মৃত্যুঘণ্টা – ৩৬

ছত্রিশ

এলেনা ও মোনার কাছে পৌঁছুতে পূর্ণ গতি তুলেছে রানা। প্রায় উড়ে চলেছে রাতের আঁধারে। তখনই টের পেল, বড় একটা সমস্যায় পড়েছে। আসলে ও জানেও না কোথায় আছে।

কেমন যেন নতুন মনে হচ্ছে নদীর বুক ও দু’পারের দেয়াল। অনেক বেশি মৃত গাছ ও সারি সারি পাথর। মসৃণ নয় মেঝে। তাড়া খেয়ে এদিকে আসার পর মনে হচ্ছে, বেশি সময় পার করে দিয়েছে নদীর খাদে। ধারণা করল, চলে এসেছে অনেক উত্তর দিকে।

এগোবার ফাঁকে দু’দিকে চোখ রাখল রানা। একটু পর এক দিকের দেয়াল বেয়ে উঠতে পারবে মনে হলো। এটিভির নাক জমিতে রাখার জন্যে সামনে ঝুঁকে গেল ও, ঝড়ের গতি তুলে উঠে এল মরুভূমির মেঝেতে। দূরে দেখল পশ্চিমে বালির ঢিবির ওপর কয়েকটা উজ্জ্বল আলো। তিন জোড়া বাতি সামনে, পেছনে আরও এক জোড়া গাড়ির হেডলাইট।

এলেনা ও মোনার পিছু নিয়েছে একদল হাউণ্ড, ভাবল রানা। আরও গতি বাড়াল, কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেলল রাইফেল। ডানে থ্রটল, ওটা ধরে বামহাতে রাইফেল রাখল হ্যাণ্ডবারের ওপর। মনে পড়ল না, আগে কখনও বামহাতে রাইফেল ব্যবহার করেছে। কিন্তু প্রথম বলে একটা কথা আছে।

.

এঁকেবেঁকে উঁচু সব ঢিবির মাঝের জমি ব্যবহার করে এগিয়ে চলেছে এলেনা, মাথায় রেখেছে কোন দিকে আছে জলায় এয়ারবোট। বড়জোর এক মাইল দূরে ওটা, ওখানে অস্ত্র নিয়ে তৈরি আছে রানার বন্ধু গ্রাহাম। সে সাহায্য করবে।

গতি না কমিয়েই ডানে বাঁক নিল এলেনা, আরেকটু হলে কাত হয়ে পড়ে যেত এটিভি। তখনই উল্টো দিকে ঝুঁকে গেল মোনা। এক মুহূর্ত পর ওই একই ভুল করল মেয়েটা।

‘বাঁক নিলে আমার মত করে ব্যালেন্স রাখবে!’ চিৎকার করে জানাল এলেনা।

‘আমি রানাকে খুঁজছি।’ পাল্টা চেঁচাল মোনা।

‘আপাতত ওর কথা ভুলে যাও! আমার মত করে কাত হও, নইলে উল্টে পড়ব!’

কথার গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে আরেকবার বাঁক নিতে হলো না এলেনাকে, মোনা বুঝে গেল, কী করতে হবে।

সামনের মরুভূমি দিন করে দিয়েছে এক স্যাণ্ড রেল। আসছে সোজা ওদের দিকেই। দ্রুতগামী ফাইটার পাইলটের মত সরে যেতে চাইল এলেনা। যেন ফাঁকি দেবে মিসাইলকে। এত দ্রুত বাঁক নিল যে স্যাণ্ড রেলের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে এল আঁধার রাতে।

কতবার এভাবে সরে যেতে পারব, ভাবতে গিয়ে হাঁফ লেগে গেল এলেনার। সত্যি বলতে, এত দূর পর্যন্ত আসতে পারবে ভাবতেও পারেনি। মনে পড়ল রানার কথা। কোথায় গেল মানুষটা? ভয়ঙ্কর খারাপ কিছু হয়ে গেল না তো?

