মৃত্যুঘণ্টা – ৯

নয়

রুই ডে জাখদান্স সেইন্ট পলের রাস্তা নির্জন। নির্দিষ্ট বাড়ির দিকে ক্যামেরা আকৃতির একটা ডিভাইস তাক করল এলেনা।

যন্ত্রটা কান পাতার মেশিন। বাড়িতে কথা বা শব্দ হলে সেটা পৌঁছে যাবে এলেনার কাছে। বিশেষ কাঁচ কমিয়ে দেয় তরঙ্গের গতি, বা ব্যবহার করা হয় জ্যামিং ডিভাইস, সেক্ষেত্রে বাধাগ্ৰস্ত হবে এই ডিভাইসের সিগনাল। অনেকটা এভাবেই রেইডার তরঙ্গ ঠেকানো হয় প্রচণ্ড শক্তির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি দিয়ে। কিন্তু শব্দের বিশেষ ছাপ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। এলেনার ডিভাইস পরিষ্কার ধরবে বাড়ির ভেতরের সব আওয়াজ।

বাড়িতে কেউ থাকলে রিডআউট সমতল রেখা দেখাবে না।

কিন্তু কোনও তরঙ্গ বা জ্যামিং ডিভাইস কাজ করছে না। টিভি বন্ধ। আপাতত থমথম করছে চারপাশ।

স্ক্যানার চালু করল এলেনা। ব্যবহার করছে ইনফ্রারেড মোড। এক দেয়াল থেকে শুরু করে চারপাশ সার্চ করল। কোথাও কোনও হিট সোর্স নেই।

‘ভেতরে কেউ নেই,’ রানাকে জানাল এলেনা।

‘গুড,’ বলল রানা।

রাস্তার চারদিক স্ক্যান করল এলেনা।

আশপাশে কেউ নেই একটা কুকুর ছাড়া।

দুপুর দুটো, আকাশ থেকে আগুন ঢালছে সূর্য।

এদিকের সবাই গেছে যে যার অফিস, কলেজ, স্কুল বা অন্য কাজে।

গাড়ির দরজা খুলল রানা।

‘কোথায় যাও?’ জানতে চাইল এলেনা।

‘বাড়িটা ঘুরে দেখতে।’

‘আমি একা যাব,’ বলল এলেনা। ‘তোমার কাছ থেকে শেখা বিদ্যা ফলাবার এই তো সুযোগ।’

‘কিন্তু…’

রানাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না এলেনা, ‘জেনেটিকস সম্পর্কে কী জানো তুমি? তার চেয়ে বাইরে থেকে আমাকে পাহারা দাও।’

‘আমি কি পাহারাদার?’

‘ছিহ্, তা কেন, তুমি আমার হিরো। সবসময় পাহারা দিতে হয় নায়িকাদেরকে। ‘

‘অন্য নায়িকারা কই? শুধু তুমি হলেই হবে?’ মৃদু হাসল রানা, ‘বলো দেখি, কী জানো জেনেটিকস সম্পর্কে?’

‘এটা জানি আমরা আসলে ভাইরাসেরই ভাই-বোন!’

একটু গম্ভীর হলো রানা, ‘কমপিউটার হ্যাক, এনক্রিপশন, বাইপাসিং অ্যালার্ম, সব বুঝে…’

‘কে বলল তোমার কাছ থেকে কিছুই শিখিনি?’ মাথা নাড়ল এলেনা। ‘তুমি মাস্টার, এবার ছাত্রীর পরীক্ষা নাও। বসে দেখো, চোরের মত ঢুকে ঠিকঠাক আবারও বেরিয়ে আসতে পারি কি না।’

সামান্য দ্বিধা করল রানা। পকেট থেকে ছোট একটা ফ্ল্যাশ ড্রাইভ বের করে ধরিয়ে দিল এলেনার হাতে। ‘এটা ব্যবহার কোরো। রেডিয়ো অন রেখো। খারাপ কিছু বুঝলে দেরি না করে যোগাযোগ করবে।

