১৩২. দুর্য্যোধনের কন্যা লক্ষ্মণার স্বয়ন্বর

মুনি বলে, অবধান কর নরবর।
দুর্য্যোধন নৃপতির কন্যা-স্বয়ম্বর।।
ভানুমতি-গর্ভে জন্ম একই দুহিতা।
রূপে গুণে অনুপমা সর্ব্ব গুণযুতা।।
ভুবনমোহিনী সুলক্ষণা-বিভূষণা।
সে কারণে নাম তার রাখিল লক্ষ্মণা।।
যুবতী হইল কন্যা, দেখি নরবর।
হৃদয়ে চিন্তিয়া তবে কৈল স্বয়ম্বর।।
নিমন্ত্রিয়া আনাইল যত রাজগণে।
পৃথিবীতে নিবাস আছিল যে যে স্থানে।।
আইল যতেক রাজা, কত লব নাম।
রূপবন্ত গুণবন্ত কুলে অনুপাম।।
রথ গজ অশ্ব দেখি না হয় গণনে।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে না শুনি শ্রবণে।।
ধ্বজ ছত্র পতাকায় ঢাকিল মেদিনী।
চরণধূলিতে আচ্ছাদিল দিনমণি।।
সবাকারে দুর্য্যোধন করিল সম্মান।
বসিল নৃপতিগণ যার যেই স্থান।।
নারদের মুখে বার্ত্তা পেয়ে শাম্ব বীর।
শুনিয়া কন্যার রূপ হইল অস্থির।।
একেশ্বর রথে চড়ি করিল গমন।
কিমতে পাইব কন্যা, চিন্তে মনে মন।।
অলক্ষিতে একান্তে রহিল রথোপরে।
হেনকালে বাহির করিল লক্ষ্মণারে।।
অনুপম রূপ তার জিনি শরদিন্দু।
ঝলমল কুণ্ডল কমল-প্রিয়-বন্ধু।।
সম্পূর্ণ মিহির জিনি অধর রঙ্গিমা।
ভ্রূতঙ্গ-অনঙ্গ চাপ জিনিয়া ভঙ্গিমা।।
খঞ্জন গঞ্জন চক্ষু অঞ্জনে রঞ্জিত।
শুকচক্ষু নাসা, শ্রুতি গৃধিনী নিন্দিত।।
বিপুল নিতম্ব, গতি জিনিয়া মরাল।
চরণে কিঙ্গিণী আর নূপুর রসাল।।
নির্ধূমাগ্নি-শিখা যেন রচিলা বিদ্যুতে।
বালসূর্য্য উদয় হিইল পূর্ব্বভিতে।।
দৃষ্টিমাত্রে রাজগণ হারায় চেতন।
দেখি জাম্ববতী-সুতে পীড়িল মদন।।
শীঘ্রগতি ধরি হাতে তুলিলেন রথে।
চালাইয়া দিল রথ দ্বারকার পথে।।
ধর ধর বলিয়া ধাইল সেনা সব।
নানা অস্ত্র লৈয়া ধায় যতেক কৌরব।।
কৃষ্ণের নন্দন শাম্ব কৃষ্ণের সমান।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ এড়ে দিব্য বাণ।।
কাটিল অনেক সৈন্য চক্ষুর নিমিষে।
নাহিক ভ্রূক্ষেপ, বীর যুঝে অনায়াসে।।
হস্তী অশ্ব রথ রথী পড়ে সারি সারি।
যতেক মারিল যুদ্ধে বলিতে না পারি।।
ভয়েতে সম্মুখে তার কেহ নাহি রয়।
ক্রোধে আগু হৈয়া বলে সূর্য্যের তনয়।।
বালক হইয়া তোর এত অহঙ্কার।
কন্যা হরি লৈয়া যাস্ অগ্রেতে আমার।।
প্রতিফল ইহার পাইবি এইক্ষণে।
এত বলি কর্ণ বীর এড়ে অস্ত্রগণে।।
ইন্দ্রজাল অস্ত্রে এড়ে সূর্য্যের নন্দন।
নিবারিতে নারে শাম্ব পড়িল বন্ধন।।
ধরিল ধরিল চোর বলি শব্দ হৈল।
কাট লৈয়া, বলিয়া নৃপতি আজ্ঞা দিল।।