ফুল স্পিডে পরের বালির ঢিবির দিকে চলেছে ওরা। উঁচু স্তূপে উঠে সাঁই-সাঁই করে নেমে যেতে লাগল মরুভূমির মেঝে

লক্ষ্য করে। চোখের কোণে দেখল, পেছন থেকে আসছে আলোর রেখা। ছড়িয়ে পড়ছে গাড়িগুলো। প্রথম সুযোগে ঘিরে ফেলবে। কাজেই ওদের উচিত এখন আঁধারে হারিয়ে যাওয়া।

সরাসরি সামনে চোখ রাখল এলেনা। ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে জলার তীরে। সামনের বালির ঢিবির ওপর উঠে আসতেই দেখল দূরে পানির ধারে সারি সারি নলখাগড়া।

কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় ভয়টা বাস্তবে রূপ নিল এবার।

স্যাণ্ড রেলের ড্রাইভাররা তাড়া করে ওদেরকে সরিয়ে এনেছে আরেক দল লোকের দিকে। জলার তীরে অপেক্ষা করছে অন্তত ছয়জন সশস্ত্র লোক ও সেই হামভি।

কড়া ব্রেক কষে থেমে যেতে চাইল এলেনা। কিন্তু এবার তৈরি ছিল না মোনা, ওর কারণে কাত হয়ে পড়ে গেল এটিভি। ছিটকে গিয়ে দু’দিকে পড়ল ওরা দু’জন।

বালির ভেতর গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে এলেনা. থামল কয়েক সেকেণ্ড পর। চট্ করে মুখ তুলে দেখল চারপাশ। একটু দূরে উল্টো হয়ে পড়ে আছে এটিভি, বনবন করে ঘুরছে চাকা। উঠে দাঁড়িয়ে এক দৌড়ে ওটার পাশে পৌঁছল ও। এইমাত্র পেছনের ঢিবি পেরিয়ে নেমে আসছে তিনটে স্যান্ড রেল। স্ক্যাবার্ড থেকে রাইফেল নিল এলেনা, দেরি হলো না শত্রুপক্ষ লক্ষ্য করে গুলি পাঠাতে।

একটা ডিউন বাগির গায়ে লাগল ওর গুলি। পথ হারিয়ে ভুল দিকে চলল তিন চাকার গাড়ি। টিলার মত ঢিবি থেকে কাত হয়ে পড়তে লাগল সরসর করে। ওটার একটা চাকা ছিটকে বেরিয়ে  গেল ফ্রিসারির মত।

শেষ ঢিবির পায়ের কাছে আছে এলেনা ও মোনা। মাত্র পাঁচ শ’ গজ গেলেই জলা। কিন্তু ওদেরকে চক্কর কাটতে শুরু করেছে অন্য দুই ডিউন বাগি। বজায় রেখেছে দূরত্ব।

এলেনা থেকে ত্রিশ ফুট দূরে হাত-পায়ে ভর করে উঠে বসেছে মোনা।

‘এদিকে, মোনা!’ গলা ছাড়ল এলেনা।

দেখে মনে হলো বেকায়দা পতনের ফলে মাথা কাজ করছে না মেয়েটার। টলমল করতে করতে এগোতে লাগল এলেনার দিকে।

‘তোমার পিস্তল কোথায়?’ আবারও চিৎকার করল এলেনা।

পোশাকের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা পিস্তল বের করে নাড়ল মোনা। বেকায়দাভাবে ধরেছে অস্ত্রটা।

‘কেউ কাছে এলেই গুলি করবে!’ এলেনা স্পষ্ট দেখল, জলার তীর থেকে সরে মোনার দিকে আসছে কয়েকজন লোক। ধীর গতি তুলে সামনে বাড়ছে হামভি, উজ্জ্বল হেডলাইট পড়েছে মোনার চোখে। বার কয়েক মাথা নাড়ল মেয়েটা।

