১১০. কেতকীর প্রতি সুরভির অভিশাপ দান

দ্রুপদ কহিল, বলি শুন তপোধন।
কার কন্যা কেতকী, তাপসী কি কারণ।।
কি হেতু রোদন কৈল গঙ্গাতীরে বসি।
ইহার বৃত্তান্ত মোরে কহ মহাঋষি।।
অগস্ত্য বলেন, শুন তাহার কাহিনী।
সত্যযুগে ছিল সেই দক্ষের নন্দিনী।।
না করিল বিভা, সে সন্ন্যাস-ধর্ম্ম নিল।
হিমালয়-মন্দিরে হরের নিবেদিল।।
তোমার আলয়ে আমি তপস্যা করিব।
তুমি আজ্ঞা দিলে আমি নির্ভয়ে থাকিব।।
হর বলিলেন, থাক এই গিরিবরে।
আমার নিকটে থাক, কি ভয় তোমারে।।
পুরুষ পাইয়া তোরে যে করে সম্ভাষ।
শীঘ্র তুমি তাঁহারে আনিবা মম পাশ।।
হরের আশ্বাস পেয়ে কেতকী রহিল।
একাসনে ধেয়ানেতে জন্ম গোঁয়াইল।।
দৈবে এক দিন তথা আইল সুরভি।
পাছে পঞ্চ ষণ্ড দেখি ঋতুমতী গবী।।
পঞ্চগোটা ষণ্ড এক সুরভির পাছে।
ষণ্ডে ষণ্ডে মহাযুদ্ধ কেতকীর কাছে।।
ষণ্ডের গর্জ্জনে কেতকীর ধ্যান ভাঙ্গে।
পঞ্চগোটা ষণ্ড দেখি সুরভির সঙ্গে।।
দেখিয়া কেতকী তবে ঈষৎ হাসিল।
কেতকী হাসিল, তাহা সুরভি জানিল।।
উপহাস বুঝিয়া হৃদয়ে হৈল তাপ।
ক্রুদ্ধা হৈয়া গোমাতা তাহারে দিল শাপ।।
নাহিক ইহাতে লজ্জা, গরু জাতি আমি।
নরযোনি হয়ে তোর, হবে পঞ্চ স্বামী।।
পুনঃপুনঃ জন্ম তোর হৈবে নরযোনি।
দুই জন্ম বৃথা তোর যাবে বিরহিণী।।
তৃতীয় জন্মেতে হবে স্বামী পঞ্চজন।
পাইবে লক্ষ্মীর অঙ্গ হৈবে বিমোচন।।
একজন-অংশে তার হৈবে পঞ্চজন।
ভেদাভেদ নহিবেক, সবে একমন।।
কেতকী পুছিল তারে করি যোড়হাত।
অল্পদোষে এত বড় শাপিলা নির্ঘাত।।
কতকালে হবে মোর শাপ বিমোচন।
এক অংশে কাহারা হইবে পঞ্চজন।।
শাপ দিলা, তবে আমি ভুঞ্জিবারে চাই।
ইহার তদন্ত মোরে কহ শুনি গাই।।
সুরভি বলিল, শুন তাহার কারণ।
একা ইন্দ্র অংশেতে হইল পঞ্চজন।।
বৃত্রাসুর নাম, ত্বষ্টা মুনির নন্দন।
পরাক্রমে জিনিলেক সকল ভুবন।।
সুররাজ রণে যবে তারে সংহারিল।
শুনি ত্বষ্টা মুনি ক্রোধে আগুন হইল।।
আজি সংহারিব ইন্দ্রে, দেখ সর্ব্বজন।
নহে মোর তপোব্রত সব অকারণ।।
ব্রহ্মবধী বিশ্বাস-ঘাতকী দুরাচার।
কি মতে বহিছে ধর্ম্ম এ পাপীর ভার।।
ত্রিশিরস পুত্র মোর তপেতে আছিল।
অনাহারী মৌনব্রতী কারে না হিংসিল।।
হেন পুত্রে মোরে মোর দুষ্ট দুরাচার।
বিশ্বাস করিয়া বৃত্রে করিল সংহার।।