আমা লঙ্ঘে এই চোর আমার অগ্রেতে।
দক্ষিণ মশানে লৈয়া কাট মূঢ়-সুতে।।
নৃপতির আজ্ঞা পেয়ে ধায় দুঃশাসন।
অনেক মারিয়া তবে করিল বন্ধন।।
কর্ণ প্রতি জিজ্ঞাসিল রাজা দুর্য্যোধন।
চিনিলা কি এই চোর, কাহার নন্দন।।
কর্ণ বলে, মহারাজ এত গর্ব্ব কার।
চোর-পুত্র বিনা চুরি কে করিবে আর।।
শুনি দুর্য্যোধনের কাঁপিছে কলেবর।
কড়মড় দশনে কচালে করে কর।।
গোকুলেতে বাড়িল গোপের অন্ন খাইয়া।
ক্ষত্রকুলে কেহ কন্যা নাহি দেয় বিয়া।।
চুরি করি সব ঠাঁই এত মত লয়।
সহজে চোরের জাতি, কিবা লাজ ভয়।।
সর্ব্বত্র করিয়া চুরি বাড়িয়াছে মন।
নাহি জানে দুরন্ত এ যমের সদন।।
সভাতে এমত লজ্জা দিলেক আমায়।
কাট লৈয়া চোরেরে বিলম্ব না যুয়ায়।।
এতেক বলিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
কে চোর বলিয়া বলে ধর্ম্মের নন্দন।।
দুর্য্যোধন বলে, যুধিষ্ঠির মহারাজ।
তোমার কি অগোচর সেই চোর-রাজ।।
ভাই ভাই বলি যারে বলহ আপনি।
গোকুলে করিল চুরি গোকুল-কামিনী।।
বিদর্ভে করিল চুরি ভীষ্মক-দুহিতা।
পুত্র কাম কৈল চুরি বজ্রনাভ-সুতা।।
পৌত্র করিলেক চুরি বাণের নন্দিনী।
এ তিন পুরুষে চোর বিখ্যাত ধরণী।।
শুনিয়া বিষণ্ন মুখ হৈল ধর্ম্মরাজ।
কৃষ্ণ-নিন্দা শুনিয়া দুঃখিত হৃদিমাঝ।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ভাই না হয় উচিত।
গোবিন্দের নিন্দা করা সবার বিদিত।।
যে পারে করিতে চুরি সেই করে চুরি।
কাহার শক্তিতে কৃষ্ণে কি করিতে পারি।।
দুর্য্যোধন বলে, ভাল বল ধর্ম্মরাজ।
যাহা হৈতে আমার ভুবনে হৈল লাজ।।
মোর কন্যা চুরি করি লয় দুরাচার।
তারে নিন্দা করিতে এ উত্তর তোমার।।
যুধিষ্ঠির কহে, কন্যা কে করিল চুরি।
আন যদি তাহারে চিনিতে যদি পারি।।
দুর্য্যোধন বলেষ চোরে, কোন্ কার্য্য হেথা।
যে কেহ হউক শীগ্র কাট তার মাথা।।
যুধিষ্ঠির বলে, যদি কৃষ্ণের নন্দন।
তার বধে ভাল কি হইবে দুর্য্যোধন।।
কৃষ্ণ বৈরী হৈলে ভাই, রক্ষা আছে কার।
কুরুকুলে বাতি দিতে না রাখিবে আর।।
ইন্দ্র যম বরুণ কুবের পঞ্চানন।
কৃষ্ণ ক্রোধ করিলে রাখিবে কোন্ জন।।
দুর্য্যোধন বলে, যদি তুমি ডরাইলে।
ইন্দ্রপ্রস্থে যাহ প্রাণ লৈয়া এই কালে।।
এখনি শরণ গিয়া লহ কৃষ্ণ ঠাঁই।
মারিব দুষ্টেরে আমি কারে না ডরাই।।
দুর্য্যোধন-বাক্য যে শুনিয়া বৃকোদর।
পাইয়া জ্যেষ্ঠের আজ্ঞা ধাইল সত্বর।।
মশানেতে দুঃশাসন ধরি শাম্ব-চুলে।
কাটিবারে হস্তেবীর খড়্গ চর্ম্ম তোলে।।