কয়েকবার গুলি করে হামভির দু’চোখ অন্ধ করে দিল এলেনা, নিজে আড়াল নিয়েছে উল্টে পড়া এটিভির পেছনে।

এখনও গুলি করছে না শত্রুপক্ষ। এলেনা ও মোনাকে ঘিরে দূর দিয়ে ঘুরছে দুই ডিউন বাগি। একটা ডান থেকে বামে, অন্যটা বাম থেকে ডানে।

ডানের ডিউন বাগি একটু দূর দিয়ে যেতেই পাগলের মত ওটার ওপর বেশিরভাগ গুলি খরচ করল মোনা।

‘আরও কাছে না এলে গুলি করবে না!’ ওকে বলল এলেনা।

‘আমি চাই না ওরা কাছে আসুক!’ আপত্তি তুলল মোনা।

মেয়েটার মন বুঝছে এলেনা। ভীষণ ভয় পেয়েছে বলে মাথায় নেই, ওদের কাছে এত গুলি নেই যে বেশি খরচ করবে।

চট করে জলার দিকে তাকাল এলেনা। গলা শুকিয়ে গেল। সর্বনাশ! যেখানে নেমেছিল, সেই জায়গা ফাঁকা! কোথাও নেই এয়ারবোট! বড় ঝামেলার ভয়ে উধাও হয়েছে জন গ্রাহাম!

.

তীরের মত ছুটে চলেছে রানা, কিন্তু দমে যেতে চাইছে মন। যে গাড়ির পিছু নিয়েছে, ওটা ওর নিজের ভেহিকেলের চেয়ে অনেক দ্রুতগামী। ড্রাইভার জানেও না, পেছন থেকে হামলা করতে চাইছে কোন লোক, কিন্তু তার সাধ্য নেই যে ধাওয়া করে ধরবে। আমি যেন এক নেড়ি কুত্তা, যে কি না ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যাবে, কিন্তু ধরতে পারবে না গাড়ি, তিক্ত মনে ভাবল রানা।

বুকে অদম্য জেদ নিয়ে ফুল স্পিডে চলেছে, চোখ দূরের বাতির ওপর। ভাল করেই জানে, ওদিকেই জলা। কিছুক্ষণ পর থেমে গেল আলোর এগিয়ে চলা। অদ্ভুতভাবে ঘুরে ঘুরে সরছে আলো। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল রানা। নেকড়ের দল বোধহয় ঘিরে ফেলেছে এলেনা আর মোনাকে!

গতি না কমিয়ে এগোল রানা। একটু পর উঠে পড়ল শেষ ঢিবির ওপর। চূড়া থেকে দেখল, বালির এই স্তূপের নিচে উল্টে পড়া এটিভির পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে এলেনা ও মোনা। হায়নার মত ওদেরকে ঘিরে বৃত্ত তৈরি করছে স্যাণ্ড রেল। শুধু তা-ই নয়, মেয়েদুটোর দিকে হেঁটে যাচ্ছে বেশ ক’জন লোক।

তেড়ে যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়, বুঝল রানা।

গতি বাড়িয়ে সরাসরি স্যাণ্ড রেল ও এলেনা- মোনার মাঝে পৌঁছতে চাইল। বামহাতে রাইফেল বাগিয়ে গুলি ছুঁড়ল সামনের ডিউন লক্ষ্য করে। ঝড়ের গতি তুলে নেমে চলেছে বালির ঢিবি থেকে।

পাঁচ সেকেণ্ড লাগল না ঝাঁঝরা করে দিতে দ্বিতীয় ডিউন  বাগি। বিস্ফোরিত হলো অকটেনের ট্যাঙ্ক, গড়াতে গড়াতে দূরে গিয়ে থামল জ্বলন্ত স্যাণ্ড রেল।