ক্লাস টু’র লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথা দোলাল এলেনা, নেমে পড়ল গাড়ি ছেড়ে। পেরিয়ে গেল রাস্তা, ঢুকে পড়ল সামনের বাগানে। চালু করে নিয়েছে ডান কানের হেডফোনের স্পিকার। সিঁড়ি বেয়ে উঠল বারান্দায়। ভাব দেখে মনে হলো বাড়ির মালকিন আসলে ও-ই। হাতে ছোট কী এক ডিভাইস। কয়েক সেকেণ্ডে পরীক্ষা হয়ে গেল, চারপাশে অ্যালার্ম নেই। ছয় সেকেণ্ড পর খুলে গেল দরজার তালা।

মনে মনে ওর প্রশংসা করল রানা।

অবশ্য, এসব আমেরিকান ডিভাইস না পেলে অন্তত পাঁচ মিনিট ব্যয় হতো এলেনার। চারপাশ বুঝে নিয়ে খালি হাতে বাড়িতে ঢুকে পড়তে রানারও প্রায় এরকম সময়ই লেগে যেত।

রানার কণ্ঠ শুনল এলেনা, ‘বেশি দেরি কোরো না।’

শক্ত কাঠের মেঝেতে খট খট আওয়াজ তুলল এলেনার হাই-হিল। সামনের ঘরটা বড় হলেও প্রায় ফাঁকা। এক কোণে পেটমোটা গদিওয়ালা চেয়ার। পাশের বুক শেলফে পুরু ধুলো।

কিচেন, ডেন আর বাথরুম ঘুরে দেখল এলেনা, ভাবল ওই লোকের বউ ছিল না। ছিহ্, সুন্দর বাড়িটার কী অবস্থা করেছে! হায়, নিঃসঙ্গ, বোকা পুরুষ!

এদিক ওদিক ঘুরে আরেকটা ঘরে ঢুকল এলেনা।

ওটা ব্যবহার করা হতো লিভিং রুম হিসেবে। ঘরের মাঝে ডেস্ক আর চেয়ার। মেঝেতে দামি কার্পেট। দেয়ালের পাশে উঁচু র‍্যাকে হাই-টেক সব ইকুইপমেন্ট। সেসবের ভেতর রয়েছে বেশ কয়েকটা শক্তিশালী কমপিউটার। আরেক দিকে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেফ্রিयারেটর ও ইনকিউবেটর। ফ্রিযের কাঁচের দরজায় বরফ না জমলেও অস্বচ্ছ। ডেস্ক থেকে বামে প্লেক্সিগ্লাসের ওঅর্কস্টেশন। বেশিরভাগ সময় ওখানেই কাটাতেন বিজ্ঞানী। ডেস্কে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী মাইক্রোস্কোপ। ওঅর্কস্টেশনে কাজ করার জন্যে আর্মহোল-এ ঝুলছে রাবারের গ্লাভস।

আসলে এই লিভিং রুম গুছিয়ে নেয়া হয়েছে ল্যাব হিসেবে। ইনকিউবেটরের পাশে থামল এলেনা। প্রথম দুটো গরম, কিন্তু ভেতরে কিছুই নেই। দেখা গেল না গ্লাস স্লাইড বা স্যাম্পল ট্রে। আছে ভেজা, কাদাটে মাটি। তৃতীয় ইনকিউবেটরে মাটির ওপর দু’ইঞ্চি পানি। কিছুই জন্ম নেয়নি ওখানে।

একটু দূরেই রেফ্রিয়ারেটর। প্লেক্সিগ্লাসের ওদিক দেখা গেল না। হাত দিয়ে কাঁচ ডলে পরিষ্কার করল এলেনা।