আজি দৃষ্টিমাত্রে ভস্ম করিব তাহারে।
এত বলি মুনিবর ধায় ক্রোধভরে।।
দুইপাটী দন্ত ঘন করে কড়মড়।
সুরাসুর দেখিয়া পলায় উভরড়।।
বায়ু বলিলেন, ইন্দ্র নিশ্চিন্তে আছহ।
ক্রোধান্বিত ত্বষ্টামুনি আইসে দেখহ।।
করে করে কচালে, ঊরুতে মারে চড়।
ক্ষিতি কাঁপে চলিতে চরণ তড়বড়।।
দীঘল জটিল দাড়ি করে নড়বড়।
সঘনে গর্জ্জয়ে যেন ঘন গড়গড়।।
নাসার নিঃশ্বাস যেন প্রলয়ের ঝড়।
নেত্রানলে পোড়ে বন শুনি চড়চড়।।
ঘন ঘন জ্হিবা ধরি দিতেছে কামড়।
ভুজে ঠেকি ভাঙ্গে বৃক্ষ শুনি মড়মড়।।
মম বাক্যে সুরপতি বাহনে না চড়।
আগু হৈয়া অর্দ্ধপথে পায়ে গিয়া পড়।।
দুই হাত বান্ধি তার চরণেতে পড়।
গলায় কুঠারি বান্ধি দন্তে লহ খড়।।
নতুবা পলাও শীঘ্র, আইল নিয়ড়।
রহিলে নাহিক রক্ষা, কহিলাম দড়।।
শুনি ইন্দ্র ভয়ে আত্মা করে ধড়ফড়।
না স্ফুরে মুখেতে বাক্য, হৈল যেন জড়।।
কোথায় লুকাব, হেন না দেখি আহড়।
আজ্ঞা কৈল আনিবারে যত হস্তী ঘোড়।।
ঐরাবত আদি যত হস্তী বড় বড়।
চতুর্দ্দিকে বেড়িয়া রাখিল যেন গড়।।
ত্বষ্টার দেখিয়া ক্রোধ ইন্দ্র পায় ত্রাস।
কোথা যাব, রক্ষা পাব, গেলে কার পাশ।।
নিকটেতে ইন্দ্রের আছিল চারি জন।
ধর্ম্ম, বায়ু আর দুই অশ্বিনী-নন্দন।।
চারি জনে চারি অংশ কৈল সমর্পণ।
অপর আত্মায় দিল নিজ দেহে স্থান।।
পঞ্চ ঠাঁই পঞ্চ-আত্মা কৈল পুরন্দর।
এক আত্মা ধরিয়া রহিল কলেবর।।
আর চারি আত্মা সমর্পিল চারি ঠাঁই।
ধর্ম্ম বায়ু অশ্বিনীকুমার দুই ভাই।।
হেনকালে উপনীত ত্বষ্টা মহাঋষি।
দৃষ্টিমাত্রে পুরন্দরে কৈল ভস্মরাশি।।
ইন্দ্রে ভস্ম বসিল ইন্দ্রাসনে।
আমি ইন্দ্র বলিয়া ঘোষিল দেবগণে।।
কেতকীর প্রতি তবে সুরভি বলিল।
হেনমতে ইন্দ্র তবে পঞ্চ ঠাঁই হৈল।।
সেই পঞ্চ অংশ হৈতে হৈবে পঞ্চজন।
তুমি তার ভার্য্যা হৈবে, না যায় খণ্ডন।।
কেতকী বলিল, কহ শুনি গো জননী।
কিমতে পাইল প্রাণ পুনঃ বজ্রপাণি।।
গবী বলে, ত্বষ্টা ইন্দ্রে করিয়া সংহার।
আপনি লইল স্বর্গে ইন্দ্রের যে ভার।।
দেবগণ গিয়া তবে কহিল ব্রহ্মারে।
ইন্দ্র বিনা থাকিতে কি পারে স্বর্গপুরে।।
ভাঙ্গিল ইন্দ্রের সভা, দেবের নগর।
নৃত্য গীত নাহি করে অপ্সরী অপ্সর।।
অনুক্ষণ হইল অসুর-উপদ্রব।
এই হেতু রহিতে না পারিলাম সব।।
এত শুনি ব্রহ্মা পাঠাইল নারদেরে।
নারদ কহিল সব ত্বষ্টার গোচরে।।
ইন্দ্রত্ব লইয়া মুনি কর ইন্দ্রকার্য্য।
ইন্দ্র বিনা উপদ্রব হৈল সর্ব্বরাজ্য।।
মুনি বলে, ইন্দ্রত্বে কি মম প্রয়োজন।
জপ তপ ব্রতে মন যায় অনুক্ষণ।।
যাহার ইন্দ্রত্বে ইচ্ছা, লউক এখন।
ত্বষ্টার এ কথা শুনি বলে তপোধন।।
ইন্দ্রেরে সৃজিল ধাতা সৃষ্টির কারণ।
বিনা ইন্দ্র ইন্দ্রত্ব করিবে কোন্ জন।।
আপনি ইন্দ্রত্ব যদি না করিবা মুনি।
ক্রোধ ত্যজি জিয়াইয়া দেহ বজ্রপাণি।।
বিধাতার সৃষ্টি রাখ, আমার বচন।
শুনিয়া স্বীকার করিলেন তপোধন।।
ইন্দ্র-ভস্ম যে ছিল অগ্রেতে আনি দিল।
শান্ত দৃষ্টে চাহি ত্বষ্টা তাঁরে জীয়াইল।।
হেনমতে দেবরাজ পুনঃ পায়প্রাণ।
তোমারে কহিলাম এ কথন পুরাণ।।
এত বলি সুরভি গেলেন নিজ-স্থান।
চিন্তিয়া কেতকী চিত্তে করিতেছে ধ্যান।।
গঙ্গাতীরে বসি কান্দে, পড়ে অশ্রুজল।
তাহে জন্ম হয় দিব্য কনক-কমল।।
এতেক বলিতে স্বর্গে দুন্দুভি বাজিল।
আকাশে থাকিয়া ডাকি দেবতা কহিল।।
অগস্ত্য কহেন যাহা, কিছু নহে আন।
পঞ্চ পাণ্ডবের হেতু কৃষ্ণার নির্ম্মাণ।।
শীঘ্র কর শুভকর্ম্ম, সুরপতি ডাকে।
এত বলি পুষ্পবৃষ্টি করে ঝাঁক ঝাঁকে।।
ইন্দ্র পাঠাইয়া দিল দিব্য আভরণ।
কেয়ূর কুণ্ডল হার বলয় কঙ্কণ।।
অম্লান অম্বর, পারিজাত পুষ্পরাজ।
চিত্ররথ সহ দিল অঙ্গনা-সমাজ।।
হেনকালে আইলেন রাম নারায়ণ।
দ্বারকা নিবাসী যত স্ত্রী পুরুষগণ।।
বিবাহ-মঙ্গল দ্রব্য বসুদেব লৈয়া।
স্ত্রীগণ লইয়া এল গরুড়ে চড়িয়া।।
আইল দেবকী দেবী রোহিণী রেবতী।
রুক্মিণী কালিন্দী সত্যভামা জাম্ববতী।।
নগ্নজিতা মিত্রবৃন্দা ভদ্রা সুলক্ষণা।
আর যত যদুনারী কে করে গণনা।।
নানারত্ন আনিল ভূষণ অলঙ্কার।
দশকোটি অশ্ব, দশকোটি রথ আর।।
দশকোটি মাতঙ্গ, বৃষভ অগণন।
উট খর শকটে পূর্ণিত করি ধন।।
সকলে দিলেন কৃষ্ণ ধর্ম্মের নন্দনে।
যুধিষ্ঠির অপার আনন্দযুক্ত মনে।।
মাতুলাণী মাতুলে প্রণমে পঞ্চজনে।
একে একে সম্ভাষেন যত যদুগণে।।
নিকটেতে রাজগণ পাইয়া বারতা।
বিবাহ-যৌতুক লৈয়া শীঘ্র এল তথা।।
যারে যেই সম্ভাষ করিল সর্ব্বজন।
আদরে করিল পূজা দ্রুপদ রাজন।।
মহাভারতের কথা অপ্রমিত সুধা।
সতত শুনহ নর ভারতের কথা।।