১০২. অর্জ্জুনের সহিত দ্রৌপদীর কুম্ভকার-গৃহে গমন

মুনি বলে, অবধান কর জন্মেজয়।
জিনিয়া সকল সৈন্য ভীম ধনঞ্জয়।।
সমস্ত দিবস হৈল, হৈল সন্ধ্যাকাল।
ধীরে ধীরে গেলেন ভার্গব-কর্ম্মশাল।।
দোঁহার পশ্চাৎ চলে দ্রুপদ-নন্দিনী।
মত্তহস্তী পাছে যেন চলিল হস্তিনী।।
চতুর্দ্দিকে বেষ্টিত যতেক দ্বিজগণ।
কেমনে বাহির হৈব চিন্তে দুইজন।।
কৃতাঞ্জলি হইয়া বলয়ে দ্বিজগণে।
বিদায় মাগি যে আজি সবাকার স্থানে।।
অর্জ্জুনের বাক্য শুনি বলে দ্বিজগণ।
এমত অপ্রিয় দ্বিজ বল কি কারণ।।
তোমা দোঁহা সঙ্গ না ছাড়িব কদাচন।
নাহি জানি কি করিবে যত ক্ষত্রগণ।।
নিশাকালে তোমা দোঁহে নিঃসখা দেখিয়া।
দোঁহে মারি দ্রৌপদীরে লইবে কাড়িয়া।।
দোঁহারে বেড়িয়া সবে থাকি চতুর্ভিতে।
যাবৎ না শুনি, ক্ষত্র নাহি এ দেশেতে।।
পার্থ বলে সে ভয় না কর দ্বিজগণ।
আজি যাহ, কালি সবে করিব মিলন।।
অনেক প্রকারে পুনঃপুনঃ বুঝাইল।
তথাপিহ দ্বিজগণ সঙ্গ না ছাড়িল।।
দ্বিজগণ মধ্যে ছিল ধৌম্য তপোধন।
ডাকিয়া নিভৃতে কহে সব দ্বিজগণ।।
কোথাকারে যাহ সবে এ দোঁহা সংহতি।
চিনিলে কি এই দোঁহে, হয় কোন্ জাতি।।
কিবা দৈত্য, কিবা দেব, রাক্ষস কিন্নর।
কাহার তনয় দোঁহে, কোন্ দেশে ঘর।।
ইহার সংহতি তবে কোন্ প্রয়োজন।
যথা ইচ্ছা তথাকারে করুক গমন।।
ধৌম্য-বাক্য শুনি সবে ভয় হৈল মনে।
দোঁহাকার সংহতি ছাড়িল দ্বিজগণে।।
দ্বিজগণ মধ্যে বীর ধৃষ্টদ্যুন্ন ছিল।
ভগিনীর মমত্ব কদাচ না ছাড়িল।।
গুপ্তবেশে পাশে পাছে চলিল সংহতি।
মেঘে ঘোর অন্ধকার কৃষ্ণপক্ষ রাতি।।
হেনকালে যুধিষ্ঠির সঙ্গে দুই ভাই।
যাইতে ভার্গব-গৃহে মিলেন তথাই।।
একা কুম্ভকার-গৃহে ভোজের নন্দিনী।
সমস্ত দিবস গেল হইল রজনী।।
না দেখিয়া পুত্রগণে কান্দেন ব্যাকুলে।
ক্ষণে উঠে, ক্ষণে বৈসে, ভাসে অশ্রুজলে।।
ভিক্ষার সময় গেল হইল রজনী।
এতক্ষণ না আইল, কি হেতু না জানি।।
চতুর্দ্দিকে শুনি যে সৈন্যের কোলাহল।
মার মার বিপ্রগণে ডাকিছে সকল।।
অনুক্ষণ দ্বন্দ্ব বিনা ভীম নাহি জানে।
আজি বুঝি বিরোধ করিল কার সনে।।
এই হেতু, দ্বিজে কিবা মারে ক্ষত্রগণ।
বহু বিলাপিয়া কুন্তী করেন রোদন।।
হেনকালে উত্তরিল পঞ্চ সহোদর।
হৃষ্টচিত্তে মায়েরে ডাকিছে বৃকোদর।।
আজি মাতা সমস্ত দিন দুঃখ পাইলা।
উপবাসে মহাক্লেশে দিন গোঙাইলা।।
অনেক কলহ আজি হইল জননী।
সে কারণে হৈল মাতা এতেক রজনী।।
রাত্রিতে মিলিল ভিক্ষা, দেখ আসি মাতা।
কুন্তী বলে বাটিয়া লহ রে পঞ্চ ভ্রাতা।।
