৎ করি কন্যা করি যে পালন।
মম বংশে রাজা হৈতে নাহি আর জন।।
সেই হেতু করিলাম মনে এ বিচার।
এই কন্যা দিয়া তারে দিব রাজ্যভার।।
কুরুবংশে শ্রেষ্ঠ তুমি না শোভে এ কথা।
এক সত্য কর, তবে দিব আমি সুতা।।
ইহার গর্ভেতে যেই জ্যেষ্ঠপুত্র হবে।
সেই সে আমার রাজ্যে রাজত্ব করিবে।।
সত্য করিলেন পার্থ, রাজা কন্যা দিল।
এক বর্ষ তথা তাঁরে রহিতে হইল।।
পরে পার্থ চলিলেন দক্ষিণ সাগর।
স্নান দান সর্ব্বত্র করেন বীরবর।।
একস্থানে তথায় দেখেন ধনঞ্জয়।
পঞ্চতীর্থ বলি তারে মুনিগণে কয়।।
অশ্বমেধ-ফল স্নানে হয়ত বিশেষে।
কিন্তু সে তীর্থসলিল কেহ না পরশে।।
বিস্মিত হইয়া পার্থ জিজ্ঞাসেন লোকে।
হেন তীর্থ লোকে না পরশে কোন্ পাকে।।
মুনিগণ বলেষ এই পুণ্যতীর্থ গণি।
কুম্ভীরের ভয়ে কেহ না পরশে পানি।।
শুনিয়া গেলেন স্নানে কুন্তীর নন্দন।
নিষেধিল তাঁহারে যাইতে সব জন।।
সৌভদ্র নামক তীর্থে পশি ধনঞ্জয়।
স্নান করিলেন বীর নিঃশঙ্ক হৃদয়।।
শব্দ শুনি কম্ভীরিণী আইল নিকটে।
অর্জ্জুনের পায়ে ধরে দশন বিকটে।।
বলে ধরি কূলে তারে তুলেন অর্জ্জুন।
গ্রাহরূপ ত্যজি কন্যা হইল তখন।।
অদ্ভুত মানিয়া জিজ্ঞাসেন পার্থবীর।
কে তুমি, কি হেতু হৈলা কুম্ভীর শরীর।।
কন্যা বলে, আমি বর্গা-নামেতে অপ্সরী।
কুবেরের ইষ্টা পঞ্চ আমরা কুমারী।।
সুবেশা হইয়া যাই যথা ধনেশ্বর।
পথে দেখি তপ করে এক দ্বিজবর।।
চন্দ্র-সূর্য্য সম তেজ মহাতপোধন।
অহঙ্কারে তাহারে করিলাম বিড়ম্বন।।
তপোভঙ্গ করিবারে গেনু তাঁর পাশ।
নৃত্য গীত বাদ্য, বহু হাস্য পরিহাস।।
কদাচিত বিচলিত নহিল ব্রাহ্মণ।
ক্রোধে মো সবারে শাপ দিল ততক্ষণ।।
অনেক বৎসর থাক গ্রাহরূপ ধরি।
করিলাম বহু স্তুতি করযোড় করি।।
অবধ্য অবলা জাতি, জানিয়া অন্তরে।
বধাধিক শাস্তি দিলা আমা সবাকারে।।
ব্রাহ্মণেরা শান্ত শীল সর্ব্বশাস্ত্রে জানি।
দয়ায় শাপান্ত আজ্ঞা কর মহামুনি।।
মুনি বলে, গ্রাহ হৈবে তীর্থের ভিতরে।
তবে মুক্ত হৈবে যদি তোলে কোন নরে।।
ব্রাহ্মণের বচন শুনিয়া পঞ্চজন।
বাহুড়িয়া যাই ঘরে হইয়া বিমন।।
আচম্বিতে দেখিনু নারদ তপোধন।
জানাইনু তাঁহাকে আপন বিবরণ।।
নারদ বলেন, নাহি হইও বিমনা।
পঞ্চ-তীর্থে গ্রাহরূপে থাক পঞ্চজনা।।
তীর্থযাত্রা হেতু যে আসিবে ধনঞ্জয়।
তাহার পরশে মুক্ত হইবে নিশ্চয়।।
সত্য হৈল যে বলিল ব্রাহ্মণ কুমার।
তোমার পরশে মুক্তি হইল আমার।।
চারি তীর্থে চারি সখী আছে যে আমার।
কৃপা করি তাহাদের করহ উদ্ধার।।
বিনয় শুনিয়া পার্থ হয়ে দয়াবান।
চারি তীর্থে চারি জনে করিলেন ত্রাণ।।
মুক্ত হৈয়া নিজ স্থানে গেল পঞ্চজন।
নিষ্কণ্টক তীর্থ করি গেলেন অর্জ্জুন।।
পুনঃ বীর মণিপুরে করেন গমন।
চিত্রাঙ্গদা সহ পুনঃ হইল মিলন।।
চিত্রাঙ্গদা-গর্ভে জনমিল যে নন্দন।
নাম রাখিলেন তার শ্রীবভ্রূবাহন।।
কত দিন বঞ্চি পুত্রে স্থাপিয়া রাজ্যেতে।
পুনঃ তীর্থ ভ্রমিবারে গেল তথা হৈতে।।