ভেতরে কিছু নেই।

কয়েকটা ফ্রিয়, খালি।

ছোট এক ইনকিউবেটরের ভেতর কী যেন নড়ছে। উঁকি দিল এলেনা। ওগুলো ধেড়ে ইঁদুর। কোনোটা মৃত, আবার কোনোটা খুবই বয়স্ক। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নড়ছে। কনটেইনমেণ্ট এরিয়া ভাল করে সিল করা। চট্ করে খুলতে পারবে না কেউ।

‘আসলে করত কী এখানে?’ বিড়বিড় করল এলেনা। একবার ভাবল, ডক্টর মোবারক সব সরিয়ে ফেলার আগেই এখান থেকে ঘুরে গেছে কেউ। এটা হয়েছে হয়তো বিজ্ঞানীকে মেরে ফেলার পর। তার আগে নির্যাতন করে তাঁর কাছ থেকে এই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে নিয়েছিল কেউ।

প্রায় ঘিরে রাখা ওঅর্কস্টেশনের কাছে থেমে এলেনা বুঝে গেল, সামনের মেডিকেল ডিভাইসটা খুবই দামি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ। ওটা অন করে আই পিসে চোখ রাখল। ভেতরে দেখার মত কিছুই নেই। অবশ্য ডিভাইসের সঙ্গে ইলেকট্রনিক রিডআউট এবং ছোট কিপ্যাড। পাওয়ার সুইচ অন করার পর দেখল নতুন মেন্যুর ইমেজ।

কোনও জেনেটিক মেটারিয়ালের পরীক্ষা চলছিল। জানার উপায় নেই, ওসব আসলে কী। ঘুরে চারপাশ দেখল এলেনা। চোখ পড়ল কমপিউটারের ওপর, হয়তো কিছু জানবে ওটা থেকে।

কমপিউটারের সামনে বসল এলেনা। টোকা দিল এন্টার কী-র ওপর।

মনিটরে ভেসে উঠল এনক্রিপশন স্ক্রিন।

সহজ অপারেটিং সফটওয়্যার নয়। হেভি-ডিউটি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল-গ্রেড সিস্টেম। এলেনার সাধ্য নেই এই কমপিউটারের পেট থেকে কিছু বের করবে।

রানার কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ ইউএসবি ড্রাইভ পকেট থেকে বের করে কমপিউটারের স্লটে ঢোকাল এলেনা। বিসিআই-এর এক তুখোড় বাঙালি গবেষক তৈরি করেছেন জিনিসটা। এমন প্রোগ্রাম, অটো লঞ্চ হলে ভেদ করবে বেশিরভাগ এনক্রিপশন ফায়ারওয়াল।

তিন সেকেণ্ড পর ড্রাইভে জ্বলে উঠল সবুজ লেড বাতি। কাজ করছে খুদে যন্ত্র। সম্ভব হলে হার্ড ডিস্কের সব তথ্য চুরি করে নিজ পেটে ভরবে ওটা। ডেস্কের নিচের টাওয়ার নিজের দিকে টানল এলেনা। জিনিসটা নড়ল না। সাধারণ বাক্সের এক গাদা পেঁচিয়ে যাওয়া তার ছুটিয়ে নেয়াই কঠিন, তার ওপর কী যেন আটকে রেখেছে সবকিছুকে।

ডেস্কের নিচে উঁকি দিল এলেনা। বাক্স ধরে রেখেছে সরু এক কেবল আর লাল এক তার। সরিয়ে আনা যাচ্ছে না কেবল। লাল তার খুবই সন্দেহজনক। ওটা গেছে কমপিউটারের পেছনে কোনও ম্যাগনেটিক সুইচ-এ।

চোখ দিয়ে লাল তার অনুসরণ করল এলেনা। ডেস্কের এক ড্রয়ারে গিয়ে ঢুকেছে ওটা। ইঁটের মত কী যেন ড্রয়ারের মাঝে। দেখে মনে হলো ওটা সি-৪।

অ্যালার্মের কী দরকার, ভাবল এলেনা। কেউ ভুল করলেই তো পুরো বাড়ি উড়ে যাবে আকাশে!

