১১৯. পারিজাত-হরণ বৃত্তান্ত

মুনি কহে, শুন কুরুবংশ-চূড়ামণি।
পারিজাত-হরণের অপূর্ব্ব কাহিনী।।
এককালে নারায়ণ বিহার কারণ।
করিলেন রৈবতক-পর্ব্বতে গমন।।
হেনকালে নারদ তথায় উপনীত।
বাজায়ে সুনাদ বীণা কৃষ্ণ-গুণ গীত।।
পারিজাত পুষ্প ছিল বীণায় বন্ধন।
গোবিন্দের হস্তেতে দিলেন তপোধন।।
পরম সুন্দর পুষ্প দেবের দুর্লভ।
যোজন পর্য্যন্ত যায় যাহার সৌরভ।।
দেখি আনন্দিত চিত্ত হৈয়া হৃষীকেশ।
পুষ্প দিয়া রুক্মিণীরে করেন সুবেশ।।
একে ত রুক্মিনী দেবী ত্রৈলোক্য-মোহিনী।
পারিজাত-সুবেশে শোভিল সবা জিনি।।
নারদ ক্ষণেক করি কথোপকথন।
বিদায় লইয়া চলিলেন তপোধন।।
কলহে সানন্দ বড় ব্রহ্মার নন্দন।
মুনি পথে যাইতে চিন্তেন মনে মন।।
সত্যভামা আগে কহি পারিজাত-কথা।
শুনিয়া কি বলে দেখি সত্রাজিত-সুতা।।
এত চিন্তি গিয়া মুনি দ্বারকা নগর।
সত্যভামা-গৃহে উপনীত ত্বরাপর।।
মুনি দেখি সত্যভামা করিলা বন্দন।
পাদ্য অর্ঘ্য অর্পিলেন বসিতে আসন।।
কোথায় আছিলা বলি জিজ্ঞাসেন সতী।
কহেন করুণ-বাক্য মুনি মহামতি।।
আজি গিয়াছিলাম যে ইন্দ্রের নগর।
পুষ্প দিয়া আমারে পূজিল পুরন্দর।।
নরের অদৃষ্টপূর্ব্ব দেবের দুর্ল্লভ।
দিল ইন্দ্র মোরে বহু করিয়া গৌরব।।
পুষ্প লভি হৈল মনে চিন্তার উদয়।
বিনা ইন্দ্র উপেন্দ্র অন্যের যোগ্য নয়।।
সে কারণে পুষ্প আনি দিলাম কৃষ্ণেরে।
পুষ্প দেখি শ্রীগোবিন্দ সানন্দ অন্তরে।।
সেইক্ষণে রুক্মিণীরে আনি জগন্নাথ।
স্বহস্তে ভূষণ করিলেন পারিজাত।।
সে পুষ্পে ভূষিবা মাত্রে ভীষ্মক দুহিতা।
রূপে ত্রৈলোক্যের নারী করিলা বিজিতা।।
সবা হৈতে প্রেয়সী তোমারে আমি জানি।
এবে জানিলাম কৃষ্ণ প্রেয়সী রুক্মিণী।।
মুনির এতেক বাক্য শুনিয়া সুন্দরী।
চিত্রের পুত্তলি প্রায় রহে মান করি।।
ছিঁড়িয়া ফেলিলা কন্ঠে ছিল যেই হার।
ঘুচাইয়া ফেলেন অঙ্গের অলঙ্কার।।
ছিঁড়িল পুষ্পের মাল্য, খসিল কুন্তল।
হাহাকার করিয়া পড়েন ভূমিতল।।
সতীর দেখিয়া কষ্ট মনে মনে হাসি।
রৈবতক-পর্ব্বতেতে বেগি যান ঋষি।।
রুক্মিণীর গৃহে কৃষ্ণ করেন ভোজন।
হেনকালে উপনীত তথা তপোধন।।
গোবিন্দ কহেন মুনি, কহ সমাচার।
পুনঃ হেথা কি হেতু আগমন তোমার।।
মুনি বলে, অবধান শ্রীমধুসূধন।
দ্বারকা নগরে গিয়াছিলাম এখন।।
সত্যভামা জিজ্ঞাসিল তোমার বারতা।
প্রসঙ্গে প্রসঙ্গে হৈল পারিজাত-কথা।।
এমত হইবে বলি জানিব কেমনে।
রুক্মিণীরে দিলা পুষ্প শুনিয়া শ্রবণে।।
সেইক্ষণে মূর্চ্ছাপন্ন পড়িল ধরণী।
হাহাকার করিয়া কান্দয়ে উচ্চধ্বনি।।
ছিঁড়িয়া ফেলিল যত বসন ভূষণ।
কপালে প্রহার হস্ত করে ঘনে ঘন।।
সব সখীগণ মিলি করয়ে প্রবোধ।
না শুনিয়ে কিছুই, দ্বিগুণ করে ক্রোধ।।
প্রাণ যাক্ প্রাণ যাক্, এই মাত্র ডাকে।
দেখিয়া এলাম শীঘ্র কহিতে তোমাকে।।
শুনিয়া গোবিন্দ চিত্তে হইল বিস্ময়।
কি করিব, কি হইবে চিন্তেন হৃদয়।।
পারিজাত পুষ্প হেতু অনর্থ ভাবিয়া।
রুক্মিণীরে শ্রীকৃষ্ণ কহেন প্রবোধিয়া।।
কি করিব বৈদর্ভি আপনি কর ক্ষমা।
যেমন চরিত্র, তুমি জান সত্যভামা।।
ক্রোধেতে আপন প্রাণ ছাড়িবারে পারে।
তোমার প্রসাদ হৈল দেহ পুষ্প তারে।।
শুনিয়া রুক্মিণী হইলেন বড় দুঃখী।
গোবিন্দেরে কহেন হইয়া অধোমুখী।।
দিয়া পুষ্পরাজ পুনঃ লইবা মুরারি।
সহজে দুর্ভাগা আমি কি করিতে পারি।।
মোরে পুষ্পা দিলা বলি পুড়িছে অন্তরে।
মরুক পুড়িয়া, কেন পুষ্প দিব তারে।।
রুক্মিণীর বাক্য শুনি চিন্তেন শ্রীহরি।
নারদেরে জিজ্ঞাসেন, বৃত্তান্ত বিবরি।।
কোথায় পাইলা পুষ্প, কহ মুনিবর।
নারদ কহেন আছে স্বর্গে তরুবর।।
ইন্দ্রের রক্ষকগণ করয়ে রক্ষণ।
তাহাতে নন্দন-বন করয়ে শোভন।।
মাগিয়া পাঠাও পুষ্প সহস্র-লোচনে।
তব নাম শুনিলে দিবেন সেইক্ষণে।।
গোবিন্দ বলেন, মুনি যাহ তুমি তথা।
মোর নাম লৈয়া ইন্দ্রে কহ এই কথা।।
ক্ষীরোদ মথনে পুষ্প হয়েছে উৎপত্তি।
একা তুমি ভোগ কর কেন শচীপতি।।
দেহ পারিজাত যে আমার ভাগ আছে।
না দিলে সহজে পুষ্প, দুঃখ পাবে পাছে।।
প্রথমেতে সম্প্রীতে মাগিহ তপোধন।
না দিলে এ সব পিছে কহিবা তখন।।
এত বলি কৃষ্ণ করি নারদে প্রেরণ।
দ্বারাবতী যান সত্যভামার কারণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশীদাস কহে, সাধু পিয়ে কর্ণ ভরি।।