বাঁকা পথ তৈরি করে ছুটতে ছুটতে লোকগুলোর ওপর গুলি চালান রানা। যোগ দিয়েছে এলেনা ও মোনা। কারণ, রাইফেলের গুলি ফুরিয়ে গেলেও আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট শব্দ শুনল ও। ঝেড়ে দৌড়াতে শুরু করেছে লোকগুলো। যে যার মত আড়াল খুঁজছে।

ঝোড়ো গতিতে এটিভি থেকে এলেনার দিকে ঘুরে তাকাল রানা। সরাসরি দুই মেয়ের দিকে চলেছে অবশিষ্ট স্যাণ্ড বেল। ওটার পেছনে চারজন লোক, একেকজন যেন মইওয়ালা ফায়ার ট্রাকের কর্মী।

এলেনা ও মোনাকে পেরিয়ে যাওয়ার আগেই স্যাণ্ড বেল থেকে নে পড়ল চারজন লোক। মেয়ে দুটোর ওপর ঝপাৎ করে ফেলল জাল। আটকা পড়ে গেল এলেনা ও মোনা। খেপা সিংহীর মত লড়তে চাইছে এখন, কিন্তু তার ফলে আরও জড়িয়ে গেল জালে।

বাঁক নিয়ে এর দিকের চলেছে রানা, নতুন করে গতি তুলছে এলেনার তরফ থেকে দেখল এলির আগুনের ঝিলিক। টলমল করে চিত হয়ে বালিতে পড়ল এক লোক। দু’হাতে খামচে ধরেছে বুক। কিন্তু দ্বিতীয় লোকটা ল্যাং মেরে এলেনাকে ফেলে দিয়ে জাপ্টে ধরল। পিস্তলের গুলি খেয়ে কাত হয়ে বালিতে পড়ল তার লাশ। তৃতীয় লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ল মোনার ওপর।

ফুল স্পিডে ওখানে পৌঁছল রানা। খালি রাইফেল ব্যবহার করল ক্রিকেটের ব্যাটের মত। ওটার বাঁটের বাড়ি পড়ার আগেই সামনে বেড়ে খপ করে ধরতে গেল চতুর্থ লোকটা। চোয়ালে নিল মারাত্মক আঘাত। ছিটকে পড়ল বালির ভেতর। এদিকে ভারসাম্য হারিয়ে ছুটন্ত এটিভি থেকে কাত হয়ে বালির মেঝেতে পড়েছে রানা। এক গড়ান দিয়ে উঠেই দেখল নিজের রাইফেল বের করে নিয়েছে এলেনা। জালের ভেতর থেকে গুলি করল তৃতীয় লোকটাকে। মোনার একটু দূরে ছিটকে পড়েছে লাশ। এলেনা যে দু’জনকে আগে গুলি করেছিল, তারাও নড়ছে না।

প্রতিপক্ষ বলতে আর বড়জোর কয়েকজন, আসছে জলার দিক থেকে। তাদেরকে এড়িয়ে পৌঁছুতে হবে পানির ধারে।

এদিকে অনেক দূরে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণহীন এটিভি। এলেনা ও মোনার পাশে থামল রানা, টান দিয়ে এলেনার ওপর থেকে সরিয়ে দিল জাল। কিন্তু একই সময়ে বেরোতে গিয়ে আরও জড়িয়ে গেল মোনা জালের ভেতর।

‘আমার একটা অস্ত্র দরকার,’ বলল রানা। জালের বড় বড় ফাটো নিয়ে নিজের পিস্তলটা বের করে ওর হাতে দিল মোনা।

জলার দিক থেকে যারা আসছে, তাদের দিকে গুলি পাঠাল এলেনা। আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই বলল, ‘বান, তোমার বন্ধ কোথায় গেল?’