সি-৪ থেকে বেরিয়ে কার্পেটের নিচ দিয়ে গিয়ে ঘরের আরেক পাশের ইনকিউবেটর ও রেফ্রিयারেটর ইউনিটের পেছনে গেছে আরেকটা তার। ওটারই ভাই গেছে এক রেফ্রিयারেটরের পাশের বুক শেলফে। ওখানে ছোট কয়েকটা ড্রয়ার। সাবধানে ঘাঁটতে গিয়ে একটার ভেতর পেয়ে গেল এলেনা এক বাইণ্ডার। ভেতরের প্রায় সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত বিপজ্জনক তার।

বাইণ্ডারের পাতা ওল্টাল। হাতে লেখা সব মন্তব্য। ডক্টর ৬— মোবারকের হাতে লেখা হলে, ইউএন অফিসের চিঠি লিখেছে অন্য কেউ।

এই বাইণ্ডারে লেখা একের পর এক টেস্ট রেযাল্টের রেকর্ড।

কোনওভাবেই যাতে তারে টান না পড়ে, তাই সাবধানে পাতা সরাচ্ছে এলেনা।

একের পর এক পাতায় গাদা গাদা নম্বর, সবই পরীক্ষার রিপোর্ট। ব্যর্থতার লিস্টি যেন তৈরি করেছেন বাঙালি বিজ্ঞানী।

এ হতেই পারে, ভাবল এলেনা। বর্তমান জেনেটিক সায়েন্সের এক শ’টা পরীক্ষার ভেতর ব্যর্থ হয় নিরানব্বুইটা এক্সপেরিমেন্ট। মস্তসব ফার্মাসিউটিকাল ল্যাবের প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর গবেষণা করেও শেষে ব্যর্থ হন, দেখাতে পারেন না ভাল কোনও ফলাফল।

পড়েছে এলেনা. সেরা সব বায়োটেক ল্যাবের জেনেটিসিস্টরা সারাজীবনেও দরকারী কোনও ওষুধ আবিষ্কার করতে পারবেন কি না, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ভাগ্যের ওপর।

এর কারণ, মানুষকে নিরাপদ রাখতে তৈরি হয়েছে কঠোর সব প্রোটোকল। ধীরে ধীরে বদলে নিয়ে আজকের সব জটিল প্রাণ তৈরি করেছে প্রকৃতি পুরো পাঁচ বিলিয়ন বছর ধরে। বহুবার ভুল করেছে প্রকৃতি, সময় নিয়ে ঠিক করে নিয়েছে নিজের ভুল। ওই একই কাজ করছে আজকের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে।

.

ডক্টর মোবারকের বাড়ির বাইরে ভাড়া করা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে রানা। বিপদ দেখলেই সতর্ক করবে এলেনাকে।

কোনও বাড়ি থেকে নির্জন রাস্তায় বেরোয়নি কেউ।

সোনালি আলোর দুপুরে থমথম করছে চারপাশ।

এরই ভেতর এসেও চলে গেছে দু’একটা গাড়ি।

এইমাত্র গেল এক ডেলিভারি ভ্যান।

দূরে দু’একজন পথচারী। কেউ এল না এ বাড়ির দিকে। বেশ কিছুক্ষণ হলো বাঙালি বিজ্ঞানীর বাড়ি সার্চ করতে গেছে এলেনা, তারপর আর যোগাযোগ করেনি।

বিরক্ত হয়ে রেডিয়োতে বলল রানা, ‘দরকারী কিছু পেলে?’

কয়েক সেকেণ্ড পর এল জবাব: ‘ভেতরে ল্যাব করেছিলেন। কমপিউটার, ইনকিউবেটর, মাইক্রোস্কোপ সহ বাড়ি উড়িয়ে দেয়ার জন্যে রেখেছিলেন সি-৪।’

‘সাবধান, এলেনা,’ বলল রানা।

‘প্রায় কিছুই ধরছি না,’ বলল এলেনা। ‘বাইরে কোনও বিপদ নেই তো?’