বায়ুবেগে বৃকোদর উত্তরিল গিয়া।
হাত হৈতে খড়গ চর্ম্ম লইল কাড়িয়া।।
তাহারে বলিল, তোর কিমত বিচার।
কাটিবারে আনিয়াছ কৃষ্ণের কুমার।।
ধর্ম্মরাজ আজ্ঞা কৈল লইতে বাহুড়ি।
এত বলি ছিঁড়িল সে বন্ধনের দড়ি।।
হাতে ধরি কোলে করি লইল শাম্বেরে।
শাম্বে দেখি যুধিষ্ঠির কহেন সাদরে।।
জাম্ববতী-নন্দন হে বৎসল আমার।
চুম্বিয়া নিলেন কোলে ধর্ম্মের কুমার।।
দেখি ক্রোধে দুর্য্যোধন কাঁপে থর থরে।
দেখ দেখ বলিয়া বলয়ে সবাকারে।।
দেখ ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আপন বিদিত।
নিরন্তর কহ যে পাণ্ডব তব হিত।।
কুলের কলঙ্ক যে অধম দুরাচার।
হেন জনে মারিতে সহায় হৈল তার।।
যুধিষ্ঠির বলে, ভাই দেখ দুর্য্যোধন।
এ রূপ এ সভামধ্যে আছে কোন্ জন।।
যদু মহাকুলে জন্ম কৃষ্ণের কুমার।
কৃষ্ণ-পুত্রে দিব কন্যা কুলের আমার।।
ইহারে না দিয়া কন্যা আর কারে দিবে।
বরপূর্ব্বা হৈল কন্যা কলঙ্ক হইবে।।
কে আর করিবে বিভা পৃথিবী-মণ্ডলে।
সভাতে দেখিল, শাম্বে করিলেন কোলে।।
দুর্য্যোধন, বলিল, তোমার নাহি দায়।
এইমত গৃহে পাছে রাখিব কন্যায়।।
মারিব দুষ্টেরে, তুমি ছাড় শীঘ্রগতি।
ভীম বলে, দুর্য্যোধন হৈলে ছন্ন-মতি।।
কি দেখিয়া এত গর্ব্ব হইল তোমার।
কৃষ্ণ-পুত্রে মারিবা যে অগ্রেতে আমার।।
কে আসে আসুক দেখি তাহার বদন।
গদাঘাতে পাঠাইব যমের সদন।।
এত বলি গদা লৈয়া বীর বৃকোদর।
চক্র-চক্রী প্রায় ফিরে মস্তক উপর।।
ভীমের বচন শুনি দুর্য্যোধন ক্রোধে।
কাড়ি লহ বলি আজ্ঞা দিল সব যোধে।।
দুর্য্যোধন-আজ্ঞাতে যতেক সহোদর।
হাতে গদা করি সবে ধাইল সত্বর।।
ব্যাঘ্রের সম্মুখে যেতে ছাগে যেন শঙ্কা।
দেখি ধায় বৃকোদর সদা রণরঙ্গা।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কহে থাকি মধ্যস্থানে।
আপনা আপনি তাত দ্বন্দ্ব কর কোনে।।
বন্দি করি রাখ শাম্বে আমার গৃহেতে।
বুঝিয়া ইহার দণ্ড করিহ পশ্চাতে।।
দুর্য্যোধনে বলে তাত কৃষ্ণের এ সুত।
শ্রুত মাত্র যদুবলে আসিবে অচ্যুত।।
ইহারে এক্ষণে যদি প্রাণেতে মারিবে।
গোবিন্দ করিলে ক্রোধ অনর্থ হইবে।।
যুদ্ধ করি গোবিন্দে করিব পরাজয়।
তবেত মারিবে এরে, ঘরেতে আছয়।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, ভাল ভাল বলি।
দুর্য্যোধন বলে, দেহ চরণে শিকলি।।
চরণে নিগড় দিয়া নিল গঙ্গা-সুত।
নিজ নিজ গৃহে সবে যাইল ত্বরিত।।
মহাভারতের কথা ভুবনে অতুল।
কাশী কহে, ব্যাসের এ কীর্ত্তি নাহি তুল।।