জলার দিকে তাকাল রানা। সত্যি ওদিকে নেই এয়ারবোট। কিন্তু দমে যাওয়ার লোক নয় গ্রাহাম। ‘তাড়া খেয়ে সরে গেছে, কিন্তু ঠিক সময়ে আবারও হাজির হবে।’

‘দেরি করলে আমরা শেষ,’ বলল এলেনা, ‘আমার কাছে আর মাত্র দুটো গুলি আছে।’

ভেস্ট থেকে নতুন ম্যাগাযিন বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিল রানা। ‘আমার আরেকটা আছে।’

শত্রুদের দিকে শেষদুটো গুলি করে খালি ম্যাগাযিন ফেলে দিল এলেনা, ভরে নিল নতুনটা। রানার দিকে তাকাল।

ওর প্রেমিক চেয়ে আছে তীরের দিকে।

গুলির ভয়ে নষ্ট এক ভেহিকেলের পেছনে লুকিয়ে পড়েছে কয়েকজন, অন্যরা আড়াল নিয়েছে বড় সব পাথরের পেছনে। আপাতত রানার দল ও জলার তীরের মাঝে কেউ নেই।

‘এরা কয়জন?’ জানতে চাইল রানা।

‘জানি না,’ বলল এলেনা, ‘তবে কমপক্ষে সাত-আটজন। বেশিও হতে পারে।’

‘গুলি করে তোমাদেরকে খতম করে দিল না কেন?’ ঘুরে মোনাকে দেখল রানা।

‘ওরা আমাকে চায়,’ সোজাসাপ্টা বলল মোনা। ‘বাবাকে খুন করেছে, কারণ উনি সাহায্য করবেন না ঠিক করেছিলেন। এখন আমাকে দরকার, জীবিত।’

এ কারণেই তোমাকে সেফ হাউসে রাখতে চেয়েছিলাম, মনে মনে বলল রানা। চারপাশ দেখল। রাগ হচ্ছে। জোর করে মিনা মোবারক আর মিনতির সঙ্গে মোনাকে রেখে আসা ভাল ছিল।

‘আগে হোক আর পরে, তোমাকে কিডন্যাপ করতে চাইবে,’ বলল রানা। ভাবছে, হামলা করবে এলেনা আর আমার ওপর, তখন আরেক দল সরিয়ে নেবে মোনাকে। যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে তাদেরকে। কিন্তু ঠেকাবে কী করে?

আবারও চারপাশ দেখল রানা। অনেক দূরের আঁধারে হারিয়ে গেছে ওর এটিভি। ‘এলেনা, তোমার এটিভি চলবে?’

‘মনে তো হয়,’ দ্বিধা নিয়ে বলল এনআরআই এজেণ্ট। হ্যাণ্ডেল ধরে গায়ের জোরে গাড়িটা সিধে করতে চাইল রানা। ধীরে উঠল জিনিসটা, বালিতে ধুপ্ শব্দে নামল চার চাকা।

‘সোজা জলার দিকে ছুটবে,’ বলল রানা, ‘ওদিকে কোথাও লুকিয়ে আছে গ্রাহাম।’

‘কিন্তু পালিয়ে গিয়ে থাকলে?’

‘পালাবে না ও,’ জোর দিয়ে বলল রানা, ‘ওকে দেখতে না পেলে দেরি না করে সোজা গাড়ি নিয়ে নামবে জলায়। লুকিয়ে পড়বে নলখাগড়ার ভেতর। পরে খুঁজে নেবে জন।

এলেনার হাত থেকে রাইফেল নিল রানা।

ভীত চোখে ওকে দেখল মোনা।

‘তোমার কী হবে? আমাদেরকে বাঁচাতে গিয়ে…’

‘মরব না, কে যেন বলেছিল, আমি যমের অরুচি,’ বলল রানা।

দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এলেনার মুখ। ‘কিন্তু… রানা…’

‘কোনও কিন্তু নেই, তোমরা সময় নষ্ট করছ,’ মৃদু ধমক দিল রানা।

মাথা দোলাল এলেনা, অন করল এটিভির সুইচ। বাতি জ্বলে উঠল প্যানেলে। ‘এখনও পাওয়ার আছে।’ এটিভির পিঠে চেপে