‘এখনও না। তবে…’ চুপ হয়ে গেল রানা। আবারও ফিরেছে ইসু্যু ডেলিভারি ভ্যান। থামল বিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে। ‘এক মিনিট, এলেনা। ঝামেলা হতে পারে।’

‘ঝামেলা আসবে কোত্থেকে?’

‘সামনের দরজা দিয়ে,’ জবাবে বলল রানা।

‘ক’জন ওরা?’

ইসুযুর কারণে বাড়ির সদর দরজা দেখতে পেল না রানা। গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে তিনজন লোক, পরনে মুভিং কোম্পানির ইউনিফর্ম। ভ্যানের পেছনে থামল একজন। বাড়ির দরজার দিকে চলেছে অন্য দু’জন।

‘কমপক্ষে দু’জন যাচ্ছে,’ বলল রানা। ‘তৃতীয়জন অপেক্ষা করছে বাইরে।’

‘বাড়ির ভেতর ঢুকবে ওই দু’জন?’

এলেনার কণ্ঠে হতাশা টের পেল রানা। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে মেয়েটা। বাধ্য না হলে সরবে না।

‘চারপাশ ঘুরে দেখছে। চেষ্টা করো বাড়ির পেছন দিয়ে বেরোতে।’

‘আমার একটু সময় লাগবে,’ বলল এলেনা।

লোকগুলোকে বাড়ির দরজা থেকে সরিয়ে নেয়া যায় কি না, তা নিয়ে ভাবছে রানা। চোখের কোণে দেখল, পেছন থেকে আসছে কালো এক ছায়া। এক সেকেণ্ডও লাগল না ওর বুঝতে, ঝট করে সরে গেল সিট থেকে। কানের কাছে খুক খুক আওয়াজ তুলে উইণ্ডশিল্ড চুর-চুর করল সাইলেন্সার লাগানো এক পিস্তল।

ঘুরে দেখার সময় নেই, ছেঁচড়ে পাশের সিটে সরল রানা। তৃতীয় গুলি বিধল খালি সিটের ফোমের বুকে। প্যাসেঞ্জার দরজা খুলে রাস্তার পাশে ফুটপাথে ধুপ করে পড়ল ও। আগেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করেছে পিস্তল। ঘাড় ফিরিয়েই গুলি পাঠাল আততায়ীকে লক্ষ্য করে।

.

বাইরে গুলির বিকট শব্দ। রানার ওয়ালথার .৩৮ ক্যালিবার পিস্তলের হুঙ্কার চিনতে ভুল হয়নি এলেনার।

এবার সরে যেতে হবে। কিন্তু মন বলছে, বহু কিছুর জবাবের খুব কাছে পৌঁছে গেছে। ঝড়ের গতিতে নোটবুকের পাতা ওল্টাল এলেনা। এতে দেরি হবে বুঝে চট্ করে চলে গেল শেষ পাতায়। ওখানে লেখা বেশ কিছু সংখ্যা ও শব্দ। শেষ এন্ট্রি গত মাসের।

লিস্টের ওপর আঙুল রেখে পড়ল এলেনা।

সিরিজ ৯৪৮- রেযাল্ট ভাল নয় বলেই মেরে ফেলতে হলো সাবজেক্টকে।

সিরিজ ৯৪৯- রেযাল্ট ভাল নয় বলেই মেরে ফেলতে হলো সাবজেক্টকে।

সিরিজ ৯৫০- রেযাল্ট নির্ধারণ করতে হবে। জীবনী-শক্তি প্রভাবিত। বাঁচতে পারেনি সাবজেক্ট।

গুলির আরেকটা আওয়াজ শুনল এলেনা। একবার দরজার দিকে চোখ গেল ওর। আবার মনোযোগ দিল নোটের ওপর।

সিরিজ ৯৫১– রেযাল্ট ভাল নয় বলেই মেরে ফেলতে হলো সাবজেক্টকে

সিরিজ ৯৫২– রেযাল্ট অদ্ভুত। কমে গেছে সাবজেক্টের টেলোমার বা জীবনী-শক্তি। যত দিন বাঁচার কথা, তার চেয়ে ৫১% কমে গেছে আয়ু।

এটাই শেষ এন্ট্রি।

কমে গেছে সাবজেক্টের টেলোমার বা জীবনী-শক্তি। যত দিন বাঁচার কথা, তার চেয়ে ৫১% কমে গেছে আয়ু।

আবারও লেখাগুলো পড়ল এলেনা।

ডিএনএ স্ট্র্যাণ্ডের মলিকিউল চেনের শেষ অংশ টেলোমার। সেলুলার রিপ্রোডাকশন, সেলুলার লাইফ স্প্যান বা মানব জীবন দীর্ঘায়ু হওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ওটার।

সায়েন্টিস্ট মোবারক আসলে কী নিয়ে কাজ করছিল?

কুঁচকে গেল এলেনার ভুরু।

তখনই দরজায় জোরালো বিস্ফোরণ হলো।

হাতে সময় নেই, নোটবুক থেকে কাগজটা ছিঁড়ে নিয়েই বাড়ির পেছন দিক লক্ষ্য করে ছুট দিল এলেনা। কয়েক সেকেণ্ড পর মনে পড়ল, কমপিউটারে রয়ে গেছে রানার ফ্ল্যাশ ড্রাইভ। দৌড়ে আবারও ফিরল ও।

তখনই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সামনের দরজা।

হ্যাঁচকা টানে কমপিউটার থেকে ইউএসবি ড্রাইভ খুলেই পেছন দরজার দিকে দৌড় দিল এলেনা।

.

ভাড়া করা গাড়ির পেছন চাকার কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রানা। উল্টো দিকে সামনের চাকার কাছে হাঁটু গেড়ে বসেছে আততায়ী। দু’জনের মাঝে আড়াআড়িভাবে বড়জোর দশ ফুট দূরত্ব।

গাড়ির তলা দিয়ে উঁকি দিল রানা। বদমাসটার পা দেখলেই ফুটো করে দেবে। কিন্তু খুব সতর্ক সে। বিরক্ত হয়ে উঠে বসে গাড়ির মাঝ দিয়ে গুলি পাঠাল রানা। হাজার টুকরো হলো জানালা। কিন্তু এসব পাত্তা না দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকল লোকটা

তিনটে সমস্যার কথা মনে এল রানার। প্রথম, দলে এরা ভারী। যে-কোনও সময়ে হামলা করবে দু’দিক থেকে। দ্বিতীয়ত, বাড়ির ভেতর আটকা পড়েছে এলেনা। পেছনের বাগানে বেরিয়ে গেলে বিপদ কমবে ওর। তৃতীয়ত, এই লোকটা ওকে খুন করতে চাইছে, কিন্তু তার গায়ে টোকাও দিতে পারবে না ও নিজে। গাড়ির ইঞ্জিন আড়াল করে রেখেছে তাকে। আরও বিপদ আছে। অকটেনে ভরা অর্ধেক টাঙ্কি। ওটা মাত্র চোদ্দ ইঞ্চি দূরে। টাঙ্কিতে গুলি ঢুকলে বিস্ফোরণের সঙ্গে আকাশে ছিটিয়ে পড়বে ওর দেহের টুকরোগুলো।

ইসু্যু ভ্যানের দিকে তাকাল রানা। কেউ নেই ওখানে। বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে অন্য দু’জন।

একটা বুলেট মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে লেগেছে পেছনের দেয়ালে। এবার সরে যেতে হবে। হাতে-পায়ে ভর করে পেছাতে লাগল রানা। গাড়ির পেছনে এসে সামনে তাক করল পিস্তল এক এক করে কয়েকটা গুলি পাঠাল নির্দিষ্ট লক্ষ্যে।