তোমা সবাকার বাক্য কর্ণে শুনি সুধা।
আনন্দ-সমুদ্রে ডুবি গেল মম ক্ষুধা।।
আয়রে সোণার চাঁদ, অরে বাছাধন।
নিকটে এস রে, দেখি সবার বদন।।
এত বলি শীঘ্র কুন্তী হইয়া বাহির।
একে একে চুম্ব দিল সবাকার শির।।
সবার পশ্চাৎ দেখি দ্রুপদ নন্দিনী।
পূর্ণ-শশধর-মুখী-গজেন্দ্র গামিনী।।
তাঁরে দেখি কুন্তী দেখি সবার পশ্চাতে।
ভীম বলে, জননী এ দ্রুপদ-দুহিতা।।
একচক্রা, নগরে শুনিলা যার কথা।
ইহার কারণে বহু বিরোধ হইল।
তোমার প্রসাধে জয় সর্ব্বত্র জন্মিল।।
এই ভিক্ষা হেতু মাতা হইল রজনী।
শুনিয়া বিস্ময় হৈলা ভোজের নন্দিনী।।
কুন্তী বলিলেন তবে শুন পঞ্চ ভাই।
কহিলাম কি কথা, অগ্রেতে জানি নাই।।
কেন হেন বৈলে পুত্র, কি কর্ক্ম করিলা।
কন্যারে পাইয়া কেন ভিক্ষা যে বলিলা।।
ভিক্ষা জানি বলি বাঁটি লও পঞ্চজন।
কিমতে মায়ের বাক্য করিবা লঙ্ঘন।।
তদন্তরে দ্রৌপদীরে কুন্তী ধরি হাতে।
যুধিষ্ঠির আগে কহে কান্দিতে কান্দিতে।।
সর্ব্ব ধর্ম্মাধর্ম্ম পুত্র তোমার গোচর।
শুনিয়াছ আমি করিলাম যে উত্তর।।
পুত্র হয়ে মোর বাক্য লঙ্ঘিবা কি মতে।
না লঙ্ঘিলে বিপরীত হইবে শুনিতে।।
যেমতে লঙ্ঘন নাহি হয় মম বাণী।
ধর্ম্মচ্যুত নাহি হয় দ্রুপদ-নন্দিনী।।
বুঝিয়া বিধান তার করহ আপনি।
এত বলি কান্দে দেবী চক্ষে বহে পানি।।
মায়ের বচনে শুনি ধর্ম্মের নন্দন।
ব্যাসের বচন পূর্ব্ব হইল স্মরণ।।
একচক্রা নগরে বলিলা ব্যাস মুনি।
পূর্ব্বে দ্বিজকন্যারে, কহিলা শূলপানি।।
পঞ্চ স্বামী হবে তোর না হয় খণ্ডন।
সেই কন্যা কৃষ্ণা নামে জন্মিলা এখন।।
তেঁই কহে মায়ে ধর্ম্ম আশ্বাস বচন।
তোমার বচন মাতা নহিবে লঙ্ঘন।।
অর্জ্জুনের চিত্ত তবে বুঝিবার তরে।
অর্জ্জুনেরে কহিলেন ধর্ম্ম নৃপবরে।।
বড় কর্ম্ম করিলা, পাইলা বহু কষ্ট।
লক্ষ্য বিন্ধি লক্ষ্য রাজা করিলা হে ভ্রষ্ট।।
বহু কষ্টে প্রাপ্ত হৈলে দ্রুপদ-নন্দিনী।
শুভকর্ম্মে বিলম্ব না কর ভাল মানি।।
ডাকাইয়া আনিয়া ধৌম্যাদি দ্বিজগণ।
বিভা আজি কর ভাই করি শুভক্ষণ।।
কৃতাঞ্জলি হইয়া কহেন ধনঞ্জয়।
অবিহিত কি হেতু বলহ মহাশয়।।
লোকে বেদে নিন্দে যেই কর্ম্ম দুরাচার।
বিবাহ তোমার আগে হইবে আমার।।
প্রথমে তোমার হবে, ভীম তার পাছে।
তদন্তরে আমার শাস্ত্রেতে হেন আছে।।
পার্থ-বাক্য শুনি ধর্ম্ম হয়ে হৃষ্টমন।
শিরে চুম্ব দিয়া করিলেন আলিঙ্গন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে, বৈকুণ্ঠে প্রয়াণ।।