বসার পর ওর পেছনে বসল মোনা।

‘যাও!’ তাড়া দিল রানা।

বালিতে পিছলে ছুটল এটিভি, একগাদা বালি ছুঁড়ল রানার নাকে-মুখে।

ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কয়েকজন, আড়াল ছেড়ে দৌড়ে এল এলেনা ও মোনার এটিভি ঠেকাতে।

স্যাও রেলের ওপর তিন পশলা গুলি ছুঁড়ল রানা। পরক্ষণে বামে-ডানের লোকগুলোর দিকে। তিন দিক দিয়ে মেয়েদুটোর পথ রুদ্ধ করতে চাইছে তারা। কিন্তু রানার গুলি খুব কাছ দিয়ে যেতেই লুকিয়ে পড়ল।

শেষপর্যন্ত হয়তো জলায় নেমে যাবে এলেনা ও মোনা, ভাবল রানা। সাহস হারিয়ে ফেলেছে শত্রুপক্ষ। এখানে আসার পর বেশ কয়েকজনকে দেখেছে মরতে। বাধ্য না হলে ঝুঁকি নেবে না। পাথরের স্তূপের আড়াল নিয়েছে।

এখনও গতি বাড়াচ্ছে এলেনা, খুলে দিয়েছে থ্রটল।

ঢিবির শেষ অংশের বালি মিশেছে কাদাটে তীরে, সেদিকে ছুটছে এটিভি। জলার কিনারায় নেই এয়ারবোট সহ গ্রাহাম। বিশ সেকেণ্ড পর পানিতে ঝপাস্ করে পড়বে এটিভি। নলখাগড়ার মাঝে লুকিয়ে পড়বে এলেনা ও মোনা। সাহস করে ওদের দিকে গুলি ছুঁড়ছে না শত্রুপক্ষ। নিজেরাও তারা বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। গোলাগুলির আওয়াজ মরুভূমির ভেতর বহু দূরে গেছে। কী হচ্ছে জানতে হাজির হবে ইরানিয়ান আর্মি।

তাতে লাভ হবে না রানা, এলেনা বা মোনার। এখন চাই গ্রাহামের কাছ থেকে সাহায্য। তার উচিত তীরে পৌঁছে যাওয়া। ওখান থেকে গুলি করলে সেই সুযোগে রানা নিজেও যেতে পারবে এয়ারবোটের কাছে। ঢিবির পায়ের কাছে বেশিক্ষণ টিকবে না ও।

কাদা ভরা মাটিতে সগর্জনে ছুটে চলেছে এটিভি। একটু পর পৌঁছুবে তীরে। এলেনা ভাল করেই জানে, ওদের দিকে আসবে না মাসুদ রানার গুলি। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করে, শত্রুপক্ষের কেউ মাথা তুললেই মরতে হবে তাকে।

বাধা দিতে এল না কেউ। দশ সেকেণ্ড পর নেমে পড়বে ওরা পানিতে। তখন নিশ্চিন্ত।

এমন সময় কী যেন হয়ে গেল। হঠাৎ করেই এলেনার কোমর থেকে ছুটে গেল মোনার দু’হাত। ছিটকে সামনে বাড়ল এটিভি। ওজন কমে যাওয়ায় বেড়ে গেছে গতি।

সামান্য গতি কমিয়ে ঘুরে তাকাল এলেনা।

পিছনের কাদায় বলের মত গোল হয়ে পড়েছে মোনা।

‘আরে,’ অবাক হয়ে এটিভি ঘুরিয়ে নিতে চাইল এলেনা। গিয়ে তুলে আনবে মোনাকে। কিন্তু তখনই ওর দিকে এল অন্তত দশটা গুলি। এ লড়াইয়ে আগে কখনও ট্রেসার দেখেনি। একদম খোলা জায়গায় পড়ে আছে মোনা। বাধ্য হয়ে এটিভি ঘুরিয়ে সরে গেল এলেনা। সামনের ডান দিকের চাকায় লাগল গুলি।

বিস্ফোরিত হলো চাকা। হাঁটু ভাঙা রেসের ঘোড়ার মত হুমড়ি খেয়ে পড়ল এটিভি। ওটার পিঠ থেকে উড়াল দিল এলেনা, ছিটকে গিয়ে পড়ল সামনে কাদার ভেতর। পাশেই জলা। কাদার ভেতর পিছলে পানিতে নেমে পড়ল ‘ এলেনা।

একদল লোক ছুটে এল ওর দিকে। দ্বিতীয় দল গেল মোনার উদ্দেশে।

অবিশ্বাস্য মনে হলো এলেনা ও রানার, উঠে দাঁড়িয়ে লোকগুলোর দিকেই পা বাড়িয়েছে মোনা!

গুলি করে দুই শত্রুকে ফেলে দিল রানা।

কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে বেরেটা দিয়ে গুলি করবে এলেনা, তখনই পেছন থেকে এল জোরালো আওয়াজ। তুমুল গতি তুলে ‘অন্ধকার চিরে ছুটে আসছে গ্রাহামের এয়ারবোট। সামনের ট্রাইপড থেকে গর্জন ছাড়ছে দুটো রাইফেল। এলেনার দিকে ছুটে আসা লোকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালাতে লাগল। ট্রাইপডের রাইফেল ঘুরিয়ে নিচ্ছে গ্রাহাম, কিন্তু দেরি হয়ে গেল। ঘুরে জলার দিকে রওনা হওয়ার আগেই মোনাকে খপ করে ধরেছে দুই লোক, ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে সরে গেল পাথরের এক স্তূপের ওদিকে।

মোনার গায়ে গুলি লাগবে ভেবে গুলি করেনি এলেনা। শুনল রানার আর্মালাইটের গর্জন। থেমে গেল গুলির আওয়াজ।

নতুন চাল দেয়ার উপায় নেই। তিনজন লোক মিলে মোনাকে ছেঁচড়ে নিচ্ছে হামভির দিকে। গুলি করতে পারবে না এলেনা, রানা বা গ্রাহাম। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পর হামভির পেছনের সিটে তুলে দেয়া হলো মোনাকে। নিজেরাও লোকগুলো উঠে পড়ল গাড়িতে। ধুম শব্দে বন্ধ হলো দরজা। পরের সেকেণ্ডে রওনা হলো হামভি। আরও কয়েকজন চেপে বসেছে অবশিষ্ট স্যাণ্ড রেল-এ। তারাও কনভয়ের লেজের মত ছুটল হামভির পেছনে। যে পুরস্কারের জন্যে এসেছিল, তা পেয়ে গেছে। মাত্র কয়েক মুহূর্তে বালির ঢিবি পেরিয়ে চোখের আড়াল হলো তারা।

কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখল এলেনা। মরুভূমির  ভেতর এখনও জ্বলছে পোড়া স্যাণ্ড রেল। ছড়িয়ে পড়ছে কটু গন্ধী ধোঁয়া। এখানে ওখানে লাশ। ঢিবির পায়ের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রানা।

.

নিজ চোখে রানা দেখেছে, শত্রুপক্ষকে যেন সাহায্য করেছে মোনা। কোনও বাধা দেয়ার চেষ্টাই করেনি। অথচ, ওর পক্ষে সহজেই সম্ভব ছিল মুক্তি পাওয়া।

নিজেকে শত্রুর হাতে তুলে দিল কেন মেয়েটা?

চরম বিরক্তি বোধ করছে রানা।

আসলে হলোটা কী?

এটিভি থেকে পড়ে গিয়েছিল মোনা?

গুলি লেগেছিল গায়ে?

ওদের বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে তুলে দিয়েছে শত্রুর হাতে?