ছোট একটা বিস্ফোরণ হলো। সিনেমার দৃশ্যের মত ফেটে পড়ল না ইসু্যু ভ্যান। ভেঙে দিয়েছে রানা ওটার পেছনের জানালা আর ট্রাঙ্ক। লকলক করা লাল আগুন চাটছে গাড়িটাকে।

ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে গেছে আততায়ী। গাড়ির তলা দিয়ে তার পা দেখল রানা। ঝেড়ে দৌড় দিল লোকটা।

গভীর মনোযোগে গাড়ির তলা দিয়ে গুলি পাঠাল রানা। তৃতীয় গুলি চুরমার করল আততায়ীর ডান গোড়ালি। হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছেঁচে গেল তার নাক-মুখ। ভিতু শেয়ালের মত গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়েছে হুক্কা-হুয়া।

.

কিচেনের ফ্রস্টেড গ্লাসের দরজার কাছে পৌঁছে গেছে এলেনা। ওদিকে সাদা আলো। এবার দরজা খুলে তীরের মত বেরিয়ে যাবে বাগানে। তা হলেই ও মুক্ত।

কিন্তু পেছনে বুট পরা ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ!

নিজেদের ভেতর চিৎকার করে কথা বলছে লোকদুটো।

দরজায় কোনও লাল তার আছে কি না চট্ করে দেখল এলেনা। না, নেই। নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল পেছনের বাগানে।

ক্ষিপ্র হরিণীর মত বাগানের মাঝে পৌঁছে গেছে, এমন সময় পেছন থেকে ট্যাক্ করা হলো ওকে। পিঠে ভারী ওজন নিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল এলেনা। গা মুচড়ে সরে যেতে চাইল, কিন্তু তখনই ওর গলার পাশে ঠেকিয়ে দেয়া হলো ক্ষুরধার ছোরার ফলা। বরফের মূর্তির মত জমে গেল এলেনা।

হাত থেকে কেড়ে নেয়া হলো বেরেটা নাইন এমএম।

‘ওঠ, শালী!’ চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। নিজে নামল এলেনার পিঠ থেকে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও দু’জন।

তাদের একজন নেতা, সে বলল, ‘ওকে বোটে নিয়ে তোল।’

তার নির্দেশ মত এলেনাকে ছেঁচড়ে নিয়ে চলল দু’জন মিলে।

তৃতীয়জন আবার ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর।

.

পাকা রাস্তায় সাপের মত কিলবিল করছে লোকটা ব্যথায়, এক দৌড়ে তার পাশে পৌঁছল রানা। ভেবেছিল এক ছুটে পৌঁছবে বাড়ির কাছে। কিন্তু এই লোকের এক সঙ্গী গিয়ে ঢুকেছে ওখানে। এদিকে এতক্ষণে বেরিয়ে যাওয়ার কথা এলেনার।

ঘুরে বাড়ি আর চারপাশ ভাল করে দেখল রানা। পুরনো দুই বাড়ির মাঝ দিয়ে সরু এক গলি। ওখানে পৌঁছে গেল রানা। দু’পাশ থেকে বাধা দিল ঝোপের পাতা। পাত্তা না দিয়ে দুই বাড়ির পেছনে হাজির হলো ও। বিজ্ঞানীর বাড়ির পেছন বাগানে দু’লোক, মাঝে বন্দি এলেনা। এক পা সামনে বেড়ে ডানের লোকটার মেরুদণ্ডের দিকে পিস্তলের নল তাক করল রানা।

পরক্ষণে ছিটকে পড়ে গেল নিজেই। কানে তালা লেগে গেছে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজে। আগুনের লেলিহান হলকার মত তপ্ত বাতাস পুড়িয়ে দিতে চাইল ওর মুখ। শরীরের এক পাশে এ্যাপনেলের বেগে লেগেছে ভাঙা কাঠের কুচি, কাঁচ ও পোড়া প্লাস্টার।

মাটিতে পড়েই গড়াতে শুরু করেছে রানা। তিন সেকেণ্ড পর বুঝল, পোশাকে আগুন ধরেনি। হাত ও হাঁটুর ওপর ভর করে উঠে বসল। ঝিমঝিম করছে মাথা। কানের ভেতর ঝিঁঝির ডাক। এক সেকেণ্ড পর বুঝল, কী হয়েছে।

চারপাশে ভলকে উঠছে ঘন কালো ধোঁয়া। কাঁধের ওপর দিয়ে বিজ্ঞানীর বাড়ি দেখল। বাইরের দিকে বিস্ফোরিত হয়েছে ওটা। উড়ে গেছে তিন দেয়াল। ধসে পড়ছে ছাত। ওই বাড়ি এখন বহু দিন আগে মরা শামুকের খোলার মতই ফোপরা। ভেতর থেকে উঠে আকাশ চাটছে আগুনের কমলা শিখা। সেই বাতাসের ধাক্কা খেয়ে সরছে কুচকুচে কালো ধোঁয়া। রানার চোখের সামনে ধসে গেল চতুর্থ দেয়াল। এবার হুড়মুড় করে পড়ে সব ঢেকে দিল ছাত।

পেছনের বাগানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এলেনা ও দুই লোক। ভাল অবস্থায় আছে এলেনা। পেছনে ছিল লোকদুটো, বর্মের মত রক্ষা করেছে ওকে।

উঠে এক দৌড়ে এলেনার কাছে পৌঁছল রানা। একই সময়ে গায়ের ওপর থেকে এক লোককে সরিয়ে উঠে বসল এলেনা। ওই লোক আর কখনও বিপদ তৈরি করবে না। মোটা এক স্টিলের পাইপের মারাত্মক আঘাতে ফুটো হয়েছে পিঠ-বুক।

হতভম্বের মত বার কয়েক মাটিতে পাক খেল অন্য লোকটা। তার হাত থেকে পুরনো একটা রিভলভার কেড়ে নিল রানা। বাধা দেয়ার সাধ্য নেই এই লোকের, ফ্যালফ্যাল করে দেখল রানাকে।

‘অথচ তুমি বলো আমিই সবসময় জিনিসপত্র ভাঙচুর করি,’ এলেনাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল রানা।

জবাব না দিয়ে একটু দূরে পড়ে থাকা বেরেটা কুড়িয়ে নিয়ে হোলস্টারে রাখল এলেনা।

‘ব্যাপারটা কী?’ জানতে চাইল রানা।

চারপাশ দেখল এলেনা। এখনও পুরো সচেতন নয়। ‘মনে তো হচ্ছে ভুল বই পড়তে গেছে!’

আকাশ থেকে এখনও ঝরছে পোড়া কাগজ ও ছাইয়ের বৃষ্টি। ওই বাড়িতে যে জ্ঞান সংরক্ষিত ছিল, সবই শেষ।

মাথার তালু টিপতে টিপতে মৃত লোকটাকে দেখছে এলেনা। ‘আমিও ওর মত হয়ে যেতে পারতাম।’ ঘুরে দেখল নদীর দিকে। ‘ওরা আমাকে একটা বোটে তুলতে চেয়েছিল।’

ওর হাত ধরে নদী লক্ষ্য করে হাঁটতে লাগল রানা। পেছনের বেড়ার মাঝে ছোট্ট দরজা, ওটা পেরিয়ে সামান্য যেতেই একটা রাস্তা। পাশেই পাথরের উঁচু দেয়াল। মাঝ দিয়ে উঠেছে সেইন  তীরে যাওয়ার সিঁড়ি।

ধাপ পেরিয়ে ওঠার সময় মোটরবোটের ইঞ্জিন চালু হওয়ার শব্দ পেল ওরা। চট্ করে পরস্পরকে দেখল রানা ও এলেনা, পরক্ষণে দৌড়ে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *