১১২. পাণ্ডবদিগের বিবাহ-বার্ত্তা শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনাদির মন্ত্রণা

বার্ত্তা উপরন্তে তার তৃতীয় দিবসে।
ভগ্নদত্ত দুর্য্যোধন উত্তরিল দেশে।।
যাবার সময় গেল দশ অক্ষৌহিণী।
পঞ্চ অক্ষৌহিণীতে আইল নৃপমণি।।
কারে রথে নাহি ধ্বজা, দন্তী দন্ত কাটা।
কারো ক্ষত দেহ, কেহ কুব্জা বোঁচা ঠুঁটা।।
কারো মুখে নাহি কথা, নাহিক বাজন।
নাহিক চামর ছত্র, নাহি চিহ্ন বাণ।।
বাপের চরণে গিয়া নমস্কার কৈল।
আশীর্ব্বাদ করি অন্ধ বার্ত্তা জিজ্ঞাসিল।।
কহ তাত যুধিষ্ঠির সহিত মিলিলা।
হুলাহুলি করিয়া সম্প্রীতে বিভা দিলা।।
কিরূপে পাণ্ডব সহ হইল মিলন।
আইল কি তব সঙ্গে পাণ্ডু-পুত্রগণ।।
শুনি দুর্য্যোধন কর্ণে লাগে চমৎকার।
জানিল ব্রাহ্মণ নহে পাণ্ডুর কুমার।।
কর্ণ বলে, কি কথা কহিলে মহাশয়।
হেন বাক্য কি মতে স্ফুরিত মুখে হয়।।
আমার পরম শত্রু পাণ্ডুর নন্দন।
আমা দেখা পাইলে কি জীয়ে পঞ্চজন।।
ছদ্ম-দ্বিজ বেশ ধরি ভাণ্ডিল আমারে।
দ্বিজ-বধ-ভয় করি ক্ষমিলাম তারে।।
তখন জানিতাম যদি, মারিতাম প্রাণে।
পাণ্ডু-পুত্র বলি শুনি তোমার বদনে।।
দুর্য্যোধন বলে, ইহা জানিব কেমনে।
এতকাল জীয়ে আছে পাণ্ডু-পুত্রগণে।।
ধিক্ ধিক্ পুরোচন মৈল ভালে পুড়ি।
কি করিল কার্য্য, লজ্জা কৈল ক্ষিতি যুড়ি।।
এক্ষণে কি হইবেক ইহার উপায়।
শিয়রে হইল শত্রু শমনের প্রায়।।
এই সন্নিকটে যদি উপায় নহিবে।
পশ্চাতে ইহার জন্য অনর্থ হইবে।।
লোক পাঠাইয়া দেহ দ্রুপদের স্থানে।
নিভৃতে কহুক গিয়া পাঞ্চাল রাজনে।।
সহস্রেক রথ দিব, সহস্রেক হাতী।
অর্দ্ধরাজ্য ভোগ কর আমার সংহতি।।
সখ্য হৈয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন তব পুত্র সহ।
আমার পরম শত্রু পাণ্ডবে মারহ।।
নতুবা পাঠাই যে সুরূপা নারীগণ।
পাণ্ডবের সহ রহুক করুক কথন।।
দ্রৌপদীরে তাহার হউক অনাদর।
তবে ক্রোধ করিবে দ্রুপদ নরবর।।
নতুবা সুহৃদ দ্বিজে তথায় পাঠাই।
প্রকারেতে ভেদ করাউক পঞ্চ ভাই।।
পঞ্চ ভাই তারা যদি বিচ্ছেদ করিব।
কোন্ ছার পাণ্ডু-পুত্র নিমিষে মারিব।।
নতুবা যাউক এক অন্তঃপুরে-লোক।
সবার অগ্রেতে কাঁদি কহে পূর্ব্ব-শোক।।
তবে তারে পাণ্ডু-পুত্র করিবে বিশ্বাস।
বিষ দিয়া বৃকোদরে করুক বিনাশ।।
ভীম বিনা পাণ্ডবেরা হইবে অনাথ।
কর্ণ-যুদ্ধে কে যাইবে অর্জ্জনের সাথ।।
দুর্য্যোধন বচন শুনিয়া কর্ণ বলে।
কিছু নাহি চিত্তে লাগে যতেক কহিলে।।
দ্রুপদ রাজারে রত্নে লোভ করাইবে।
ত্রৈলোক্য পাইলে সেও না ত্যজে পাণ্ডবে।।
একেত জামাতা, আর দ্বিতীয়ে বলিষ্ঠ।
এক্ষণে কি দ্রুপদের আছে পূর্ব্বাদৃষ্ট।।
দ্বিজ দ্বারা ভ্রাতৃভেদ কি করিতে পারি।
ভেদ না হইল পঞ্চ স্বামী এক নারী।।
ভীমেরে মারিতে পারে আছে কোন্ জন।
কত না করিলা গৃহে আছিল যখন।।
বিষ দিলা, নানা অস্ত্র গর্ত্ত খুঁড়েছিলে।
অবশেষে জতুগৃহে দাহন করিলে।।
করিলা যতেক কিবা হইল তাহায়।
এক্ষণে হইল তার অনেক সহায়।।
নারীগণ কি করিবে পাণ্ডবের ঠাঁই।
কটাক্ষেও পরস্ত্রী না দেখে পঞ্চ ভাই।।
যতেক উপায় বল, নাহি লয় মনে।
বিনা দ্বন্দ্বে সাধ্য নহে পাণ্ডুর নন্দনে।।
যাবৎ না আইসেন কৃষ্ণ যদু-বলে।
যাবৎ না পায় বার্ত্তা নৃপতি সকলে।।
রজনীর মধ্যে গিয়া নগর বেডিব।
সপুত্র দ্রুপদ সহ পাণ্ডবে মারিব।।
কর্ণের বচন শুনি অন্ধ নৃপবর।
সাধু সাধু বলিয়া প্রশংসে বহুতর।।
এ বিচার করিতে তোমারে যোগ্য দেখি।
তবে ভীষ্ম বিদুর দ্রোণেরে আন ডাকি।।
সে সবার মত দেখি কি করে যুকতি।
এত বলি সবারে ডাকিল শীঘ্রগতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, সদা কর পান।।