আসলে কী হয়েছে জানার উপায় নেই, ভাবল রানা। এখন এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজেই বা কী হবে? বাস্তব হচ্ছে মোনাকে নিয়ে গেছে তারা। ওর কাছে রয়ে গেছে মাটির ট্যাবলেটের একটা অংশ।

রাইফেলের বাঁটের বাড়ি খেয়ে চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল এক তরুণ, এখন জ্ঞান ফিরছে তার।

কয়েক ফুট দূরে সে। মুখ নিচু করে তাকে দেখল রানা। এই তরুণের চেহারা কেমন চেনা চেনা লাগল।

হ্যাঁ, প্যারিসে দেখেছে। বিধ্বস্ত বোট থেকে নেমে পালিয়ে গিয়েছিল সেইন নদীতে।

ঘোর ধরা চোখে রানাকে দেখছে। ভয় পেল শত্রুর কঠোর চোখ দেখে।

‘তোমাকে বাঁচতে দেয়া হবে না,’ নিচু স্বরে বলল রানা।

উঠে বসে এদিক ওদিক তাকাল তরুণ। সুযোগ পেলে তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত পালিয়ে যাবে।

‘আমার দিকে তাকাও!’ বলল গম্ভীর রানা।

ফুলে যাওয়া চোয়ালে হাত রাখল তরুণ। কিন্তু তার মুঠোর ভেতর ছোট কী যেন।

জলা থেকে উঠে রানার কাছে পৌঁছে গেছে এলেনা।

নড়ে উঠল তরুণের হাত।

একই সময়ে ঝট করে রাইফেল তুলল রানা।

‘না!’ একটু দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল এলেনা।

কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল রানার রাইফেল।

ভীষণ ব্যথায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তরুণ। এক গুলিতে ফুটো করে দেয়া হয়েছে তার পাঞ্জা। সুস্থ হাতে চেপে ধরল ক্ষত। মুখ তুলে দেখল নিষ্ঠুর লোকটাকে।

‘ভেবেছিলাম তুমি মেরেই ফেলবে,’ রানাকে বলল এলেনা। ঘুরে এলেনাকে দেখল রানা।

ওর কঠোর চোখ দেখে শিউরে উঠল এনআরআই এজেণ্ট। ‘হয়তো খুনই করব,’ বলল রানা। ‘কিন্তু তার আগে জেনে নেব এর সঙ্গীরা কোথায় নিয়ে গেছে মোনাকে।’

একইসময়ে আবারও কর্কশ আওয়াজ তুলল রানা ও এলেনার বেল্টের স্ক্যানার। ফার্সি ভাষায় আলাপ করছে দু’জন।

রানার দিকে তাকাল এলেনা।

‘আর্মি রওনা হয়েছে,’ বলল রানা, ‘একে সঙ্গে নেব। কোথাও নিয়ে গিয়ে ইণ্টারোগেশন করব।’ এলেনার রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে নিল ও। খপ করে তরুণের কাঁধ চেপে ধরে এক টানে দাঁড় করিয়ে দিল।

ফুটো তালু থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে দেখে তরুণের শার্ট ছিঁড়ে নিল এলেনা। কাপড় দিয়ে ব্যাণ্ডেজের মত করে ক্ষত বেঁধে দিল। আরেক ফালি কাপড় নিয়ে বেঁধে দিল দু’ কবজি। 

অনায়াসে হালকা তরুণকে ডান কাঁধে তুলল রানা, চলল জলার দিকে। ওর সঙ্গে রয়েছে এলেনা।

কিছুক্ষণ পর এয়ারবোটে উঠল ওরা। ময়দার বস্তার মত মেঝেতে তরুণকে ধুপ করে ফেলল রানা। ‘জন, রওনা হও।’

এয়ারবোট ঘুরিয়ে নিল গ্রাহাম, পরক্ষণে ঝড়ের গতি তুলে ছুটল ইরাকি এলাকা লক্ষ্য করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *